13/04/2024
নবিজি (স.) রওজা থেকে প্রতিদিন লাখো জিয়ারতকারিদের সালামের জবাব দেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ইলমে তাসাউউফ তথা সুফিবাদ বিষয়ে এমফিল ফাস্ট ক্লাশ ফাস্ট ও পিএইচডি গবেষক, বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ ও সুফিসাধক এবং ওয়ার্ল্ড সুফিজম সেন্টার এর প্রেসিডেন্ট আলহাজ্ব সালেহ আহমদ মিয় সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেন, যে সকল মাওলানারা ওয়াজে বলেন আল্লাহর রাসুল (স.) কবরে মৃত (নাউজুবিল্লাহ!),, ওনার আব্বা-আম্মা জাহান্নামি ও উনি নূর নন, তারা মিথ্যা বলছেন। তিনি এ বিষয়গুলোর সংক্ষিপ্ত দলিল ও নিজের অভিমত ব্যাখ্যা করেন-
নবিজি (স.) রওজায় জীবিত। রওজাকে কবর বলা মূর্খতা। এরশাদ হয়েছে," যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তোমরা কখনও তাদের মৃত ধারণা কর না বরং তারা তাদের রবের কাছে জীবিত এবং জীবিকাপ্রাপ্ত"(আলে ইমরান: ১৬৯)। হজরত রাসুল (স.) বলেন," অবশ্যই আল্লাহ তা'আলা আম্বিয়া কেরামের দেহ মুবারক মাটির জন্য হারাম করে দিয়েছেন"( ইবনে মাজাহ)। নবিজি (স.) বলেন, " আমার উম্মত যখন আমার রওজার সামনে এসে সালাম দেয়, আমি তার সালামের জবাব দিয়ে থাকি" ( সুত্র: মক্কা লাইব্রেরি, সৌদি আরব)।
তিনি আরও বলেন, " কেউ যদি দূরবর্তী স্থান থেকে দরুদ পাঠ করে তা আমার কাছে পৌঁছানো হয়"(বায়হাকি)। নবিজি ফরমান, " আল্লাহর কিছু ফেরেস্তা আছে, তারা জমিনে বিচরণ করে এবং আমার উম্মতের প্রেরিত সালাম আমার কাছে পৌঁছে দেয়" ( নাসায়ি ও দারিমী)। হজরত আবু হুরায়রা বলেন, নবিজি (স.) এরশাদ করেন," কোন ব্যক্তি আমার উপর সালাম পাঠালে আল্লাহ তা'আলা আমার রুহের উপর সালাম পাঠান, অত:পর আমিও তার উপর সালাম পাঠিয়ে থাকি"( আবু দাউদ ও বায়হাকি)।
নবিজি (স.) আল্লাহর বান্দা ও মানুষ। কিন্তু তিনি আমাদের মত মানুষ নন। হজরত আদম (আ.) মাটির তৈরি। নবি নুর না মাটি, এ কথায় বক্তারা টেনে আনেন হজরত আদম (আ.) কে। বলেন আদম মাটির তৈরি। সাবধান! মনে রাখতে হবে, আদম (আ.) কিন্তু মাটি হলেও আল্লাহর নবি! যারা বলে নবি আমাদের মত মানুষ, তারা কি এ সাক্ষ্য দিতে পারে যে সেও একজন নবি বা রাসুল? সুতরাং আগে ইলমে তাসাউউফের জ্ঞান ধারণ করুন, তারপর বলুন নবিজি (স.) কি আমাদের মত মানুষ?
নবিজি ফেরেস্তার মতো নুরের তৈরি হতে যাবেন কেন?
