Shanta Roy

Shanta Roy Everyone has a different clock, wait for your time.

08/01/2023

আমানত-সঞ্চয়ে ঝুঁকির ভয়, নাকি ব্যাংকের ওপর আস্থার সংকট

‘ব্যাংকসমূহে জনগণের আমানত সম্পূর্ণ নিরাপদ রয়েছে’, ‘ব্যাংকে টাকার সংকট হলে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক’—সংবাদ সম্মেলন করে এমন ঘোষণাসহ জরুরি বিজ্ঞপ্তি এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি) বলেছে, বর্তমানে ব্যাংকব্যবস্থায় অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।
আমরা এখানে দুটি প্রশ্ন রাখতে চাই। বাংলাদেশ ব্যাংক কি চাইলেই বাণিজ্যিক ব্যাংকে নগদ টাকা সরবরাহ করতে পারে? আমানতকারীরা যেসব বাণিজ্যিক ব্যাংকে অর্থ ও সঞ্চয় জমা রেখেছে, তাদের সেবার গ্যারান্টি বাংলাদেশ ব্যাংক আগ বাড়িয়ে কেন দিচ্ছে? কেন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো নিজেরা আমানতের নিরাপত্তার ব্যাপারে গ্রাহক যোগাযোগ করেছে না!
সরকারপ্রধানের আগাম দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা, ২০২৩ সালকে কঠিন বছর ঘোষণা করা, বিএনপির সফল বিভাগীয় গণসমাবেশ, দেশের চলমান বিদ্যুৎ-জ্বালানিসংকট, অসহনীয় মূল্যস্ফীতি, ডলার-সংকটসহ বৈশ্বিক মন্দার আভাস ইত্যাদির সম্মিলিত প্রভাবে ভবিষ্যতে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার শঙ্কা আছে, এমন ভয়ে কেউ কেউ ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে ফেলার ভাবনায় তাড়িত হয়ে থাকতে পারেন। এটা ব্যাংকের তারল্য বা নগদের সংকট নয়; বরং আস্থার সংকট।
এমতাবস্থায় নিয়ন্ত্রক বা রেগুলেটর হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত বাণিজ্যিক ব্যাংককে এই বলে সতর্ক করা যে তারা যাতে মাঝারিসহ বড় চেক অনার করার সময় গ্রাহক হয়রানি না করে। যেকোনো নগদায়নকে সহজ করে। কোনো ব্যাংক যাতে প্রবেশপথে বা অর্থ উত্তোলন বুথের সামনে লিখে না রাখে যে, এক লাখ টাকার বেশি উত্তোলনে এত কর্মদিবস আগে জানাতে হবে। ৫ লাখ টাকার বেশি নগদায়নে যাতে গড়িমসি করা না হয়, গ্রাহকদের না ঘোরায়। বড় চেক অনারে যে পজিটিভ পে-স্লিপের ব্যবস্থা আছে, সেটার হয়রানিমুক্ত বাস্তবায়ন হয়। মেয়াদি জমা, ফিক্সড ডিপোজিট কিংবা সঞ্চয়ী স্কিম ভাঙাতে কোনো ব্যাংক যাতে বাধা না দেয়। কোনো ব্যাংকের খারাপ আচরণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব আকারে ছড়িয়ে গেলে আস্থার সংকট গভীর হবে।
সুস্পষ্টভাবে, ব্যাংকিং খাতে অনাস্থা ও তারল্যসংকটের সঙ্গে নীতিগত সমস্যার সংযোগ রয়েছে। মেধাহীন নিয়ম, অর্থ মন্ত্রণালয় নির্দেশিত পলিসি, মূল্যস্ফীতি সহায়ক ভুল মুদ্রানীতি, তারল্যসংকট-সহায়ক আমানত ব্যবস্থা, খেলাপিসহায়ক ঋণদান, দায়হীন অক্ষম নিয়ন্ত্রণ, সরকার দলীয়দের নতুন ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়া, বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালনায় দুর্বৃত্তপনার লাগাম পরানোর শক্তিহীনতাসহ সব কাজকর্মেই বাংলাদেশের ব্যাংকের অক্ষমতার চিত্র ফুটে উঠছে।
মানুষ বাংলাদেশ ব্যাংকে টাকা রাখে না, ফিক্সড ডিপোজিট সঞ্চয় করে না। ফলে গ্রাহক যে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে টাকার বিনিময়ে সেবা চায়, তাকেই সেবার নিশ্চয়তা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত নিজের রেগুলেটরি ক্ষমতা পোক্ত করা, ব্যাংকিং সেবায় কিংবা অর্থ উত্তোলনে হয়রানি হচ্ছে কি না, যেসব যাচাই-বাছাই করে পদক্ষেপ নেওয়া। গ্রাহক যদি বুঝতে পারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সঠিক সময়ে সঠিক নিয়ন্ত্রণটা করছে না, তাহলে তারল্যসংকট না থাকলেও আস্থার সংকট কিছুতেই কমবে না।
আস্থার সংকট কেন? উত্তরটা গভীরে গিয়ে খুঁজতে হবে। কয়েকটা উদাহরণ দিই, ‘দুর্বল ১০ ব্যাংক চিহ্নিত, নাম বলেননি গভর্নর’(ইত্তেফাক ৪ আগস্ট ২০২২)। দুর্বল এই ১০ ব্যাংকের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিগত কয়েক বছরে ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়নি। এ কারণে গ্রাহকের মনে আশঙ্কা জেগেছে, তার ব্যাংকটির কী অবস্থা!
‘৯ ব্যাংক মূলধনও খেয়ে ফেলেছে, ঘাটতি ছাড়াল ১৯ হাজার কোটি টাকা’ ২৮ মার্চ ২০১৮। ‘খারাপ অবস্থায় ১০ ব্যাংক’(১৯ জানুয়ারি ২০২০) বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং নিয়ে সমকাল প্রতিবেদন। ‘ব্যাংক খাতে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা (১৪ নভেম্বর ২০২২, প্রথম আলো)’। ‘বাড়বাড়ন্ত খেলাপি ঋণ’, ‘সব সুবিধা খেলাপিদের জন্যই’ (১৫ নভেম্বর ২০২২, প্রথম আলো)। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব অপব্যবস্থাপনা ও জালিয়াতি থামানোর প্রশ্নে কার্যত অক্ষম ও নিষ্ক্রিয় বলে গণমাধ্যমের এসব খবরে মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট প্রবল হবে, এটাই স্বাভাবিক।
পরিচালকেরা ৬ থেকে ৯ বছর টানা পদে থাকতে পারেন বলে বেসরকারি ব্যাংকে স্বেচ্ছাচারিতা ও জবাবদিহিহীনতা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তাঁরা ঋণদান পদ্ধতিকে অ্যাবিউজ করছে। জাতীয় সংসদে খোদ মন্ত্রী বলেছেন, পরিচালকেরা নিজেদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করে লক্ষকোটি টাকার কাছাকাছি খেলাপি করেছে। বেসরকারি ব্যাংকে এক পরিবারের চার পরিচালক অনুমোদনের আইন সরকার করেছে। যেকোনো রাজনৈতিক-সংকটে এসব পারিবারিকভাবে পরিচালিত ব্যাংকের ব্যাপারে মানুষের আশঙ্কা আছে। যদি সম্ভাব্য সরকার পরিবর্তন কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে আমানত গায়েব করে মালিক-পরিচালকেরা পালিয়ে যান, তাহলে আমানতের কী হবে!
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম ১৫ নভেম্বর প্রথম আলোতে লিখেছেন, ‘গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার যে হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, তা মোটেও সঠিক নয়। অবলোপন করা ঋণ, আদালতে মামলা চলছে এমন ঋণ এবং বারবার পুনঃতফসিল করা ঋণের হিসাব খেলাপি ঋণে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। সব মিলিয়ে দেখলে বর্তমানে খেলাপি ঋণ চার লাখ কোটি টাকার বেশি হবে। খেলাপি ঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে।’
অভিযোগ আছে, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা এখন সরাসরি ব্যাংক দেয় না। বাংলাদেশ ব্যাংকে রিকুইজিশন দিয়ে আনতে বাড়তি সময় লাগে। পদ্ধতিগত ঝামেলায় অনেকে বেকায়দায় পড়ছেন, বিভ্রান্তও হচ্ছেন। এদিকে ডলারের বাস্তব সমস্যার কারণে, পণ্য আমদানির এলসি বা ঋণপত্র বন্ধে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা সমস্যায় আছে। এই সব মিলে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর অনাস্থা আসলে এমনি এমনি আসেনি।
বাংলাদেশে কয়েক বছর থেকেই ব্যাংক আমানতের সুদের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি। ফলে ব্যাংকে টাকা রাখলেই লোকসান। ব্যাংকে টাকা রাখলে গড়ে সুদ পাওয়া যায় ৪ শতাংশের সামান্য বেশি, অথচ সরকারি হিসেবেই মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি, বেসরকারি হিসেবে আরও বেশি। বছর শেষে প্রকৃত বিচারে আমানতকারীর কোনো লাভ নেই, বরং সরকারের কর কর্তনের পরে দ্বিতীয় ধাপে লোকসান হয়! ব্যাংকে টাকা রাখলে যদি সেটা কমে যায়, মানুষ অর্থ উঠিয়ে ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত দ্রুত ব্যাংকিং খাতে দুর্বৃত্তপনা বন্ধ করে, আমানতে সুদের হার বাড়িয়ে, খেলাপি ঋণ বন্ধ করে, প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্যের বিপরীতে সঠিক ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করে, ব্যাংকের পুলিশি আচরণ বন্ধ করে, ব্যাংক আমানতে কর কমিয়ে, সঞ্চয়ে সুদ বাড়িয়ে আস্থা তৈরি করা, গ্রাহকের আমানত সুরক্ষা করার দায়িত্ব নেওয়া। অর্থহীন সস্তা কোনো বিজ্ঞাপন না দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিচালন ও নীতিগত কাজে মনোযোগ দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলেই বাণিজ্যিক ব্যাংকে এ ভাবে টাকা দিতে পারে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকের নগদের সংকট হলে প্রথমে অন্য ব্যাংক থেকে কলমানি রেটে টাকা ধার করবে। সেখানেও না পেলে স্থায়ী আমানতের বিপরীতে একটা হারে সুদে ও শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করবে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক যে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, সেটার সরল অর্থ অনেকেই ভিন্নভাবে নিতে পারে। চলমান তারল্যসংকটের কিছু কাঠামোগত কারণও আছে।
বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই নিয়মবহির্ভূতভাবে সরকারের বন্ড কিনে নিয়ে সরকারকে টাকা ছাপিয়ে দিচ্ছে, অথচ বন্ড কেনার কথা বেসরকারি ব্যাংকের। বিধিবিদ্ধ প্রক্রিয়ায় না গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থ ছাপানো দেশে মূল্যস্ফীতি তৈরি করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিবি কি সরকারকে বন্ড ফিরিয়ে দিয়ে সমপরিমাণ অর্থ ‘মানি মার্কেটে’ ফেরত দিতে পারছে?
বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকটে কারখানা বন্ধ হয়ে বেকারত্ব বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ করতে বাধ্য হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির বিপরীতে সুদের হার অন্তত অর্ধেক বলে আমানতকারীরা ব্যাংকে টাকা রাখতে আগ্রহী হচ্ছেন না। একদিকে নগদায়ন বাড়ছে, অন্যদিকে নতুন জমার হার কমেছে বলে ব্যাংকে তারল্য কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকে বা খোলা বাজারে ডলার বিক্রি করছে বলেও বাণিজ্যিক ব্যাংকের তারল্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে যাচ্ছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকে নতুন সম্পদ তৈরি না হলে এই অর্থ কেন্দ্রীয় থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকে এমনি এমনি ফিরবে না।
তারল্য ফেরাতে বাণিজ্যিক ব্যাংককে বৈদেশিক রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় বাড়তে হবে। কিংবা বেসরকারি বিদেশি ঋণ আনতে হবে, চলতি বছরে ১৮ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণের দায় বকেয়া রেখে নতুন বৈদেশিক ঋণ কঠিন। রপ্তানি আয় বাড়িয়ে ডলার আয় বাড়ালে, প্রবাসী আয় বাড়ালে—নতুন সম্পদ হিসেবে ডলারের বিপরীতে ব্যাংকে নতুন টাকা আসবে বা তারল্য তৈরি হবে। কিন্তু ব্যাংক রেটের ওপর অনাস্থায় রেমিট্যান্স হুন্ডিতে চলে যাচ্ছে। সেপ্টেম্বরের পর অক্টোবরেও প্রবাসী আয় কমেছে, অক্টোবরে আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় (৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম) এসেছে। ইপিবির হিসেবে অক্টোবরে রপ্তানি আয়ও গত বছর একই মাসের তুলনায় কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। (প্রথম আলো ৩ নভেম্বর)।

