08/03/2025
দ্রাঘিমালন্ঠন পাঠ ও বাংলা কবিতার একলা মিস্ত্রি সাজ্জাদ সাঈফ
মার্চ ২০২১-ফেব্রুয়ারি ২০২৫, পাক্কা ৪ বছরে তিলে তিলে ব্যক্তিজীবন, জাতীয় জীবন, ধর্ম অধর্ম, রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, আবহমান বাংলা সংস্কৃতির মূলদ উপস্থাপনা, সমাজব্যবস্থা, সমাজসংস্কার, ফ্যাসিজম ও সাম্প্রদায়িকতা, বিশ্ব রাজনীতিতে মুসলিম নির্যাতন, ইসলামী স্বর্ণযুগ ও অনৈক্যের ইতিহাস, জুলাই বিপ্লবের রক্তক্ষয়ী অর্জন বিসর্জন ও আশংকা, সুশীল এলিটদের বাংলাদেশ বিরোধী উন্মাদনা, জন্ম মৃত্যু আধ্যাত্ম্য, সহজিয়া, মানবধর্ম সহ নিজেকে ক্রমাগত ভেঙেচুরে সাজ্জাদ সাঈফ নতুন চেহারায় উপস্থিত করেছেন ৬ষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ 'দ্রাঘিমালন্ঠন'কে, নিজে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে খ্যাত আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে পরিত্যাগ করে ফ্যাসিজম প্রতিহতের যে জীবনের ঝুঁকি নেয়া অবস্থান নিয়েছিলেন ২০১২-২০১৩ সন হতে সেই তিনিই জুলাই গণহত্যার বিপক্ষে সপরিবারে যুক্ত হবার সময় যাবতীয় লেখালেখির জন্য সকল উড়োচিঠি হুমকি পুলিশী রেইডকে তোয়াক্কা না করেন নাই রাষ্ট্রের প্রশ্নে জনগণের প্রশ্নে। এরই নজির হিসাবে বইটি 'আত্মনির্জনতা' ও মানবতার প্রয়োজনে 'আত্মপ্রকাশ' দুইটি পর্বে বিভক্ত করেছেন যা সমকালীন কবিদের মধ্যে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার দিক থেকে কবি হিসেবে সাজ্জাদ সাঈফের অনস্বীকার্য অবস্থানকেই নির্দেশ করেন। আমরা বিভিন্ন সময়ে তাকে যে রকম অসত্য ও অন্যায় আয়োজনে নিরাপোষ পেয়েছি যারপরনাই তার কবিত্বের সাথে অবধারিত অখ্যাতি জুড়ে দিয়েছে সব সময়ই এখানেও এর ব্যতিক্রম নন তিনি। এলিয়টের ওয়েস্টল্যান্ড হতে মালার্মের প্রতীকি বার্তা, জীবনানন্দের হাজার বছরের সভ্যতাযাত্রা হতে আল মাহমুদের লোকায়ত অভিযাত্রা, উৎপলের সিনট্যাক্স ক্যারিশমা হতে বিনয়ের অটোমেটিক রাইটিং, কাদরীর নাগরিক স্বর হতে ভাস্করের আত্মনির্জনতার সার্বিক সাইকোসোশ্যাল জার্নিসহ বাংলা কবিতা যখন ক্রমাগত আত্মোন্নয়ন দাবি করে চলেছে কবির কাছে সাজ্জাদ সাঈফের কাব্যযাত্রা সেখানে অবিশ্বাস্য রকম সফলতা জারি করে এগিয়ে যাচ্ছে সভ্যতার সকল সুন্দর আর অবক্ষয়কে তুখোড় নিজস্বতায় জারিত করে, যেখানে ভাষার অভ্যন্তর প্রাকৃতিক সুন্দরে সুশীতল সেখানে এই কবি নিরীক্ষার নামে অহেতুক জবরদস্তির দিকে না এগিয়ে দৃশ্যের পর দৃশ্যে সাবলীল নিরীক্ষাকেই অবলম্বন করে একে একে প্রতিটি বইয়েই নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে যেখানে নিজস্বতার সিগনেচারকেও অটুট রেখে চলেছেন যুগপৎ মুন্সিয়ানায়। এই কবি বিগত ত্রিশ বছরের বাংলা কবিতায় নিঃসন্দেহে সবচেয়ে আন্ডাররেটেড বাঙ্গালি কবি যার ঘোর বিরোধিতা দৃশ্যমান চিরাচরিত মিডিয়াকাঠামোর প্রতি। যখন সমকালীন অধিকাংশ কবি একে একে বহু মঞ্চ পুরস্কার গোষ্ঠীর হৈচৈ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত তখনও কাব্যচর্চার দুই যুগে এসেও এই চির অভিমানী কবি সমস্ত লাইমলাইট হতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রেখে সাধকপ্রবৃত্তিতে লিখে চলেছেন সভ্যতা ও মানুষের টোটেম, ইউটোপিয়া, সহজিয়া, সময়কে তিনি ঈশ্বর বলেছেন আর নিজেকে বলেন 'বাংলা ভাষার সামান্য মিস্ত্রিমাত্র'...
