23/04/2025
সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই গ্রামের সবার কানে দুঃসংবাদটি পৌঁছে গেলো।
দুই দিন নিখোঁজ থাকা গ্রামের সব চেয়ে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর ব্যাক্তি রইস উদ্দিন ওরফে বড় মিয়ার লাশ শাপলা দিঘিতে ভেসে উঠেছে। দিঘির চারপাশে শত শত লোকের ভীড়। তাদের সবার মুখে ভয় ও আতংক।
যেই বড় মিয়ার ভয়ে গ্রামবাসী তটস্থ থাকতো, যার কথার বাইরে গ্রামের কাক পক্ষীও ডাকতো না, সেই লোকটির এহেন মৃত্যু নিশ্চয়ই কোনো ভয়াবহতার আলামত। এই চিন্তায় অনেকের হাত পা কাঁপতে শুরু করলো।
গঞ্জের থানায় খবর দেয়া হয়েছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ চলে আসবে।
নিঝুমকান্দি গ্রামে গত ৩৬ বছরে একবারের জন্যও পুলিশ আসেনি। আসার দরকারও হয়নি। কারণ এই গ্রামে রইস উদ্দিন মিয়াই ছিলেন আদালত এবং বিচারপতি। গ্রামের সব ধরনের বিচারকার্য, মীমাংসা, কেনা-বেঁচা, বিয়ে-শাদী থেকে শুরু করে সব কিছুই রইস উদ্দিনের কথা মতো হতো।
কেউ কখনোই রইস উদ্দিনের কথার বাইরে কিংবা রায়ের বাইরে কথা বলতো না। অবশ্য কথা বলার সাহস এবং সাধ্য কারো ছিলোও না। গ্রামের অর্ধেকের বেশি জমিজমার মালিকই রইস উদ্দিন মিয়া। তিনি এই নিঝুমকান্দি গ্রামের অঘোষিত জমিদার বটে।
সকাল ৯ টার দিকে দু'জন কনস্টেবল সহ একজন পুলিশ কর্মকর্তা গাড়ি নিয়ে চলে এলেন। কর্মকর্তার নাম হেলাল। বয়স ৫০ এর কাছাকাছি। কাঁচাপাকা চুল-দাড়ি আর স্ফীত ভুড়িতে লোকটাকে অদ্ভুত লাগছিলো।
গাড়ি থেকে নেমেই লোকটা হাসি হাসিমুখে পিক করে একদলা পানের পিক ফেললো। কী অদ্ভুত!!
একটা লোক মারা গেছে, আর উনি হাসছেন!!!
এ কেমন পুলিশ?
আঙুলে লেগে থাকা চুন গুলো গাড়ির দরজায় মুছে ফেলে হাসি হাসি মুখে হেলাল সাহেব বলে উঠলেন "জন্মিলে মরিতে হইবে, এই জগতের দায়।"
সবাই অবাক হয়ে হেলাল সাহেবকে দেখছেন। হেলাল সাহেব নির্বিকার। হয়তো শত শত লাশ দেখে হেলালের এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। তার নির্দেশে দিঘির স্বচ্ছ পানি থেকে বড় মিয়ার লাশ দিঘির ঘাটে তোলা হলো।
পানিতে অনেক সময় থাকার কারণে বড় মিয়ার লাশ টা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। দূর্গন্ধও আছে। হেলাল সাহেব নির্বিকার ভঙ্গিতে লাশ টাকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলছেন।
প্রায় ৫ মিনিট পর বলে উঠলেন, "গলা টিইপ্পা মারা হইছে মনে হইতাছে। একটা কানও কাইটা নেয়া হইছে। এই কানের জন্য তো দিঘিতে আবার সার্চিং চালানো লাগবো। হয়তো যেই বেটা মারছে, সে সাথে করে কানটা নিয়েও যাইবার পারে।"
এই বলে আবার একটা পান মুখে দেন হেলাল সাহেব।
এরপর উঠে দাঁড়িয়ে গলা উঁচু করে সবাই কে উদ্দেশ্য করে বললেন, "এই গ্রাম থেকে আমার অনুমতি না নিয়া আগামী ১ মাসের মধ্যে কেউ বাইরে যাইবার পারব না। এর মধ্যে তদন্ত শেষ করুম ইনশাল্লাহ। যে ই মাইরা থাকো না কেন, এই হেলালের কাছ থাইকা বাঁচন নাই। কি কথা ক্লিয়ার?"
সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে হেলালের তর্জন গর্জন শুনছিলো। আর মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ছিলো। দুপুর নাগাদ বড় মিয়ার লাশ পোস্টমর্টেমের জন্য গঞ্জে নিয়ে যাওয়া হলো।
পরের দিন বাদ আসর বড় মিয়ার জানাজা আর দাফন সম্পন্ন হলো। তার একমাত্র পুত্র সন্তান সাজ্জাদ আমেরিকা প্রবাসী। তাই সে বাবার মরা মুখটাও দেখতে পারলো না। ওই ছেলে ছাড়া বড় মিয়ার পরিবারে আপন কেউ নেই বললেই চলে৷ যদিও কর্মচারী, চাকরবাকর মিলিয়ে বড় মিয়ার বাড়িতে প্রতিদিন মোট ৫৩ জন লোক থাকতো।
ওইদিন নিঝুমকান্দি গ্রামের সন্ধ্যাটা কেমন জানি নীরব আর রহস্যময় ছিল।
"বড় মিয়ার মত ক্ষমতাশালী আর দাপুটে মানুষটাকে কে বা কারা এমন নিষ্ঠুরতার সাথে খুন করলো?" --- এই প্রশ্নই গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো।
সবাই অপেক্ষা করছিলো নতুন এক ভোরের, যেখানে এই মৃত্যুর রহস্য সমাধান করে হাসিমুখে কথা বলবেন পানখোর পুলিশ কর্মকর্তা হেলাল সাহেব।
.........চলবে.........
শাপলা_দিঘির_রহস্য
্ব
লেখা_Tariqul Islam Tariq