11/07/2024
নতুন শিক্ষা কারিকুলাম ও মূল্যায়ন নিয়ে আমার ভাবনা
নতুন কারিকুলাম নিয়ে সকলে মন খারাপ করলেও একজন ইসলাম শিক্ষার শিক্ষক হিসেবে কিছু কারণে আমি খুশি ছিলাম।
খুশির কারণ-১ : সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির সালাত অধ্যায়ে ব্যক্তিজীবনে সালাতে প্রয়োগ করছে কী না? এ বিষয়ে চেকলিষ্ট নেওয়ার বিষয় ছিলো নতুন কারিকুলামের অধীনের বইয়ে।
খুশির কারণ-২: ইসলাম একটি ব্যবহারিক ধর্ম। ট্রেনিং এ এবং কারিকুলামের নির্দেশনা পড়ে বুঝলাম, বিভিন্ন পর্যায়ে ইসলামের পাঠ্য বিষয়গুলো শিক্ষার্থীরা নিজেদের ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগের চর্চা করবে এবং এর ভিত্তিতে তাদের ফলাফল (মূল্যায়ন) হবে।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, বর্তমান মূল্যায়নে যে প্রশ্ন তাতে শ্রেণিভিত্তিক PI এর কোন মিল নেই। বর্তমান ষান্মাসিক মূল্যায়নে অষ্টম শ্রেণির জন্য এনসিটিবি কর্তৃক সিলেবাসে ছিল ১ - ৭২ পৃষ্ঠা পর্যন্ত।
যার অধীনে আছে ১ম অধ্যায় - আল্লাহর পরিচয়, রসূলগণের প্রতি ঈমান, ঈসা আলাইহিস সালাম, মাহদি আলাইহি সালাম, আখিরাত, কিয়ামত, তকদির, শাফায়াত, শিরক। অধ্যায় ০২, ইবাদত, সালাত,সাওম, যাকাত, হজ।
সারা বছর পড়ালাম কি, আর মূল্যায়নে প্রশ্ন এলো কি?
যদি এমন প্রশ্ন হয় তাহলে পাঠ্য বইয়ের আর দরকার হবে না। শিক্ষার্থীরা বই পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। নাম প্রকাশে অনুচ্ছুক একজন শিক্ষক এক্ষেত্রে মন্তব্য করেন- “হিসাব ক্লিয়ার: বই থেকে প্রশ্ন হবে না মানে বই পড়ার প্রয়োজন নাই!! এটাই মনে হয় মাটির নিচ থেকে শেকড় কাটা....."
আজ মূল্যায়নের সময় শিক্ষার্থীদের হাজারো প্রশ্ন স্যার, কি পড়লাম আর সরকারি নির্দেশনায় কি এল? কত যে একক কাজ, দলগত কাজ, পোস্টার পেপার করিয়েছি। কিন্তু......
জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে এই প্রশ্নের সাথে উল্লেখিত কোন পাঠের মিল খুঁজে পাচ্ছিনা। অষ্টম শ্রেনির আজকের ইসলাম শিক্ষা মূল্যায়নের ৫টি কাজ নিয়ে আমার মূল্যায়ন ও পরামর্শ তুলে ধরলাম।
কাজ ১: প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বিনিময়। (দলগত কাজ ১)
এক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ কিভাবে করবে শ্রেণিকক্ষের বাইরে গিয়ে, না দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতে চলমান বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ? বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে স্পষ্ট নয়। বাংলা মাধ্যমের প্রশ্নে শুধু দুর্যোগ বুঝাতে প্রাকৃতিক অথবা সামাজিক (Environmental or Social) উল্লেখ রয়েছে। সম্ভাব্য উত্তর হিসেবে ধরে নেই তারা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প এগুলো লিখলো। অথবা, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন এগুলো লিখলো। এজন্য ৪০ মিনিট হাস্যকর ছাড়া কিছুই নয়, আমার মনে হয়েছে। কারণ এগুলো চিন্তা করতে অষ্টম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর ৫ মিনিটই যথেষ্ট। যদি তারা তাদের সামাজ বইয়ে থাকার বিষয়কে কেন ইসলাম শিক্ষা বিষয়ে লিখবে এটা ভেবেই ঘন্টা পার করতে পারে!
