01/06/2025
জেলা প্রশাসক জানালেন, মাওলানা ভাসানী সেদিন সন্ধ্যায় বরিশাল থেকে খুলনা আসবেন সড়কপথে রূপসা ফেরিঘাট দিয়ে। আমার কাজ রূপসা ফেরিঘাট থেকে মাওলানা সাহেবকে খুলনা সার্কিট হাউসে নিয়ে আসা, জেলা প্রশাসক ও সামরিক আইন প্রশাসকের সঙ্গে একটি জরুরি সাক্ষাৎকারের কথা বলে। আমি শুনে কিছুটা হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করলাম, কিন্তু তিনি না আসতে চাইলে? তাঁকে কি গ্রেপ্তার করতে হবে?
প্রশ্নের উত্তরে জেলা প্রশাসক বললেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করার জন্য পুলিশ পাঠাতাম, তোমাকে না। তোমাকে পাঠাচ্ছি মাওলানা সাহেবকে কৌশলে নিয়ে আসতে। তুমি আমার গাড়ি নিয়ে যাবে, ওটিতে তাঁকে নিয়ে আসবে। ব্রিগেডিয়ার দুররানি বললেন ইংরেজিতে, আমরা তোমার ওপর ভরসা করে আছি।
অগত্যা রওনা হলাম রূপসা ফেরিঘাটের উদ্দেশে জেলা প্রশাসকের সরকারি গাড়িতে, পেছনে জিপে কিছু পুলিশ, যাতে বিপদ হলে তারা সামাল দিতে পারে। ফেরিঘাটে যখন পৌঁছালাম, তখন রাত আটটা, গাড়ির চলাচল খুব কম। আমি সরাসরি ফেরিতে গাড়ি ঢুকিয়ে ফেরিচালককে বললাম ওপারে নিয়ে সে যেন ফেরি চলাচল বন্ধ রাখে। এ ধরনের আদেশ পেয়ে ফেরিচালক হতভম্ব হলেও সঙ্গে পুলিশ দেখে সে ভাবল, আমি কেউকেটা। তাই বিনা প্রতিবাদে ওপারে ফেরি নিয়ে গেল। ওপারে পৌঁছে আমি গাড়ি আর কূলে তুললাম না। আমার আর পুলিশের জিপ ফেরিতেই থাকল। উদ্দেশ্য, আর কোনো গাড়ি যেন না উঠতে পারে। আর সেই সুযোগে ঘাটে পৌঁছানোর পর মাওলানাকে যেন আমি আমার গাড়িতে ওঠাতে পারি। কিন্তু এমনই কপাল, কিছুক্ষণ পর মাওলানা ভাসানী একটি ছোট গাড়িতে এলেন, যেটা তাঁর ড্রাইভার কসরত করে ফেরিতে তুলে ফেলল। আমার কৌশল কাজে লাগল না।
অগত্যা গাড়ি ফেরিতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভাসানীর গাড়ির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে তাঁকে আমার পরিচয় দিয়ে বললাম যে আমি তাঁকে খুলনায় অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে। এতে অত্যন্ত খুশি হয়ে ভাসানী গাড়ি থেকে বেরিয়ে আমার সঙ্গে হাত মেলালেন। আমার জীবনে এই প্রথম মাওলানা ভাসানীর সাক্ষাৎ, কিছুটা অভিভূত। তবু সাহস করে বললাম, স্যার, আপনাকে জেলা প্রশাসক আমন্ত্রণ জানিয়েছেন রাতের খাবারের জন্য সার্কিট হাউসে, সঙ্গে গাড়িও পাঠিয়েছেন। এই বলে সামনের গাড়িটি দেখালাম।
গাড়ির দিকে যেতে যেতে ভাসানী জিজ্ঞেস করলেন জেলা প্রশাসকের নাম। বলতেই তিনি চিনলেন। ভাবলাম, আর কোনো চিন্তা নেই, তিনি আমার সঙ্গে যাবেন। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, সার্কিট হাউসের নিমন্ত্রণে আর কেউ আছেন কি না। আমি কিছু না ভেবেই বললাম ব্রিগেডিয়ার দুররানির কথা। এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ভাসানী পিছু ফিরে তাঁর গাড়িতে সটান উঠে পড়লেন। তিনি দরজা বন্ধ করার আগে আমি দৌড়ে তাঁর গাড়িতে পাশে বসে তাঁর হাত দুই হাতে ধরে বললাম, স্যার, দয়া করে একটু সার্কিট হাউস হয়ে যান। আমার ওপর জেলা প্রশাসক অনেক নির্ভর করে আছেন। আমার চাকরিজীবনের সবে শুরু।