এমতাবস্থায় অভ্যন্তরীণ আমানত বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়ে, এবং খেলাপি ঋণ ফেরত এনে তারল্যসংকটের কাঠামোগত সমাধান ছাড়া বিকল্প নেই। বাণিজ্যিক ব্যাংককে অবশ্যই মূল্যস্ফীতির হারের বেশি বা অন্তত সমান হারে সুদ দিতে হবে। না হলে ব্যাংক দেউলিয়ার ঝুঁকিতে না পড়লেও নগদায়ন বাড়বে। তারল্যসংকট সমাধানের প্রধান খাত দুর্বৃত্তায়িত প্রশ্রয়ে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তৈরি করা খেলাপি ঋণ ফেরানো।
খেলাপি ঋণ না ফিরিয়ে ‘ব্যাংকে টাকার সংকট হলে দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক’—এ কথা বলার অর্থ ভালো না। এর অর্থ এমনও হতে পারে, একদিকে বিশেষ মালিকানাধীন ব্যাংকের ঋণ ইচ্ছাকৃত খেলাপি করা হবে, অন্যদিকে সরকার জনগণের টাকা বেইল আউট করে অসৎ মালিকদের ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখবে। অতীতে সরকারি ব্যাংক থেকে ঋণ দিয়ে মূলধন খেয়ে ফেলা বেসরকারি ব্যাংক বাঁচিয়ে রাখার ঘটনা দেখেছি। সরকার পরিবর্তন হলে কিংবা দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা হলে এসব ব্যাংকে রক্ষিত আমানতের কি হবে, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে ভয় আছে। তাই বাংলাদেশের ব্যাংকের উচিত সস্তা বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে, ‘কীভাবে ব্যাংকে টাকা রাখাকে লাভবান করা যায়’—সে ব্যবস্থা করা।

