Israt Jahan Dyuti

Israt Jahan Dyuti প্রকাশিত বইসমূহ — প্রভাতকিরণ, কয়লা, এমনই শ্রাবণ ছিল সেদিন, শূন্য কুলায় ফেরারি পাখি, প্রভাতরত্ন, রৌদ্রভেলা।

 #বুনো_মেঘের_হাতছানি—❝আগামী পর্ব থেকেই অতীতের অংশে ঢুকব? না-কি আগে আশফির কাজিন গার্লফ্রেন্ডের আগমনটা করাব?❞ছোট্ট করে মতা...
17/09/2025

#বুনো_মেঘের_হাতছানি—❝আগামী পর্ব থেকেই অতীতের অংশে ঢুকব? না-কি আগে আশফির কাজিন গার্লফ্রেন্ডের আগমনটা করাব?❞

ছোট্ট করে মতামত দিতে পারেন। কনফিউজড লাগছে একটু৷ কারণ যারা নিয়মিত পড়ছেন‚ তারা অধিকাংশই কিছু জানাচ্ছেন না পড়ে৷ তাই বুঝতেও পারছি না‚ আপনাদের মনোযোগ ধরে রাখতে পারছি কি-না।

 #বুনো_মেঘের_হাতছানি #ইসরাত_জাহান_দ্যুতি৯.গুগল ম্যাপের ওপর ভরসা করে বড়ো পথ ছেড়ে এক সরু গলির মধ্যে ঢুকল মারিশা। ম্যাপ দেখ...
16/09/2025

#বুনো_মেঘের_হাতছানি
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৯.

গুগল ম্যাপের ওপর ভরসা করে বড়ো পথ ছেড়ে এক সরু গলির মধ্যে ঢুকল মারিশা। ম্যাপ দেখাচ্ছে এটাই নাকি সঠিক পথ! হেঁটে অনেকটা সামনে এগোনোর পর হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল ও। চোখেমুখে দ্বিধা আর চিন্তা। কোনদিকে এগোবে এবার‚ তার সঠিক নির্দেশনা দিতে পারছে না ম্যাপ। বুঝতে পারল‚ ওর ডিজিটাল দুনিয়া এই গ্রামের বাস্তবের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না আর। পথের মানচিত্রটি কেবল কিছু রেখা দেখাচ্ছিল। কিন্তু গ্রামের ভেতরে কোন পথটি বাঁক নিয়েছে বা কোথায় শেষ হয়েছে‚ তা স্পষ্ট নয়।

ভোরের আকাশ সবে ফরসা হচ্ছে৷ বলা চলে ধোঁয়াটে ফরসা। ও যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে‚ সে জায়গাটি গ্রামের ঠিক মধ্যিখান নয়। বরং যেন গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আরেকটি প্রান্তে যাওয়ার সংযোগস্থল। দু’পাশে থাকা মাটির পুরনো বাড়িগুলোর ছায়া দীর্ঘ হয়ে পথের ওপর পড়ে আছে বলে পথগুলোকে আরও অন্ধকার ও রহস্যময় করে তুলেছে। তবে এখানে বাড়িগুলো কোনো নির্দিষ্ট সারিতে নয়‚ বরং এলোমেলোভাবে সাজানো। বেশিরভাগ বাড়িই পাথরের দেয়াল আর মাটির প্রলেপ দিয়ে তৈরি। যার ছাদে টিন বা খড়ের ছাউনি। কোথাও কোথাও কোনো বাড়ির রান্নাঘর থেকে কাঠের ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছে। ভেজা মাটি আর কাঠের উনুনের ওই পোড়া ধোঁয়ার এক অদ্ভুত মিশ্র গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসে। গভীর নিস্তব্ধতা চারপাশে। কেবল কোনো কোনো বাড়ির ভেতর থেকে আসা কথোপকথনের ক্ষীণ শব্দ আর দূর থেকে ভেসে আসা গৃহপালিত পশুর ডাকাডাকি ভেসে আসছে মাঝে মাঝে।

