29/09/2025
মার্কিন ভিসা ফি বৃদ্ধির পর যেভাবে স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে ভারতীয়দের
আনন্তর্জাতিক ডেস্ক:
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এই মাসে এক ঘোষণায় এইচ-১বি ভিসা প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন এনেছে। কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষ বিদেশি কর্মী নেয়ার সবচেয়ে বড় পথ হিসেবে ব্যবহৃত এই ভিসার ফি বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে নাটকীয়ভাবে। আগে যেখানে খরচ ছিল গড়ে দুই হাজার ডলার, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ডলার। ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্তে স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে ভারতীয় তরুণ-তরুণীদের। ভারতের উত্তরাখণ্ডের পাহাড়ি শহর বাগেশ্বরের মেয়ে মেঘনা গুপ্তা। ছোটবেলা থেকেই তার লক্ষ্য ছিল, ২৩ বছরের মধ্যে মাস্টার্স শেষ করে কয়েক বছর ভারতের বড় কোনো কোম্পানিতে চাকরি করবেন, তারপর ৩০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে স্থায়ী হবেন। সেই স্বপ্ন পূরণের আশায় তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছেন টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিসেসের (টিসিএস) হায়দরাবাদ অফিসে। পদোন্নতির অপেক্ষায় ছিলেন, যাতে ক্যালিফোর্নিয়ার পশ্চিম উপকূলে প্রজেক্টে কাজের সুযোগ পান। কিন্তু ২৯ বছরে এসে তার সব হিসাব এলোমেলো হয়ে গেছে। ট্রাম্পের নতুন সিদ্ধান্তের ফলে কোনো ভারতীয় কর্মীকে এই ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার খরচ কমপক্ষে ১ লাখ ৬০ হাজার ডলার হয়ে যাচ্ছে, যা অনেক ক্ষেত্রে দেশীয় কর্মী নিয়োগের তুলনায় অনেক বেশি। ট্রাম্প প্রশাসনের যুক্তি, এর ফলে মার্কিন কোম্পানিগুলো বিদেশি কর্মী না নিয়ে, স্থানীয়দের নিয়োগ দিতে উৎসাহিত হবে। কিন্তু বাস্তবে এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে ভারত। কারণ, ২০২৪ সালে সব এইচ-১বি ভিসার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই পেয়েছিলেন ভারতীয় নাগরিকরা। চিকিৎসা থেকে শুরু করে তথ্যপ্রযুক্তি খাত-প্রায় প্রতিটি জায়গাতেই ভারতীয় পেশাজীবীদের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে বেশি। চীনারা ছিলেন অনেক পিছিয়ে, মাত্র ১২ শতাংশ। আল জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মেঘনা বলেন, “এটা আমার জন্য ভীষণ হৃদয়বিদারক, আমার সারা জীবনের পরিকল্পনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার। এখন মনে হচ্ছে সেই ‘আমেরিকান ড্রিম’ আসলে একটা নিষ্ঠুর রসিকতা।” ভারতের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি সত্ত্বেও দেশের অবকাঠামো সংকট, কর্মসংস্থানের ঘাটতি আর বৈষম্যের কারণে লাখো তরুণ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে সুযোগ খোঁজেন। সরকারি তথ্য বলছে, ২০২০ সালে যেখানে ৯৪ হাজার ভারতীয় বিদেশে গিয়েছিলেন, ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৪৮ হাজারে। মাত্র পাঁচ বছরে এই হার ২৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের নতুন নীতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে ভারতীয়দের দখল করা মধ্যম স্তরের চাকরিগুলোকে। এগুলোর মধ্যে সফটওয়্যার ডেভেলপার, প্রজেক্ট ম্যানেজার থেকে শুরু করে ফাইন্যান্স ও স্বাস্থ্যখাতের ব্যাক-অফিস সাপোর্টের চাকরিও রয়েছে। গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, “এক লাখ ডলার ফি মানে হলো এন্ট্রি-লেভেল কর্মীর বার্ষিক বেতনের চেয়েও বেশি খরচ। ছোট প্রতিষ্ঠান ও স্টার্টআপদের পক্ষে এটা একেবারেই অযৌক্তিক।” তার মতে, মার্কিন কোম্পানিগুলো এখন কেবল বিশেষজ্ঞ স্তরের, অতি-দুর্লভ পদের জন্য বিদেশি কর্মী আনবে। অন্যদিকে সাধারণ কাজ অফশোরে ভারত বা অন্য হাবে সরিয়ে দেবে। কেবল নতুন আবেদনকারীরাই নন, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত হাজারো ভারতীয়ও আতঙ্কিত। মেটার এক সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার জানান, তিনি এবং তার স্ত্রী দুজনেই এইচ-১বি ভিসায় আছেন। যদিও বিদ্যমান ভিসা বা নবায়নের ক্ষেত্রে নতুন ফি প্রযোজ্য নয় বলে স্পষ্ট করা হয়েছে, তবুও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন তারা। তিনি বলেন, “গত ১১ বছরে কখনো ভারতের কথা মাথায় আসেনি। কিন্তু এ ধরনের অস্থিতিশীলতা আমাদের মতো অনেককে জীবন বদলে দেয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে। তার সহকর্মীদের অনেকেই শিশুদের স্কুলিং, বাড়ি কেনা, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, সবকিছু নিয়ে এখন দোটানায়। তার মতে, “অভিবাসীদের অবদান যুক্তরাষ্ট্রের সাফল্যের শেকড়ে মিশে আছে। একবার যদি এই প্রতিভা চলে যায়, তাহলে উদ্ভাবনও থেমে যাবে।” এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কেও নতুন টানাপোড়েন সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি ওয়াশিংটন ভারতের রপ্তানির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যার অর্ধেক আরোপ করা হয়েছে রাশিয়া থেকে তেল কেনার জন্য। এখন ভিসা নীতির ধাক্কায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। ভারতের আইটি খাতের শীর্ষ সংগঠন নাসকম বলেছে, আকস্মিক এ নীতি পরিবর্তন “পরিবারগুলোকে বিপর্যস্ত করবে”এবং চলমান প্রজেক্টগুলোর ধারাবাহিকতায় আঘাত হানবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দপ্তর অবশ্য বলছে, এটা ভারতের জন্য সুযোগ হতে পারে, বিদেশমুখী দক্ষ জনশক্তিকে দেশে ফিরিয়ে আনার। কিন্তু বাস্তবে অনেক তরুণ বিকল্প হিসেবে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য কিংবা নিউজিল্যান্ডের দিকে ঝুঁকছেন, ভারতে ফেরার কথা ভাবছেন না। প্রবাসী শিক্ষার্থীদের সংগঠন নর্থ আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস জানায়, এই ঘোষণার পরই আতঙ্কিত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তাদের হটলাইনে ৮০টির বেশি প্রশ্ন এসেছে। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সুধাংশু কৌশিক বলেন, “এটা অভিবাসীদের মনে করিয়ে দেয়া যে তারা এখানে কোনোদিনই পুরোপুরি নিরাপদ নয়। যেকোনো মুহূর্তে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।”