সুস্পষ্টভাবে, ব্যাংকিং খাতে অনাস্থা ও তারল্যসংকটের সঙ্গে নীতিগত সমস্যার সংযোগ রয়েছে। মেধাহীন নিয়ম, অর্থ মন্ত্রণালয় নির্দেশিত পলিসি, মূল্যস্ফীতি সহায়ক ভুল মুদ্রানীতি, তারল্যসংকট-সহায়ক আমানত ব্যবস্থা, খেলাপিসহায়ক ঋণদান, দায়হীন অক্ষম নিয়ন্ত্রণ, সরকার দলীয়দের নতুন ব্যাংক লাইসেন্স দেওয়া, বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালনায় দুর্বৃত্তপনার লাগাম পরানোর শক্তিহীনতাসহ সব কাজকর্মেই বাংলাদেশের ব্যাংকের অক্ষমতার চিত্র ফুটে উঠছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক দুর্বৃত্ত মালিকানা, রাজনৈতিক প্রশাসনের ভূত সরিয়ে, সরকারের ছায়া কেটে একটা স্বাধীন ও সক্ষম প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হোক, এটাই দেশের মানুষের চাওয়া।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য। [email protected]

11/12/2022

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জন ও উত্তরণ প্রসঙ্গে

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
১১ ডিসেম্বর, ২০২২
কালেরকণ্ঠ

বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মোটামুটি একটি পর্যায়ে এসেছে। বিশেষ করে ১৯৯০ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে নানা উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মূলত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ দুটি সূচক আমাদের অর্জিত হয়েছে। একটা হলো, আমরা উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছেছি।
বিজ্ঞাপন
আরেকটা হলো, আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছেছি। আমরা যে অর্থনৈতিক অর্জনটা করেছি, তার কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আমরা কিভাবে ভবিষ্যতে এগোতে পারি, সেটা এখন বিবেচ্য বিষয়।
আমাদের তিনটা বিষয়ের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। প্রথমত, আমরা যে অর্জনটা করছি সেটার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশ ছোট্ট একটা ভূখণ্ড। কিন্তু বিশাল জনসংখ্যার দেশ। অনেকে বলেছিল, এটা একটা উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হবে না। উন্নতি করতে পারবে না, এটা তলাবিহীন ঝুড়ি। আবার কেউ বলেছে, উন্নয়নের একটা পরীক্ষা। সেটা ছিল সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। বিশেষ করে বাংলাদেশের লোকের যে সামর্থ্য ও যোগ্যতা-আকাঙ্ক্ষা, সেগুলো তারা বিচার করতে পারেনি। এখন এই পর্যায়ে আসার পরে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা এসেছি। এখন আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে।
kalerkanthoপ্রথম থেকেই আমরা দেখেছি যে দেশের সার্বিক উন্নয়ন; বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে কতগুলো উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে সবুজ বিপ্লব, কৃষি বিপ্লব—এগুলোর সঙ্গে ধীরে ধীরে আমরা মার্কেট ইকোনমি অর্থাৎ বাজার অর্থনীতির দিকে এগোলাম। তখন শিল্প বিকশিত হচ্ছিল। ছোট ছোট শিল্প দিয়ে শুরু। আস্তে আস্তে আমরা বড় শিল্প, বিশেষ করে গার্মেন্টশিল্প বিকশিত হলো।
বিভিন্ন রাস্তাঘাট নির্মিত হওয়া এবং দ্রুত অবকাঠামো তৈরি করে করে আমরা কতগুলো ধাপ পার করে এসেছি। সেখানে অবশ্য কতগুলো দিক ছিল; আমরা প্রবৃদ্ধির দিকে বেশি নজর দিচ্ছিলাম। কিন্তু আমরা ডিস্ট্রিবিউশন বা ইকুয়ালিটি কিংবা সমতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিইনি। এখনো যে দিচ্ছি তা না। প্রেক্ষিত আছে কিন্তু আমাদের সেটা প্রভাবিত করেছে। অনেকে এটাকে বলে মডেল। আবার অনেকে বলে বিস্ময়কর বা আশ্চর্য ঘটনা। এগুলো বলার কারণ হলো, মডেল বলে এ জন্য যে মোটামুটি ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিস্ময়কর বলে এ কারণে যে এখানে সম্পদের অপ্রতুলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক নানা রকম অস্থিরতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও কিন্তু আমরা এগোচ্ছি। এ জন্য অনেকে বলে যে উন্নয়নের চমক। আমরা যে পুরোপুরিভাবে খুব একটা টেকসই উন্নয়নে আছি সেটাকে নির্দেশ করে না।
কারণ এখানে আমাদের ঝুঁকিটা কিন্তু রয়ে গেছে। প্রথম ঝুঁকি হলো, আমাদের যে অর্থনৈতিক উন্নয়নটা হচ্ছে, সেটা যেকোনো সময় বাইরের দেশের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। যেটা এখন হয়েছে। যেমন ধরুন মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। রপ্তানিতে সমস্যা আছে। রেমিট্যান্স খুব একটা বাড়ছে না। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এগুলো আমাদের বড় ধরনের নাড়া দিয়েছে। এসবের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ কারণেও ঝুঁকি দেখা দিয়েছে, যেমন—আমাদের ব্যাংকিং খাতে সমস্যা আছে। পুঁজিবাজারে সমস্যা আছে। দুর্নীতি, মুদ্রাপাচারের সঙ্গে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলার অভাব আছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতার অভাব আছে। সব মিলিয়ে আমরা একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছি। এই ঝুঁকিগুলো কিন্তু আমরা কাটিয়ে উঠতে না পারলে উত্তরণের পথে সেটা বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।
আমাদের অর্জন কিন্তু কম নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটেছে। একসময় কৃষি খাতের যে বিরাট একটা অবদান ছিল, সেটা এখন ২০-২২ শতাংশের বেশি নেই। কৃষি কিন্তু আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ডের মতো। বিশাল একটা জনশক্তি এটার ওপর নির্ভর করে। গ্রামীণ অর্থনীতির একটা রূপান্তর হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি এখন শুধু শস্য উৎপাদন কৃষিনির্ভর নয়। পণ্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছে। হাঁস, মুরগি, মাছের খামার হয়েছে। আমাদের মাছ রপ্তানিও করা হচ্ছে।
গ্রাম ও শহরের যে ভৌগোলিক পার্থক্যটা ছিল এখন কিন্তু আগের মতো সুস্পষ্ট নয়। তবে কিছুটা পার্থক্য আছে। যেমন—ঢাকা শহর বা বড় শহরে যা আছে, তা গ্রামে নেই। গ্রামে ভালো হাসপাতাল নেই। যথাযথ শিক্ষাব্যবস্থা নেই। ভালো বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। সেখানে ঘাটতি আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন করার ক্ষেত্রে যে সম্ভাবনা, সেটা কিন্তু আছে। গ্রামকে আর শহরকে আলাদা করে না দেখা প্রয়োজন। গ্রাম যে শহরের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং দুটির যে পারস্পরিক সম্পর্ক, এটা কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীমূলক উন্নয়ন নিয়ে কথা হচ্ছে। আমাদের ৫০ শতাংশের বেশি লোক কিন্তু ব্যাংকিংব্যবস্থার ভেতরে নেই। আমি বলব, আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিংব্যবস্থার ভেতরে নেই। অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থার ভেতরে আছে। ক্ষুদ্রঋণ, সেভিংস সোসাইটি, তারপর সঞ্চয়, সমবায়ের ভেতরে এরা আছে। কিন্তু ব্যাংকে নেই। অন্তর্বর্তীমূলক অর্থনীতির সুযোগ কিন্তু সাধারণ মানুষের এখনো নেই। বিশেষ করে ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতারা কিন্তু এখনো ঋণ নেওয়ার সুবিধা পায় না।
দ্বিতীয়ত, মফস্বল বা অনেক লোক জানেই না কী সুবিধা পাওয়া যায়। এখানে একটা ইনফরমেশন গ্যাপ আছে। তথ্যের অভাব আছে। মানুষ যদি না জানে সরকার কী সার্ভিস দিচ্ছে, তাহলে কিন্তু মানুষ সে সার্ভিসটা নিতে পারবে না। এই যে তথ্যের অবাধ প্রবাহ, তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া; সেটা যথেষ্ট নয়। অতএব অন্তর্বর্তীমূলক যে উন্নয়ন, আর্থিক ঋণ পাওয়ার সুযোগ, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য খাতে সুযোগ, সেটা কিন্তু অনেক কম হচ্ছে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আমাদের আয় ও সম্পদের বৈষম্য দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু সবচেয়ে বড় জিনিস হলো যে ব্যবধানটা বেড়ে যাচ্ছে। অনেকে বলবে, গরিব ও গ্রামের লোকদের তো আগে মোবাইল ফোন ছিল না, তারা আধুনিক ছিল না। গ্রামে এখন ব্যায়ামাগার আছে। এখন নাকি গ্রামে বিউটি পার্লারও আছে। এগুলো কোনো ব্যাপার না। এগুলো ছাড়া তাদের সুবিধা আছে, যাদের অর্থ আছে, বিশেষ করে গ্রামে যাদের সন্তানরা বিদেশে আছে, তারা টাকা পাঠায়। তারা এই ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিতে পারে। গ্রামে গিয়ে দেখুন, অন্যরা আবার সেই সুবিধাগুলো নিতে পারে না। অতএব এই বৈষম্যটা যদি আমরা দূর না করি, তাহলে এটা আমাদের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্যই ছিল রাজনৈতিক স্বাধিকার এবং অর্থনৈতিক মুক্তি। এবং সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক উন্নয়নের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, কোয়ালিটি অব লাইফ, এডুকেশন, হেলথ, তথ্য পাওয়ার অধিকার ও নীতিনির্ধারণ করার ক্ষেত্রে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু এগুলো আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি। এই জিনিসগুলো নিশ্চিত করতে হবে।
আমি মনে করি, কতগুলো বিশেষ জিনিস আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। প্রথম হলো, আমাদের যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে, অতিদ্রুত যদি সেগুলোর মোকাবেলা আমরা না করি, তাহলে দেখব হঠাৎ করে আমরা খাদের কিনারে পৌঁছে গেছি। একবার খাদের মধ্যে পড়ে গেলে ওঠার আর কিছু থাকবে না। অতএব আগেই কিন্তু প্রস্তুতিগুলো নিতে হবে। দ্রুত দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের সক্ষমতার অভাব আছে। দ্বিতীয়ত, স্বচ্ছতা-জবাবদিহির অভাব আছে। তৃতীয়ত আছে সুশাসনের অভাব। এই তিনটি বিষয়—সক্ষমতা, স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।
সমস্যা নিয়ে কথা বলা হয় যাক। যেমন—আমাদের গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি। আমাদের প্রডাক্টিভিটি ও দক্ষতা কিন্তু অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু গার্মেন্ট সেক্টরে আমরা উত্তরোত্তর ভালো করছি। আর ডিজাইন, ওরা তো এটা দিয়েই দেয়। আর গুটিকয়েক লোক ব্যাংকের ঋণ পায়। সহায়তা পায়। অন্যগুলো কিছুটা পাচ্ছে—চামড়া, সিরামিকস, তারপরে পাট। এগুলো ঋণ পাচ্ছে, কিন্তু সেটা খুব বেশি না।
দ্বিতীয়ত, এটা আমি আগেই বলেছি, এটা ব্ল্যাক হোল। খাদের কিনারে চলে আসা এবং সমস্যা সমাধান না হলে খাদে অর্থাৎ অন্ধ গহ্বরে পতিত হওয়া।
তৃতীয়ত হলো, বৈষম্য ও সামাজিক নিরাপত্তা, সোশ্যাল সিকিউরিটি; আমরা বৃদ্ধ ও বিধবাদের ভাতা দিচ্ছি, এটা আসলে একটা বিশেষ শ্রেণির জন্য। এবং ভাতাটা যে খুব বেশি, তা নয়। অতএব, সর্বজনীনভাবে যারা দরিদ্র লোক, যাদের আয়ের সংস্থান কম, যারা কর্মহীন; তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সামাজিক নিরাপত্তার বলয় সম্প্রসারণ ও কার্যকর করতে হবে।
সার্বিকভাবে সামষ্টিক নীতি, বাজেট-রাজস্বনীতি, তারপর মুদ্রানীতি, আমাদের এক্সপোর্টের নীতি আছে, বাণিজ্যনীতি—আমরা যে নীতিগুলো নিয়ে থাকি সেগুলো নেওয়া এক জিনিস আর কৌশলগুলো নির্ধারণ করা আরেক জিনিস। সবচেয়ে বড় জিনিস হলো কৌশলগুলো বাস্তবায়ন করা। আমাদের বাজেটে অনেক কার্যক্রমের আশ্বাসের কথা বলা হয়, পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়িত হয় না। এডিবির অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হয়, বহু প্রজেক্ট আছে সেগুলো সময়মতো শেষ হয় না।
মাইক্রোলেভেলে এবং স্থানীয় পর্যায়ে মোটামুটি লোকজন চেষ্টা করছে। নিজেদের জীবনের সংগ্রামে কৃষক, শ্রমিক, তাঁরা নিজস্ব তাগিদে কিন্তু অনেক কিছু করে যাচ্ছেন। কোনো কিছুই থেমে থাকছে না। সরকার যদি সহায়তা করে, ভালো। সরকার যদি অ্যাফিশিয়েন্ট হয়, সরকার যদি ঠিকভাবে শাসন করে; মানুষের যে সৃজনশীলতা, তাদের যে উদ্যম সেটা কিন্তু আরো বিকশিত হয়। অর্থাৎ যতটুকু প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হওয়ার আমাদের সম্ভাবনা আছে। সেই সম্ভাবনার জন্য আমাদের কিছু বিষয় স্বীকার করতে হবে। বিশ্লেষণ করে বের করতে হবে কী কী ভুল ছিল। উত্তরণের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। সমস্যাগুলো স্বীকার করতে হবে। দ্রুত সমাধানের দিকে যেতে হবে। এবং জনগণকে সঙ্গে নিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের কথা শুনতে হবে।
লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
অনুলিখন : রায়হান রাশেদ

