23/08/2025
যশোরের পথে গোপালগঞ্জের দুর্গে নুরের হুঙ্কার: সৈনিক থেকে সেনাপতি এবং নতুন রাজনীতির ইশতেহার
==================================
রাজনীতির গতিপথ বড়ই বিচিত্র। কখনো একজন সাধারণ কর্মী সময়ের দাবিতে হয়ে ওঠেন একজন অকুতোভয় সেনাপতি। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে যে তরুণ মুখটি—নুরুল হক নুর—সাধারণ ছাত্রছাত্রীর অধিকার আদায়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিল, সেই মুখটিই আজ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির দুর্গে দাঁড়িয়ে ছুড়ে দিচ্ছেন নতুন চ্যালেঞ্জ। তার মূল গন্তব্য ছিল যশোর টাউন হলের জনসভা। কিন্তু সেই দীর্ঘ যাত্রাপথে, তিনি ক্ষণিকের জন্য থামলেন প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক তীর্থভূমি হিসেবে পরিচিত গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর কলেজ মোড়ে। এই পথসভাটি কোনো পূর্বনির্ধারিত বিশাল আয়োজন ছিল না, কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে তিনি যে বক্তব্য রেখেছেন, তা নিছক একটি ভাষণ ছিল না; বরং ছিল প্রথাগত রাজনীতির বলয়ের বাইরে একটি নতুন শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের বলিষ্ঠ ঘোষণা। এই ঘটনাটি তার ‘সৈনিক থেকে সেনাপতি’ হয়ে ওঠার যাত্রাপথকে আরও সুস্পষ্ট করেছে।
নুরুল হক নুরের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অন্যতম পরিচয় হলো তার প্রতীকী পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষমতা। যশোর যাওয়ার পথে গোপালগঞ্জকে একটি পথসভার জন্য বেছে নেওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক কৌশল। যে জেলাকে দেশের বর্তমান সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এবং ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতার উৎসকেন্দ্র হিসেবে দেখা হয়, সেখানে দাঁড়িয়ে সরাসরি ব্যবস্থার সমালোচনা করা—এর জন্য যে কেবল সাহস নয়, গভীর কৌশলও প্রয়োজন, তা নুর দেখিয়েছেন।
তার বক্তব্যে তিনি একই সাথে প্রশংসা ও সমালোচনার এক যুগপৎ এবং ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল অবলম্বন করেছেন। একদিকে তিনি গোপালগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। তিনি স্মরণ করেছেন এই মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের—জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে সাংবাদিক নির্মল সেন, ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার ও কিংবদন্তী শিল্পী ফিরোজা বেগমদের মতো ব্যক্তিত্বদের। এই প্রশংসার মাধ্যমে তিনি নিজেকে গোপালগঞ্জ-বিদ্বেষী হিসেবে উপস্থাপিত হওয়া থেকে রক্ষা করেছেন এবং স্থানীয় জনগণের আবেগের সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, "গোপালগঞ্জের সব মানুষ খারাপ নয়, ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশি। গোপালগঞ্জের মানুষ অতিথি পরায়ণ।"
অন্যদিকে, এই শ্রদ্ধার আবরণের নিচেই তিনি উন্মোচন করেছেন বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির কঠোর বাস্তবতা। তিনি গোপালগঞ্জে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ঘটনাকে ‘নৃশংসতা’ বলে অভিহিত করে বলেন, "আমি এটা মেনে নিতে পারিনি।"
তার পুরো ভাষণের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সবচেয়ে আলোচিত উক্তিটি ছিল, "সুবিধাবাদী রাজনীতি করলে শেখ হাসিনার কেবিনেটে সবচেয়ে ভালো মন্ত্রী হতে পারতাম, শত সহস্র কোটি টাকার মালিক থাকতাম। কিন্তু আমরা সেটার সাথে আপোস করিনি।" এই একটি বাক্যেই নুর তার রাজনৈতিক ভাবমূর্তি নির্মাণ করেছেন। তিনি নিজেকে প্রচলিত রাজনীতিবিদদের থেকে আলাদা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যারা ক্ষমতা বা অর্থের লোভে আদর্শচ্যুত হন না। তরুণ প্রজন্ম এবং দেশের প্রচলিত দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ জনগোষ্ঠীর কাছে এই বার্তাটি অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
