12/03/2025
সুবেহ সাদিকের নরম আলো জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ছে। বাইরে মসজিদের মাইকে ফজরের আজান শোনা যাচ্ছে। "আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার!" ধীর লয়ে মধুর সুর বয়ে চলেছে, যেন রাতের শেষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে নতুন দিনের আশার কথা বলছে।
আমি চোখ মেলে চেয়ে থাকে ছাদের দিকে। মনে আজ এক অদ্ভুত ব্যথা। রোজার মাস চলছে, রহমতের দিনও শেষ হয়ে গেলো। অথচ কতদিন হয়ে গেল মা-বাবার সঙ্গে একসঙ্গে ইফতার করা হয়নি। কর্মব্যস্ত জীবনের তাড়নায় গ্রাম ফেলে শহরে চলে এসেছি, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন দূরত্ব বেড়েই চলেছে।
আজান শেষ হলে সে ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। অজু করার জন্য ঘটি ভর্তি পানি নিই। শীতল পানির ছোঁয়া লাগতেই আমার মনে পড়ে, মা কী যত্ন করে আমাকেছোটবেলায় ফজরের নামাজে তুলতেন! বাবা পাশে বসিয়ে সুরা ইয়াসিন শেখাতেন। কিন্তু আজ আমি একা। এই শহরের ব্যস্ততায় সে নামাজ পড়লেও সেই তৃপ্তি খুঁজে পায় না।
রোজার সময় হলে মায়ের হাতের ইফতার যেন এক অন্যরকম আনন্দ দিত। খেজুর, মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, আর ঠান্ডা শরবতের স্বাদ এখনও মুখে লেগে আছে। বাবা প্রতিদিন কোরআন তিলাওয়াত করতেন, আর মা দোয়া করতেন—"আল্লাহ, আমাদের সন্তানকে হেফাজত করো।"
এখন ইফতারের সময় হলে আমি একা একাই মা-বাবার স্নেহ হাতড়ে ভিক্ষারির মতো মোবাইলের পর্দায় মা-বাবার পুরোনো ছবি দেখতে দেখতে খেতে বসি। কিন্তু সেই স্বাদ, সেই অনুভূতি আর আসে না। আম্মা আমার ভেতরটা খালি খালি লাগে।
আব্বা ও আব্বা, তোমারে দেখতে মন চায়, মন চায়, তুমি রোজার মুখে আমাকে শাষণ করো। আসরের নামাজের পর বলো, " গাছে উইঠা একটা নিমের ডাল ভাইঙ্গা নিয়ে আসো, আমি মেস ওয়াক করবো।"
আব্বা আমি বাড়ি যাচ্ছি, তোমার মেসওয়াকের নিমের ডাল ভাইঙ্গা দিতে, অজুর জন্য ঘটি ভর্তি পানি দিতে, পাঞ্জাবিতে আতর লাগাইতে।
শাওয়াল মাসের চাঁদের জ্যোৎস্নায় ভেসে আসে, আমি অফিসে ছুটির দরখাস্ত করেছে গত সপ্তাহে, বাড়িতে যাবো তাই। অথচ এখনো ছুটি মঞ্জুর করেনি। অথচ কত ভাবনা টুকে রেখেছিলাম মনে মনে।
সে দাগ-চিহ্ন ট্রেনের জানালার পাশে বসে সে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকবো। বাইরের সবুজ মাঠ, ছোট ছোট গ্রাম, মাটির ঘর দেখে তার শৈশবের দিনগুলোর কথা মনে পড়বে।
বাড়ির গেটে পা রাখতেই ছোটবোন দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবে মা দৌড়ে এসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলবে, "কত দিন পর দেখলাম তোর মুখটা!"
বাবা চুপচাপ তাকিয়ে থাকবে, তারপর ধীরে ধীরে কাছে এসে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলবে, "আমার ছেলে, অনেক বড় হয়ে গেছে!"
আমার বিভ্রম কাটে! মুখের রুচি কমে গিয়েছে।মা-বাবার মুখ দেখা, তাদের কণ্ঠ শুনা আমার কাছে বড় খাদ্য। এখনো তো আমার ছুটি হয়নি। ঘরের মেঝেতে খেজুর, এক চামচ দই, এক গ্লাস স্যালাইন মিশ্রিত পানি নিয়ে মাগরিবের আজানের জন্য উপেক্ষা করছি। আজানের ধ্বনি কানে আসে, বুঝতে পারি —এই আজান, এই পরিবেশ, এই মায়া—এগুলো ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। মা-বাবার সঙ্গে নামাজ পড়ে, একসঙ্গে বসে ইফতার করে সে যেন জীবনের আসল শান্তি খুঁজে পাওয়া যায়।
বাবাকে সকালে পাশে বসিয়ে বলবো, "জীবনে কত কিছু পেছনে পড়ে যায়, কিন্তু আল্লাহর রহমত কখনও পেছনে পড়ে না। দোয়া করুন যেনো, সময় থাকতেই আপন মানুষদের সময় দিতে শেখি।"
আমি যেনো বুঝতে পারি—জীবনের আসল সফলতা শুধু চাকরি বা টাকা নয়, বরং মা-বাবার দোয়া, পরিবার, আর আল্লাহর নৈকট্য।
ইফতার খেতে খেতে চোখ বন্ধ করে দোয়া করি ' আল্লাহ, আমাকে আমার পরিবার থেকে কখনো দূরে রাইখো না।
হুইসেল হুসেন