13/09/2025
জাবি'তে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী কামরুল ইসলাম কে যেভাবে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়ঃ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রথম ও ছাত্রশিবিরের ইতিহাসে ৬৯তম শহীদ হলেন কামরুল ইসলাম। শহীদ কামরুল ইসলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এসে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন আল্লাহর রাস্তায়। তিনি ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের একজন কর্মী।
১৯৯৪ সালের ১৭ আগস্ট কামরুল ইসলামকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হতে হয়। বিনা অপরাধে একজন ভর্তিচ্ছুকে সন্ত্রাসীরা যেভাবে ঠাণ্ডা মাথায় পিটিয়ে হত্যা করেছে তা অন্ধকার যুগের বর্বরতাকেও হার মানায়। দেশের অন্যতম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরণের নৃশংস ও পৈশাচিক হত্যাকান্ডে বিবেকবান প্রত্যেকটি মানুষই বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিল।
১৯৯৪ সালের ১৬ই আগস্ট শহীদ কামরুল ইসলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৪-৯৫ শিক্ষাবর্ষে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তির মৌখিক পরীক্ষা দিতে মওলানা ভাসানী হলে এক বন্ধুর কক্ষে ওঠেন। ছাত্রদলের মাজহারের নেতৃত্বে ৮/১০ জন সন্ত্রাসী কামরুল ইসলামকে পড়ার টেবিল থেকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায় হলের ৩৩২ নম্বর কক্ষে। কামরুল ইসলামকে শিবির-কর্মী সন্দেহে কিল, ঘুষি ও লাথি দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেয়া হয়। পরে তার পকেটে শিবিরের ডায়েরি দেখে নিশ্চিত হয়ে সারারাত নির্মম নির্যাতন করে। সন্ত্রাসীরা অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় লাঠি, রড, পেপসির বোতল ও অন্যান্য ধারাল অস্ত্রের উপর্যুপরি আঘাতে তার মাথা ও শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে। তার আর্তচিৎকারে চারদিক প্রকম্পিত হলেও সেদিন ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের ভয়ে কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে সাহস পায়নি।
রাত আরো গভীর হলে সন্ত্রাসীরা আবারও খুনের নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠে। এবার কামরুলের আর্তচিৎকার যেন বাইরে থেকে শুনা না যায়, এ জন্য তার মুখে কাপড় গুজে দেয় খুনী হায়েনার দল। সারারাত ধরে পালাক্রমে নির্যাতন চালিয়ে কামরুলের হাত ও চোয়াল ভেঙ্গে দেয়৷ পিপাসায় কাতর হয়ে; আল্লাহ গো বাঁচাও, পানি..... পানি...... বলে চিৎকার করলেও তাকে সারারাতে একফোটা পানিও খেতে দেয়নি৷ বরং তাকে নির্যাতন করা হয়নি, এই মর্মে একটি মুচলেকা দিতে বাধ্য করে৷ সারারাত নির্যাতনের ফলে কামরুলের শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি ঘটে৷
১৭ই আগস্ট সকালে আহত কামরল ইসলামকে মওলানা ভাসানী হলের দু'জন সিকবয় শফিক ও বাবুলকে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু কর্তব্যরত ডাক্তার তার অবস্থা মারাত্মক দেখে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার জন্য পরামর্শ দেন। সিকবয় দু'জন মুমূর্ষু কামরুলকে নিয়ে বেবী টেক্সিযোগে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হওয়ার পর সাভার বাজারের কাছে গেলে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এ সময় তারা ঢাকার দিকে না গিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে আসার সময় নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলের পূর্বে ঢাকা- আরিচা মহাসড়কের পাশে জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে তার লাশ ফেলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে।
পরে সাভার থানার পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে নিয়ে যায়। এ ঘটনার লিখিত বিবরণ মওলানা ভাসানী হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক এনামুল হক খান, ভিসি অধ্যাপক আমিরুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে জমা দেন৷ খুবই অবাক করা বিষয় সকাল থেকে লাশ পড়ে থাকলেও হলের প্রভোস্ট এনামুল হক খান ভিসিকে এখবর জানান রাত ৯টার সময়। এর আগে শিক্ষক ক্লাবে বসে রাত ৭টার দিকে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ড. নইম সুলতান, নুরুল হক, আতিকুর রহমান, ড. মোজাম্মেল হক, জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ আবাসিক শিক্ষকদের সাথে বৈঠক করেন। এতেই বুঝা যায় কতটা বিবেকহীন ছিলেন এই শিক্ষক সমাজ।
এরপর ২২শে আগস্ট ভিসি আমিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সিণ্ডিকেট এক জরুরি সভায় উক্ত ঘটনার জন্য গভীরভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করা। সিণ্ডিকেট উক্ত ঘটনার তদন্ত চূড়ান্তকরণসহ অবিলম্বে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিশেষভাবে অনুরোধ করে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শহীদ কামরুল ইসলামের চিহ্নিত খুনীরা ক্যাম্পাসের সর্বত্র পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে ঘুরে বেড়ালেও কেউ গ্রেফতার হয়নি৷
এ ঘটনায় ২৪ আগস্ট সাভারের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৬৭ জন শিক্ষক এবং সাভার ও ধামরাই সরকারি কলেজের ১৭৩ জন ছাত্রছাত্রী এই হত্যার বিচারের দাবি করে বিবৃতি দেয়। ২৯ আগস্ট সাভার-ধামরাই এলাকার ৮০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছাত্রদলের এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি করে। ৩০ আগস্ট ঢাকা জজকোর্টের ৭১ আইনজীবী এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানান।
কিন্তু কি ছিল শিবির-কর্মী কামরুলের অপরাধ? কেন আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ভাসানী হলের নির্জন কক্ষে সম্পূর্ণ অসহায় অবস্থায় এভাবে জীবন দিতে হলো তাকে। সে তো তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব অর্জন করেনি, কারো স্বার্থে আঘাত হানেনি। তবে কেন তাকে জীবন দিতে হলো? আসলে এছাড়া কামরুলের আর কোন অপরাধ ছিল না যে, সে নিয়মিত নামাজ পড়তো, ইসলামকে নিজের জীবনে ও সমাজে বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখতো। কিন্তু যারা নামাজ পড়তে দেখলে নিজেদের গাত্রদাহ অনুভব করে, দাড়ি টুপি দেখলে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে, তারা চায়নি এ ধরনের একটি আদর্শবান ছাত্র ভর্তি হোক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাই তাদের হাতে নির্মমভাবে জীবন দিতে হলো মেধাবী আদর্শবান ছাত্র কামরুল ইসলামকে।
যে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পাখি হত্যা করলে তার ছাত্রত্ত্ব বাতিল হয়, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির পরিচয়ে কাউকে হত্যা করলে বিচার তো দূরের কথা বরং তাকে পুরস্কৃত করা হয়। চরিত্রবান মেধাবীদের অবাধ বিচরণ কম থাকার কারণেই হয়তোবা এখানে ধর্ষণের সেঞ্চুরি প্রকাশ্যে উদযাপন করার পরিবেশ তৈরি হয়ছিল। তাই ইসলাম কে আর উপেক্ষা নয়, প্রমোট করা জরুরী। তাহলেই ভালো থাকবে আমার-আপনার প্রাণের স্পন্দন- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচ এম জোবায়ের
সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
৩৩ তম ব্যাচ
মওলানা ভাসানী হল।