মারিশা আশপাশে তাকাল। কোন পথ ধরে এগিয়ে গেলে আবার ভুল পথে চলে যাবে‚ এই আশঙ্কায় সামনে এগোনোর সাহস পেল না। কারও বাড়িতে গিয়ে কড়া নাড়ারও উপায় নেই। গ্রামের মানুষেরা এখনো তাদের উষ্ণ বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ওর সামনে এখন তিনটি পথ—একটা ডানে‚ একটা বামে আর একটা সোজা। বাঁ দিকের পথটা সংকীর্ণ। যেটা দুই বাড়ির মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে ওপরের দিকে উঠে গেছে। পথটির দুই পাশে ছোটো ছোটো ঝোপঝাড় আর তার শেষটা গিয়ে মিশে গেছে এক ক্ষেতের দিকে। পথটা দেখে মনে হচ্ছে এটাই হয়তো পাহাড়ে যাওয়ার পথ। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় তো নেই।

মাঝের পথটা সোজা সামনে চলে গেছে। এটা অন্য দুটি পথের তুলনায় কিছুটা চওড়া আর এর দুই ধারে কিছু পাথর দিয়ে সীমানা তৈরি করা। কিছু জায়গায় স্থানীয়রা পাথর বসিয়ে সিঁড়ির মতো ধাপ তৈরি করেছে‚ যাতে ওঠা-নামা সহজ হয়। এই পথটা গ্রামের আরও গভীরে প্রবেশ করেছে। যেখানে আরও কিছু ঘুমন্ত বাড়ি দেখা যাচ্ছে। পথটা দেখে প্রধান পথ মনে হলেও এর শেষ কোথায়‚ তা বোঝা যাচ্ছে না। আর তৃতীয় পথটা ডান দিকে বাঁক নিয়ে এক সবুজ অরণ্যে গিয়ে মিশেছে।

মারিশা ওর হাতের আইপ্যাডের দিকে তাকাল। উজ্জ্বল স্ক্রিনে শুধু একটি নীল বিন্দু কাঁপছিল। যেটা বোঝাচ্ছে সে ঠিক কোথায় আছে। কিন্তু কোন পথটা ওকে সঠিক গন্তব্যে নিয়ে যাবে‚ তা বোঝাচ্ছে না। গ্রামের এই নীরবতার মাঝে দাঁড়িয়ে রইল পথহারা মুসাফিরের মতো। আর পথের এই ত্রিভুজ তাকে এমন এক গভীর দ্বিধায় ফেলে দিল যে বুঝতে পারল না কোন পথটা তাকে এই অচেনা গোলকধাঁধা থেকে বের করে নিয়ে যাবে।

এদিকে ডেনিম প্যান্টের পকেটে কাঁপছে অন্য ফোনটা। অনেকক্ষণ ধরেই কাঁপছে—এক সেকেন্ড বিরতি না নিয়ে কল করেই চলেছে আশফি। অমন অপমানের পর তার হঠাৎ ওই সস্তা ফ্লার্টি কথাবার্তা বিরক্ত লাগছিল বলে ফোনটা কেটে দিয়েছিল তখন। কিন্তু প্রচণ্ড টেনশনে সব বিরক্তি উবে গেছে এখন৷ মারিশা ভাবছে‚ পথের নির্দেশনাটা নেবে না-কি একবার আশফির থেকে? কিন্তু জিজ্ঞেস করলেই তো জবান কাটারুটা আগে এমন সব কথা বলবে যে‚ শুনেই ওর চাঁদিতে আগুন ধরে যাবে। আসল কথা শোনার আর ধৈর্যই থাকবে না তখন!

এখন তবে উপায় কী? এভাবে মাঝ পথে দাঁড়িয়ে থাকলে তো বেগনাসকোটের চূড়া থেকে সূর্যদয়টাও দেখা হবে না‚ অন্নপূর্ণা রয়েল ক্যাম্পেও পৌঁছানো হবে না আজ। রাগের মাথায় রাত থাকতেই বেরিয়ে পড়াটা চূড়ান্ত বোকামি হয়েছে ওর। তা অবশ্য এখন বুঝে লাভ কী? এখন হয় নিজের ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে যে-কোনো একটা পথ বেছে নিতে হবে‚ আর নয়তো ফিরে যেতে হবে। বেলা হলে তারপর রওনা হতে হবে আবার। মিনিট দুয়েক ভাবনাচিন্তা শেষে হাতে থাকা ফোনের স্ক্রিনটা নিভিয়ে দিল সে। মনের ভেতরে জমে থাকা হতাশার কুয়াশা আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। সামনে থাকা তিনটে অচেনা পথের দিকে তাকিয়ে থেকে আর লাভ নেই। ঠিক করল‚ ফিরেই যাবে। দ্বিতীয়বার হঠকারীর মতো না জেনেশুনে এগোনোর ভুলটা আর করতে চাইলো না৷ তবে রূপাকোট রিসোর্টে ফিরবে না সে। আশফির মুখোমুখি আর হবে না এ জীবনে।

