Razonna Mystiverse

Razonna Mystiverse আমি তোমাদেরই লোক
(2)

সব রকমের বিনোদন ও সায়েন্স ফিকশন, কালোজাদু, তন্ত্রমন্ত্রের গল্প বা বাস্তব ঘটনা, হরর গল্প ও সিনেমা দেখতে পেইজটি ফলো করুন।

ইউটিউবে লিখে সার্চ দিন এবং দেখুন। Horror Short film

কুয়াশায় ঢাকা শহর ২য় পর্ব(সাইকো থ্রিলার): অর্পন রহমান১.ডিবি অফিসের গা-ছোঁয়া আলোয়, রিয়ান বসে ছিল একটি স্যাঁতসেঁতে টেবিলের...
08/07/2025

কুয়াশায় ঢাকা শহর ২য় পর্ব

(সাইকো থ্রিলার)

: অর্পন রহমান

১.

ডিবি অফিসের গা-ছোঁয়া আলোয়, রিয়ান বসে ছিল একটি স্যাঁতসেঁতে টেবিলের পেছনে, তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল অফিসার হাবিব। গুমোট পরিবেশে, বাইরে রাতের অন্ধকার আরও ভারী হয়ে উঠেছিল। একের পর এক খুনের তদন্তে যাওয়া রিয়ান আজ শেষ কথা বলবে।

তার চোখের সামনে পড়ে ছিল খুনের মামলা, প্রতিটি খুনের ধরন ছিল আলাদা, কিন্তু একটি ভয়ঙ্কর ঐক্য ছিল তাদের মধ্যে। প্রতিটা হত্যার পেছনে ছিল একটি অসীম বিশ্বাস—পাঁচতন্ত্রের পূর্ণতা।

রিয়ান টেবিলের ওপর একটি ফাইল খুলে দেখাল, যেখানে প্রতিটি খুনের বিশদ বর্ণনা দেওয়া ছিল। তার মুখে রুক্ষ শব্দ বের হলো—"প্রথমে আগুন।"

আগুন দিয়ে খুন
"আগুনের পথ একদম আলাদা," রিয়ান বলল, "এটা একটি শাশ্বত পদ্ধতি—অগ্নি। আগুন দিয়ে খুন করলে, শরীর পুড়ে না শুধুমাত্র, আত্মাও দগ্ধ হয়ে যায়। এই খুনে মৃত্যুর আগে, ভুক্তভোগী যেমন শারীরিকভাবে পুড়েছিল, তেমনি তার আত্মাও পুড়ে গেল। একে বলা হয় তাপীয় হত্যাকা-। খুনী আগুনের মতো ধ্বংসাত্মক। তার চোখে শুধুমাত্র মৃত্যু, যেখানে সবার শেষ মানে নিঃশেষিতা—কেউ ফেরে না। এটাই আগুনের প্রকৃতি।"

রিয়ান থামলেন, চোখের কোণে কিছু গা-ছোঁয়া কিছু ভয়ের অনুভূতি উঠছিল।
"এটাই শুরু," তিনি আবার বললেন, "এরপর পানি দিয়ে খুন।"

পানি দিয়ে খুন
"পানি সবকিছু শুদ্ধ করতে পারে, তবে পানি দিয়েও খুন হয়। হত্যাকারী পানির মত ধীরে ধীরে আক্রমণ করে, কিন্তু এই ধরনের খুনে মরতে একটু সময় নেয়, জল শ্বাস বন্ধ করে দেয়, কিন্তু ধীরে ধীরে। শ্বাস নিতে না পেয়ে শিকার শেষে মারা যায়। ঘন স্নিগ্ধতা, মৃতদেহ স্নানের মত শীতল। এই খুনের মধ্যে আছে ভয়াবহ স্নিগ্ধতা, যা শিকারকে ধীরে ধীরে মিশিয়ে ফেলে, সঠিকভাবে অনুভব করাতে পারে না যে মৃত্যুর কাছে পৌঁছানো হয়ে গেছে।"

রিয়ান পেন্সিল দিয়ে টেবিলের ওপর কিছু আঁকলেন, আবার মুখ তুললেন।
"এবার বায়ু দিয়ে খুন।"

বায়ু দিয়ে খুন
"বায়ু খুনের সবচেয়ে বিচিত্র ধরন," রিয়ান শুরু করলেন, "বায়ু কিছুই স্পর্শ করে না, কিন্তু শিকার অনুভব করতে পারে তার গলায় আক্রমণ। বায়ু দিয়ে খুনে কোনো পদক্ষেপ নেই, কোনো আঘাত নেই, শুধু শ্বাসের বাধা, অক্সিজেনের শূন্যতা। শিকার দমবন্ধ হয়ে মারা যায়। বায়ু হত্যাকারী কখনো দৃশ্যমান হয় না, তার অস্তিত্ব নরম, কিন্তু ধারালো। এই ধরনের খুনে, শিকার নিজের শরীরের মধ্যে ছড়িয়ে যাওয়া অদৃশ্য আক্রমণ অনুভব করে, অথচ কিছুই দেখা যায় না।"

হাবিব কিছুটা শিউরে উঠল।
"মাটি দিয়ে?" সে জিজ্ঞেস করল।

মাটি দিয়ে খুন
"মাটি, মাটির উপর খুন, এটি মূলত চাপের মাধ্যমে। মৃত্যুর সৃষ্টির সময় মাটি জড়িয়ে যায়, শেষ হয়ে যায়, যেমন শিকারকে মাটির গায়ে চাপ দিয়ে চেপে ধরে রাখা হয়। মাটি দিয়ে খুনে, শিকারকে গুম করে দেয়া হয়—শ্বাস বন্ধ, মাটির স্তরে চাপ। সে যখন বুঝতে পারে, তার শ্বাস আরও কমে যাচ্ছে, তখন তার নিজ জীবনের উপলব্ধি শেষ হয়ে যায়। মাটির এই খুন সবকিছুকে চাপিয়ে দেয়, তাকে জানিয়ে দেয় যে তার শেষ সময় এসেছে।"

রিয়ান থেমে গেলেন, একটু বিরতি নিয়ে, তারপর আবার কথা বললেন।
"এখন, আকাশে খুন।"

২.

আকাশে খুন
"আকাশ খুনের সবচেয়ে অদ্ভুত ধরন," রিয়ান বললেন, "এটা আলাদা, কারণ আকাশ থেকে খুন হওয়া মানে ঐশ্বরিক বা অবাস্তব—শিকারকে আকাশ থেকে তোলার মতো অনুভূতি। তার চোখের সামনে মৃত্যু আছেই, তবে সেটি মনে হয় স্বপ্নের মতো। আকাশে খুনের মেসেজটি সুস্পষ্ট—তুমি জানো যে তুমি মরবে, তবে কি হবে তা জানো না। কুয়াশা, বজ্রপাত, কিংবা বায়ুমণ্ডলের চাপ—সবই আকাশে খুনের অস্ত্র হতে পারে। এটা অদৃশ্য, অস্পষ্ট—এতে কেবল একটি বোধ থাকে, আর সেটা মৃত্যু।"

রিয়ান একবার মাথা তুলে দেখল, হাবিব তার চোখে একটু অসহায় দেখাচ্ছে।
"সবগুলো হত্যার পেছনে একটাই পথ—একটি দুষ্টু ধারাবাহিকতা, যা শিকারকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে, আর খুনী পায় তার শক্তি। কুয়াশা, এই হত্যাকান্ডগুলোর পেছনে, একটি তন্ত্রের পূর্ণতা খুঁজছে।"

রিয়ান চুপচাপ দাঁড়িয়ে গ্লাস থেকে পানি খান।
"তারপরও," তিনি বললেন, "এখন আমি জানি, এই খুনগুলো একযোগে এমনভাবে ঘটছে, যে আমরা যারা দেখি, আমরা এখন তার ধারাবাহিকতায় দাঁড়িয়ে আছি। এই মৃত্যু কোনো সাধারণ খুন নয়, এটি একটি মহাপরিকল্পনা—যার অন্ধকার ঠিক পেছনে রয়েছে।"

ঠিক এইখানেই কুয়াশার বিভ্রম ও বিকার একসঙ্গে মিশে যায়।

সে বলে, সে পঞ্চতন্ত্র সাধনায় লিপ্ত—
অগ্নি, জল, মাটি, বায়ু, আকাশ—এই পাঁচ মহাভূতের প্রতীকী উৎসর্গের মাধ্যমে সে চায় অমরত্ব।
সে বিশ্বাস করে, প্রতিটি খুন হচ্ছে একেকটি “তপস্যা”, আর প্রতিটি মৃত্যুর রক্তে সে ধীরে ধীরে ঈশ্বরতুল্য হয়ে উঠছে।
সে বলে—

“দেহ নশ্বর, কিন্তু রক্তের মধ্য দিয়ে আমি পৌঁছে যাব দেবলোক।
যাদের মেরে ফেলছি, তারা আমার সিঁড়ি।
আমি ঈশ্বর হব।
আমি আর মরব না।”

৩.