16/11/2022

মাইক্রোসফট পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন তৈরির ১১টি কার্যকরী টিপস! 💻

ইউনিভার্সিটির প্রেজেন্টেশন কিংবা কর্পোরেট জগতের আইডিয়া পিচিং সেগমেন্ট- আপনার অতি সাধারণ আইডিয়াগুলোও অসাধারণ করে তোলে মাইক্রোসফট পাওয়ারপয়েন্ট। মাইক্রোসফট পাওয়ারপয়েন্ট -এর কথা ক্লাস সিক্স থেকে স্কুলের আইসিটি বইয়ে জেনে আসলেও, আমাদের বেশিরভাগেরই এইটা ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে। এটা এমন একটা সফটওয়্যার, যার মাধ্যমে কোনো বক্তব্য, ব্রিফিং, বিজ্ঞাপন, ডাটা, গ্রাফ, চার্টের উপর অ্যানিমেশন, ট্রানজিশন বা ইফেক্ট এপ্লাই করে প্রেজেন্টেশন তৈরি করা যায়।
জেনে অবাক হবেন প্রতিদিন ৩০ মিলিয়নেরও বেশি পাওয়ারপয়েন্ট Presentation বানানো হয়,এবং তার মধ্যে ৮০% এরও বেশি হয় নিম্নমানের। আপনার প্রেজেন্টেশান ওইসব ৮০% এর মধ্যে নয় তো? কীভাবে আমরা ভাল একটা Presentation বানাতে পারি সেটা নিয়ে মূলত আলোচনা করব। প্রফেশনাল কাজের জগতে মাইক্রোসফট পাওয়ারপয়েন্ট -এর গুরুত্ব নতুন করে বলার কিছু নেই। কর্পোরেট জগতে অফিস সফটওয়্যারগুলোর পুরোপুরি বিকল্প আজ অবধি বাজারে আসেনি।

আর পাওয়ারপয়েন্টের যেকোনো স্লাইডের গুরুত্ব বহুলাংশ নির্ভর করে তার আউটলুক এবং উপস্থাপনার উপর। একই লেখা কেউ সুন্দর করে উপস্থাপন করে সবার প্রশংসার পাত্র হতে পারে, সেই কথাই আবার উপস্থাপনা দৈন্যদশার দরুন সবার হাসির খোরাকও হতে পারে! তাই পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন তৈরির ১১টি কার্যকরী টিপস নিয়েই আজকের এই ব্লগ।

🔴 ফন্টে নজর দিন
একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন তৈরি করার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে লেখাটুকু আর লেখার দ্বারা ঠিকঠাক বার্তা যাচ্ছে কিনা এটা নিশ্চিত করে তার ফন্ট। বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টে দেখা গেছে যে, ফন্টের দ্বারা কথার টোন পর্যন্ত বদলে যেতে পারে। ফন্টের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় খুব খেয়াল রাখতে হবে। তা হলো ফন্ট এমবেড করা। অনেকসময়ই দেখা যায় প্রেজেন্টেশন শেয়ার করার দরকার পড়ে, তখন যাতে অন্যের পিসিতে স্লাইডের লেখাগুলো ফেটে না যায়, সেজন্য এটি খুবই কার্যকরী পদ্ধতি। আরেকটি বিকল্প হতে পারে প্রেজেন্টেশন সব সময় পিডিএফ হিসেবে একটা কপি সেভ করে রাখা, কোনো অনিচ্ছাকৃত কারণে ডাটা করাপ্ট হলেও যেন ব্যাক-আপ থাকে।

🔴 ডিজাইনের আগে দরকার লিখে নেয়া
থ্রি সিক্সটি এইট নামে একটি ডিজাইন এজেন্সির সিইও কেনি নগুয়েন বলেন, একটি পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে বক্তার বলাকে সাহায্যটুকু করে থাকে। অর্থাৎ এটা আপনার মাথায় রাখতে হবে যে, স্লাইড কিন্তু কখনই বক্তব্যের বিকল্প নয়। তাই ডিজাইন যদি একশতে একশ থাকে, আর আসল স্পিচ তথৈবচ হয়, তাহলে কিন্তু চলবে না। এজন্যই বলা হয়, ডিজাইনের আগে দরকার হল মূল বিষয়বস্তু লিখে নেয়া, আসল স্পিচ রেডি রাখা। দরকারে হ্যান্ডনোট ব্যবহার করা।
হাতে-কলমে, কাগজে এই গ্রাউন্ডওয়ার্ক করা যেতে পারে, এতে আসল রাফ বিষয়াদি সেরে যায়। রাফ সাজানোর জন্য প্রতি পেজের জন্য একটি করে হেডলাইন দিয়ে লেখা শুরু করতে পারেন, এরপর যা যা মাথায় আসে সব এলোমেলো চিন্তাগুলো খাতায় প্লট করে ফেলুন। রাফ পাতায় সব উগড়ে দেয়ার পর, ঠাণ্ডা মাথায় সাজিয়ে নিতে পারেন। এতে কোনো পয়েন্ট আর বাদ যাবে না।