কাজ-২ : সমস্যা খুজে বের করি। একক কাজ। এখানে দুর্যোগের ফলে কী কী সমস্যা হয় তা বের করতে বলা হয়েছে।
কাজ-৩ : দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ইসলামি দৃষ্টিকোণে কি করবে সেটা দলগতভাবে লিখে উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। পরীক্ষা শুরুর ৮০ মিনিট পর শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারলো যে, হে এবার ইসলাম শিক্ষার পরীক্ষা শুরু। কাজ-১ এ প্রাকৃতিক অথবা সামাজিক দুর্যোগ বলা হলেও কাজ-৩ এ প্রাকৃতিক ও সামাজিক দুর্যোগ বলা হয়েছে। বিষয়টি বোধগম্য নয়। দুটি বিষয়ে যদি ইসলামি দৃষ্টিকোণে লিখতে হয় এবং পূর্বের সৃজনশীল পদ্ধতির ন্যায় গ এর সাথে ঘ এর মিল খুঁজতে হলেওতো একইভাবে লিখা দরকার ছিলো। এ কাজে শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ্যবইয়ের যাকাত ছাড়া অন্য কিছুর সাথে মিল খুঁজে পেলাম না। শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন না বুঝার কারণে দুর্যোগ মোকাবিলা রোজা রাখা, হজ্জ করা ইত্যাদি হাস্যকর উত্তরও দিয়েছে। কি করার কথা কি করছি। হায় আল্লাহ! কিভাবে কি মূল্যায়ন করলাম। আমি জানতে চাই দুপুরে সে ভাত খেয়েছে, না খিচুড়ি। কিন্তু প্রশ্ন করলাম আজ কি বৃষ্টি হয়েছে। যদি উত্তর দেয় হে, তাহলে বুঝে নিবো ও আচ্চা যেহেতু বৃষ্টি হয়েছে সেহেতু তার মা খিচুড়িই রান্না করবেন। মিল খোঁজার চেষ্টা করলাম। আপনারাও করতে পারেন।
কাজ-৪ ও ৫ : বিষয়গুলো কিভাবে সিলেবাসের সাথে সম্পর্কিত বুঝলাম না। তবে হ্যাঁ এটি ইসলাম শিক্ষার প্রশ্ন হয়েছে তাই অন্তত এ বিষয়ে শিক্ষার্থীরা কিছু না কিছু লিখতে পেরেছে।
পরামর্শ:
মূল্যায়ন প্রকিয়ায় (প্রশ্ন/নির্দেশনা) এমনভাবে করতে হবে, যেন শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের মূল্যায়ন করতে পারা যায়।
কখনো ৪/৫ ঘন্টার পরীক্ষা আদর্শ হতে পারে বলে আমার মনে হয় না, মূল্যায়ন উৎসব বলা হয়েছে, কিন্তু উৎসবের কোনো আমেজ পাচ্ছি না।
একান্তই ব্যক্তিগত অভিমত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিভিন্ন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ যারা এই কারিকুল্যামের ইসলাম শিক্ষা বিষয়ের বই লিখক, প্রশ্ন কর্তা, প্রশিক্ষণ দাতা দুনিয়ায় আপনাদের সফলতায় আমরা হাততালি দিবো। আশাকরি পরকালেও আপনারা হাততালি পাবেন।
আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন। আমাদের অবস্থা যেন এমনটা না হয়। 'জান্নাতীদের কেউ কেউ জাহান্নামীদের দেখে বিস্ময় প্রকাশ করবে। বলবে, আরেহ, আপনারা জাহান্নামে গেলেন কী করে? অথচ আমরা আপনাদের কাছ থেকেই আদব কায়দা শিখেছিলাম, দ্বীনের জ্ঞান পেয়েছিলাম। এগুলোর বরকতেই তো আমরা জান্নাত পেয়েছি। কিন্তু আপনাদের এই অবস্থা কেন?'' তখন উত্তরে তারা বলবে, 'আমরা আমলের কথা বলতাম ঠিকই, কিন্তু নিজেরা করতাম না।' — ইমাম শাবী (রহিমাহুল্লাহ) [মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ, ১৩/৪]
Nasir Uddin