মানুষ ফেরেস্তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। মহান আল্লাহ আদমের ভেতর ঢুকে ফেরেস্তা থেকে সিজদাহ্ নিয়েছিলেন।
নবিজি (স.) আদম নবির সিলসিলায় আখেরি নবি। তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসুল, ওনার কাছে ওহি এসেছে। ৪ বার সিনাহ চাক হয়েছে। ওনাকে মেরাজের রাতে মহান আল্লাহ আরশে আজীমে নিজের সামনে নিয়ে মেহমানদারি করিয়েছেন, যা আলাপ করার করেছেন, যা দেবার দিয়েছেন এবং ওনার প্রতি ওই সময় আল্লাহ যথেষ্ট উদার ছিলেন। এই সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনায় উভয়ের মধ্যে দূরত্ব ছিল দুই ধনুক বা ২ হাত পরিমাণ। এখানে কিছু অবুঝ তাফসীরকারক ও ইসলামি স্কলাররা বলেন, নবিজি (স.) মেরাজে আল্লাহকে দেখেন নি, তিনি জিব্রাইল (আ.) কে "আসল সুরতে" দেখেছেন! এগুলো বানোয়াট বয়ান। আল্লাহ নিজ বন্ধু মুহাম্মদ (স.) কে দাওয়াত করে বাড়িতে নিয়ে নিজে দেখা না দিয়ে জিব্রাইলের আসল রূপ দেখান, বিষয়টি হাস্যকর ও অযৌক্তিক নয় কি? অথচ আল কুরআন ও হাদিস প্রমাণ করে নবিজি (স.) সে রাতে আল্লাহর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। নবিজির চাচা হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) ও বলেছেন, নজিবি (স.) মেরাজে আল্লাহকে সামনাসামনি দেখেছেন। বস্তুত যারা আল্লাহকে নিরাকার জানে, তারাই সাক্ষাৎ বা দেখার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আউলাই ফেলেন! আল্লাহ নিরাকার এ কথা কুরআন ও হাদিসে নাই, বরং আল্লাহর নূরের আকার আছে, ওনাকে দেখা যায়; এ সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে অসংখ্য বাণি এসেছে। নবিজি (স.) কে আল্লাহ গায়েব জানার জ্ঞান দিয়েছেন। উনি 'হজরত আয়েশা (রা.) এর ঘরে প্রবেশ করলে, ওনার চেহারা মুবারক থেকে এত উজ্জ্বল নুর বিচ্ছুরিত হয় যে, মা আয়েশা ওনার সেলাইয়ের সূই অন্ধকারে খুঁজে পান।' এরশাদ হয়েছে, " হে নবি! (আপনি) আল্লাহর আদেশে তাঁর দিকে আহবানকারীরূপে ও প্রজ্জ্বলিত প্রদীপরূপে" ( আলআহযাব: ৪৬)। আল্লাহ বলেন," তোমাদের কাছে এসেছে আল্লাহর তরফ থেকে এক জ্যোতি ( মুহাম্মদ) ও একটি সমুজ্জ্বল কিতাব" ( আল মায়েদা: ১৫)। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, "আমি মুহাম্মদ কে আমার মুখমণ্ডলের নূর দ্বারা সৃজন করেছি" ( বড়পির আব্দুল কাদির জিলানি রচিত, সিররুল আসরার গ্রন্থ)।
মুফতি আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ গং ও তার পুত্র এবং ছাত্ররা ওয়াজে বলে নবিজি কবরে মৃত, উনি বারযাখি জীবনে আছেন। "বারযাখ" অর্থ হল বাধা, প্রতিবন্ধক, বিচ্ছেদ, দেয়াল ইত্যাদি। ইসলামী পরিভাষায়, বারযাখ হল মৃত্যু পরবর্তী কবরের রুহানি বা আত্মিক জীবন, যেখানে ব্যক্তি
তার জীবনের কর্মফল প্রাথমিকভাবে ভোগ করে এবং কেয়ামত বা শেষ বিচারের দিন না আসা পর্যন্ত এভাবে তা চলমান থাকে। অতএব, নবিজির ক্ষেত্রে এ শব্দটা যায়? ( নাউজুবিল্লাহ!)
আসুন দেখে নেই কবর, মাযার ও রওজা সম্পর্কে অভিধান কি বলে?