🔴 চিত্র এবং লেখার মাঝে প্রতিসমতা নিশ্চিত করা
আমেরিকান বিজ্ঞানী অ্যালান লাইটম্যান বলেন, মানবমস্তিস্ক প্রতিসমতার মাঝে ভালো কাজ করতে পারে। তিনি আরও বলেন, এর কারণটা কিছুটা মনস্তাত্ত্বিক, প্রতিসমতা বিভিন্ন বস্তুর মাঝে একটি নিয়মতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। আর আমরা এমনভাবেই ডিজাইন করা যাতে যেকোনো অর্ডার (নিয়মতন্ত্র) মেনে চলা সহজ হয়। তাই স্লাইডের মধ্যের অবজেক্টগুলো যাতে প্রতিসম থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটা অবজেক্টের মাঝের প্রতিটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ একটা একটা সিলেক্ট করে অ্যালাইন করা কঠিন, এর থেকে সবগুলো একসাথে সিলেক্ট করে অ্যালাইন করা বেশি সময়সাশ্রয়ী।

🔴 স্লাইডে অডিও যোগ করা যেতে পারে
কিছুদিন দারুণভাবে ব্যবহার করতে পারলে দেখবেন, এটাই আপনার প্রেজেন্টেশনের সবথেকে পছন্দের পার্ট হয়ে যাবে। এই অংশেই সবচেয়ে সৃজনশীল হওয়া যায়। আলতু ফালতু অডিও মোটেও যোগ করা যাবে না, যেটা বক্তব্যের টোনের সাথে যায়, এমন কিছুই যোগ করবেন। সর্বদা মনে রাখতে হবে যে, অডিও যেন কোনোমতেই বক্তব্যের থেকে বেশি লাউড হয়ে না যায়। লঘু চালের হোয়াইট ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ দিতে পারেন, এমন মিউজিক অনলাইন থেকে সহজেই নামিয়ে নিতে পারবেন।

🔴 ফেইড অ্যানিমেশন হতে পারে সহজ সমাধান
স্লাইডের শুরুতে এবং শেষে ইন্ট্রো আর আউট্রো নিয়ে চিন্তিত? সমাধান খুঁজে পাচ্ছেন না? ফেইড অ্যানিমেশন হতে পারে আপনার মহৌষধ। কারণ ফেইড ইফেক্ট যেমন আপনার স্লাইডকে করবে স্মুদ, তেমনি দেখার এক্সপেরিয়েন্সটাকেও আরও শাণিত করবে। এই একই কথা কিন্তু খাটে ভিতরের এলিমেন্টগুলোর জন্যও। যেখানেই কোনো জেনেরিক সল্যুশন দরকার, ফেইড ব্যবহার করে দিতে পারেন নিশ্চিন্তে।
তাই বলে আবার একটা স্লাইডের সবকিছুতেই ফেইড দিবেন না, কোথায় লাগামটা টানতে হবে এটা ঠিক করতে হবে আপনাকেই। পরিমিত ব্যবহার করলেই এক ধরনের ওয়ান স্টপ সল্যুশন হয়ে যেতে পারে এই ফেইড অ্যানিমেশন।

🔴 নিজস্ব অ্যানিমেশন বানিয়ে নিন
সুনির্দিষ্ট কোনো ডিজাইনের দরকার? যা অন্য কোথাও মিলছে না? আপনার মাথায় আইডিয়াটা ঘুরছে কিন্তু সেই টেম্পলেট বিভিন্ন জায়গায় হন্যে হয়ে খুঁজেও পাচ্ছেন না? সহজ সমাধান, নিজেই বানিয়ে ফেলুন! হ্যাঁ, নিজের ওপর আস্থা রাখুন, এমনও হতে পারে, এক্সিস্টিং টেম্পলেটগুলোর থেকে আপনার বানানো কাস্টমমেড অ্যানিমেশনটাই বেশি ভালো লাগছে।
এজন্য যা করবেন, অ্যাড অ্যানিমেশন থেকে মোশন পার্টস, তারপর কাস্টম পাথসে গিয়ে নিজের দরকারমত ডিজাইন দিয়ে দিন। আঁকা শেষ হলে এস্কেপ বাটন চেপে বেরিয়ে আসুন। ব্যস, তৈরি হয়ে যাবে আপনার কাঙ্ক্ষিত অ্যানিমেশন! আবার ওখানে আগে থেকে দিয়ে রাখা মোশন পাথগুলো থেকেও এডিট করে করতে পারেন, যেভাবে আপনার সুবিধা হয়, সেটিই করবেন আরকি।

🔴 পাওয়ারপয়েন্টের সাইজ কমিয়ে ফেলুন
এত পরিশ্রম করে সুন্দর একটা মাইক্রোসফট পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানালাম আর তারপর বড় সাইজের বিড়ম্বনায় কাউকে সেন্ড করতে পারছি না, এই সমস্যায় হামেশাই আমাদের পড়তে হয়, তাইনা? এখন বলছি তার সমাধান। সবগুলো ছবিকে কমপ্রেস করে সাইজ অনেকটা কমিয়ে ফেলা যায়।
এর জন্য যেতে হবে, ফরম্যাট, তারপর কমপ্রেস পিকচার, তারপর একটা ছবিতে কমাতে চাইলে তো কাজ শেষ। কিন্তু মজার বিষয় হল, এখানেই একবারে সবগুলো ছবির সাইজ কমপ্রেস করে ফেলা যায়, শুধু অ্যাপ্লাই অনলি টু দিস পিকচার এই অপশনটা ডিসিলেক্ট করে দিলেই হবে!
আরেকটা টোটকা বলি, স্লাইড একদম রেডি হয়ে গেলে, যখন দেখবেন আর কোনো প্রকার এডিট দরকার নেই, সেসময় নিশ্চিন্তে পিডিএফ আকারে সেভ করে ফেলুন! বুম, দেখবেন সাইজ অনেকটাই কমে গেছে। কাহিনি এখানেই শেষ নয়, আইলাভপিডিএফ ডট কম বা অ্যাডোবি অ্যাক্রোব্যাট প্রো… এদের কোনো একটির সাহায্যে এই পিডিএফের আকারও অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারবেন! আর যদি প্রোজেক্টরে দেখানোর জন্য বানিয়ে থাকেন, সবশেষে ১৫০ ডিপিয়াই দিয়ে ওয়েব ভার্সন হিসেবে সেভ করে রাখতে পারেন। আর ফাইনালি ইমেল করতে হলে ৯৬ ডিপিয়াইই যথেষ্ট! তাই, সাইজ নিয়ে দুশ্চিন্তা- আর না, আর না!

