
08/07/2025
কুয়াশায় ঢাকা শহর ২য় পর্ব
(সাইকো থ্রিলার)
: অর্পন রহমান
১.
ডিবি অফিসের গা-ছোঁয়া আলোয়, রিয়ান বসে ছিল একটি স্যাঁতসেঁতে টেবিলের পেছনে, তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল অফিসার হাবিব। গুমোট পরিবেশে, বাইরে রাতের অন্ধকার আরও ভারী হয়ে উঠেছিল। একের পর এক খুনের তদন্তে যাওয়া রিয়ান আজ শেষ কথা বলবে।
তার চোখের সামনে পড়ে ছিল খুনের মামলা, প্রতিটি খুনের ধরন ছিল আলাদা, কিন্তু একটি ভয়ঙ্কর ঐক্য ছিল তাদের মধ্যে। প্রতিটা হত্যার পেছনে ছিল একটি অসীম বিশ্বাস—পাঁচতন্ত্রের পূর্ণতা।
রিয়ান টেবিলের ওপর একটি ফাইল খুলে দেখাল, যেখানে প্রতিটি খুনের বিশদ বর্ণনা দেওয়া ছিল। তার মুখে রুক্ষ শব্দ বের হলো—"প্রথমে আগুন।"
আগুন দিয়ে খুন
"আগুনের পথ একদম আলাদা," রিয়ান বলল, "এটা একটি শাশ্বত পদ্ধতি—অগ্নি। আগুন দিয়ে খুন করলে, শরীর পুড়ে না শুধুমাত্র, আত্মাও দগ্ধ হয়ে যায়। এই খুনে মৃত্যুর আগে, ভুক্তভোগী যেমন শারীরিকভাবে পুড়েছিল, তেমনি তার আত্মাও পুড়ে গেল। একে বলা হয় তাপীয় হত্যাকা-। খুনী আগুনের মতো ধ্বংসাত্মক। তার চোখে শুধুমাত্র মৃত্যু, যেখানে সবার শেষ মানে নিঃশেষিতা—কেউ ফেরে না। এটাই আগুনের প্রকৃতি।"
রিয়ান থামলেন, চোখের কোণে কিছু গা-ছোঁয়া কিছু ভয়ের অনুভূতি উঠছিল।
"এটাই শুরু," তিনি আবার বললেন, "এরপর পানি দিয়ে খুন।"
পানি দিয়ে খুন
"পানি সবকিছু শুদ্ধ করতে পারে, তবে পানি দিয়েও খুন হয়। হত্যাকারী পানির মত ধীরে ধীরে আক্রমণ করে, কিন্তু এই ধরনের খুনে মরতে একটু সময় নেয়, জল শ্বাস বন্ধ করে দেয়, কিন্তু ধীরে ধীরে। শ্বাস নিতে না পেয়ে শিকার শেষে মারা যায়। ঘন স্নিগ্ধতা, মৃতদেহ স্নানের মত শীতল। এই খুনের মধ্যে আছে ভয়াবহ স্নিগ্ধতা, যা শিকারকে ধীরে ধীরে মিশিয়ে ফেলে, সঠিকভাবে অনুভব করাতে পারে না যে মৃত্যুর কাছে পৌঁছানো হয়ে গেছে।"
রিয়ান পেন্সিল দিয়ে টেবিলের ওপর কিছু আঁকলেন, আবার মুখ তুললেন।
"এবার বায়ু দিয়ে খুন।"
বায়ু দিয়ে খুন
"বায়ু খুনের সবচেয়ে বিচিত্র ধরন," রিয়ান শুরু করলেন, "বায়ু কিছুই স্পর্শ করে না, কিন্তু শিকার অনুভব করতে পারে তার গলায় আক্রমণ। বায়ু দিয়ে খুনে কোনো পদক্ষেপ নেই, কোনো আঘাত নেই, শুধু শ্বাসের বাধা, অক্সিজেনের শূন্যতা। শিকার দমবন্ধ হয়ে মারা যায়। বায়ু হত্যাকারী কখনো দৃশ্যমান হয় না, তার অস্তিত্ব নরম, কিন্তু ধারালো। এই ধরনের খুনে, শিকার নিজের শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়া অদৃশ্য আক্রমণ অনুভব করে, অথচ কিছুই দেখা যায় না।"
