28/10/2024
ভিড়ের বাসে, ফুটপাতে, মার্কেটে আমি মেয়েদের শরীরে হাত দিতাম। ভিড়ের কারণে মেয়েরা ধরতে পারতো না। আর যদি হাত দেয়ার সুযোগ না থাকতো তাহলে চোখ দিয়ে তাদের শরীর লেহন করতাম।
খারাপ জায়গায় যাওয়ার অভ্যাস ছিলো। ভার্সিটিতে পড়ার সময় একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক হয়েছিলো। কিন্তু এক নারীতে স্থির থাকার মানুষ আমি ছিলাম না। তাই গোপনে আরো কয়েকটা প্রেম করি। এবং নানা ছলছুতো করে তাদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করার চেষ্টা করতাম। এবং শারীরিক সম্পর্ক হয়ে গেলে মেয়েগুলোর উপর মিথ্যা দোষ চাপিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতাম।
মাস্টার্স পড়ার সময় কী করে যেনো বাবা জানতে পারলেন আমি খারাপ জায়গায় যাই।
যার মাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন তিনি বাবাকে বললেন, "ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দিন। তাহলে ওর চরিত্রের সমস্যা দূর হয়ে যাবে।"
এরপরই তাড়াহুড়ো করে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। আমিও ভেবেছিলাম বিয়ের পর আমার চরিত্র ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু তা হলো না। বিয়ের আগে যে অপকর্মগুলো করেছিলাম বিয়ের পরও সেগুলো করে যেতে লাগলাম। এমন দক্ষতার সাথে অপকর্মগুলো করতাম যে, আমার স্ত্রী বিন্দুমাত্র টের পেতো না।
সময়ের সাথে সাথে এক ছেলে এক মেয়ের বাবা হলাম। সব কিছু ঠিকঠাক ভাবেই যাচ্ছিলো। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো ছেলে যখন ভার্সিটিতে পড়ার শেষ দিকে তখন।
একদিন এক অফিস সহকর্মী আমাকে বললো, "ছেলেকে দ্রুত বিয়ে করিয়ে দিন।"
বললাম, "এখনই কীসের বিয়ে? ছেলেটা পড়াশোনা শেষ করুক। টাকা পয়সা উপার্জন করুক। তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে।"
সহকর্মী বললো, "আপনার তো আর্থিক সমস্যা নেই। ছেলেকে শোধরাতে চাইলে বিয়ে করিয়ে দিন।"
আশ্চর্য হয়ে বললাম, "শোধরানোর কথা কেনো বলছেন?"
তারপর সহকর্মী নিচু গলায় যা বললো তাতে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ছেলে খারাপ জায়গায় যায়।
বাসায় এসে নীরবে ভাবতে লাগলাম কী করা যায়? বিয়ের পর আমি তো ভালো হয়ে যাই নি, ছেলে কি ভালো হবে? কে জানে সে হয়তো ভালো হয়ে যাবে।
এরপর তড়িঘড়ি করে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দিলাম। কিন্তু আমার কপাল খারাপ। ছেলে শোধরালো না। বিয়ের পর অন্য নারীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে ছেলের সাথে ছেলের বউয়ের প্রায় সময় ঝগড়া হতে লাগলো। এক পর্যায়ে অবস্থা এতো খারাপ হলো যে, ওদের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার অবস্থা হলো। ছেলের বউকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিয়েটা রক্ষা করলাম।
এরপর বেশ কিছুদিন স্বাভাবিক ভাবে গেলো। ভাবলাম ঝামেলা সব দূর হয়ে গেলো। কিন্তু আমার ভাবনায় ভুল ছিলো। কারণ এরপর এমন একটা ঘটনা ঘটলো যা আমি কল্পনা করতে পারি নি।
আমার মেয়ে একদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে এসে ওর মাকে বললো, ওর স্বামীর চরিত্র ভালো না। অন্য নারীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক আছে। এবং এই নিয়ে কিছু বলতে গেলে গায়ে হাত তোলে।
শুনে মেজাজ এমন খারাপ হলো যে বলার মতো নয়। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলাম তালাক দিয়ে মেয়েকে ওখান থেকে নিয়ে আসবো।
তালাকের কথা বলাতে অনেকে বললো, সরাসরি তালাকে না গিয়ে জামাইকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সংসারটাকে টিকিয়ে দেয়ার জন্য।
উত্তরে তাদের কড়া ভাষায় বললাম, "যাদের চরিত্রে সমস্যা থাকে সেটা আজীবন থাকে। কোনো ভাবে সেটা পাল্টায় না। তাই তালাক ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়। আমি জেনেশুনে মেয়েকে জাহান্নামের মধ্যে রাখতে পারি না। আমার মেয়ে পানিতে ভেসে আসে নি।"
ডিভোর্স করিয়ে মেয়েকে যেদিন বাড়ি নিয়ে এলাম সেদিন জানলাম ছেলের বউ ছেলেকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ছেলের বউকে ঠেকাতে গেলে তার বাবা কঠিন গলায় যে কথা বললেন তাতে আমি আর কিছু বলতে পারলাম না।
তিনি বললেন, "যাদের চরিত্রে সমস্যা থাকে সেটা আজীবন থাকে। কোনো ভাবে সেটা পাল্টায় না। তাই তালাক ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়। আমি জেনেশুনে মেয়েকে জাহান্নামের মধ্যে রাখতে পারি না। আমার মেয়ে পানিতে ভেসে আসে নি।"
ছেলের বউ যেদিন চিরতরে চলে গেলো সেদিন থেকে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। ছেলেটা অফিস যাওয়া বন্ধ করে দিনরাত রুমে শুয়ে থাকতো। আর মেয়েটা বিষন্ন হয়ে থাকতো। বাড়িটাকে মনে হতো কবরের মতো।
স্ত্রী চোখের পানি ফেলে বলতো, "কী অপরাধে আল্লাহ আমাদের এমন শাস্তি দিলেন?"