নুরুল হক নুর কেবল সমালোচক নন, তিনি একটি নতুন দিনের স্বপ্নও দেখান। তাই তিনি শুধু সমস্যার কথা বলেই থেমে যাননি, সমাধানের একটি রূপরেখাও উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, "পুরানো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে নির্বাচন হলে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা সম্ভব নয়।" তার প্রস্তাবিত "নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের" কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা। এই ধরনের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তাকে নিছক একজন আন্দোলনকারী থেকে রাষ্ট্রনায়কোচিত চিন্তার অধিকারী নেতা হিসেবে পরিচিত করতে সাহায্য করছে।
নুরের এই পথসভার পর সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় ছিল গোপালগঞ্জের স্থানীয় মানুষের প্রতিক্রিয়া। সভা শেষে দেখা গেছে, সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মাঝে একটি সূক্ষ্ম আলোচনা চলছে, যা নুরের রাজনৈতিক জীবনের জন্য একটি বড় সাফল্য হিসেবেই বিবেচিত হতে পারে। অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর এবং সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান তাদের বক্তব্যে অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। তারা গোপালগঞ্জের নামে, বঙ্গবন্ধু বা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে কোনো কুরুচিপূর্ণ বা আক্রমণাত্মক মন্তব্য করেননি।
স্থানীয়দের মতে, এই সম্মান প্রদর্শনের পুরস্কারও তারা পেয়েছেন হাতেনাতে। অতীতে অনেক বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকে গোপালগঞ্জে এসে বাধার মুখে পড়তে হয়েছে, এমনকি সেনাবাহীনির নিরাপত্তা ভ্যানে (এপিসি) করেও এলাকা ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু নুর ও তার সঙ্গীরা নির্বিঘ্নে নিজেদের গাড়িতে করেই পরবর্তী গন্তব্য যশোরের পথে রওনা হতে পেরেছেন।
এই ঘটনাটি গোপালগঞ্জের রাজনীতিতে একটি অলিখিত বার্তা স্পষ্ট করে দিয়েছে, যা অনেক স্থানীয়ের মুখেই উচ্চারিত হচ্ছে: “যারা গোপালগঞ্জের অনুভূতি না বুঝে কথা বলে, তাদের পরিণতি ভালো হয় না। অতিথির মতো আসলে অতিথির মতোই ফিরে যেতে পারবেন। আর যুদ্ধ করতে আসলে ঘোড়ার লেজে বেঁধে দেবে গোপালগঞ্জবাসী।” এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, নুর তার বক্তব্যের মাধ্যমে সেই ‘অতিথি’র সম্মানটুকু আদায় করে নিতে পেরেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রতিপক্ষের দুর্গে দাঁড়িয়েও কেবল বুদ্ধিদীপ্ত ও কৌশলপূর্ণ বক্তব্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা সম্ভব। এটি তার অপরিপক্কতার অভিযোগকে অনেকটাই ম্লান করে দেয় এবং তাকে একজন কৌশলী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
যশোরের পথে নুরুল হক নুরের গোপালগঞ্জ সফর নিছক একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না; এটি ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা বার্তা। তিনি দেখিয়েছেন, রাজনীতি শুধু ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং এটি একটি আদর্শিক লড়াই এবং একই সাথে কৌশলের খেলা।
‘সৈনিক থেকে সেনাপতি’ হয়ে ওঠার এই কঠিন যাত্রায় তিনি কতটা সফল হবেন, তা সময়ই বলে দেবে। তবে গোপালগঞ্জের মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি যে হুঙ্কার দিয়েছেন এবং একই সাথে যে রাজনৈতিক পরিপক্কতা দেখিয়েছেন, তা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘস্থায়ী কম্পন সৃষ্টি করেছে। জনগণ যদি সত্যিই একটি বিকল্প খোঁজে, তবে নুরুল হক নুরের এই কৌশলগত উত্থানকে তারা উপেক্ষা করতে পারবে না। তার এই পথচলা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সাংবাদিক,
আর. টি. হাসান,
#জিওপিটিভি