হাবিব কিছুটা শিউরে উঠল।
"মাটি দিয়ে?" সে জিজ্ঞেস করল।
মাটি দিয়ে খুন
"মাটি, মাটির উপর খুন, এটি মূলত চাপের মাধ্যমে। মৃত্যুর সৃষ্টির সময় মাটি জড়িয়ে যায়, শেষ হয়ে যায়, যেমন শিকারকে মাটির গায়ে চাপ দিয়ে চেপে ধরে রাখা হয়। মাটি দিয়ে খুনে, শিকারকে গুম করে দেয়া হয়—শ্বাস বন্ধ, মাটির স্তরে চাপ। সে যখন বুঝতে পারে, তার শ্বাস আরও কমে যাচ্ছে, তখন তার নিজ জীবনের উপলব্ধি শেষ হয়ে যায়। মাটির এই খুন সবকিছুকে চাপিয়ে দেয়, তাকে জানিয়ে দেয় যে তার শেষ সময় এসেছে।"
রিয়ান থেমে গেলেন, একটু বিরতি নিয়ে, তারপর আবার কথা বললেন।
"এখন, আকাশে খুন।"
২.
আকাশে খুন
"আকাশ খুনের সবচেয়ে অদ্ভুত ধরন," রিয়ান বললেন, "এটা আলাদা, কারণ আকাশ থেকে খুন হওয়া মানে ঐশ্বরিক বা অবাস্তব—শিকারকে আকাশ থেকে তোলার মতো অনুভূতি। তার চোখের সামনে মৃত্যু আছেই, তবে সেটি মনে হয় স্বপ্নের মতো। আকাশে খুনের মেসেজটি সুস্পষ্ট—তুমি জানো যে তুমি মরবে, তবে কি হবে তা জানো না। কুয়াশা, বজ্রপাত, কিংবা বায়ুমণ্ডলের চাপ—সবই আকাশে খুনের অস্ত্র হতে পারে। এটা অদৃশ্য, অস্পষ্ট—এতে কেবল একটি বোধ থাকে, আর সেটা মৃত্যু।"
রিয়ান একবার মাথা তুলে দেখল, হাবিব তার চোখে একটু অসহায় দেখাচ্ছে।
"সবগুলো হত্যার পেছনে একটাই পথ—একটি দুষ্টু ধারাবাহিকতা, যা শিকারকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে, আর খুনী পায় তার শক্তি। কুয়াশা, এই হত্যাকান্ডগুলোর পেছনে, একটি তন্ত্রের পূর্ণতা খুঁজছে।"
রিয়ান চুপচাপ দাঁড়িয়ে গ্লাস থেকে পানি খান।
"তারপরও," তিনি বললেন, "এখন আমি জানি, এই খুনগুলো একযোগে এমনভাবে ঘটছে, যে আমরা যারা দেখি, আমরা এখন তার ধারাবাহিকতায় দাঁড়িয়ে আছি। এই মৃত্যু কোনো সাধারণ খুন নয়, এটি একটি মহাপরিকল্পনা—যার অন্ধকার ঠিক পেছনে রয়েছে।"
ঠিক এইখানেই কুয়াশার বিভ্রম ও বিকার একসঙ্গে মিশে যায়।
সে বলে, সে পঞ্চতন্ত্র সাধনায় লিপ্ত—
অগ্নি, জল, মাটি, বায়ু, আকাশ—এই পাঁচ মহাভূতের প্রতীকী উৎসর্গের মাধ্যমে সে চায় অমরত্ব।
সে বিশ্বাস করে, প্রতিটি খুন হচ্ছে একেকটি “তপস্যা”, আর প্রতিটি মৃত্যুর রক্তে সে ধীরে ধীরে ঈশ্বরতুল্য হয়ে উঠছে।
সে বলে—
“দেহ নশ্বর, কিন্তু রক্তের মধ্য দিয়ে আমি পৌঁছে যাব দেবলোক।
যাদের মেরে ফেলছি, তারা আমার সিঁড়ি।
আমি ঈশ্বর হব।
আমি আর মরব না।”
৩.