আসুন দীর্ঘ ৫ বছর পর এই স্বেচ্ছানির্বাসিত কবির সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'দ্রাঘিমালন্ঠন'কে নেড়েচেড়ে পড়ি কিছুটা-
কতদূর এগিয়ে গেলে যাত্রাপথেরা পায় কবিতার মর্যাদা, আর থাকে মানচিত্রের বিক্ষত দাগ, সবুজ তামাদি হবার গল্প। এতখানি নিঃসঙ্গতা হতে স্বপ্নেরা মাথা উঁচু রাখে তাই মনে হয় কিছু তো বলার কথা ছিল তোমারই, তুমি সেই ভূমিসন্তান, তবে কেন তুমি নাই শ্লোগানের মঞ্চে, নাই বিধানে কোনো!
এমনতর নীরবতা কি ধ্যানের শামিল নাকি দৃঢ় কোনো প্রতিজ্ঞার প্রস্তুতি?
*
যেভাবে সকলে উড়ে, প্রতিযোগী, জয়ের তাড়ায়।
আপোষে বেচিনি মাথা, দিই নাই খাটতে ভাড়ায়!
*
মিথ্যা বলছি না, আলাওল পূর্বসূরি আমাদের, ঘুমানোর আগে আসে কাজলরেখার পায়ের শব্দ কানে, আয়না ঘুরিয়ে টিপ পড়ছে কাজলা দিদি।
সত্য হতে আমরা আলোকবর্ষ দূরের বাসিন্দা। ক্ষেতের কাকরোলে ঠোকর দিচ্ছে পাখি। তোমার কলমে এসে ধাক্কা দিচ্ছে গুরুত্বহীন নিন্দারা, যাতে ভর করে আকবরের দরবারে এসেছিলো আবুল ফজলের কর্তিত মুণ্ড।
*
তবুও মানুষ নিজেকে কেন্দ্রে রেখে নিঃশেষে বিভাজ্য আজ। তুমি বিব্রত। ভাবছো তোমার এপিটাফ নিয়ে। ভাবছো তোমার কীর্তি কী!
অসংখ্য গ্রাম ঘিরে ফেলেছে দৈত্যাকার নগরীগুলি। বিদেশি বিনিয়োগে বিষাক্ত সব অরণ্যপথ। আর তোমার কবরে বিলাসিতাও স্পষ্ট, শুধু সমাধিফলকে লিখে গেছে কারা- 'এই লোক কোনোদিন প্রতিবাদ করেনি, মস্ত ফেরেব্বাজ ছিলো'!
*
কতকাল থেকে একটা বৃত্তের মধ্যে বসে থেকে আমিও ছত্রভঙ্গ, পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করছে সিঁড়ি, আমি উঠতে পারছি না!
*
বহুদূর ফ্রন্টফুটে এসে ট্রাভেলিং ব্যাগ নিয়ে যে কোনো বাসে আজ উঠে যেতে পারি। স্বপ্নকে সন্তানসম দীর্ঘ চুমুর পর যে কোনো আঘাত আজ ফিরিয়ে দিতে পারি আমি খল-সমাজের!
*
কতদিন আগে দেখা, তবু তুমি প্রাত্যহিক, হস্তরেখায়; চেনাজানা পথের মতন ডানে বায়ে ঢুকে গেছো বুকে। একটা কবিতা লিখে আমি সেই পথে যাব-
শাপলাপাতার নিচে এক ব্যাঙ, ওপর-ওপর বৃষ্টি হচ্ছে দেখো।
*
পিছনে ঝোপের দিকে শিয়ালেরা ডাকে;
শহরতলীর দিকে তারা নেভে জ্বলে!
নদীর নোলক মিশে বাতায়ন আঁকে;
সেখানে পুকুর এসে পড়েছে বিপাকে!