🔴 দরকারে ভিডিওতে কনভার্ট করুন
হাবস্পটের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রেজেন্টেশনে ভিডিওর ব্যবহার শুধু কার্যকরীই নয়, বরং দর্শকপ্রিয়ও। তাই নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা যেতে ভিডিও। আর হ্যাঁ, স্লাইডকে ভিডিও বানানো কিন্তু খুব একটা কঠিন কাজ নয়। তুড়ি মেরে করে ফেলুন, স্লাইডটি শুধু ভিডিও হিসেবে সেইভ দিয়েই! তবে একটা জায়গায় সাবধান, স্লাইড দেখে দেখে একটু যাচাই বাছাই করে টাইমিংটা দিবেন। নচেৎ দেখা যাবে, কোথাও লেখা না বুঝে উঠতেই পার হয়ে যাবে, আর কোথাওবা বসে থাকতে থাকতে দর্শক বিরক্ত হয়ে যাবে। এ অংশটা ঠিকঠাক করতে পারলেই অসাধারণ দর্শকনন্দিত ভিডিও তৈরি! সাথে হালকা চালে একটা থিম মিউজিক দিয়ে দিলেন নাহয়, একদম লা’জবাব প্রেজেন্টেশন হাজির।

🔴 গ্রাফ-চার্ট ব্যবহারে সবকূল রক্ষা হয়
এটা আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই জানি যে, যেকোনো বিষয়েরই তথ্য যখন টেক্সটের আকারে আসে তখনকার চেয়ে লোকজন পড়তে বা দেখতে পছন্দ করে যখন তা কোনো গ্রাফ বা পাই চার্ট অথবা বার ডায়াগ্রামের মাধ্যমে প্রদর্শন করা হয়। এজন্যে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন তৈরি করার সময় স্লাইডের মাঝে কিছু গ্রাফ বা চার্ট ব্যবহার করা সবসময়ই পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। এতে যেমন তথ্য সুন্দর করে উপস্থাপনও করা যায় সাথে দর্শকও খুশি থাকে। তাই সবকূলই রক্ষা হয় আরকি!

🔴 ব্যাকগ্রাউন্ড মুছে ফেলা
প্রেজেন্টেশনের জন্য স্লাইডে অনেকধরনের ছবি যুক্ত করতে হয়। তার মধ্যে অনেক ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড নিষ্প্রয়োজন। বরং সেসব ছবি ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াই প্রেজেন্টেশনের সাথে আকর্ষণীয় মনে হয়।
সাধারণত এই ব্যাকগ্রাউন্ড রিমুভ করার কাজগুলোর জন্য আমরা ফটোশপের সাহায্য নিয়ে থাকি। তবে আপনি চাইলে সহজেই মাইক্রোসফট পাওয়ারপয়েন্ট ব্যবহার করেও কোনো ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড মুছে দিতে পারবেন।
যেই ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড রিমুভ করতে চান, তা আগে স্লাইডে ইম্পোর্ট করুন। তারপর ছবিটি সিলেক্ট করে Format ট্যাবের Picture Tools এ যান এবং সেখান থেকে Remove Background অপশনে ক্লিক করুন। এবার আপনার সিলেক্টকৃত ছবির পিছনে গোলাপি রঙয়ের একটি রেঞ্জ আসবে। এই রেঞ্জের মধ্যে যা যা থাকবে, পাওয়ারপয়েন্ট তা সব মুছে দিবে। এই রেঞ্জ আপনি নিজেও সিলেক্ট করে নিতে পারবেন।

🔴 আনসেভড ফাইল উদ্ধার:
অনেকসময় দেখা যায়, কাজ করতে যেয়ে অন্যমনস্কতার কারণে আমাদের এত কষ্টে তৈরি করা প্রেজেন্টেশন ফাইলটা ডিলিট হয়ে গিয়েছে। ফটোশপ কিংবা মাইক্রোসফট ওয়ার্ডে ডিলিট হয়ে যাওয়া বা সেভ না করা ফাইল রিকোভার করা একটু কঠিন হলেও, মাইক্রোসফট পাওয়ার পয়েন্ট -এ এই কাজটা খুবই সহজ।
মাইক্রোসফট পাওয়ারপয়েন্ট -এ যেয়ে ফাইলটি ওপেন করুন। সেখানের ডান পাশের অংশে আপনার সেভ করা সবগুলো ফাইল পাবেন। স্ক্রল করে একটু নিচের দিকে নামতেই দেখবেন 'Recover Unsaved Presentations' নামের একটা অপশন আছে। ব্যস, এক ক্লিকেই আবার সব ফিরে পাবেন!

29/10/2022

দেশকে উপনিবেশে পরিণত করেছে ধণিক শ্রেণি।

21/10/2022

মূল্যস্ফীতি সামলাব কীভাবে?