কিন্তু বাস্তবতা খুবই ভিন্ন।
রোগ বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কুয়াশা একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোপ্যাথ।
তার ভেতরে অপরাধবোধ নেই।
খুন করার সময় তার মধ্যে করুণা, ভয়, কিংবা পিছুটান কাজ করে না।
বরং খুনই তার একমাত্র সুখ।
ডিবি অফিসে ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিস্টরা রিপোর্ট দেয়:
“বিষয়টি স্পষ্ট: কুয়াশা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক সাধনার নামে নিজের সিরিয়াল কিলিংকে যুক্তি দিচ্ছে। সে নিজেকে তান্ত্রিক, পঞ্চতন্ত্রী, এমনকি ঈশ্বর ভাবছে।
কিন্তু এগুলো সবই তার মনস্তাত্ত্বিক বিভ্রমের ফল।
আসলে সে খুনের আসক্তিতে ভোগা এক মারাত্মক সাইকো কিলার।”
কুয়াশার ভেতরের প্রক্রিয়াটি এরকম:
Antisocial Personality Disorder (ASPD): তার বিবেকহীনতা ও ঠান্ডা মাথার খুন করার ক্ষমতা এখান থেকে।
Delusional Paranoia: সে ভাবে গোটা পৃথিবী তাকে ঠকিয়েছে, ঈশ্বর তাকে ত্যাগ করেছে। তাই সে এখন ঈশ্বরকে প্রতিস্থাপন করতে চায়।
DID (Dissociative Identity Disorder): তার নানা রকম বিকৃত পরিচয়ের জন্ম—সে কখনো নিজেকে হিন্দু ব্রাহ্মণ ভাবে, কখনো ইহুদি পিশাচ, কখনো ছোটবেলার রাশেদ নামে চিত্রনাট্য লেখক।
BPD-based impulsive violence: যখনই কেউ তার পরিকল্পনায় বাধা দেয়, সে হিংস্রভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। আচমকা বিস্ফোরণের মতো খুন করে ফেলে।
রিয়ান বলেছিল একবার:
“সে কখনোই তন্ত্রসাধক ছিল না।
সে একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত খুনী,
যে নিজের রক্তপিপাসা ঢাকতে চেয়েছে শাস্ত্রের ছায়া দিয়ে।
তাঁর আসল সাধনা—হত্যার মধ্যেই অমর হয়ে থাকা।”
কুয়াশা হয়তো বিশ্বাস করে, প্রতিটি খুনের মাধ্যমে সে মৃত্যুকে জয় করছে।
কিন্তু বাস্তবে—
সে মৃত্যু নয়, বিকারের পূজারী।
আর তার দেবতা হলো—নেশা,
যেখানে প্রতিটি ছিন্ন শরীরের গন্ধই তাকে মনে করিয়ে দেয়
সে এখনো বেঁচে আছে।
৪.
রাত ছিল অচেনা অন্ধকারে মোড়ানো।
ঢাকার উপকণ্ঠে শীতলক্ষ্যার ধারে পুরনো একটি পোড়োবাড়ি, যেখানে অনেক আগে একটি পরিবার আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল।
সেই ভাঙা দেয়াল আর ছেঁড়া পর্দার ঘরে বসে ছিল এক কিশোরী—মিমি।
বয়স পনেরো।
ভয়ে তার ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছিল।
সে এসেছিল এক বন্ধুর সঙ্গে, “চ্যালেঞ্জ” নিতে।
গুজব ছিল, এখানে রাতে এলেই ছায়া দেখা যায়—আর কেউ কেউ বলে, ছায়াটা আসলে একটা “মানুষ”।
মিমির বন্ধু ফিরোজ বাইরে গিয়েছিল সিগারেট আনতে।
তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে, ফিরোজ ফেরেনি।
ঘরের ভেতর হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটা এলো।
কোনো জানালা খোলা ছিল না।
তারপর দরজার পাশে একটা হালকা শব্দ—
একটা ধাতব জিনিস যেন ঘষটে চলেছে মেঝেতে।
মিমি ভয়ে পেছনে তাকায়।
সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক।
লম্বা, কঙ্কালসার, সাদা চাদরে মোড়া দেহ।
চুলগুলো লম্বা আর ভিজে।
তার চোখদুটি যেন খালি—কিন্তু তাতে আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল না।
হাঁ করে দাঁড়িয়ে, সে এক অদ্ভুত শব্দ করছিল—ঠিক যেন কেউ গলা নাড়তে গিয়ে হাঁসফাঁস করছে।
মিমি বলল, “কে আপনি?”