কিন্তু বাস্তবতা খুবই ভিন্ন।

রোগ বিশ্লেষণ অনুযায়ী, কুয়াশা একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোপ্যাথ।
তার ভেতরে অপরাধবোধ নেই।
খুন করার সময় তার মধ্যে করুণা, ভয়, কিংবা পিছুটান কাজ করে না।
বরং খুনই তার একমাত্র সুখ।

ডিবি অফিসে ফরেনসিক সাইকিয়াট্রিস্টরা রিপোর্ট দেয়:

“বিষয়টি স্পষ্ট: কুয়াশা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক সাধনার নামে নিজের সিরিয়াল কিলিংকে যুক্তি দিচ্ছে। সে নিজেকে তান্ত্রিক, পঞ্চতন্ত্রী, এমনকি ঈশ্বর ভাবছে।
কিন্তু এগুলো সবই তার মনস্তাত্ত্বিক বিভ্রমের ফল।
আসলে সে খুনের আসক্তিতে ভোগা এক মারাত্মক সাইকো কিলার।”

কুয়াশার ভেতরের প্রক্রিয়াটি এরকম:

Antisocial Personality Disorder (ASPD): তার বিবেকহীনতা ও ঠান্ডা মাথার খুন করার ক্ষমতা এখান থেকে।

Delusional Paranoia: সে ভাবে গোটা পৃথিবী তাকে ঠকিয়েছে, ঈশ্বর তাকে ত্যাগ করেছে। তাই সে এখন ঈশ্বরকে প্রতিস্থাপন করতে চায়।

DID (Dissociative Identity Disorder): তার নানা রকম বিকৃত পরিচয়ের জন্ম—সে কখনো নিজেকে হিন্দু ব্রাহ্মণ ভাবে, কখনো ইহুদি পিশাচ, কখনো ছোটবেলার রাশেদ নামে চিত্রনাট্য লেখক।

BPD-based impulsive violence: যখনই কেউ তার পরিকল্পনায় বাধা দেয়, সে হিংস্রভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। আচমকা বিস্ফোরণের মতো খুন করে ফেলে।

রিয়ান বলেছিল একবার:

“সে কখনোই তন্ত্রসাধক ছিল না।
সে একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত খুনী,
যে নিজের রক্তপিপাসা ঢাকতে চেয়েছে শাস্ত্রের ছায়া দিয়ে।
তাঁর আসল সাধনা—হত্যার মধ্যেই অমর হয়ে থাকা।”

কুয়াশা হয়তো বিশ্বাস করে, প্রতিটি খুনের মাধ্যমে সে মৃত্যুকে জয় করছে।

কিন্তু বাস্তবে—

সে মৃত্যু নয়, বিকারের পূজারী।
আর তার দেবতা হলো—নেশা,
যেখানে প্রতিটি ছিন্ন শরীরের গন্ধই তাকে মনে করিয়ে দেয়
সে এখনো বেঁচে আছে।

৪.

রাত ছিল অচেনা অন্ধকারে মোড়ানো।
ঢাকার উপকণ্ঠে শীতলক্ষ্যার ধারে পুরনো একটি পোড়োবাড়ি, যেখানে অনেক আগে একটি পরিবার আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল।
সেই ভাঙা দেয়াল আর ছেঁড়া পর্দার ঘরে বসে ছিল এক কিশোরী—মিমি।
বয়স পনেরো।
ভয়ে তার ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছিল।

সে এসেছিল এক বন্ধুর সঙ্গে, “চ্যালেঞ্জ” নিতে।
গুজব ছিল, এখানে রাতে এলেই ছায়া দেখা যায়—আর কেউ কেউ বলে, ছায়াটা আসলে একটা “মানুষ”।
মিমির বন্ধু ফিরোজ বাইরে গিয়েছিল সিগারেট আনতে।
তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে, ফিরোজ ফেরেনি।

ঘরের ভেতর হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটা এলো।
কোনো জানালা খোলা ছিল না।

তারপর দরজার পাশে একটা হালকা শব্দ—
একটা ধাতব জিনিস যেন ঘষটে চলেছে মেঝেতে।
মিমি ভয়ে পেছনে তাকায়।

সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক।
লম্বা, কঙ্কালসার, সাদা চাদরে মোড়া দেহ।
চুলগুলো লম্বা আর ভিজে।
তার চোখদুটি যেন খালি—কিন্তু তাতে আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল না।
হাঁ করে দাঁড়িয়ে, সে এক অদ্ভুত শব্দ করছিল—ঠিক যেন কেউ গলা নাড়তে গিয়ে হাঁসফাঁস করছে।

মিমি বলল, “কে আপনি?”
কিন্তু উত্তর এল না।
শুধু তার হাত ধীরে ধীরে উঠে গেল, আঙুলে ধরা একটা কাটা জিভ।

সে ফিসফিস করে বলল,
“চুপ থাক। শব্দ করলে ঈশ্বর ঘুম ভেঙে যাবে।
আর ঘুম ভাঙলে, সে রক্ত চায়।”

মিমি দৌড় দিতে চেয়েছিল।
কিন্তু ঠিক তখন সে দেখতে পেল—ঘরের মাঝখানে মেঝেতে ফিরোজ পড়ে আছে।
তার শরীর নেই, কেবল মাথাটা বসানো হয়েছে পাঁচ কোণার মাঝে।
চোখ দুটি তুলে নেওয়া, আর কপালে খোদাই করা—
"জল পূর্ণ হল। এখন বায়ু আসবে।"

মিমি চিৎকার করতে গেল।
কিন্তু কিছু বলার আগেই তার মুখে যেন কেউ কাঁচি ঢুকিয়ে দিল।

লোকটা—মানে কুয়াশা—পেছন থেকে এসে তার মুখের ওপর থাবা বসায়, আর কানের পাশে ফিসফিস করে—

“তোর শরীর দিয়ে আজ বায়ু পূর্ণ হবে।
শ্বাসটা আমার দরকার।
তুই আজ ঈশ্বরের ষষ্ঠ ঘুমের দরজা খুলবি।”

তারপর…

তাকে আর পাওয়া যায়নি।

পরদিন সকাল।

শীতলক্ষ্যার কাদা মাটির পাশে পড়ে ছিল একটি মৃতদেহ।
নাকে কাপড় গুঁজে শ্বাস বন্ধ করে খুন করা হয়েছে।
মুখের চারপাশে কালো কালি দিয়ে আঁকা—একটি সর্পিল বাতাসের প্রতীক।
আর দেয়ালে রক্ত দিয়ে লেখা—

“বায়ু ঘুমাল।
এবার আকাশ নামবে।”

৫.

ডিবি অফিসে রিয়ান কেসটি হাতে পান।
তদন্তে গিয়ে তিনি শুধু একটা শব্দ পান মৃতদেহের পকেট থেকে, কুয়াশার লেখা একটি চিরকুট:

“আমি আসছি আকাশে।
আমি আসছি তোমার সন্তান নিয়ে।
এবার ঈশ্বর মরবে।”

রিয়ানের হাতে তখনো কাঁপছিল সেই কাগজ।
বাতাসে তখনো ভেসে বেড়াচ্ছিল কুয়াশার সেই ফিসফিসি—
শুধু রিয়ানের কানে...

“তুই কিছুই পারবি না, সুফি।
কারণ আমি ভয় না।
আমি সেই ভয়, যাকে তুই লুকিয়ে রাখিস ধ্যানে।
আমি তো তোর মধ্যেই আছি…”

কুয়াশা নিজেকে বহুবার ‘ছায়া’ বলে দাবি করে।
কিন্তু সেই ছায়া কেবল বিভ্রান্তি নয়—তার ভেতরে ঘুরে বেড়ায় শত শত মুখ, শত শত পরিচয়।
তার অন্যতম দুটি বিকৃত রূপ—
১. Father Gregory, একজন রোমান ক্যাথলিক পুরোহিত
২. Rabbi Eliazar ben Shimon, একজন ইহুদি কাব্বালাহ-শিক্ষিত পাদ্রী

এ দুটি সত্তা নিয়ে সে দুই দেশে গিয়েছিল।
যেখানে সে শুধু নিজেকে লুকোয়নি,
বরং সে সাধনা করেছে খুনের নতুন আচার।

রোমানিয়ার কার্পাথিয়ান অঞ্চলে—Father Gregory

কুয়াশা ওখানে এক গির্জার আশ্রমে ঢুকেছিল।
সাদা পোশাক, লম্বা ক্রস, মাথায় সন্ন্যাসীর টুপি—
সে পরিচয় দেয় Gregory, Father of Redemption নামে।