"কবর" শব্দের আভিধানিক অর্থ মৃতদেহ মাটিতে পুতেঁ রাখার গর্ত। মৃত মানুষকে কবরে শায়িত করাকে বলা হয় দাফন করা"। সাধারণ মানুষের সমাধিস্থলকে কবর বলে।
"মাজার" অর্থ ‘যিয়ারতের স্থান’। মাজার বলতে আওলিয়া-দরবেশগণের সমাধিস্থলকে বোঝায়।
মাজার একটি আরাধনার স্থান। একজন সুফি সাধক বা দরবেশের মাজারে মানুষ যিয়ারতের জন্য যান, যা ধর্মীয় পরিদর্শন এবং আত্মার সন্তুষ্টি ও ফায়েজ বরকতের সাথে সম্পর্কিত।
নবি, রাসুল ও উচ্চ শ্রেণির অলিআল্লাহর ইন্তেকাল পরবর্তী চিরস্থায়ী আবাসস্থলকে "রওজা" বলা হয়। এর সংলগ্ন স্থানে মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান ও ময়দান ইত্যাদি গড়ে ওঠে। সুফীতত্ত্বের অনুসারীরা ফায়েজ, বরকত ও রহমত লাভের আশায় সুফি দরবেশদের "রওজা মুবারক" যিয়ারত করতে পছন্দ করেন।
নবিজি(স.) এর উম্মত ও আশেকরা নবিজির সুগ্রাণ, সালামের জবাব, কাশফ বা স্বপ্নে নবিজির দিদার এবং জান্নাত লাভের আশায় হজ ও ওমরায় গিয়ে মদিনার রওজায় শায়িত নবিজির জিয়ারত করে। নবিজি সালামের উত্তর দেন! এখন উম্মতে মুহাম্মদি কিরূপে দয়াল নবিজিকে (স.) সম্মান প্রদর্শন করবে, তা তার নসিবের ওপর বর্তায়!
নবিজি (স.) এর সম্মানিত আব্বা-আম্মা জান্নাতে আছেন। উনারা 'দ্বীনে হানিফ' এর অনুসারি ছিলেন। অর্থাৎ হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর ধর্মের অনুসারী " মুসলমান" ছিলেন। নবিজির পিতা ও মাতা বাস্তবিক জীবনে আধ্যাত্মিক মানদন্ডে উচ্চ মাকামের অধিকারী বান্দা ও আল্লাহর বন্ধু ছিলেন। মুলত কুরাইশগণ "দ্বীনে হানিফ" এর অনুসারি ছিল। দ্বীনে হানিফ মানে "ইসলাম"। তারাও মুসলমান। আল্লাহ বলেন," সে (ইব্রাহিম) ছিল একনিষ্ঠ সরলপন্থি মুসলিম"( আলে ইমরান: ৬৭)।
ওয়ার্ল্ড সুফিজম সেন্টারের প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশ্যে বলেন, কাজেই নবিজির বংশধর পূর্বপুরুষগণ দ্বীনে হানিফের অনুসারী মুসলমান ছিলেন। আর নবিজি (স.) শিশুকাল থেকে এইরূপ পরিবারের ইসলামি আকিদা ধারণ করে হজরত ইব্রাহিম (আ.) কে মুর্শিদ বা পথ প্রদর্শক দিলে লয়ে ২৫ থেকে ৪০ মোট ১৫ বছর হেরা গুহায় ধ্যান-মুরাকাবা করে আল্লাহ পক্ষ থেকে নবুওয়ত প্রাপ্ত হন!
ধর্মজ্ঞান ২৫ বছর বয়সের একজন যুবকের মনে আকর্ষীক আসে না। এটা বাল্যকাল থেকে নিজের ভেতর স্বীয় পরিবারের সদস্যদের আচার-আচরণ ও ধর্মীয় অনুশাসন থেকে তৈরি হয়ে ওঠে। কাজেই নবিজিও (স.) দ্বীনে হানিফের অনুসারী ছিলেন নবুয়তের আগ পর্যন্ত।
হজরত নবিজি (স.) এর বংশে যদি কোন ধর্মীয় চর্চা বা আমল না-ই থাকত, তবে তিনি কোন ধর্মের দর্শন মোতাবেক হেরা গুহায় সাধনা করেছিলেন? যারা বলে নবিজির আব্বা-আম্মা মুসলমান ছিলেন না, ওনার
পূর্বপুরুষ পৌত্তলিক ছিল ( নাউজুবিল্লাহ!)। তারা ইলমে তাসাউউফ তথা সুফিবাদ শিক্ষায় উত্তম পথ প্রদর্শকের পরামর্শ নিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করে দিলের কপাট খুলতে হবে। তবেই ঈমানের পিতা তথা হজরত রাসুলুল্লাহর (স.) সাথে কিরূপ সম্মান প্রদর্শন করা উচিত সে শিক্ষা মহান আল্লাহর তরফ থেকে আপন অন্তরে উদ্ভাসিত হবে। আমিন।
°ডেস্ক রিপোর্ট, মুহাম্মদ শাহাদাত হোসেন, অতিরিক্ত বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমার যুগ।