কিন্তু উত্তর এল না।
শুধু তার হাত ধীরে ধীরে উঠে গেল, আঙুলে ধরা একটা কাটা জিভ।
সে ফিসফিস করে বলল,
“চুপ থাক। শব্দ করলে ঈশ্বর ঘুম ভেঙে যাবে।
আর ঘুম ভাঙলে, সে রক্ত চায়।”
মিমি দৌড় দিতে চেয়েছিল।
কিন্তু ঠিক তখন সে দেখতে পেল—ঘরের মাঝখানে মেঝেতে ফিরোজ পড়ে আছে।
তার শরীর নেই, কেবল মাথাটা বসানো হয়েছে পাঁচ কোণার মাঝে।
চোখ দুটি তুলে নেওয়া, আর কপালে খোদাই করা—
"জল পূর্ণ হল। এখন বায়ু আসবে।"
মিমি চিৎকার করতে গেল।
কিন্তু কিছু বলার আগেই তার মুখে যেন কেউ কাঁচি ঢুকিয়ে দিল।
লোকটা—মানে কুয়াশা—পেছন থেকে এসে তার মুখের ওপর থাবা বসায়, আর কানের পাশে ফিসফিস করে—
“তোর শরীর দিয়ে আজ বায়ু পূর্ণ হবে।
শ্বাসটা আমার দরকার।
তুই আজ ঈশ্বরের ষষ্ঠ ঘুমের দরজা খুলবি।”
তারপর…
তাকে আর পাওয়া যায়নি।
পরদিন সকাল।
শীতলক্ষ্যার কাদা মাটির পাশে পড়ে ছিল একটি মৃতদেহ।
নাকে কাপড় গুঁজে শ্বাস বন্ধ করে খুন করা হয়েছে।
মুখের চারপাশে কালো কালি দিয়ে আঁকা—একটি সর্পিল বাতাসের প্রতীক।
আর দেয়ালে রক্ত দিয়ে লেখা—
“বায়ু ঘুমাল।
এবার আকাশ নামবে।”
৫.
ডিবি অফিসে রিয়ান কেসটি হাতে পান।
তদন্তে গিয়ে তিনি শুধু একটা শব্দ পান মৃতদেহের পকেট থেকে, কুয়াশার লেখা একটি চিরকুট:
“আমি আসছি আকাশে।
আমি আসছি তোমার সন্তান নিয়ে।
এবার ঈশ্বর মরবে।”
রিয়ানের হাতে তখনো কাঁপছিল সেই কাগজ।
বাতাসে তখনো ভেসে বেড়াচ্ছিল কুয়াশার সেই ফিসফিসি—
শুধু রিয়ানের কানে...