মামুন রশীদ
২১ অক্টোবর ২২
সমকাল

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া এবং জ্বালানি তেলের কভিড-পরবর্তী মূল্যবৃদ্ধিতে প্রায় গোটা বিশ্বই উচ্চ পণ্যমূল্যজনিত সমস্যায় ভুগছে। যুদ্ধ বা কভিড পরিস্থিতি ছাড়াও মূল্যস্টম্ফীতির কারণ হিসেবে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি, চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হ্রাস কিংবা আমদানি বৃদ্ধি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা মেটানোকে দায়ী করা হচ্ছে।
অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী মূল্যস্টম্ফীতি মূলত 'কস্ট পুশ' বা 'ডিমান্ড পুশ'। তবে ইদানীংকালে একদিকে বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি, অন্যদিকে আয় কমে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরও প্রতিকূল। এ পরিস্থিতিতে উন্নত দেশগুলোর প্রায় সবাই সুদের হার বাড়িয়ে ও মুদ্রার সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্টম্ফীতি বাগে আনতে সফল হচ্ছে। কিন্তু বিকাশমান বা উদীয়মান অর্থনীতিগুলোতে শুধু একটি দাওয়াই দিয়েই পুরো ফল মিলবে না।
এদিকে, বাংলাদেশে এরই মধ্যে মূল্যস্টম্ফীতি প্রায় দুই অঙ্কে চলে গেছে। সরকারি হিসাবেই সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্টম্ফীতি ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। বাস্তবে ভোক্তাদের খরচ বেড়েছে আরও বেশি। কিন্তু সুদহার বৃদ্ধি 'অস্ত্র' প্রয়োগে নীতিনির্ধারকরা এখনও অনীহ। এখানে মূল্যস্টম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে যদিও পরপর তিনবার বা রেপোর সুদহার (কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের অর্থ ধার করার পদ্ধতি বা হার) বাড়ানো হয়েছে, মূল্যস্টম্ফীতির হার কমেনি। শুধু তাই নয়, বাজারে মুদ্রা সরবরাহও কমেনি। উপরন্তু, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বেড়েই চলেছে। ফলে গত বছরের তুলনায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত।
স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্টম্ফীতি বৃদ্ধির চাপ তৈরি হয়েছে ব্যাংক খাতে। আমানতসহ সবকিছুতে খরচ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রেপো রেট বাড়ানো হয়েছে।
আন্তঃব্যাংক রেট বেড়েছে। ডলারের রেট বেড়েছে। তথাপি ঋণের সুদহার বাড়ছে না। এর ফলে ব্যাংকগুলো নানা ধরনের সমস্যায় পড়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) আমাদের দেশে ব্যাংক ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। বিভিন্ন ব্যাংক কর্মকর্তা বলছেন, ডলারের দাম ও মূল্যস্টম্ফীতি বেড়ে অর্থনীতিতে যে চাপ তৈরি হয়েছে, তাতে নির্দিষ্ট সুদহারের মধ্যে থেকে ব্যাংকগুলোর পক্ষে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তো ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। ক্ষুদ্র আমানতকারীদেরও ব্যাপক সমস্যা হচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে আমানত ও ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেওয়া অথবা সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে বৈঠকও হয়েছে।
কিছুদিন আগেও অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতনরা মন্তব্য করেছিলেন, ৬-৯ বা ৭-১১ সুদহার সীমা তুলে দিলে উদ্যোক্তাদের খরচ বাড়বে। তাঁদের ধারণা ছিল, এতে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা খরচ বৃদ্ধি পাবে। কেদ্রীয় ব্যাংকপ্রধান নিজেই বলেছিলেন, উদ্যোক্তাদের কম খরচে ঋণ দিতে চান, যাতে উৎপাদন খরচ কমে আসে। অর্থনীতির ক্ষুধার্ত খাতগুলোতে অর্থের প্রবাহ বাড়ে। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদরা বরাবরই বলে আসছেন, ঋণের সুদহার না বাড়ানোর কারণেই মূল্যস্টম্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আগেই বলেছি, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সুদহার বেঁধে রাখা ঠিক হচ্ছে না। ব্যাংকে আগের মতো উদ্বৃত্ত অর্থও নেই। মানুষ আমানত তুলে নিচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে নিম্ন ও সীমিত আয়ের অনেকেই সঞ্চয় হারিয়েছেন বা ভেঙে খাচ্ছেন। ব্যাংকগুলোকে আবার আমদানি ও রেমিট্যান্স দায় নিষ্পন্নেম্নর জন্য নিয়মিত ডলার কিনতে হচ্ছে। তাই তাদের সবকিছু বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সুদহার বাড়িয়ে আমানত সংগ্রহ করতে হবে। একইভাবে অন্যদেরও ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দিতে হবে।
গত বছরের ৮ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণ ও ক্ষুদ্র আমানতকারীদের স্বার্থে ৩ মাস ও তার বেশি মেয়াদের আমানতে সুদের হার মূল্যস্টম্ফীতির হারের চেয়ে কম হতে পারবে না বলে নির্দেশনা দিয়েছিল। বর্তমানে মূল্যস্টম্ফীতি ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই নির্দেশনামতে ব্যাংকগুলোর ৯ দশমিক ১০ শতাংশের বেশি হারের সুদে আমানত সংগ্রহ করার কথা। আবার আগের নির্দেশনা অনুসারে তাদের ঋণ বিতরণ করতে হবে ৯ শতাংশের কম সুদে। সুদ বা মুনাফা নির্ধারণে আগের ৩ মাসের গড় মূল্যস্টম্ফীতি হারকে বিবেচনায় নিতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ের মেয়াদি আমানত এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকতা-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, অবসর-উত্তর পাওনা প্রভৃতি পরিশোধের লক্ষ্যে গঠিত তহবিল বাবদ রক্ষিত মেয়াদি আমানতের ওপর সুদ বা মুনাফার হার মূল্যস্টম্ফীতির হারের চেয়ে কম নির্ধারণ করা যাবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমানতের সুদহার নির্ধারণ যখন করে দেয়, তখন ঋণের সুদহার ছিল ৯ শতাংশ, আর মূল্যস্টম্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এরই মধ্যে সেপ্টেম্বরে মূল্যস্টম্ফীতি ৯ দশমিক ১০ শতাংশে চলে গেছে। অথচ ব্যাংক ঋণের সুদহার একই রয়ে গেছে।
আগেই বলেছি, মূল্যস্টম্ফীতির চাপ সামলাতে ৪ মাসে ৩ বার রেপো রেট বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও ব্যাংক ঋণের সুদহার না বাড়ানোয় এটা মূল্যস্টম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উপকারে আসছে না। বরং ঋণের সুদহার বাড়লে তা বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমাতে ভূমিকা রাখবে, যা মূল্যস্টম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বোচ্চ সীমা বহাল থাকার নির্দেশনায় রেপোর কারণে ব্যাংকের অর্থ ধার নেওয়ার খরচ বাড়লেও গ্রাহকদের ঋণ পেতে সুদহার ৯ শতাংশের বেশি দিতে হচ্ছে না। ফলে ঋণ বিতরণ বেড়েছে।
অন্যদিকে আমানতে সুদহার বাড়াতে না পারায় চাহিদা অনুযায়ী আমানত আসছে না। এতে কমে আসছে ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য।
ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য চলতি বছরের জুন শেষে ছিল ২ লাখ ৩ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা। জুলাইয়ে তা ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭২৫ কোটি টাকায় নেমে আসে। আগস্ট শেষে ১ লাখ ৭৪ হাজার ১৭৭ কোটি টাকায় নেমেছে। অথচ গত বছরের আগস্ট শেষে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য ছিল ২ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
মূল্যস্টম্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আবার রেপো রেট বাড়ানো হলেও এতে শুধু কলমানি মার্কেটে সুদহার সাড়ে ৫ শতাংশ থেকে আরেকটু বাড়বে। আর কোনো প্রভাব পড়বে না। ব্যাংক ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার বাড়িয়ে বা কিছুটা শিথিল করে ৯ থেকে সর্বোচ্চ ১২ বা ১৫ শতাংশ করলে ব্যবসায়ীদের ঋণের খরচ বাড়ত। তখন তারা ব্যয় নিয়ন্ত্রণে যেত। মূল্যস্টম্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসত।
এটা ঠিক, অন্যান্য দেশকে অনুসরণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকও মূল্যস্টম্ফীতির লাগাম টানতে দুই বছর পর গত ২৯ মে থেকে রেপো সুদহার ৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে তিন দফা বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশে নিয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে মূলত বাজারে টাকার প্রবাহ কমাতে, যাতে ব্যাংকগুলো বেশি সুদের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কম টাকা ধার করে। তবে ব্যাংক ঋণের সুদহার না বাড়ানোর কারণে টাকার প্রবাহ কমছে না। যে কারণে গত আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, যা প্রায় ৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সুদহার বাড়ালেই মূল্যস্টম্ফীতি কমে আসবে- এত সরল সমাধানে অবশ্য বিশ্বাস কম রাখাই ভালো। তবে মূল্যস্টম্ফীতি মোকাবিলায় অন্যান্য দেশের মতো সুদের হার অবশ্যই বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি, সরবরাহ শৃঙ্খলা উন্নতকরণ, বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, পণ্য আমদানি ও আপৎকালীন সংরক্ষণে দক্ষতা, উৎপাদকদের ন্যায্যমূল্য প্রদান; সার, বীজ, সেচ ব্যবস্থাসহ বাজার ব্যবস্থাপনায়ও সৌকর্য দেখাতে হবে। বৃহৎ খাদ্যপণ্য আমদানিকারক ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও আস্থায় নিতে হবে।
মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্নেষক

Address

Dinajpur
5200

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Shanta Roy posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Shanta Roy:

Share