*
তারা এটুকু জানে না ক্ষতই যার অলংকার তাকে আর কতটা আঘাতে হেস্তনেস্ত করা যায়!
তারচেয়ে বরং যে মফস্বল তুমি জীবনকে দিলে, লড়াইয়ে উসকে দিয়েছো মগজ, সেইসব ঘামঝরা স্বর ব্যঞ্জনে জারী রাখো দৈনন্দিন।
এত ঘাস বুনেছিলে মনে, এত ছন্দ ঝুমুর কাকনে
যেন ফুরানো সুরের ঝিরি, পিছুটান-ধান ভানে স্মৃতির কৃষাণে!
*
দেখতে দেখতে বাংলা কবিতার মজমা ছেড়ে বহুদূর এসে গেছি। শন-খড়ি পোড়ানো জ্বালে ফুটন্ত কেতলির চায়ে, চুমুক দিচ্ছি নিখোঁজ মানুষের মত, চারদিকে নাই কেউ চেনাজানা!
এখানে গ্ল্যামার নাই, আর নাই বহুছাপা হবার মোহ-
কেউ শোনে নাই যেই ভাষার ঝনন কানে, আজকে সেই ধ্বনিচত্বর থেকে শুরু করেছি হাঁটা!
*
এক জন্মে কতটা নীরব হলে ব্যক্তিত্বে কালিমা লাগে না কারো?
*
এত শত গ্রাম ঝলমলে ড্রেস পরে নগরীর খ্যাতি পেলো আমাদের স্বপ্ন দেখা ফুরালো না। নদীর উজান লক্ষ্য করে কত ক্লেশ গায়ে নিয়ে যে হারিয়ে গিয়েছে স্বপ্ন পূর্ণ হবার গল্প তা শুধু ইতিপূর্বে শ্রেণীসাম্যের নামে, বিপ্লবের নামে, পরিবর্তনের নামে ধোকা খাওয়া গণমানুষ জানেন, চা-শ্রমিকেরা জানেন, শহীদ-মাতারা জানেন!
*
আমাদের ঘুমকাতর চোখ ভুলে গেছে উঠানসকাল, চারিদিকে দেয়ালের আস্তর, কল্পিত সবুজে মাখা! সব পথে প্রবৃত্তির পানশালা মনে ও মন্থনে! আর বিপ্লব এখানে সুশীল রাজনীতির খপ্পরে পড়ে কড়কড়ে টাকার ব্যপার যে হবে না তুমি কি সিওর বাংলাদেশ?
তবু দেখবে মানুষই ভুলে যাবে মানুষের আহাজারি; সংঘবদ্ধ হাত, প্রখর মিছিল সব; যেমন ফিলিস্তিন, যেমন হুতির পাল্টা মিসাইল, ভুলে যাবে মুসলিম!
*
যেন গাঙ বেয়ে আসে খুরধ্বনি, করতালি, পানাম নগরী ধেয়ে, যেন অন্তেষ্টিক্রিয়া সেরে এসে ফ্যাসিবিরোধী মিছিলে নিহত কন্যার ছবিতে হাত বুলাচ্ছে কেউ; ফ্যাসিস্ট পতনের সেই ফুলচন্দন দৃশ্যের পর কেন এখানে মবের তাড়া আজ, প্রশ্নবিদ্ধ এক সংবিধান নিয়ে উসখুস করে বাংলার ফুসফুস?
কবিতা এখন মৌলিক অধিকার, গেরিলার পাইপগান যাকে ভুলে গেছি আমরা, আজ ভুলে যাব মিসাইল এটাক গতকালকের; রক্তবর্ণ গাজার অদূরে জলপাইঘন গল্পে ঘুমায় প্রাচীন ফিলিস্তিন, অন্তর জুড়ে তার আকসা-মিনার!
কবি সাজ্জাদ সাঈফ বাংলাদেশের সাহিত্যমণ্ডলে প্রথম বই 'কবি নেবে যীশুর যন্ত্রণা' দিয়ে যাত্রা করা এক ম্যারাথন রানার, তাকে অবজ্ঞা করা যায় কিন্তু কোনোক্রমেই অস্বীকার করা যাবে না মর্মে চিহ্নিত করা সময়ের দাবি নিশ্চয়ই।
-
মোঃ তাসকিন আমিনুল হক
সিনিয়র লেকচারার
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
ঢাকা সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি কলেজ।