“তুই কিছুই পারবি না, সুফি।
কারণ আমি ভয় না।
আমি সেই ভয়, যাকে তুই লুকিয়ে রাখিস ধ্যানে।
আমি তো তোর মধ্যেই আছি…”
কুয়াশা নিজেকে বহুবার ‘ছায়া’ বলে দাবি করে।
কিন্তু সেই ছায়া কেবল বিভ্রান্তি নয়—তার ভেতরে ঘুরে বেড়ায় শত শত মুখ, শত শত পরিচয়।
তার অন্যতম দুটি বিকৃত রূপ—
১. Father Gregory, একজন রোমান ক্যাথলিক পুরোহিত
২. Rabbi Eliazar ben Shimon, একজন ইহুদি কাব্বালাহ-শিক্ষিত পাদ্রী
এ দুটি সত্তা নিয়ে সে দুই দেশে গিয়েছিল।
যেখানে সে শুধু নিজেকে লুকোয়নি,
বরং সে সাধনা করেছে খুনের নতুন আচার।
রোমানিয়ার কার্পাথিয়ান অঞ্চলে—Father Gregory
কুয়াশা ওখানে এক গির্জার আশ্রমে ঢুকেছিল।
সাদা পোশাক, লম্বা ক্রস, মাথায় সন্ন্যাসীর টুপি—
সে পরিচয় দেয় Gregory, Father of Redemption নামে।
গির্জায় সে রাত জেগে প্রার্থনা করত, কিন্তু তার ঘরে কেউ ঢুকলে শুনত—
সে “সান্টা মারিয়া” বলার বদলে ফিসফিস করছে এক অচেনা ভাষায়, আর তার সামনে পুড়ছে মানুষের চুল।
একদিন সে স্থানীয় এক এতিম বালককে ডাকে।
তাকে বলে—"তোমার আত্মা অস্পষ্ট। আমি তোমার দেহ থেকে পাপ সরিয়ে দেব।"
তিন দিন পর বালকের দেহ পাওয়া যায় গির্জার নিচের crypt-এ।
তার বুক খোলা, বুকে খোদাই করা ক্রস।
আর চোখ দুটি নেই।
পাশেই ছিল এক চিঠি—
“এই দেহ পবিত্র হলো আগুনে।
আমি ‘ল্যাম্ব অফ গড’ নয়—আমি ঈশ্বরের ছায়া।
আমি আগুন দিয়ে উদ্ধার করি।”
কুয়াশা গায়েব হয়ে যায়।
রোমানিয়া পুলিশ ব্যর্থ হয়।
তবে ক্যাথলিক চার্চের একটি সিক্রেট রিপোর্টে বলা হয়:
“Gregory নামে যিনি এসেছিলেন, তার চোখে ঈশ্বরের আলো ছিল না।
তার চোখ ছিল অতল, যেন অন্য কোনো সময় থেকে এসেছেন তিনি।”
৬.
জেরুজালেমে—Rabbi Eliazar ben Shimon
ইস্রায়েলের এক পুরনো সিনাগগে হঠাৎ আবির্ভূত হয় এক রাব্বি—
পুরু দাড়ি, কালো হ্যাট, হাতে চামড়ার পুরাতন ‘সেফার জোহর’।
সে দাবি করে, সে Eliazar, এক বংশানুক্রমিক কাব্বালাহ পণ্ডিত।
সে বলে, “আমি মৃত আত্মাদের কান্না শুনি।
তাদের মুক্তি দরকার।
আমাকে তন্ত্র জানা আছে।”
প্রথমে সবাই মুগ্ধ।
সে রাত জেগে ‘গেমাত্রিয়া’ চর্চা করে, কাব্বালাহ ঘরানায় আত্মা বিশুদ্ধির কথাও বলে।
কিন্তু দুই সপ্তাহ পর, এক নারী শিক্ষার্থীর নিখোঁজ সংবাদ মেলে।
তারপর এক পাহাড়ি গুহায় তার মৃতদেহ উদ্ধার হয়—
চোখে খোদাই করা হিব্রু অক্ষর “אেল” (אל), যার মানে ঈশ্বর।
তার চারপাশে মোমবাতি আর ছিন্ন ছিন্ন মাংস, যা দিয়ে আঁকা হয়েছে “ঐশ্বরিক নামের গঠনচক্র”।
সিনাগগে রাখা হয় সতর্কবার্তা।
Rabbi Eliazar গায়েব হয়ে যায়।
কেউ জানত না সে আসলে কে।
“কুয়াশা শুধু খুন করে না।
সে প্রতিটি ধর্মকে ব্যবহার করে।
সে ঈশ্বরের মুখোশ পরে, তারপর ছায়ার ছুরি চালায়।
সে কখনো Gregory, কখনো Eliazar,
কিন্তু আসলে, সে কেউ না।
সে খালি এক ভয়,
এক বিকার,
এক নেশাগ্রস্ত ঈশ্বর হওয়ার বিভ্রম।
এবার সে ফিরবে।
৭.
