21/06/2025
পালিয়ে বাঁচা মেয়েরা:
সৌদি আরবের গার্ডিয়ানশিপ ব্যবস্থায়
নারীর বন্দিজীবন ও মুক্তির লড়াই
পারি ডেস্ক | বাড়ি—অনেকের জন্য এটি শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতীক। কিন্তু বিশ্বের বহু নারীর জন্য, বিশেষ করে সৌদি আরবের মতো সমাজে, ‘বাড়ি’ মানেই বন্দিদশা—একটি পिंজর, যার তালা তৈরি হয়েছে আইন, সংস্কৃতি ও পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ দিয়ে। এখানে নারীরা যুগের পর যুগ ধরে আইনি ও সামাজিকভাবে পুরুষ অভিভাবকের অধীন। তারা একা ভ্রমণ করতে পারে না, কাজ করতে পারে না, এমনকি চিকিৎসাও নিতে পারে না অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া।
এই ব্যবস্থাকে যারা চ্যালেঞ্জ করে, তাদের জীবনের পথ সহজ নয়। তারা হয়ে ওঠে পালিয়ে বাঁচা শিল্পী—রাত্রির আঁধারে নিঃশব্দে হারিয়ে যায়, সীমান্ত পেরিয়ে, নিজ নিয়তির নতুন মানচিত্র আঁকে, নিছক সাহস আর অবিচল ইচ্ছাশক্তিকে সম্বল করে।
২০১৯ সালে, মাত্র আঠারো বছর বয়সে, রাহাফ মোহাম্মদ নিজের জীবন ফিরিয়ে নিতে সিদ্ধান্ত নেন। এক নিপীড়নমূলক পরিবারের অন্তরালে আবদ্ধ, যেখানে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিল তাকে, রাহাফ জানতেন, পালানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। কুয়েতে এক পারিবারিক ভ্রমণের সময় তিনি সুযোগ নেন। ব্যাংককের একটি বিমানবন্দর হোটেল কক্ষে নিজেকে বন্ধ করে দিয়ে আসবাব দিয়ে দরজা আটকে রাখেন, আর সামাজিক মাধ্যমে সাহায্যের আহ্বান জানান সারা বিশ্বের কাছে।
সৌদি কর্তৃপক্ষ চেয়েছিল তাকে ফিরিয়ে নিতে। কিন্তু এবার গোটা বিশ্ব তা দেখছিল। রাহাফের বার্তাগুলো ভাইরাল হয়, আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হয়। অবশেষে কানাডা তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়। আজ রাহাফ সেখানেই একজন মুক্ত নারী হিসেবে বসবাস করছেন, কথা বলছেন সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, যা তার স্বাধীনতাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল।
তবে সব নারীর ভাগ্য রাহাফের মতো হয়নি। ২০১৭ সালে, দিনা আলি লাসলুম নামের এক ২৪ বছর বয়সী সৌদি নারী অস্ট্রেলিয়ায় পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ফিলিপাইনে তাকে ধরে ফেলে তার পরিবার। এয়ারপোর্টের সিকিউরিটির সামনেই তাকে বেঁধে, মুখে কাপড় গুঁজে, জোর করে বিমানে তুলে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর থেকেই তিনি নিখোঁজ। আর কখনো কেউ তার খবর পায়নি।
দিনার গল্প আমাদের কাঁপিয়ে তোলে—এক জীবন্ত দলিল, কী ভয়ংকর ঝুঁকি নিতে হয় একজন নারীকে, যদি সে নিজের জীবনটাকে নিজের মতো করে গড়তে চায়।
তাদের এই পালানোর পেছনে থাকে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর ধরে পরিকল্পনা। পাসপোর্ট গোপন করে রাখা, জরুরি নাম্বার মুখস্থ করা, সন্দেহ এড়াতে মিথ্যে গল্প রপ্ত করা—সবই থাকে তাদের প্রস্তুতির অংশ। তারা জানে ধরা পড়লে কী হতে পারে: কারাবাস, নির্যাতন, এমনকি মৃত্যুও। তবু তারা পথ ধরে, কারণ বেঁচে থাকার বিকল্পটা আরও ভয়ংকর—একটি জীবন, যেখানে নেই স্বাধীনতা, নেই পছন্দের অধিকার, নেই নিজের শরীর বা সিদ্ধান্তের ওপর কর্তৃত্ব।
রাহাফ, দিনা এবং তাদের মতো অসংখ্য নারীর গল্প শুধু মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাহিনি নয়—এগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা শুধু কোনো কাগজে লেখা অধিকার নয়, এটি জীবনের জন্য লড়াই করার সাহস। যারা পালায়, তারা শুধু নিজের জীবন নয়, ইতিহাসের গতিপথও বদলায়।
এটি এক অসমাপ্ত লড়াইয়ের গল্প—নারীর অধিকার, মর্যাদা ও আত্মমর্যাদার জন্য এক সংগ্রাম, যা এখনো চলছেই।