11/07/2025
- স্যার,আমাকে চিনতে পেরেছেন?
- না বাবা, আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। তুমি কে?
- আমি একসময় আপনার ছাত্র ছিলাম।
- ও আচ্ছা! এখন তুমি কি করছ?
- আমি একজন শিক্ষক।
সাবেক ছাত্রের মুখ থেকে এই কথা শুনে বৃদ্ধ শিক্ষক অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন, "বাহ্! খুব ভালো! খুব ভালো! আমার পেশা বেছে নিয়েছ তাহলে!"
যুবক মৃদুহেসে জবাব দিল, "আসলে আমি আপনার মতো একজন শিক্ষক হতে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আপনি আমাকে আপনার মতো হতে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছেন স্যার!"
বৃদ্ধ শিক্ষক কিছুটা কৌতূহল নিয়ে যুবকের শিক্ষক হওয়ার নেপথ্য কারণ জানতে চাইলে, যুবক তার শিক্ষক হয়ে উঠার গল্প বলতে গিয়ে বৃদ্ধ শিক্ষককে স্মরণ করিয়ে দিলে, স্কুলে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার কথা।
"মনে আছে স্যার, একদিন আমার এক সহপাঠী বন্ধু, যে আপনারও ছাত্র ছিল, একটি নতুন হাতঘড়ি নিয়ে ক্লাসে এসেছিল। তার ঘড়িটি এতোটাই সুন্দর ছিল যে আমি কোনভাবেই লোভ সামলাতে পারিনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যেভাবেই হোক ঘড়িটি আমার চাই। এরপর সুযোগমতো তার পকেট থেকে ঘড়িটি চুরি করি আমি। কিছুক্ষণ পর আমার সেই বন্ধু তার ঘড়ির অনুপস্থিতি লক্ষ্য করে এবং তখনই আমাদের স্যার অর্থাৎ আপনার কাছে অভিযোগ করে। তার এই অভিযোগ শুনে আপনি ক্লাসের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "আজ ক্লাস চলাকালীন সময়ে এই ছাত্রের ঘড়িটি চুরি হয়েছে, যেই চুরি করে থাকো, ঘাড়িটি ফিরিয়ে দাও।"
আপনার নির্দেশ শুনেও আমি ঘাড়িটি ফেরত দিতে পারিনি।
কারণ, ঘড়িটি ছিল আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয়। তাছাড়া, আমরা খুবই গরীব ছিলাম, এমন ঘড়ি কেনার সামর্থ্যও আমাদের ছিল না।
যাই হোক, সেদিন আপনি দরজা বন্ধ করে সবাইকে বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ক্লাসরুমের ফ্লোরের মধ্যে একটি গোলাকার বৃত্ত তৈরি করতে বললেন এবং সবাইকে চোখ বন্ধ করার নির্দেশন দিলেন, অতঃপর ঘড়ি উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আপনি পর্যায়ক্রমে আমাদের সবার পকেট এবং ব্যাগ খুঁজতে লাগলেন। আমরা সবাই আপনার নির্দেশনা মোতাবেক নীরবে দাঁড়িয়ে রইলাম।
এক এক করে পকেট এবং ব্যাগ চেক করতে করতে একটা সময় আপনি যখন আমার ব্যাগে হাত দিয়ে ঘড়িটি খুঁজে পেলেন। তখন ভয়ে, লজ্জায় আমার শরীর কাঁপছিল। কিন্তুু সেই মুহূর্তে, ঘড়িটি আমার কাছ থেকে উদ্ধার হবার পরও আপনি কিছু বলেননি এবং শেষ পর্যন্ত সব ছাত্রকেই চেক করছিলেন। সবশেষে, আপনি আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, "ঘড়ি পাওয়া গেছে, এবার তোমরা সবাই চোখ খুলতে পারো।"
ঘড়িটি পাবার পর আমার সেই বন্ধুটি আপনার কাছে জানতে চেয়েছিল, ঘড়িটি কার কাছে পাওয়া গিয়েছিল? আপনি তাকে বলেছিলেন, ঘড়িটি কার কাছে পাওয়া গেছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তোমার ঘড়ি যে পাওয়া গেছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
সেই দিনের ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে আপনি আমার সাথে আর কোনো কথা বলেননি। এমনকি সেই গর্হিত কাজের জন্য আমাকে তিরস্কার পর্যন্ত করেননি। নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য আপনি আমাকে স্কুলের কোনো কামরায় নিয়ে যাননি। ঘটনাটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়, অথচ আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে চুরি হওয়া ঘড়িটি উদ্ধার করলেন এবং সবার সামনে আমার সম্মান রক্ষা করলেন।
সেই ঘটনার পর আমি বহুদিন অনুশোচনায় ভুগেছি। ক্লাসে ঘটে যাওয়া ওই ঘটনা ওই দিনই শেষ হয়ে গেলেও এর রেশ রয়ে যায় আমার মনের মধ্যে। বিবেকের সাথে যুদ্ধে বার বার দংশিত হয়েছি। নীরবে অনুশোচনার আগুনে পুড়েছি।তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম, এইসব অনৈতিক কাজ জীবনে আর কখনো করব না। একজন ভালো মানুষ হব — একজন শিক্ষক হব। সত্যিকার অর্থে মানুষ গড়ার কারিগর হব। আপনার কাছ থেকে সেদিন আমি স্পষ্ট বার্তা পেয়েছিলাম: একজন শিক্ষকের কেমন হওয়া উচিত। অপমান ছাড়াও মানুষকে সংশোধন করা যায় সেটি আপনার কাছ থেকেই শিখেছি। আপনার উদারতা এবং মহানুভবতা আজ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে স্যার।
সাবেক ছাত্রের কথাগুলো শুনতে শুনতে বৃদ্ধ শিক্ষকের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল! চোখের জল মুছতে মুছতে মৃদু হেসে শিক্ষক বললেন, "ঘটনাটি আমার দিব্যি মনে আছে। কিন্তুু আমি তোমাকে মনে রাখিনি, কারণ সে সময় শুধু তোমাদের নয়, আমার চোখও বন্ধ ছিল।"
তারপর শিক্ষক দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, "তুমিই বলো বাবা, কোনো শিক্ষক কি সন্তানতুল্য ছাত্রদের চোরের বেশে দেখতে পারে? আমি চাই আমার ছাত্রদের বীরের বেশে দেখে গর্ব করতে।"