গির্জায় সে রাত জেগে প্রার্থনা করত, কিন্তু তার ঘরে কেউ ঢুকলে শুনত—
সে “সান্টা মারিয়া” বলার বদলে ফিসফিস করছে এক অচেনা ভাষায়, আর তার সামনে পুড়ছে মানুষের চুল।

একদিন সে স্থানীয় এক এতিম বালককে ডাকে।
তাকে বলে—"তোমার আত্মা অস্পষ্ট। আমি তোমার দেহ থেকে পাপ সরিয়ে দেব।"

তিন দিন পর বালকের দেহ পাওয়া যায় গির্জার নিচের crypt-এ।
তার বুক খোলা, বুকে খোদাই করা ক্রস।
আর চোখ দুটি নেই।

পাশেই ছিল এক চিঠি—

“এই দেহ পবিত্র হলো আগুনে।
আমি ‘ল্যাম্ব অফ গড’ নয়—আমি ঈশ্বরের ছায়া।
আমি আগুন দিয়ে উদ্ধার করি।”

কুয়াশা গায়েব হয়ে যায়।

রোমানিয়া পুলিশ ব্যর্থ হয়।
তবে ক্যাথলিক চার্চের একটি সিক্রেট রিপোর্টে বলা হয়:

“Gregory নামে যিনি এসেছিলেন, তার চোখে ঈশ্বরের আলো ছিল না।
তার চোখ ছিল অতল, যেন অন্য কোনো সময় থেকে এসেছেন তিনি।”

৬.

জেরুজালেমে—Rabbi Eliazar ben Shimon

ইস্রায়েলের এক পুরনো সিনাগগে হঠাৎ আবির্ভূত হয় এক রাব্বি—
পুরু দাড়ি, কালো হ্যাট, হাতে চামড়ার পুরাতন ‘সেফার জোহর’।

সে দাবি করে, সে Eliazar, এক বংশানুক্রমিক কাব্বালাহ পণ্ডিত।
সে বলে, “আমি মৃত আত্মাদের কান্না শুনি।
তাদের মুক্তি দরকার।
আমাকে তন্ত্র জানা আছে।”

প্রথমে সবাই মুগ্ধ।
সে রাত জেগে ‘গেমাত্রিয়া’ চর্চা করে, কাব্বালাহ ঘরানায় আত্মা বিশুদ্ধির কথাও বলে।

কিন্তু দুই সপ্তাহ পর, এক নারী শিক্ষার্থীর নিখোঁজ সংবাদ মেলে।
তারপর এক পাহাড়ি গুহায় তার মৃতদেহ উদ্ধার হয়—
চোখে খোদাই করা হিব্রু অক্ষর “אেল” (אל), যার মানে ঈশ্বর।
তার চারপাশে মোমবাতি আর ছিন্ন ছিন্ন মাংস, যা দিয়ে আঁকা হয়েছে “ঐশ্বরিক নামের গঠনচক্র”।

সিনাগগে রাখা হয় সতর্কবার্তা।

Rabbi Eliazar গায়েব হয়ে যায়।

কেউ জানত না সে আসলে কে।

“কুয়াশা শুধু খুন করে না।
সে প্রতিটি ধর্মকে ব্যবহার করে।
সে ঈশ্বরের মুখোশ পরে, তারপর ছায়ার ছুরি চালায়।
সে কখনো Gregory, কখনো Eliazar,
কিন্তু আসলে, সে কেউ না।
সে খালি এক ভয়,
এক বিকার,
এক নেশাগ্রস্ত ঈশ্বর হওয়ার বিভ্রম।

এবার সে ফিরবে।

৭.

আর আমি জানি, তার পঞ্চম উৎসর্গের মঞ্চ—
আমার শহর, আমার ঘর,
আমার সন্তান।”

ঢাকার আকাশ সেদিন ভারী ছিল।
মেঘ জমেছিল, কিন্তু বৃষ্টি নামছিল না—
এক ধরনের অস্বস্তিকর স্তব্ধতা ছড়িয়ে ছিল পুরো শহরে।

ডিবি অফিসের প্রধান কনফারেন্স রুমে কেউ কিছু বলছিল না।
শুধু একটা সংবাদ টেবিল জুড়ে ছড়িয়ে ছিল:
"ডিবি অফিসার রিয়ানের পাঁচ বছরের সন্তান 'আরিয়ান' নিখোঁজ।"

ঘটনার ৩২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে।
কোনো দাবি, কোনো মুক্তিপণ চাওয়া হয়নি।
সিসিটিভি ফুটেজের একটিতে শুধু দেখা গেছে—একজন লম্বা লোক, মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা,
ছেলেটিকে কোলে নিয়ে নিচ্ছে।
তার গায়ের চাদর রক্ত রঙের।

আরিয়ানের খেলার ঘরে পাওয়া গিয়েছিল একটি পুঁথি বই।
তাতে লেখা—

“শেষ পঞ্চতন্ত্র আসন্ন।
আকাশের উৎসর্গ দেবতা নিজে।
এবার ঈশ্বর মরবে... শিশুর মুখে।”

রিয়ান নিজে তদন্তে নামে।
নিজের সন্তান উদ্ধারের জন্য, এবার সে ডিবি অফিসার নয়,
সে একজন বাবা—
আর একমাত্র সেই বোঝে, কুয়াশা কী চায়।

সেদিন রাতে, নারায়ণগঞ্জের পাশের মেঘনা নদীর চর থেকে ভেসে আসে এক ছোট্ট শিশুর চিৎকার।
চিৎকার শুনে আশেপাশের লেকজন ছুটে যায়।

পালিয়ে যায় কুয়াশা।

বালির নিচে শ্বাস রুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল শিশুটিকে, মাথায় এক ধরনের কাব্যিক খোদাই—

"আকাশের বাতাস স্তব্ধ হলে, ঈশ্বর চোখ মেলে।”

কিন্তু অলৌকিকভাবে, শিশু আরিয়ান বেঁচে থাকে।
তাকে উদ্ধার করে আনে রিয়ান।

কিন্তু তখনও বাচ্চাটি অচেতন।
তার চোখ বন্ধ, ঠোঁটে কোনো শব্দ নেই,
শুধু বুকটা ধীরে ধীরে ওঠানামা করছে।

রিয়ান বাচ্চাকে কোলে তুলে কাঁদতে কাঁদতে একটিই কথা বলছিল—
"আমি তোকে দেবতা হতে দেব না। তোকে নিজ হাতে খুন করবো।"

হাসপাতালে বাচ্চাটি যখন চিকিৎসাধীন,
তখনই রিয়ান হঠাৎ পড়ে যায়, জ্ঞান হারায়।

আর কুয়াশা?

সে গায়েব।

সেদিন রাতেই, কাশিমপুরের এক পুরনো সীমানা দিয়ে
একজন লোককে হাঁটতে দেখা যায়—
গায়ে সাদা চাদর, হাতে চামড়ার পুঁথি।

সিকিউরিটি ক্যামেরায় তার মুখ দেখা যায় না,
কিন্তু তার হাঁটার ছায়ায় দেখা যায় দুটি চোখ আলাদা হয়ে নড়ছে।
আর তার ছায়া...
সেই ছায়া ছিল শিশুর আকৃতিতে।

৮.

ডিবির রিপোর্টে লেখা হয়:

“শিশু উদ্ধার হয়েছে।
কিন্তু কুয়াশা পলাতক।
খুনের সংখ্যা থেমেছে,
কিন্ত পঞ্চতন্ত্রের পঞ্চম উৎসর্গ—
এখনো পূর্ণ হয়নি।”

রিয়ানের জ্ঞান ফিরেছে দুদিন পর,

আর ওর পাশে চুপচাপ শুয়ে ছিল ছোট্ট আরিয়ান।
তার বুকের ওপরে হালকা একটা আঁচড়—
ঠিক যেন কেউ লিখে দিয়েছে বাতাসে:

“ঈশ্বর এখন শিশু।”

৯.

মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত চূড়ান্ত রিপোর্ট

রোগীর নাম: আয়ান ঘোষ (ছদ্মনাম: কুয়াশা)
বয়স: আনুমানিক ৩৫
লিঙ্গ: পুরুষ
জাতীয়তা: ভারতীয় (পরবর্তীতে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশ)
রেফার্ড বাই: ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (DB)

মুল্যায়নকারী:
ডা. সায়মা আহমেদ
সাইকিয়াট্রিক কনসালট্যান্ট, ঢাকা মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
তারিখ: (গোপনীয়)

পূর্ববর্তী ইতিহাস (Case History):

শৈশবের ট্রমা:
রোগীর শৈশবে গুরুতর পারিবারিক সহিংসতা ও মানসিক নির্যাতনের ইতিহাস রয়েছে। বাবা ছিলেন শাসক প্রকৃতির ও নির্মম; মা অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং আবেগপ্রবণ।
রোগীর বয়স ৯ বছর থাকাকালীন মায়ের মৃত্যু ঘটে। প্রথমে এটিকে দুর্ঘটনা বলা হলেও, পরবর্তীতে রোগী নিজেই স্বীকার করে—সে মাকে হত্যা করেছে এবং বাবার ওপর দোষ চাপিয়ে বাবাকে মানসিকভাবে ধ্বংস করে আত্মহত্যায় বাধ্য করে।

প্রেমে প্রতারণা:
কৈশোর ও যৌবনে প্রেমিকা পদ্মাবতীর বিশ্বাসঘাতকতায় রোগী তীব্র আবেগিক বিপর্যয়ের শিকার হন। সেই ঘটনা তার ব্যক্তিত্ব ভাঙনের অন্যতম ট্রিগার হয়ে ওঠে।

পরিচয় বিভ্রান্তি ও ধর্মীয় উন্মাদনা:
নিজেকে বিভিন্ন সময় হিন্দু তান্ত্রিক, খ্রিস্টান পুরোহিত, ইহুদি রাব্বি, সুফি সাধক হিসেবে দাবি করেছে। তার বিশ্বাস, সে পঞ্চতন্ত্র সাধনার মাধ্যমে ‘অমরত্ব’ বা ‘ঈশ্বরত্ব’ অর্জন করছে।

চিকিৎসা ও মনস্তাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ:

১. Dissociative Identity Disorder (DID):

রোগীর ভেতরে স্পষ্টভাবে একাধিক ব্যক্তিত্ব সক্রিয় রয়েছে।

স্ব-পরিচয়ের সীমানা দুর্বল বা ভাঙা; কখনো সে নিজেকে আয়ান ঘোষ, কখনো রাশেদ, কখনো Father Gregory, Rabbi Eliazar, আবার কখনো নিজেকে শুধুই ‘কুয়াশা’ হিসেবে উপস্থাপন করে।

প্রতিটি ব্যক্তিত্বের ভাষা, অভিব্যক্তি, আচরণ ও বিশ্বাস ভিন্ন।

২. Delusional Paranoia (চরম মাত্রা):

রোগী বিশ্বাস করে সে স্বর্গীয়/ঈশ্বরীয় দায়িত্ব পালন করছে, পৃথিবীকে "পাপমুক্ত" করছে।

সে মনে করে, সমাজ, ধর্ম, পরিবার সবাই তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে।

paranoid চিন্তাভাবনা ক্রমাগতভাবে বাস্তব-বিচ্যুতি ঘটায় এবং হিংস্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।

৩. Antisocial Personality Disorder (ASPD):

অপরাধের জন্য অনুশোচনা বা গ্লানি বোধের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি।

দায়িত্বহীনতা, অসংবেদনশীলতা, নিয়ম ও সামাজিক নীতির প্রতি অবজ্ঞা লক্ষণীয়।

অত্যন্ত কৌশলী ও প্রতারক; প্রায় প্রতিটি অপরাধই পূর্বপরিকল্পিত এবং প্রতীকী।

৪. Borderline Personality Traits with Impulsive Aggression:

হঠাৎ করে তীব্র রাগ, শত্রুতা ও সহিংস আচরণ প্রদর্শন।

অতীত সম্পর্ক, বিশেষ করে পদ্মাবতীর ঘটনা তাকে আবেগিকভাবে অস্থিতিশীল করে তোলে এবং তা তাৎক্ষণিক হিংস্রতা ও খুনের দিকে চালিত করে।

আচরণগত বিশ্লেষণ:

রোগী তার খুনগুলোকে পঞ্চতন্ত্র (পাঁচ মহাভূত) সাধনার অংশ বলে মনে করে।

প্রতিটি খুনে থাকে প্রতীকী নিদর্শন, যেমন আগুনে পোড়ানো, পানিতে ডুবানো, মাটিচাপা দেওয়া, বায়ুতে শ্বাসরোধ, আকাশের চিহ্ন এঁকে মৃত্যু।

ভাষাগত চর্চা জটিল; সে সংস্কৃত, হিব্রু, আরবি ও বাংলা একসঙ্গে মিশিয়ে অদ্ভুত প্রার্থনা পাঠ করে।

আত্মপরিচয় এবং বাস্তবতা–উভয়ের সংজ্ঞা বিকৃত।

মানসিক অবস্থার রেটিং (DSM-5 অনুসারে):

মানসিক উপসর্গ উপস্থিতির মাত্রা

Dissociative Identity Disorder : চরম
Delusional Paranoia : চরম
Antisocial Personality Disorder (ASPD) : চরম
Borderline Impulsivity/Violence : মাঝারি থেকে চরম
Reality Orientation : (ব্যবহারিক উপলব্ধি) খুবই দুর্বল

ঝুঁকি বিশ্লেষণ (Risk Assessment):

নিজের জন্য ঝুঁকি: নেই। আত্মহত্যার প্রবণতা নেই, বরং নিজেকে অমর বলে মনে করে।

অন্যের জন্য ঝুঁকি: অত্যন্ত উচ্চ। সম্ভাব্য আবার হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে—বিশেষ করে ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক পরিবেশে।

চিকিৎসকের চূড়ান্ত মন্তব্য:

রোগী আয়ান ঘোষ, যিনি নিজেকে কুয়াশা হিসেবে ঘোষণা করেছেন, মানসিকভাবে অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং তার মনস্তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি এবং অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

তার রোগসমষ্টি একসঙ্গে ক্রিয়াশীল হয়ে এক দানবীয় মনঃপ্রবৃত্তি গঠন করেছে, যা ধর্ম, পরিচয়, আধ্যাত্মিকতা ও প্রতারণার স্মৃতি নিয়ে নিজের মধ্যে নতুন পরিচয় তৈরি করে—যে পরিচয় সমাজবিরোধী, ভয়ংকর, এবং ভীষণভাবে অস্পষ্ট।

“এই রোগীকে কোনওভাবে কারাগারে নয়, বরং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা-সম্পন্ন সাইকিয়াট্রিক ইনস্টিটিউটে আজীবনের জন্য পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত।”

সংযুক্ত:

অডিও রেকর্ডিং ট্রান্সক্রিপ্ট

চিত্রাঙ্কিত খুনের প্রতীকসমূহ

ফিজিক্যাল নিউরোস্ক্যান রিপোর্ট

পলিগ্রাফ পরীক্ষার ফলাফল (বিচ্যুতি প্রবণ)

লেখ্য কবিতা ও ধর্মীয় প্রলাপ

[শেষ রিপোর্ট | গোপনীয় | কর্তৃপক্ষের অনুমোদনে প্রকাশযোগ্য]
Prepared by:
ডা. সায়মা আহমেদ
সাইকিয়াট্রিক কনসালট্যান্ট
ঢাকা মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট

কিন্তু এই রিপোর্ট কি কাজে আসবে কেউ জানে না।
যেমন জানে না কুয়াশা কোথায়?

কোথায় কুয়াশা?
আসলে কে এই কুয়াশ?

[বি: দ্র: সবগুলো চরিত্র কাল্পনিক। লেখকের কল্পনা থেকে চরিত্র গুলোর সৃষ্টি। বাস্তবের কারো সাথে মিল নেই।]

#অর্পন_রহমান

বৃষ্টির জলে ভেজা চিঠি: অর্পন রহমানবৃষ্টি তখন অল্প অল্প ঝরছে। আকাশ যেন হালকা ধূসর চাদরে ঢেকে আছে। বাতাসে শিউলি ফুলের মত ক...
08/07/2025

বৃষ্টির জলে ভেজা চিঠি

: অর্পন রহমান

বৃষ্টি তখন অল্প অল্প ঝরছে। আকাশ যেন হালকা ধূসর চাদরে ঢেকে আছে। বাতাসে শিউলি ফুলের মত কাঁপে ফেলে আসা কিছু মুহূর্ত, আর তার মধ্যেই বসে আছে নীরা—এক জানালার পাশে। হাতে পুরনো একটা চিঠি।

চিঠির কাগজটা ভেজা, কোণায় নীল কালি ছড়িয়ে গেছে। শব্দগুলো ঝাপসা। তবু তার মনের ভেতর শব্দগুলো একদম স্পষ্ট—

"তুই না থাকলে দিন কিভাবে যায় বুঝি না।"

একটুখানি হাসে নীরা। অনেকদিন পর। নিজেকেই বলে—"এই কথাটা বলেছিল ও, যখন আমরা বর্ষায় সিঁড়ির নিচে আশ্রয় নিয়েছিলাম। ওর গায়ের গন্ধে মিশে ছিল কুয়াশা।"



নীরা আর অনিরুদ্ধ। ছোটবেলা থেকে পাশাপাশি বড় হয়েছে । কিন্তু ভালোবাসার ব্যাখ্যা তখনো জানে না। জানত শুধু, একসঙ্গে থাকলেই যেন একটা অদ্ভুত শান্তি ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।

শান্তি, যা সন্ধ্যার আগেই ঝরে যাওয়া শিউলি ফুলের মতো ক্ষণস্থায়ী।

তারা স্কুল পেরিয়ে কলেজে উঠল। আর চুপচাপ ভালোবাসা জন্ম নিতে লাগল তাদের চোখে, হাঁটার ছন্দে, কুয়াশা-মাখা সকালের চুপিচুপি হাত ছোঁয়ার মধ্যে।

এভাবে তাদের হৃদয়ের ভেতর জন্ম নিতে লাগল এক নীরব ভাষা, যা কথার চেয়ে গভীর, স্পর্শের চেয়ে নিঃশব্দ।

৩.