আমার মিনতির জন্য কি না জানি না, মাওলানা ভাসানী স্থির চোখে চেয়ে হেসে বললেন, চলো, তোমার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে মোলাকাত করেই যাই, তবে ওই সরকারি গাড়িতে নয়, আমার গাড়িতে। বলে তিনি একটু সরে আমাকে জায়গা করে দিলেন। গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া আরও দুজন লোক ছিল, একজন সামনে, আরেকজন ভাসানীর ডান পাশে। আমি পাশে বসে চলতে চলতে আল্লাহকে শুকরিয়া জানালাম।
সার্কিট হাউস পৌঁছানোর পর ভাসানীকে ভেতরে নিয়ে দেখি জেলা প্রশাসক অভ্যর্থনাকক্ষে নিজেই দাঁড়িয়ে, আর ব্রিগেডিয়ার দুররানি পাশে। দুজনই ভাসানীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে হাত মেলালেন। পরে তাঁকে তাঁরা পাশের একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন। আমাকে জেলা প্রশাসক বললেন অভ্যর্থনাকক্ষে অপেক্ষা করতে।
পাশের কক্ষে মিটিং ঘণ্টা খানেক চলল। ঘরের ভেতর কথাবার্তা বেশ নিচু গলায় হচ্ছিল, তাই কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু শেষের দিকে ভাসানী জোর গলায় কথা বলছিলেন। আগের কথা যদিও শুনিনি, তাঁর শেষের কথা শুনে মনে হলো, তিনি ব্রিগেডিয়ারকে উদ্দেশ করে বলছেন খাঁটি উর্দুতে, ‘দেখো, পাকিস্তান বাঙালি মুসলমান নে বানায়া, উও পাকিস্তান তোড়না নেহি চাহতে, তোমহারা প্রেসিডেন্ট ইসকো তোড়না চাহতা হ্যায়। (বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান বানিয়েছে, তারা পাকিস্তান ভাঙতে চায় না, তোমার প্রেসিডেন্ট ভাঙতে চায়)।’ এই কথা বলতে বলতে দরজা খুলে ভাসানী বেরিয়ে আসেন, পেছন পেছন ব্রিগেডিয়ার দুররানি আর জেলা প্রশাসক। কিন্তু কথা তখনো তাঁর শেষ হয়নি। ভাসানী তাঁর স্বভাবসুলভ আঙুল উঁচিয়ে উর্দুতে বলেন, এভাবে পাকিস্তান থাকবে না। তারপর সোজাসুজি ব্রিগেডিয়ার দুররানিকে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একজন ব্যভিচারী। তোমরা (সেনাবাহিনী) এ প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছ না কেন? তোমাদের বুদ্ধি-বিবেচনা নেই? এ লোক শুধু মদখোরই নয়, অসৎ চরিত্র। এই লোকই পাকিস্তান ভাঙবে।
ভাসানী বাইরে দাঁড়িয়ে আঙুল নাচাতে নাচাতে বলছেন আর আমি অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম লাল মুখ করে ব্রিগেডিয়ার দুররানি তাঁর কথা শুনে যাচ্ছেন নীরবে। আর কথা না বাড়িয়ে ভাসানী যখন গাড়িবারান্দার দিকে যাচ্ছিলেন, তখন জেলা প্রশাসক রাতের খাবারের কথা বললে তিনি জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, রাতে তিনি বেশি খান না, এবং এখন বিশ্রামের জন্য তাঁর নির্দিষ্ট স্থানে যাবেন। আমি পেছনে পেছনে এলে তিনি বললেন, তাঁর সঙ্গে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এই বলে তিনি তাঁর গাড়িতে উঠে গেলেন। গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে জেলা প্রশাসক ও ব্রিগেডিয়ার দুররানি তাঁকে বিদায় দিলেন।
সেদিন ব্রিগেডিয়ার দুররানি মাওলানা ভাসানীকে কতখানি বোঝাতে পেরেছিলেন জানি না, কিন্তু যেভাবে ভাসানী সামরিক সরকার আর তার প্রধানকে সম্বোধন করেছিলেন বিশেষ বিশেষণে (তার কয়েকটি শব্দ আমি বাদ দিয়েছি), তা থেকে এটাই বুঝেছিলাম, তাঁর উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বরং ভাসানীই তাঁকে শুনিয়ে গেলেন।
[জিয়াউদ্দিন চৌধুরী: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, অ্যাসাসিনেশন অব জিয়াউর রহমান অ্যান্ড দ্য আফটারম্যাথ বইয়ের লেখক, প্রথম আলো]