19/05/2024
জার্মানিতে পড়তে যেতে চাইলে আপনার যেসব বিষয়ে জানা উচিত
জার্মানি বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ। প্রযুক্তিসহ নানান কারণে দেশটি ইউরোপের সেরা। শিক্ষাব্যবস্থাও আধুনিক এবং সময়োপযোগী। আর তাই, উচ্চশিক্ষার জন্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অন্যতম পছন্দের গন্তব্য জার্মানি।
দেশটিতে পড়তে যেতে চাইলে জার্মান সংস্কৃতিসহ বেশ কিছু বিষয়ে জেনে রাখা উচিত আপনার। আজকের পোস্টে এমনই কিছু বিষয়ে নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে-
ভিসা রিকোয়েরমেন্টস:
প্রথমেই আপনার জানতে হবে, জার্মান ভিসা পেতে হলে কী কী ডকুমেন্টস দরকার। আদৌ আপনার তা আছে কি না। না থাকলে কী কী জোগাড় করতে হবে, কতো সময়ে তা জোগাড় করা সম্ভব। এজন্য চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন, ঢাকাস্থ জার্মান দূতাবাসের ওয়েবসাইটে। দেখতে পারেন চেকলিষ্ট।
জার্মানির গ্রেড সিস্টেম:
জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সিজিপিএ ১’ হচ্ছে সব থেকে ভালো গ্রেড আর সিজিপিএ ৪ হচ্ছে সব থেকে পেছনের সারির (খারাপ) গ্রেড। আর ফেল বিবেচনা করা হয় ‘সিজিপিএ ৫’-কে।
প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সাধারণ যোগ্যতা প্রয়োজন সর্বোচ্চ সিজিপিএ -২ দশমিক ৫। অর্থাৎ কোনো শিক্ষার্থীর সিজিপিএ -২ দশমিক ৫-এর কম হলেই প্রাথমিকভাবে ভর্তির জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হন। এক্ষেত্রে আপনার ফলাফল, দুর্বলতা ও কোন কোন জায়গা আপনি এগিয়ে, আগে থেকেই তা খুঁজে বের করা উচিত।
ওয়েটিং পিরিয়ড:
বর্তমান সময়ে জার্মানিতে উচ্চশিক্ষায় সব থেকে বড় বাধা হচ্ছে দূতাবাসে ভিসা সাক্ষাৎকারের সময় পাওয়া। প্রায় ১৯ থেকে ২১ মাসের দীর্ঘ ওয়েটিং পিরিয়ড পার করে যেতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। আপনি কতোটা সময় ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতে পারবেন, না আদৌ আপনার অন্য দেশে যাওয়া উচিত- শুরুতেই ভেবে দেখতে পারেন।
জার্মানিতে ভর্তি পদ্ধতি:
জার্মানিতে ভর্তির জন্য দুই ধরনের পদ্ধতি চালু আছে। একটি হচ্ছে ওপেন অ্যাডমিশন, অন্যটি অ্যাপটিচুড টেস্ট (রেস্টিকটেড)। প্রথমটির ক্ষেত্রে শুধু ব্যাচেলরের ফলাফল ও অন্যান্য কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে ভর্তি নেয়া হয়। অন্যটিতে কাগজপত্র যাচাইয়ের পাশাপাশি অনলাইনে পরীক্ষাও দিতে হয়।
আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাচ্ছেন, এবং আপনার কোর্সের রিকোয়রমেন্ট কী- আগে থেকে জেনে রাখতে পারেন।
ভাষা:
যদিও আপনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি কোর্সে যেতে পারবেন। কিন্তু জার্মানিতে টিকে থাকতে ‘জার্মান ভাষার’ বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে পরামর্শ হলো- লম্বা ওয়েটিং পিরিয়ডে রোজ অল্প-বিস্তর ভাষার চর্চা করুন।