চিঠি লেখা শুরু হলো এক বর্ষার দিনে। অনিরুদ্ধের হাতে ধরা নীরার ভেজা গাল, আর সেই অস্থিরতা থেকে জন্ম নিল—লিখে ফেলা অনুভব।

ছোট ছোট কাগজে নীরা লিখত—

"তুই আমার সকাল। তুই আমার ভেজা জানালা। আমি যেদিন কথা বলি না, সেদিনও তোকে নিয়ে কত কী বলে ফেলি নিজের ভেতরে।"

অনিরুদ্ধ লিখত—

"তোর প্রতিটি লেখা যেন আমার শ্বাস। আমি জানি না, আমি ঠিক কী চাচ্ছি, কিন্তু তুই না থাকলে আমার কিছুই ঠিকঠাক চলে না।"

এই চিঠিগুলো ছিল যেন তাদের ভালোবাসার ছায়াপথ। শব্দ ছিল অল্প, কিন্তু অনুভব ছিল বিস্তীর্ণ।

৪.

বর্ষা এলেই তাদের প্রেম বদলে যেত। হঠাৎ নিঃশব্দ হয়ে পড়ত, কণ্ঠে থাকত অস্থির সুর। তার বুঝতে পারত, এই সময়গুলোতে তারা নিজেদেরকর হারিয়ে ফেলে। তাদের মধ্যে বৃষ্টি একটা দেয়াল হয়ে দাড়ায়।

এক রাতে, সে একা ভিজতে ভিজতে নীরার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। হাতে ছিল একটা চিঠি। চিঠিতে লেখা ছিলো

" তুই প্রতি বৃষ্টিতে কোথায় হারিয়ে যাও
আর কোনো বৃষ্টিতে তোকে হারাতে চাই না"

এই না-পাওয়া অনুভব ছিল তাদের প্রেমের গভীরতম সুর।

নীরা উত্তরে লেখে.
"আর কোন বৃষ্টিতে তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। তোমার সব বৃষ্টিতে আমাকে পাশে পাবে।"

৫.

কলেজ ফাঁকি দিয়ে তারা অনেক দূরে চলে যেত হঠাৎ করে। মেলার ভিড়ে, নদীর ঘাটে, কিংবা পুরনো বাজারের ধারে—সবখানে তারা খুঁজত এক ধরনের নিজস্বতা।

নীরা বৃষ্টির দিনে এক নির্দিষ্ট জানালার পাশে বসে থাকত। অনিরুদ্ধ চিঠিতে বলেছিলো
"বৃষ্টি হলে জানালার পাশে বসিস, আমি আসবো। একবার শুধু দেখবো তোকে। তারপর হয়ে যাবো মেঘ। বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দেবো তোকে। "
নীরা জানত অনিরুদ্ধ আসবে না। তবু বসে থাকত।

“কারও জন্য চুপচাপ বসে থাকাটাও একটা প্রার্থনার মত।”

চিঠিতে লিখত—

“আমি জানি তুমি আসবে না।
তবু তোমার অপেক্ষায় জানালার কাঁচ ভিজিয়ে দেই প্রতি বৃষ্টির রাতে।
যেন তুমি ফিরলে বলো—এই জানালাটা তো আমার নীরার।”

৬.

জীবনটাতে হঠাৎ ঝড় এলো
সব এলোমেলো হয়ে গেলো দুজনার।
নীরার পরিবারের কাছে পৌছে গেলো ওদের রিলেশনশিপ এর কথা। নীরাকে দূরে খালার কাছে পাঠিয়ে দেবে মা, সিদ্ধান্ত হলো।
অনিরুদ্ধ চলে গেল অন্য শহরে।

যাওয়ার আগের দিন টিপটিপ বৃষ্টিতে দেখা করল যেখানে ওরা দেখা করতো নদীর ধারে।
চোখে দিয়ে অঝোরে জল পড়ছিলো নীরার । তবু মেনে নিয়েছিলো।

অনিরুদ্ধ বলল— “তুই তো বলেছিলি, আর কোনো বর্ষায় আমায় ছেড়ে যাবি না…”

নীরা উত্তর দিল— “আমি তো তোমার কাছেই থাকতে চাই আজীবন… তুমিই তো পালিয়ে যাচ্ছে।

অনিরুদ্ধ বললো " মাঝে মাঝে আমার নিজের কাছ থেকেই নিজেই পালাই ।”

এই দেখা শেষ দেখা—তারা দুজনেই জানত।

দুজন দুজনকে বিদায় জানানোর সময় নীরা একটা চিঠি গুঁজে দেয় অনিরুদ্ধর হাতে।

কিন্তু সে চিঠি আর পড়া হয় না। বৃষ্টির জলে ভিজে ছিড়ে যায় চিঠিটা, মুছে যায় চিঠির সব কথা। অনিরুদ্ধর আর কোন দিন জানা হয় না, চিঠির কথা গুলো।

৭.

চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায়। নীরা চলে যায় দূরে।
ব্যস্ত হয়ে পড়ে, শহরের ভিড়, নতুন সম্পর্ক, নতুন মানুষ।

তবুও মাঝে মাঝে সে এখনো মাঝরাতে জানালার পাশে বসে কাগজে চিঠি লেখে। কখনো পাঠায় না। ডায়েরির পাতায় গুঁজে রাখে।

“আমি সেই মেয়ে, যে জানে তুমি ফিরবে না, তবু প্রতিটি বৃষ্টিতে জানালার পাশে বসে থাকি।”

জীবন গুছিয়ে ফেলে নীরা। সংসার, কাজ, সামাজিকতা। চারপাশে হাসি, আলো, উৎসব। কিন্তু তার ভিতরে থেকে যায় এক মেয়ে—যে এখনো বৃষ্টিতে কাঁপে, এখনো কাগজ ছুঁয়ে বোঝে কারো স্পর্শ।

প্রতিটি চিঠিতে সে লেখে—

“আজ আবার জানালায় বৃষ্টি। তোমার গায়ের গন্ধ নেই, তবু আমার নি:শ্বাসে তোমার নামে জমে থাকে। তুমি পালালে কেন? হয়নি জানা। ”

৮.

নীরা একটা চিঠি লেখে। বৃষ্টির কালিতে মনের কাগজে
কিন্তু পাঠায় না কোন ঠিকানায়।

“প্রিয় অনিরুদ্ধ,

আমরা কেউ কারো হইনি। তুমি ছিলে আমার জীবনের সবচেয়ে গভীর নদী। তোমার সঙ্গে থাকা মানে ছিল নিজেকে খুঁজে পাওয়া। আমি তোমাকে আর কখনো খুঁজব না। তবু জানবে, প্রতি বৃষ্টির রাতে আমার বুকের ভিতর তোমাকে নিয়ে একটা চিঠি ভিজে যায়।
আমরা মিশিনি ভালোবেসে সব মানুষ যেভাবে মেশে, আমরা গিয়েছি প্রাজ্ঞ আঁধারে না-জানার টানে ভেসে।
আমরা দু'জনে রচনা করেছি একে অপরের ক্ষতি,
প্রবাসী প্রেমের পাথরে গড়েছি অন্ধ অমরাবতী।
আমরা মিশিনি বিহ্বলতায় শুক্রে-শোণিতে-স্বেদে,
আমাদের প্রেম পূর্ণ হয়েছে বেদনায়, বিচ্ছেদে।"

চিঠির নিচে এক ফোঁটা জল। বৃষ্টি? না কি সেই মেয়েটার চোখের?

কেউ জানে না।

৯.

বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে...
অনিরুদ্ধ জানালার পাশে বসে বৃষ্টি দেখছে।
ওর বৃষ্টি খুবই প্রিয়, বৃষ্টিতে ওর জন্ম।
আবার সব হারায়ও বৃষ্টিতেই....
জানালার কাঁচে জমে ওঠে পুরনো দিন। কোথাও বসে আছে এক নীরা—অপ্রকাশিত চিঠির গন্ধে, আর এক অনিরুদ্ধ—যে সময় থেমে যাওয়ার পরও অপেক্ষা করে।

তাদের ভালোবাসা মিশে গেছে বৃষ্টির জলে।

আর সেই জলে এখনো ভেজে এক চিঠি—

যা কেউ কখনো পুরোটা পড়ে না, কিন্তু হারিয়ে যেতে যেতে ছুঁয়ে যায়।

বৃষ্টির জলে ভিজেছে
ছিঁড়েছে তোমার শেষ চিঠিটা

কি করে জানাবো, বলো
হয়নি জানা ছেঁড়া চিঠির কথা।

#অর্পন_রহমান

কুয়াশায় ঢাকা শহর ১ম পর্ব(সাইকো থ্রিলার): অর্পন রহমানপাঁচ বছরের এক বাচ্চার মুখ থেঁতলে দেওয়া হয়েছে রেললাইনের পাশে।লাশটি প...
07/07/2025

কুয়াশায় ঢাকা শহর ১ম পর্ব

(সাইকো থ্রিলার)

: অর্পন রহমান

পাঁচ বছরের এক বাচ্চার মুখ থেঁতলে দেওয়া হয়েছে রেললাইনের পাশে।
লাশটি পড়ে আছে শীতলক্ষ্যার পাশের লালখালির খোলা ঘাসে।
তার চোখ দুটো নেই।

ডিবি অফিসার রিয়ান চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। শীতল হাওয়ায় তার পাঞ্জাবির খোলা প্রান্ত উড়ছিল। পেছনে দাঁড়ানো ইনস্পেক্টর হাবিব বলল, “স্যার, এটা এই মাসের চতুর্থ খুন। আগেরগুলোর মতোই… চোখ দুটো তুলে নেওয়া, গলা কাটা, শরীরের চারদিকে পাঁচ কোনা দিয়ে আঁকা চিহ্ন।”

রিয়ান হাঁটলেন। নরম ঘাসের উপরে নিঃশব্দ পা ফেললেন। তার হাতে ছিল একটি তসবিহ। চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে তিনি বললেন, “তার আত্মা এখনো এই মাটির কাছেই ঘুরছে।”

হাবিব অবাক হয়ে বলল, “স্যার?”

রিয়ান বললেন, “ঘুম ভাঙেনি ওর। ও ঘুমিয়ে গেছে রক্তের মধ্যেই। ঘুমের মধ্যে যে ভয় ছিল, সেই ভয় নিয়েই রয়ে গেছে।”
হাবিব আর কিছু বলল না। অভ্যস্ত হয়ে গেছে এমন কথা শুনতে। রিয়ান শুধুই একজন অফিসার না, তিনি একজন সুফি সাধক।
তার মনে হয় না, সে কেস তদন্ত করছে—সে আসলে ছায়া খুঁজছে। ঘরের কোণে জমে থাকা পুরোনো ভয়, নীরব কান্না, আর ফেলে আসা নামহীন আত্মাগুলোর মিছিল।

২.

খুনি নিজের নাম জানে না।
তবে সে নিজেকে ডাকে “কুয়াশা” নামে।
তার ভাষায়, কুয়াশার ধর্ম নেই।
একবার সে বলে, সে একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ, যে কালীপূজা করত ছোটবেলায়।
কখনো সে নিজেকে ভাবে এক ইহুদি যাজক, যার আত্মা ঘুরে বেড়ায় বাংলার বাতাসে।
আবার এক সময় সে নিজেকে মানে না, ভাবে শুধু ছায়া।
আর নিজের বিশ্বাস?
সে পাঁচতন্ত্রে বিশ্বাস করে।
যেখানে আত্মা হলো শক্তি।
আর হত্যা হলো উৎসর্গ।

কুয়াশা একদিন মিরপুরের একটি বাসায় ঢুকে এক প্রৌঢ় নারীকে গলা কেটে খুন করল।
নারীর লাশের পাশে সে পাঁচটি সাদা মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখল, আর নারীর বুকের ওপর রাখল একটা ‘চামড়ার পুঁথি’।
পুঁথিতে লেখা:
“অগ্নি, বায়ু, জল, মৃত্তিকা, আকাশ—এই পাঁচতন্ত্রে মাংস দান করলাম। দেহে ঈশ্বর নেই, ঈশ্বর হলো ছিন্ন মাথার চিৎকার।”

ডিবির কাছে এরকম খুনের রিপোর্ট ছিল মোট আটটি।
প্রতিটা খুনের ধরন একই—
নিয়মিত, পদ্ধতিগত, যেন একটা তন্ত্রমতে যজ্ঞ হচ্ছে।

৩.

কুয়াশার মধ্যেও কুয়াশা নেই।
সে কখনো নিজেকে রাশেদ বলে মনে করে—এক নিরীহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, যে গল্প লিখত।
আবার কখনো ভাবে, তার ভেতরে আছে “শরৎ” নামের এক নৃশংস ব্রাহ্মণ, যার পূর্বজন্মে সে নেপালের কোনো দুর্গামন্দিরে পশু বলি দিত।
রাতে সে নিজেকেই গলা টিপে ধরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়।
আর ফিসফিস করে,
“তুই মিথ্যে… তুই নেই… আমি তোর ছায়া…”

ডাক্তাররা বলেছে সে Dissociative Identity Disorder-এ ভুগছে।
কিন্তু ওষুধ কাজ করেনি।
কারণ কুয়াশা শুধু মানসিক রোগী নয়—সে আস্থা রেখেছে এক বিকৃত দর্শনে, এক বিকৃত সাধনায়।
যেখানে খুন হলো উপাসনা।
আর ভয় হলো দেবতা।

৪.

রিয়ান এক রাতে বসেছিল ধ্যানমগ্ন হয়ে।
তার চৌকি জুড়ে ছিল চারটা মৃত শিশুর ছবি।
হঠাৎ সে চোখ খুলে বলল, “সে আসছে। এই পূর্ণিমাতেই সে আবার উৎসর্গ দেবে। এবার সে জবাই করবে নিজের ঈশ্বরকে।”

পরদিন ভোরে এক চিঠি আসে ডিবি অফিসে।
চিঠিতে লেখা:
“আমি পূর্ণ করব আমার পঞ্চতন্ত্র। এবার রক্ত পড়বে আকাশের নামে।
আমি আসছি।
আর তুমি, রিয়ান, তোমাকে আমি জানি।
তুই আগেও আমার পিছনে এসেছিলি।
মায়া কাটাতে পারবি না। তোরও মুখে ছায়া লেগে গেছে।
আমরা এক...”

রিয়ান মসজিদের অজুখানায় বসে চুপ করে রইলেন।
তার চোখে জল।
তার ঠোঁটে ছিল একটিমাত্র বাক্য—
“লা-মাওত ইল্লা বিল্লাহ।”
— মৃত্যু নেই, আল্লাহ ছাড়া।

তারপর তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
কুয়াশার ছায়া যে দিক থেকে আসছে, তিনি জানেন।
তাকে আটকাতে হবে, শুধু পুলিশি ছক দিয়ে নয়, বরং সেই ঘোর থেকে, সেই বিভ্রম থেকে, সেই শূন্যতা থেকে—
যা কুয়াশার জন্ম দিয়েছে।

৫.

শেষ রাতে নারায়ণগঞ্জের পুরোনো একটি হাভেলিতে অভিযান চলে।
ভেতরে ধরা পড়ে কুয়াশা।
কিন্তু তার হাতে তখনো রক্ত।
তার চোখে খালি দৃষ্টি।
সে বলে,
“তুইও তো খুন করিস রিয়ান… নিজের ঘুমকে খুন করিস প্রতিদিন… নিজেকে চিনিস না… আমি তোর আরশের ছায়া…”

রিয়ান শুধু চেয়ে থাকে তার চোখে।
আর ফিসফিস করে,
“তুই নেই।
তুই আয়নার উল্টোদিকে আটকে পড়া এক বিভ্রম।
আল্লাহু হক।”

৬.

