24/08/2025
ভৌতিক গল্প
পারের গ্রামের মানুষরা দিনের আলোতে নদীকে ভালোবাসে। মাছ ধরে, নৌকা ভাসায়, আর ছোট ছোট শিশুরা তীরে দৌড়ায়। কিন্তু রাত হলেই নদী বদলে যায়। কুয়াশা ঘন, হাওয়া শীতল, আর নদীর ঢেউগুলো যেন অদৃশ্য হাতের মতো ফিসফিস করে। কেউ রাতে নদীর ধারে যায় না। সবাই জানে, নদীর পারের অন্ধকারে রয়েছে ভুত—যার কথা কেউ চোখে দেখেনি, কিন্তু যার উপস্থিতি অনুভূত হয়।
এক রাতে, আমি কৌতূহল এবং সাহস নিয়ে নদীর ধারে গিয়েছিলাম। বাতাস শীতল, কুয়াশা চোখে পড়ার মতো ঘন। নদীর ঢেউগুলো যেন আমাকে সতর্ক করছে। হঠাৎ, পানি থেকে দেখা দিল ছায়া। প্রথমে মনে হলো কোনো মানুষ, কিন্তু ছায়াটি অদ্ভুত। কাছাকাছি এলো, আর আমি বুঝতে পারলাম—এ মানুষ নয়।
ভুতটি দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ, চোখ লাল আগুনের মতো জ্বলছে। মুখে অদ্ভুত হাসি, যেন হাসি আর চিৎকারের মিলন। আমি পিছিয়ে যেতে চাইলাম, কিন্তু পা যেন মাটিতে আটকে গেছে। ভুত ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। নদীর ঢেউগুলো যেন তার সঙ্গে নাচছে, আর হাওয়া তার শব্দকে বহন করছে।
হঠাৎ, নদীর জলে আরো ছায়া ভেসে উঠল। ছায়াগুলো এক হয়ে ঘুরতে লাগল, নদীর ঢেউ এবং হাওয়ার সঙ্গে মিলিত হয়ে এক অদ্ভুত সুর তৈরি করল, যা হৃদয় কেঁপে দিচ্ছিল। তাদের চোখে অন্ধকার, মুখে অদৃশ্য হাসি, আর আঙুলগুলো যেন নদীর জলে ছায়া হয়ে ভেসে উঠছে।
আমি চিৎকার করতে চাইলাম, কিন্তু শব্দ বের হল না। হঠাৎ, ভুত আমার চারপাশে ঘুরে দাঁড়াল, নদীর তীরে ছোট ছোট অদৃশ্য আওয়াজ শোনা গেল—পায়ের ছাপ, ফিসফিস করা কথা, হঠাৎ কাঁপানো হাহাকার। নদী, জঙ্গল, কুয়াশা—সব মিলিয়ে মনে হলো আমি এক অদৃশ্য জগতে আটকা পড়েছি।
রাত গভীর হল। হাওয়া থেমে গেল। নদীর জলে ভুতের ছায়া মিলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু চোখের লাল আগুন এখনও জ্বলছে। গ্রামে কেউ জানে না আমি নদীর ধারে কি দেখেছি। কিন্তু আমি জানি—ভুত এখনও সেখানে আছে। চুপচাপ, অদৃশ্য, এবং ভয়ঙ্কর।
যে কেউ নদীর ধারে একা যায়, সে ভুতের দৃষ্টি পায়। সেই দৃষ্টি কখনও ভুলে যায় না। নদীর ঢেউ, রাতের হাওয়া, জঙ্গল—সব মিলিয়ে মনে করিয়ে দেয় ভুত এখনও অপেক্ষা করছে।
আমি নদীর ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম, চোখ ঘুরিয়ে তাকাচ্ছিলাম—ভুতের দিকে। হঠাৎ, তার লাল চোখগুলো আমার দিকে সরাসরি তাকালো। হৃদয় যেন থেমে গেল। নদীর ঢেউ চুপচাপ, হাওয়া থেমে আছে, সব কিছু যেন আমার চারপাশের শূন্যে ভাসছে।
ভুত ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে এলো। তার আঙুলগুলো বাতাসে ছায়ার মতো ঝুলছে, এবং সে যেন আমার ভয়কে টেনে আনছে। আমি সরে যেতে চাইলাম, কিন্তু পা মাটিতে আটকে আছে। হঠাৎ, নদীর জলে হালকা শব্দ—কেউ কাঁদছে, কেউ চিৎকার করছে। মনে হলো আগের সব ভুক্তভোগী আমার চারপাশে ভেসে উঠছে।
ভুতের হাসি এবার আরও ভয়ঙ্কর। সে বলতে চায় কিছু, কিন্তু শব্দ আসে না—শুধু নদীর ঢেউ এবং হাওয়া তার কথা বহন করছে। হঠাৎ, সে আমার হাত ধরে টানল। শীতলতা এতটা যে আমার দেহ জুড়ে চামড়া রকম জড় হয়ে গেল। চোখ বন্ধ করেও ভয় মনে থেকে গেল।
আমি হু হু করে নিশ্বাস নিচ্ছিলাম। নদীর তীরে হঠাৎ অদ্ভুত ছায়া—একটি শিশু, একটি বৃদ্ধ, এবং কেউ অচেনা মুখের ছায়া—সব ভুতের সঙ্গে মিলিত হয়ে ঘুরছে। তারা নদীর ঢেউ এবং রাতের হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে এক ভয়ঙ্কর নাচ করছে।
আমি চিৎকার করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনো শব্দ বের হল না। মনে হলো, নদী এবং ভুত এক হয়ে আমাকে গ্রাস করছে। হঠাৎ ভুতের লাল চোখগুলো হঠাৎ ম্লান হয়ে গেল, আর ছায়াগুলো মিলিয়ে গেল নদীর গভীরে। আমি কেঁপে কেঁপে দাঁড়িয়ে রইলাম।
রাত শেষে, যখন গ্রামে সবাই ঘুমিয়ে পড়ল, আমি নদীর ধারে একা বসে ছিলাম। জানতাম, ভুত চলে গেছে না। সে এখনও অপেক্ষা করছে—অদৃশ্য, চুপচাপ, রাতের অন্ধকারে। যে কেউ নদীর ধারে একা যায়, সে ভুতের দৃষ্টি পায়, এবং সেই দৃষ্টি কখনও ভুলে যায় না।
নদী শান্ত, কুয়াশা ঘন, কিন্তু ভুত এখনও আছে। প্রতিটি ঢেউ, প্রতিটি হাওয়া মনে করিয়ে দেয়—ভয়ঙ্কর রাতের নদী, যেখানে অদৃশ্য ভুত তার শিকার খুঁজছে।