বলা হয়ে থাকে, ইংরেজি জানলেও সাধারণত জার্মানরা তা বলে না। তারা তাদের ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান থেকে এটি করেন। তাই জার্মান ভাষা না জানলে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সবখানে ভোগান্তির সম্ভাবনা থাকে।
জীবনযাত্রার খরচ:
জার্মানি অন্যান্য দেশের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম টিউশন ফি এবং টিউশন ফি না দিয়ে পড়ার সুযোগ থাকলেও আপনার জীবনযাত্রার খরচ আপনাকেই বহন করতে হবে। শহরের ওপর নির্ভর করে জীবনযাত্রার খরচ পরিবর্তিত হতে পারে।
আবাসন, খাবার, পরিবহন এবং অন্যান্য জীবনযাত্রার খরচের জন্য আপনার কী পরিমাণ বাজেট দরকার, কীভাবে কী করবেন, আগে থেকেই সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিত।
বলা হয়ে থাকে, শিক্ষার্থীদের বাসস্থানের ও দৈনন্দিন খরচ শিক্ষার্থী চাকরি করেই পুষিয়ে নিতে পারে।
ব্লক মানি:
জার্মানিতে অন্য দেশের মতো ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখাতে হয় না। তবে,১১ হাজার ২০৮ ইউরোর (প্রায় ১৫ লাখের অধিক) মতো দেশটির একটি ব্যাংকে জমা করতে হয়। যা অনেকের জন্য ‘কষ্টসাধ্য’ হতে পারে। তাই আপনি যদি জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার কথা ভাবেন, একদম শুরুর দিকেই এ নিয়ে ভাবা উচিত।
বাসস্থান:
জার্মানিতে সিঙ্গেল রুম, সেয়ার্ড এপ্যার্টম্যান্ট, স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট, স্টুডেন্টদের জন্য ইউনিভার্সিটির হোস্টেল, ডরমিটরি ইত্যাদি নানান উপায় আছে। তবে, ডর্মে- সিট পেতে অনেক সময়ই দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। কিছু নির্দিষ্ট পরামর্শ অনুসরণ করে এ যাত্রা সহজ করা সম্ভব।
যেমন: আপনি অ্যাডমিশন নেয়ার পরে ডর্মের জন্যে আবেদন করবেন। অনেকসময় ডর্ম আপনাকে আপনার এস্টিমেট ডেটের আগেই রুম দিয়ে দিতে পারে। তখন মেইল করে তাদের পুরো বিষয়ে বুঝিয়ে কিছুদিন সময় চেয়ে নিতে হবে। এবং ফ্লাই করার কয়েকমাস আগে থেকে আবার যোগাযোগ করে সমন্বয় করতে হবে। এজন্য অনলাইন ঘেটে আরও তথ্য সংগ্রহ করে নিতে পারেন।
এছাড়া বাংলাদেশি কমিউনিটি, বিদেশি ব্যাচমেট ও সিটির ফেসবুক গ্রুপ থেকে আপনি বাসা খোঁজার বিষয়ে সহযোগিতা নিতে পারেন।
সংস্কৃতি:
ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে জার্মান সংস্কৃতি এবং শিষ্টাচারের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে তৈরি করুন। জার্মানরা সময় মেনে চলা, সরাসরি যোগাযোগ এবং ব্যক্তিগত স্থানকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এমন অনেক বিষয় রয়েছে, যা আগে থেকে জানা থাকলে আপনি পরবর্তীতে ঝামেলায় পড়বেন না।
পরিবহন:
জার্মানিতে ট্রেন, বাস, ট্রাম এবং পাতালরেলের মতো চমৎকার গণপরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে। সস্তা ভ্রমণ ভাড়ার ‘স্টুডেন্ট ডিসকাউন্ট কার্ড’ পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে আগে থেকে জেনে রাখা ভালো। ‘৪৯ ইউরোর টিকেট’সহ বেশ কিছু উপায় আছে।
খণ্ডকালীন কাজ:
একজন আন্তর্জাতিক ছাত্র হিসেবে, আপনি জার্মানিতে খণ্ডকালীন কাজ করতে পারবেন। কিন্তু আপনি কত ঘণ্টা কাজ করতে পারবেন তার ওপর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, জার্মানিতে একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী মোট ১২০ দিন ফুলটাইম কিংবা ২৪০ দিন পার্ট টাইম কাজ করতে পারেন।
ফুলটাইম মানে ৮ ঘণ্টা আর পার্ট টাইম মানে ৪ ঘণ্টা। কিন্তু আপনি যদি ৩ ঘণ্টার শিফট করেন সেটাও পার্ট টাইম হিসাবে কাউন্ট হবে। আবার ৫ ঘণ্টার শিফট করলে ফুলটাইম হিসাবে কাউন্ট হবে, এমন কী একটা টার্ম আছে; এ সম্পর্কিত আরও তথ্য অনলাইন ঘেটে জেনে নিতে পারেন।
শিক্ষার্থীরা সাধারণত যেসব কাজ করে তার মধ্যে হোটেল, রেস্তোরাঁ, বারে কাজসহ খাবার পরিবহনের কাজ যেমন রয়েছে; তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রজেক্টে অধ্যাপকের সঙ্গে কাজের সুযোগ আছে যথেষ্ট।
নেটওয়ার্কিং:
নতুন দেশে লোকজনের সাথে পরিচিত হওয়া বা নেটওয়ার্কিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কীভাবে দেশটির স্টুডেন্ট ক্লাব, সোসাইটি ও ইভেন্টে যোগ দিবেন, কীভাবে লোকেদের সাথে দেখা করবেন বা বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিবেন, তা আগে থেকে ধারণা রাখতে ভালো হয়।
ইউটিউব -এক্ষেত্রে আপনাকে তথ্য পেতে এবং তাদের (জার্মান) আচরণ বুঝতে সহায়তা করতে পারে।
হেলথ ইনস্যুরেন্স:
জার্মানিতে হেলথ ইনস্যুরেন্স বাধ্যতামূলক, তাই আপনাকে জার্মানিতে থাকতে হলে হেলথ ইনস্যুরেন্সের মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। কীভাবে এবং কাদের মাধ্যমে কখন ‘হেলথ ইনস্যুরেন্স’ করবেন, এর মেয়াদ ও অন্যান্য বিষয়ে খোঁজ নিতে পারেন।
ভ্রমণের সুযোগ:
পড়াশোনার সময় সেমিস্ট্রার ব্রেকে বা আপনার সুবিধাজনক সময় আপনি আশপাশের দেশ ও জার্মানিতে ঘুরে দেখতে পারেন। শেনজেনভুক্ত দেশগুলোতে আপনি কোনো ঝক্কি ছাড়াই ঘুরতে পারবেন। এসব জায়গায় ভ্রমণের খরচ সাধারণত খুবই কম। আগে থেকে ট্র্যাভেল বিষয়ক ধারণা নিয়ে রাখতে পারেন। এছাড়া ট্রেন, বাস, বা বাজেট এয়ারলাইনগুলো সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে পারেন।
ব্যাংকিং:
জার্মানির ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিতে পারেন। তাতে ব্লক অ্যাকাউন্ট, হেলথ ও ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্সসহ জার্মানিতে পৌঁছে অন্যান্য আর্থিক বিষয়ে লেনদেনে আপনি অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকবেন।
সাংস্কৃতিক ইভেন্ট:
জার্মানিতে বছর জুড়ে বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য অনুষ্ঠান, উৎসব এবং প্রদর্শনী হয়। ইন্টারনেট ঘেঁটে মোটামুটি এক নোট বানিয়ে ফেলতে পারেন।
উল্লেখ্য, শিক্ষার্থীদের জন্য ডিসকাউন্ট বা বিনামূল্যের টিকিটের সুবিধা থাকে অনেক অনুষ্ঠানেই।
খাবার:
জার্মানদের খাবার রীতি সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন। অনেকে বাঙালি খাবার খুঁজে পেতে বা হালাল দোকান খুঁজে পাওয়া নিয়ে ভাবেন, তারা আগে থেকে তথ্য জোগাড় করে রাখতে পারেন।
আবহাওয়া:
জার্মানির বিভিন্ন আবহাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে আপনার। ঠান্ডা, তুষারময় শীত থেকে গরম আবহাওয়া কখন কেমন থাকে আগে থেকেই জেনে নিতে পারেন।
অ্যাকাডেমিক পরিবেশ:
জার্মানিতে অ্যাকাডেমিক প্রত্যাশা এবং গ্রেডিং সিস্টেমের সাথে নিজেকে পরিচিত করতে পারেন। শিক্ষা ব্যবস্থা স্বাধীন অধ্যয়নের সুযোগ, প্রয়োজনে সমালোচনা, চিন্তাভাবনা, বক্তৃতা ও সেমিনারের সক্রিয় চিত্র নিয়ে নিতে পারেন। বলা হয়ে থাকে, জার্মানরা অনেক বেশি অভিযোগ করে।
পছন্দের সাবজেক্টে পড়া শেষে চাকরির সুযোগ:
জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমে অর্থনীতি, বিজনেস, ফিন্যান্স, ফার্মেসি, বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাডভান্সড ম্যাটেরিয়ালস, অ্যাডভান্সড অনকোলজি, কমিউনিকেশন টেকনোলজি, এনার্জি সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, মলিকিউলার সায়েন্স, পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, পলিমার সায়েন্স, ফটো ভোলাটিকস, ইলেকট্রনিকস, মেকাট্রনিক্স, জিওলজি ও মাইনিং, পলিটিক্যাল সায়েন্স, কম্পিউটার সায়েন্সসহ প্রকৌশল ও জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পড়ার সুযোগ আছে।
কিন্তু যেই বিষয়েই পড়েন না কেনো, পড়াশোনা শেষে তা চাকরির বাজারে কেমন ডিমান্ডেবল তা আগে থেকে জেনে নেয়া উচিত।
স্টুডেন্ট সাপোর্ট সার্ভিস:
জার্মানির ইউনিভার্সিটিগুলো ছাত্রদের জন্য অ্যাকাডেমিক অ্যাডভাইসিং, কাউন্সেলিং এবং ক্যারিয়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সাপোর্ট সার্ভিস দিয়ে থাকে। পড়াশোনার সময় সমস্যায় পড়লে কী ধরনের সংগঠন খুঁজবেন, বা যোগাযোগ কীভাবে করবেন, জেনে রাখতে পারেন।
রেসিডেন্স পারমিট রিনিউ:
ভিসার মেয়াদের আগে আপনার তা রিনিউ করতে হবে। কোনো সমস্যা এড়াতে কীভাবে তা করবেন, তা নিয়ে ধারণা নিয়ে রাখতে পারেন।
স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা:
জার্মানিতে থাকাকালীন আপনার শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতায় কী করবেন। অসুস্থ হলে কীভাবে সহায়তা পাবেন। জার্মান স্বাস্থ্যব্যবস্থা কীভাবে কাজ করতে- জানা উচিত।
রেসিজম:
বলা হয়ে থাকে জার্মানির কিছু কিছু ছোট শহর ও বাসে, ট্রামে মাঝে-মাঝে রেসিজমের ঘটনা ঘটে। যেমন: জার্মানরা হয়তো আপনার পাশে বসতে চাইবে না।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়লে কীভাবে মানিয়ে নিবেন, অনলাইন আর্টিকেল বা ইউটিউব থেকে সে বিষয়ে অন্যদের অভিজ্ঞতা ও কৌশল জানতে পারেন।
স্থায়ীভাবে থাকার সুবিধা:
জার্মানিতে পড়াশোনা শেষে প্রায় দুই বছরের ‘জব সার্চিং ভিসা’ দেয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে একজন শিক্ষার্থী চাকরি খুঁজে নিতে পারলে জব সার্চিং ভিসা ওয়ার্ক ভিসায় রূপান্তর করা হয়। এরপর একজন শিক্ষার্থী পিআর বা স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদন করতে পারেন।
জার্মানিতে বসতি গড়তে চাইলে আগে থেকেই -এ বিষয়ে সার্বিক খোঁজ নিয়ে রাখতে পারেন।
© Ridoy Alom