কুয়াশাকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়।
তাকে রাখা হয়েছিল সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ঘরে।
তার ঘরে ছিল না কোনো ধাতব বস্তু, কোনো আয়না, এমনকি খাটের কাঠও ছিল মোটা ফোমে মোড়া।
তারপরও সে চুপ থাকত না।

মা শান্তি ঘোষ

ছোটবেলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ ছিলেন আমার মা, শান্তি ঘোষ।

তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন,
আমার জন্য পায়েস রান্না করতেন,
রাতে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন—
“সোনা, কেউ কিছু বললে তুমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলবা—আমি আলাদা। আমি ভালো।”

আমি বিশ্বাস করতাম।
যতদিন মা ছিলেন, আমি ভালোই ছিলাম।

কিন্তু মা ছিলেন ভীষণ আবেগপ্রবণ, কখনো কখনো অসংলগ্ন।

একবার মা বাবার সঙ্গে ঝগড়ার সময় আমার ঘরে ঢুকে বলেছিলেন—
“তুই শুধু আমার। তুই যদি আমাকে ছেড়ে যাস, আমি নিজে মরব।”

সেই শব্দগুলো তখন বুঝিনি।

কিন্তু এক রাতে… মা আমার পাশে শুয়ে, ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন,
“তুই বড় হলে আমায় ভুলে যাবি… তাই আমি তোকে চিরদিনের করে নিচ্ছি।”

তার কণ্ঠস্বর ছিল অসামঞ্জস্যপূর্ণ। চোখ জ্বলছিল।

আমি ভয়ে গা শক্ত করে ছিলাম।

সেই রাতে আমি ঘুমোইনি।

পরদিন ভোরে, মা যখন চুল আঁচড়াচ্ছিলেন আয়নার সামনে,
আমি পিছন থেকে তার ওড়না টেনে গলায় পেঁচিয়ে ফেলি।

সে কেঁপে উঠেছিল। ছটফট করেছিল।

তখন আমার বয়স নয় বছর।

আমি কাঁদিনি।
শুধু তাকিয়ে ছিলাম—
তার চোখের ভেতরে কোনো এক ছায়া তখনও নড়ছিল।

তারপর, দৌড়ে গিয়ে বাবার কাছে চিৎকার করে বলেছিলাম—
“বাবা! মা পড়ে গিয়েছে ছাদ থেকে! মা পড়ে গিয়েছে!”

বাবা ছুটে গিয়েছিলেন।
আমরা সবাই বলেছিলাম—পা পিছলে গিয়েছিল।

কিন্তু সত্যি হলো—আমি মা'কে মেরেছিলাম।
কারণ আমার ভিতরে তখনই জন্ম নিয়েছিল প্রথম ছায়া।

বাবা হরিপদ ঘোষ

মায়ের মৃত্যুর পর বাবা সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিলেন।
তিনি আমাকে ‘অভিশপ্ত’ বলতেন।

“তুই পিশাচের জাত। তোর জন্মে তোর মা মরল।”

আমার মাথার চুল কামিয়ে দিতেন।
ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখতেন দিনের পর দিন।

একদিন, আমি তার ঘুমের ওষুধে অতিরিক্ত ডোজ মিশিয়ে দিই।

তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।

তারপর আমি নিয়ে যাই একটা পুরনো ব্লেড।

তাঁর ঘাড় বরাবর কাটে এক টান দিয়ে।

রক্ত ছড়িয়ে পড়ে বইয়ের ওপরে—
সেই বই, যেখানে লেখা ছিল “বিবেকানন্দের চিন্তা”।

তারপর আমি নিজে গিয়ে প্রতিবেশীকে ডাকি। বলি—

“বাবা আত্মহত্যা করেছেন! আমি ঘুমাচ্ছিলাম…”

পুলিশ আসে।
বাবার মানসিক ভারসাম্যহীনতার পুরনো রেকর্ড সামনে আসে।
তাকে ‘সুইসাইড’ হিসেবে মেনে নেওয়া হয়।

আর আমি?
নতুন স্কুলে ভর্তি হই।

নতুন শহরে চলে যাই।

নতুন নাম নেই—আয়ান ঘোষ।

কিন্তু ভেতরে?
ভেতরে তখন কুয়াশা জন্ম নিয়েছে।

"তুই জানিস, আমি মা'কে কাঁদতে দেইনি।
আমি তাকে ঠান্ডা করে রেখেছিলাম,
কারণ ভালোবাসা মানে বাঁধা।
আমি তাকে মুক্ত করেছিলাম।
আমি ঈশ্বর ছিলাম তার কাছে।"

"আর বাবা?
সে আমার প্রথম ছায়াকে মেরেছিল।
আমি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি—রক্তে লেখা একটা কবিতা।"

কুয়াশা শুধু একজন খুনী নয়।
সে ছিল নিজেরই শিশু বয়সের শিকার।
সে ছিল ভালোবাসা ও শাসনের বিকৃত ফসল।
সে হত্যা করেছিল তার জন্মকে।

কারণ সে চেয়েছিল মুক্তি।

কিন্তু সে যা পেয়েছিল—
তা ছিল শুধু ছায়া।

৬.

পদ্মাবতী

তখন আমি একটা কলেজে আংশিক প্রভাষক ছিলাম, বাংলা সাহিত্যে।
দিনভর কবিতা পড়তাম, বিকেলে চায়ের কাপে গুলিয়ে দিতাম রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ।
আমি তখনো জানতাম না, আমার ভিতরে একটা কুয়াশা জমে উঠছে।
যেটা শুধু চুলে বা চোখে না, বরং স্নায়ুতে, নিঃশ্বাসে, ছায়ায়।

পদ্মাবতী আমার ক্লাসে প্রথম আসে মেঘলা একটা দিন।
দূর থেকে তাকিয়ে ছিল, চোখে সুরের মতো নরম কৌতূহল।

সে পরে বলেছিল,
"আপনার চোখে ঘর নেই, আয়ান স্যার। আপনি কোথাও থাকেন না।"

আমি হেসেছিলাম।
বলেছিলাম,
"আমিও তো জানি না আমি কে।"

এই একটি বাক্যে আমরা কাছাকাছি হয়ে যাই।

পদ্মাবতী ছিল তীব্র আবেগী, নাটকপ্রেমী, দুরন্ত।
আমার লেখা কবিতা তার কণ্ঠে শুনতাম—
যেমন শোনা যায়, শীতের রাতে পুরনো গান।

সে আমায় বলত “আয়ানদা”,
আর আমার জন্য আনত তেঁতুল মাখানো ডাবের জল।
বৃষ্টি হলে সে বলত,
"চলুন ভিজে যাই—জ্বর হলে আপনি কবিতা লিখবেন, আমি সেবা করব।"

সে আমার একাকিত্ব ভেঙে দিয়েছিল।
আমার আয়নার দিকে তাকানো বন্ধ হয়েছিল।
আমি প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম—এই পৃথিবীটাও ভালো হতে পারে।

সেদিন ছিল শুক্রবার।
পদ্মাবতী বলেছিল, “আজ একটা বিশেষ চমক আছে।”

আমি অপেক্ষা করছিলাম, শহরের এক পুরনো কাফেতে।
তিন ঘণ্টা কেটে যায়, আসে না।
ফোন বন্ধ।

সন্ধ্যায় আমি দেখতে পাই একটা ফেসবুক পোস্ট—

“Engaged to DSP Arindam Roy. Beginning our new journey!”

সঙ্গে ছবি—সোনালি বেনারসি, কপালে টিপ, আর হাসি…
যে হাসি আমার কখনো হয়নি।

আমার ভিতরে যেন একটা দরজা খুলে গেল।
অথবা দরজা ভেঙে ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো সেই ছায়া।
যে ছায়া আমি চেনা ছিলাম না, কিন্তু ছিলাম।

একটা মাস অপেক্ষা করেছিলাম।

একদিন পদ্মাবতী আমায় ফোন করল।
বলে,
“তুমি কেন ভুলে গিয়েছো আয়ানদা?
আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল, আমি কিছু করতে পারিনি।

আমি তাকে একটি পুরনো লাইব্রেরিতে ডাকলাম।

সে এলো।
চোখে কালি, ঠোঁটে চাপা কিছু অপরাধবোধ।

আমি তাকে বললাম,
“আজ তোমার জন্য একটা কবিতা এনেছি।”

আমি তাকে বসালাম কাঠের টেবিলে।
দেয়ালজুড়ে বই, জানালা দিয়ে ঢুকছে কুয়াশা।

আমি কবিতা পড়তে পড়তে তার হাত ধরলাম।
তারপর ফিসফিস করে বললাম,

“তুমি জানো, বিশ্বাসঘাতকতা কাকে বলে?”

সে থমকে গেল।

আমি বললাম,

“তুমি আমাকে ভেঙে দিয়েছো, পদ্মাবতী।
আর আমি, এখন শুধু ছায়া।”

তারপর আমি পেছন থেকে বের করলাম তীক্ষ্ণ ছোট ছুরি।
যেটা আমি সেইদিন কিনেছিলাম যেদিন ওর বাগদানের ছবি দেখেছিলাম।

আমি ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে তার গলার বাম পাশে চাপ দিলাম।

সে কেঁপে উঠল, চোখ বিস্ফারিত।

একটাও চিৎকার করেনি।

হয়তো আমার চোখে কিছু দেখেছিল—
ভালোবাসা, ঘৃণা, বা শুধুই উন্মত্ততা।

তারপর আমি তার শরীর মেঝেতে নামিয়ে রাখলাম।

তার রক্ত দিয়ে পাশের দেয়ালে লিখলাম—
“আমার ঈশ্বর মরে গেছে।
এখন আমি শুদ্ধ।”

৭.