আমার তখন ইচ্ছে হতো স্ত্রীকে বলি, "সব দোষ আমার। আমার কারণেই ছেলেমেয়েরা কষ্ট পেলো।"
কিন্তু মান সম্মান হারানোর ভয়ে বলতে পারতাম না।
জীবনের এই চরম দুঃখময় দিনে অনুভব করলাম, আল্লাহ ছাড়া আর কেউ আমাকে উদ্ধার করতে পারবে না। আমি হজ্জ করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, আমি কোনো ভাবে হজ্জে যেতে পারছিলাম না। আমার পাসপোর্ট ভিসা নতুবা অন্য কোনো কাগজপত্রে কিছু একটা সমস্যা হয়ে যেতো এবং হজ্জে যাওয়া বাতিল হয়ে যেতো।
অবশেষে বুঝলাম সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে। কেনো আল্লাহ আমাকে হজ্জে যেতে দিচ্ছেন না?
অতঃপর এক রাতে মাথা নিচু করে স্ত্রীকে আমার চরিত্রের কথা খুলে বললাম। বিয়ের পর অন্য নারীর সাথে সম্পর্ক করে আমি যে তাকে ধোঁকা দিয়েছি সব বললাম। আমার কুকর্মের একটি কথাও গোপন করি নি।
সব বলার পর তাকে বললাম, "তুমি চাইলে আমাকে তালাক দিয়ে চলে যেতে পারো। তোমার ভরণপোষণসহ যা যা লাগে সব দেবো। আবার তুমি চাইলে আমাকে ক্ষমা করতে পারো। তুমি ক্ষমা না করলে আমার ইহকাল পরকাল দুটোই শেষ হয়ে যাবে।"
আমাকে অবাক করে দিয়ে স্ত্রী আমাকে ক্ষমা করলো।
তবে সে আমাকে বলেছিলো, "আমি তোমাকে তোমার জন্য ক্ষমা করি নি। ক্ষমা করেছি ছেলেমেয়েদের জন্য। কারণ ছেলেমেয়েদের জীবনে দুর্দশা নেমে এলেও তাদের মাথার উপর এখনো বাবা মার ছায়া আছে। এখন যদি সেটাও সরে যায় তাহলে তাদের দুর্দশার আর অন্ত থাকবে না।"
এরপর আর হজ্জে যেতে সমস্যা হলো না। পাসপোর্ট ভিসায় কোনো ত্রুটি হলো না। তবে হজ্জে একা যাই নি। স্ত্রীকেও নিয়ে গেলাম।
বাবা মা হজ্জে যাচ্ছে দেখে ছেলেমেয়েরা খুশি হলো। তাদের খুশি দেখে কী যে ভালো লাগলো!
হজ্জ থেকে এসে মেয়েটার আবার বিয়ে দিলাম। তবে ছেলেটা আর বিয়ে করতে চাইলো না।
সে তার মাকে বললো, "মা, সংসার করতে ভয় লাগে। যদি আবার স্ত্রীকে কষ্ট দিয়ে ফেলি?"
ওর মা তখন বললো, "তোমার একথা থেকেই বোঝা যায় আল্লাহ তোমার মন পরিষ্কার করে দিয়েছেন। বাবা, তুমি নিশ্চিন্তে সংসার করতে পারো।"
ছেলে মায়ের কথা রাখলো।
বিয়ের রাতে স্ত্রীকে বললাম, "যদি ভাগ্যগুণে কোনোদিন জান্নাতে যাই তবে আল্লাহকে বলবো, আমার একটিও হুরপরী চাই না। শুধু আমার স্ত্রীকে চাই।"
সে ভেবেছিলো আমি মজা করছি। তাই গুরুত্বহীন চোখে আমার দিকে তাকালো। কিন্তু যখন দেখলো আমার চোখে পানি তখন সে বুঝলো আমি মজা করছি না।
সে তখন আমার ডান হাত তার দু হাতের মুঠোয় নিয়ে কোমল করে ধরলো।
এমন পরম মায়াময় স্পর্শে আমার কান্না না থেমে আরো বেড়ে গেলো।
"মায়া"
- রুদ্র আজাদ