আর আমি জানি, তার পঞ্চম উৎসর্গের মঞ্চ—
আমার শহর, আমার ঘর,
আমার সন্তান।”
ঢাকার আকাশ সেদিন ভারী ছিল।
মেঘ জমেছিল, কিন্তু বৃষ্টি নামছিল না—
এক ধরনের অস্বস্তিকর স্তব্ধতা ছড়িয়ে ছিল পুরো শহরে।
ডিবি অফিসের প্রধান কনফারেন্স রুমে কেউ কিছু বলছিল না।
শুধু একটা সংবাদ টেবিল জুড়ে ছড়িয়ে ছিল:
"ডিবি অফিসার রিয়ানের পাঁচ বছরের সন্তান 'আরিয়ান' নিখোঁজ।"
ঘটনার ৩২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে।
কোনো দাবি, কোনো মুক্তিপণ চাওয়া হয়নি।
সিসিটিভি ফুটেজের একটিতে শুধু দেখা গেছে—একজন লম্বা লোক, মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা,
ছেলেটিকে কোলে নিয়ে নিচ্ছে।
তার গায়ের চাদর রক্ত রঙের।
আরিয়ানের খেলার ঘরে পাওয়া গিয়েছিল একটি পুঁথি বই।
তাতে লেখা—
“শেষ পঞ্চতন্ত্র আসন্ন।
আকাশের উৎসর্গ দেবতা নিজে।
এবার ঈশ্বর মরবে... শিশুর মুখে।”
রিয়ান নিজে তদন্তে নামে।
নিজের সন্তান উদ্ধারের জন্য, এবার সে ডিবি অফিসার নয়,
সে একজন বাবা—
আর একমাত্র সেই বোঝে, কুয়াশা কী চায়।
সেদিন রাতে, নারায়ণগঞ্জের পাশের মেঘনা নদীর চর থেকে ভেসে আসে এক ছোট্ট শিশুর চিৎকার।
চিৎকার শুনে আশেপাশের লেকজন ছুটে যায়।
পালিয়ে যায় কুয়াশা।
বালির নিচে শ্বাস রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল শিশুটিকে, মাথায় এক ধরনের কাব্যিক খোদাই—
"আকাশের বাতাস স্তব্ধ হলে, ঈশ্বর চোখ মেলে।”
কিন্তু অলৌকিকভাবে, শিশু আরিয়ান বেঁচে থাকে।
তাকে উদ্ধার করে আনে রিয়ান।
কিন্তু তখনও বাচ্চাটি অচেতন।
তার চোখ বন্ধ, ঠোঁটে কোনো শব্দ নেই,
শুধু বুকটা ধীরে ধীরে ওঠানামা করছে।
রিয়ান বাচ্চাকে কোলে তুলে কাঁদতে কাঁদতে একটিই কথা বলছিল—
"আমি তোকে দেবতা হতে দেব না। তোকে নিজ হাতে খুন করবো।"
হাসপাতালে বাচ্চাটি যখন চিকিৎসাধীন,
তখনই রিয়ান হঠাৎ পড়ে যায়, জ্ঞান হারায়।
আর কুয়াশা?
সে গায়েব।
সেদিন রাতেই, কাশিমপুরের এক পুরনো সীমানা দিয়ে
একজন লোককে হাঁটতে দেখা যায়—
গায়ে সাদা চাদর, হাতে চামড়ার পুঁথি।
সিকিউরিটি ক্যামেরায় তার মুখ দেখা যায় না,
কিন্তু তার হাঁটার ছায়ায় দেখা যায় দুটি চোখ আলাদা হয়ে নড়ছে।
আর তার ছায়া...
সেই ছায়া ছিল শিশুর আকৃতিতে।
৮.
ডিবির রিপোর্টে লেখা হয়:
“শিশু উদ্ধার হয়েছে।
কিন্তু কুয়াশা পলাতক।
খুনের সংখ্যা থেমেছে,
কিন্ত পঞ্চতন্ত্রের পঞ্চম উৎসর্গ—
এখনো পূর্ণ হয়নি।”
রিয়ানের জ্ঞান ফিরেছে দুদিন পর,
আর ওর পাশে চুপচাপ শুয়ে ছিল ছোট্ট আরিয়ান।
তার বুকের ওপরে হালকা একটা আঁচড়—
ঠিক যেন কেউ লিখে দিয়েছে বাতাসে:
“ঈশ্বর এখন শিশু।”
৯.
মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত চূড়ান্ত রিপোর্ট
রোগীর নাম: আয়ান ঘোষ (ছদ্মনাম: কুয়াশা)
বয়স: আনুমানিক ৩৫
লিঙ্গ: পুরুষ
জাতীয়তা: ভারতীয় (পরবর্তীতে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ)
রেফার্ড বাই: ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (DB)
মুল্যায়নকারী:
ডা. সায়মা আহমেদ
সাইকিয়াট্রিক কনসালট্যান্ট, ঢাকা মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
তারিখ: (গোপনীয়)
পূর্ববর্তী ইতিহাস (Case History):
শৈশবের ট্রমা:
রোগীর শৈশবে গুরুতর পারিবারিক সহিংসতা ও মানসিক নির্যাতনের ইতিহাস রয়েছে। বাবা ছিলেন শাসক প্রকৃতির ও নির্মম; মা অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং আবেগপ্রবণ।
রোগীর বয়স ৯ বছর থাকাকালীন মায়ের মৃত্যু ঘটে। প্রথমে এটিকে দুর্ঘটনা বলা হলেও, পরবর্তীতে রোগী নিজেই স্বীকার করে—সে মাকে হত্যা করেছে এবং বাবার ওপর দোষ চাপিয়ে বাবাকে মানসিকভাবে ধ্বংস করে আত্মহত্যায় বাধ্য করে।
প্রেমে প্রতারণা:
কৈশোর ও যৌবনে প্রেমিকা পদ্মাবতীর বিশ্বাসঘাতকতায় রোগী তীব্র আবেগিক বিপর্যয়ের শিকার হন। সেই ঘটনা তার ব্যক্তিত্ব ভাঙনের অন্যতম ট্রিগার হয়ে ওঠে।
পরিচয় বিভ্রান্তি ও ধর্মীয় উন্মাদনা:
নিজেকে বিভিন্ন সময় হিন্দু তান্ত্রিক, খ্রিস্টান পুরোহিত, ইহুদি রাব্বি, সুফি সাধক হিসেবে দাবি করেছে। তার বিশ্বাস, সে পঞ্চতন্ত্র সাধনার মাধ্যমে ‘অমরত্ব’ বা ‘ঈশ্বরত্ব’ অর্জন করছে।
চিকিৎসা ও মনস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ:
১. Dissociative Identity Disorder (DID):
রোগীর ভেতরে স্পষ্টভাবে একাধিক ব্যক্তিত্ব সক্রিয় রয়েছে।
স্ব-পরিচয়ের সীমানা দুর্বল বা ভাঙা; কখনো সে নিজেকে আয়ান ঘোষ, কখনো রাশেদ, কখনো Father Gregory, Rabbi Eliazar, আবার কখনো নিজেকে শুধুই ‘কুয়াশা’ হিসেবে উপস্থাপন করে।
প্রতিটি ব্যক্তিত্বের ভাষা, অভিব্যক্তি, আচরণ ও বিশ্বাস ভিন্ন।
২. Delusional Paranoia (চরম মাত্রা):
রোগী বিশ্বাস করে সে স্বর্গীয়/ঈশ্বরীয় দায়িত্ব পালন করছে, পৃথিবীকে "পাপমুক্ত" করছে।
সে মনে করে, সমাজ, ধর্ম, পরিবার সবাই তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে।
paranoid চিন্তাভাবনা ক্রমাগতভাবে বাস্তব-বিচ্যুতি ঘটায় এবং হিংস্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।
৩. Antisocial Personality Disorder (ASPD):
অপরাধের জন্য অনুশোচনা বা গ্লানি বোধের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি।
দায়িত্বহীনতা, অসংবেদনশীলতা, নিয়ম ও সামাজিক নীতির প্রতি অবজ্ঞা লক্ষণীয়।
অত্যন্ত কৌশলী ও প্রতারক; প্রায় প্রতিটি অপরাধই পূর্বপরিকল্পিত এবং প্রতীকী।
৪. Borderline Personality Traits with Impulsive Aggression:
হঠাৎ করে তীব্র রাগ, শত্রুতা ও সহিংস আচরণ প্রদর্শন।