কুয়াশার জন্মতো মায়ের মৃত্যুতেই হয়েছিলো, সেই কুয়াশা আয়ান ঘোষ থেকে বেড়িয়ে আসে পদ্মাবতীর মৃত্যুর পর।

সেই দিন আমি প্রথম আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখি—
আমি আয়ান ঘোষ না।

আমি সেই লোক, যে আলোতে জায়গা পায় না।

আমি কুয়াশা।

আমার জন্ম পদ্মাবতীর রক্ত থেকে।

আমি প্রেমিক ছিলাম না—
আমি ছিলাম তার ঘৃণার আয়না।

যেখান থেকে আর ফেরত আসা যায় না।

প্রতিদিন রাতে সে ফিসফিস করে বলত,
“আজ অগ্নি… কাল জল… শেষ দিনে আসবে আকাশ…”

এক রাতে হঠাৎ এক নার্স চিৎকার করে ওঠে।

দায়িত্বরত স্টাফরা দৌড়ে গিয়ে দেখে, নার্সটি মেঝেতে পড়ে কাঁপছে, মুখ দিয়ে গড়িয়ে আসছে রক্ত।
তার জিভ নেই।
চোখ ফাঁকা হয়ে আছে ভয়ে।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়—
নার্স যখন কুয়াশাকে ওষুধ খাওয়াতে যায়, হঠাৎ কুয়াশা ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মুখের ওপর।
মুখে মুখ ঢুকে গিয়ে জিভ কামড়ে ছিঁড়ে নেয়।
তারপর নার্সের রক্ত মেখে দেয়ালে একটি প্রতীক আঁকে—পাঁচ কোনা একটি তারকা, মাঝখানে একটি চোখ।
তারপরই সে গায়েব হয়ে যায়।

হাসপাতালের পুরো ভবন খালি করে তল্লাশি চালানো হয়।

কিন্তু কুয়াশা নেই।

শুধু একটি জানালার লোহার গ্রিল পাওয়া যায়—বাঁকা, রক্তে লাল।
আর তার নিচে পড়ে থাকে একটি ছোট্ট চামড়ার পুঁথি।
পৃষ্ঠার এক কোণে লেখা ছিল:

“শেষ রক্তের আগুন এখনো জ্বলে নাই।
আকাশের খুন এখনো বাকি…”

রিয়ান খবর পেয়ে পৌঁছান হাসপাতাল চত্বরে।

তখন বাতাসে অদ্ভুত একটা শব্দ ভাসছিল।
ঠিক যেন বাচ্চা কারো কান্না,
কিংবা গভীর রাতে গলা কাঁপানো ফিসফিসি—

“তুই কি আসবি, রিয়ান?
তোর ঈশ্বর কি তোকে বাঁচাতে পারবে এবার?”

রিয়ান চুপ করে থাকেন।
তার চোখ দুটো বন্ধ।
তার ঠোঁট নড়ে—
কোনো নামহীন ধ্যানে।

আর বাতাসে ঘুরে বেড়ায় সেই ছায়া...
কুয়াশা…
যে এখনো খুঁজে ফিরছে তার পঞ্চম উৎসর্গ।
আকাশ।
শুদ্ধতম।
সবচেয়ে নির্দোষ।

একটি শিশু...
হয়তো...

রক্তাক্ত হাসপাতাল থেকে পালানোর পর কুয়াশা নিখোঁজ হয়ে যায়।
পুলিশ, ডিবি, র‌্যাব—কেউই তার কোনো খোঁজ পায় না।
কিন্তু সে হারায়নি, বরং প্রস্তুত হচ্ছিল।

৮.

নেপাল সীমান্তের কাছে হিমালয়ের এক অন্ধকার উপত্যকায়,
চাঁদের আলোয় শ্মশানঘাট কাঁপছিল আগুনের লোলজিহ্বায়।
চারপাশে শুধু ছাই আর ছিন্ন মাথার ছায়া।

এক অঘোরী বসে আছে আগুনের সামনে, নগ্ন দেহে ছাই মেখে, চোখে মদের মতো লাল আগুন।
তার সামনে শুয়ে আছে একটি মৃতদেহ।
আর তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে কুয়াশা।

অঘোরী জিজ্ঞেস করে,
"তুই কার খোঁজে এসেছিস, পিশাচ?
রক্ত চুষিস, অথচ জ্ঞান চাস কেন?"

কুয়াশা বলে না কিছুই।
সে শুধু মাথা নিচু করে।
তার কপালে তখনো নার্সের রক্ত লেগে।

অঘোরী ধীরে ধীরে মৃতদেহের বুকে ছাই ছড়িয়ে দেয়।
তারপর বলে,
"যদি সত্যিই মুক্তি চাস, তবে শবকে ঈশ্বর ভাব।
যে ঘ্রাণে ঘেন্না লাগে, সেখানেই জন্ম নেয় তন্ত্র।
চোখ বন্ধ কর।
আর যা দেখবি, তা গিলে ফেল, ভয় নয়।"

সেই রাতেই কুয়াশা করে শব সাধনা।

গভীর ধ্যানে বসে, মৃতদেহের উপর, নগ্ন, অন্ধকারে,
সে দেখে তার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে তার সব চরিত্রেরা—
রাশেদ, শরৎ, যাজক, যমদূত, ছোটবেলার সে নিজে...
প্রত্যেকেই ফিসফিস করে বলে,
"তুই পঞ্চতন্ত্রের চতুর্থ উৎসর্গ দিয়েছিস।
শেষটায় দেবতা নিজেই তোর হাতে মরবে…"

তারপর সে উঠে দাঁড়ায়,
চোখ দুটি ঠিকরে বেরিয়ে আসে আগুনের মতো।
সে আর মানুষ নয়।

সে এখন সেই ঈশ্বর—যাকে গড়ে তোলা হয়েছে রক্ত, বিভ্রান্তি আর ছিন্ন আত্মার ধ্যান দিয়ে।

৯.

পরের মাসে সে যায় থিম্পু, ভুটানের গা-ছোঁয়া অঞ্চলের এক গুম্ফায়।

সেখানে থাকে এক প্রবীণ বৌদ্ধ গুরু—লামা থেনজিং।
সে অন্ধ, কিন্তু তার চোখের অভ্যন্তরীণ দৃষ্টি দেখে ছায়ারও ছায়া।
কুয়াশা তার সামনে বসে, দিনের পর দিন চুপচাপ।
কোনো কথা বলে না।

তৃতীয় দিন, গুরু বলে,
"তুমি যাকে খুঁজছ, সে তুমিই।
তোমার ভয়, তোমার ঈশ্বর, তোমার রক্ত—সব একই জিনিস।
কিন্তু এক জিনিস বুঝে রেখো,
যে নিজের ছায়া খায়, সে আলো পায় না, শুধু জ্বলে।"

কুয়াশা বলে,
"আমি জ্বলতেই এসেছি।
আমি দেবতা জ্বালাতে চাই।
তাদের যারা চুপ থেকেছে যখন আমার আত্মাকে কেটে কেটে ভাগ করেছিল কেউ।
আমি ঈশ্বরকে হত্যা করব।"

লামা থেনজিং মাথা নিচু করে।
এক ফোঁটা জল পড়ে তার চোখ থেকে।
সে ধীরে ধীরে বলে,
"তুমি ঈশ্বরকে মারতে পারো না।
কারণ তুমি নিজেই হয়ে গেছ এক পিশাচিক ঈশ্বর।
তুমি নিজেই তোর শেষ উৎসর্গ।"

সে রাতেই কুয়াশা গুম্ফা ত্যাগ করে।
পেছনে পড়ে থাকে এক পাথরের মূর্তি, যেটার চোখে হঠাৎ করে দেখা যায় রক্তের রেখা।
আর বাতাসে ভেসে আসে সেই পুরনো ফিসফিসি—

"আকাশ...
শেষ উৎসর্গ আকাশ…
শিশুর চিৎকার...
আর রক্তে লেখা ঈশ্বরের মৃত্যু..."

কুয়াশা ঢাকায় ফিরে আসবে।
শেষ উৎসর্গ নিয়ে।
যা কিনা কোনো অপরিচিত শিশু নয়,
বরং—

রিয়ানের নিজের সন্তান।

চলবে...

[বি: দ্র: সবগুলো চরিত্র কাল্পনিক। লেখকের কল্পনা থেকে চরিত্র গুলোর সৃষ্টি। বাস্তবের কারো সাথে মিল নেই।]

#অর্পন_রহমান

Address

Khansaheb RoadJomadder Bhari, Bhandaria, PirojpurBarishal
Dhaka
8550

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Razonna Mystiverse posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share