অতীত সম্পর্ক, বিশেষ করে পদ্মাবতীর ঘটনা তাকে আবেগিকভাবে অস্থিতিশীল করে তোলে এবং তা তাৎক্ষণিক হিংস্রতা ও খুনের দিকে চালিত করে।
আচরণগত বিশ্লেষণ:
রোগী তার খুনগুলোকে পঞ্চতন্ত্র (পাঁচ মহাভূত) সাধনার অংশ বলে মনে করে।
প্রতিটি খুনে থাকে প্রতীকী নিদর্শন, যেমন আগুনে পোড়ানো, পানিতে ডুবানো, মাটিচাপা দেওয়া, বায়ুতে শ্বাসরোধ, আকাশের চিহ্ন এঁকে মৃত্যু।
ভাষাগত চর্চা জটিল; সে সংস্কৃত, হিব্রু, আরবি ও বাংলা একসঙ্গে মিশিয়ে অদ্ভুত প্রার্থনা পাঠ করে।
আত্মপরিচয় এবং বাস্তবতা–উভয়ের সংজ্ঞা বিকৃত।
মানসিক অবস্থার রেটিং (DSM-5 অনুসারে):
মানসিক উপসর্গ উপস্থিতির মাত্রা
Dissociative Identity Disorder : চরম
Delusional Paranoia : চরম
Antisocial Personality Disorder (ASPD) : চরম
Borderline Impulsivity/Violence : মাঝারি থেকে চরম
Reality Orientation : (ব্যবহারিক উপলব্ধি) খুবই দুর্বল
ঝুঁকি বিশ্লেষণ (Risk Assessment):
নিজের জন্য ঝুঁকি: নেই। আত্মহত্যার প্রবণতা নেই, বরং নিজেকে অমর বলে মনে করে।
অন্যের জন্য ঝুঁকি: অত্যন্ত উচ্চ। সম্ভাব্য আবার হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে—বিশেষ করে ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক পরিবেশে।
চিকিৎসকের চূড়ান্ত মন্তব্য:
রোগী আয়ান ঘোষ, যিনি নিজেকে কুয়াশা হিসেবে ঘোষণা করেছেন, মানসিকভাবে অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং তার মনস্তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি এবং অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
তার রোগসমষ্টি একসঙ্গে ক্রিয়াশীল হয়ে এক দানবীয় মনঃপ্রবৃত্তি গঠন করেছে, যা ধর্ম, পরিচয়, আধ্যাত্মিকতা ও প্রতারণার স্মৃতি নিয়ে নিজের মধ্যে নতুন পরিচয় তৈরি করে—যে পরিচয় সমাজবিরোধী, ভয়ংকর, এবং ভীষণভাবে অস্পষ্ট।
“এই রোগীকে কোনওভাবে কারাগারে নয়, বরং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা-সম্পন্ন সাইকিয়াট্রিক ইনস্টিটিউটে আজীবনের জন্য পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত।”
সংযুক্ত:
অডিও রেকর্ডিং ট্রান্সক্রিপ্ট
চিত্রাঙ্কিত খুনের প্রতীকসমূহ
ফিজিক্যাল নিউরোস্ক্যান রিপোর্ট
পলিগ্রাফ পরীক্ষার ফলাফল (বিচ্যুতি প্রবণ)
লেখ্য কবিতা ও ধর্মীয় প্রলাপ
[শেষ রিপোর্ট | গোপনীয় | কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে প্রকাশযোগ্য]
Prepared by:
ডা. সায়মা আহমেদ
সাইকিয়াট্রিক কনসালট্যান্ট
ঢাকা মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
কিন্তু এই রিপোর্ট কি কাজে আসবে কেউ জানে না।
যেমন জানে না কুয়াশা কোথায়?
কোথায় কুয়াশা?
আসলে কে এই কুয়াশ?
[বি: দ্র: সবগুলো চরিত্র কাল্পনিক। লেখকের কল্পনা থেকে চরিত্র গুলোর সৃষ্টি। বাস্তবের কারো সাথে মিল নেই।]
#অর্পন_রহমান