যে পথ দিয়ে এসেছিল‚ সেই পথ ধরেই পা বাড়াল মারিশা। কয়েক কদম হাঁটার পরই তার চোখ পড়ল দূরের এক বাঁকে। আবছা আলোয় দেখতে পেল একটি ছায়ামূর্তি দ্রুত গতিতে এ পথেই এগিয়ে আসছে। প্রথমে সে ভাবল কোনো গ্রামবাসী হবে। কিন্তু মানুষটির হাঁটার ধরন আর তার গতিবেগ দেখে থমকে পড়ল ও। আস্তে আস্তে ছায়াটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। বুকটা ধুকপুক করে উঠল ওর। এ তো আর কেউ নয়—আশফি! পরনে সেই চেনা ছাই রঙা টি-শার্ট। মুখটা দেখাল যেন চিন্তায় মাখা। সে কি ওর খোঁজেই বেরিয়ে পড়েছে? তার চোখে মুখে এক ধরনের তীব্র অনুসন্ধান দেখতে পেল। চিন্তায় ডোবা সেই অনুসন্ধানী দৃষ্টিজোড়া দেখে ওর মনে হলো‚ যেন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে গিয়ে হলেও কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে খুঁজে বের করবেই সে।

সংকীর্ণ মাটির রাস্তার দুই ধারে চোখ বুলানো শেষে সামনে চাইলো আশফি। প্রশান্তিময় নীরব ভোরের আবছা আলোতে আচমকাই আবিষ্কার করল অদূরে‚ ফ্লোরাল প্রিন্ট ব্লাউজ পরনে এক মেয়েকে। চুলগুলো মেসি বান করা। পিঠে একটা বিরাট ব্যাগপ্যাক আর হাতে ধরা আইপ্যাড। মুহূর্তেই থেমে গেল আশফি। তার মুখে থাকা উদ্বেগের রেখাগুলো মিলিয়ে গেল এক নিমিষেই।

হৃদয়ে জমে থাকা ভয় আর হতাশা হঠাৎ করেই উবে গেছে মারিশারও। আশফি যে ওর খোঁজেই বেরিয়ে ফোন করছিল এতক্ষণ‚ তা আর বুঝতে বাকি নেই। তবে তার চোখে চোখ পড়ার আগেই সে হাঁটতে শুরু করেছে আবার৷ না‚ ফিরতি পথ নয়৷ সে মোটেও ওই নির্দয়টাকে বুঝতে দেবে না‚ ও পথ চিনতে পারছে না।

দীর্ঘ এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল আশফি। মারিশাকে ডেকে থামাতে চাইলো একবার৷ কিন্তু কিছু একটা ভেবে হাঁটতে শুরু করল ওর পিছু পিছু। রাগারাগি করার চিন্তাটাও বাদ দিল। মিনিট দশেক পর দেখা গেল মারিশা নিজেই থেমে পড়েছে সেই ত্রিভুজ পথের সামনে। আশফিকে না দেখার ভান ধরে আইপ্যাডের স্ক্রিনে গুগল ম্যাপটা দেখছে দাঁড়িয়ে। পুরো ব্যাপারটাই একরকম অভিনয় আরকি। কেবল অপেক্ষায় আছে সে‚ কখন আশফি এসে ওর সামনে দাঁড়াবে আর তখনই সে রাগ দেখিয়ে তাকে কপট বকাঝকা করে যে-কোনো একটা পথে এগিয়ে যাবে। ভুল হলে আশফি নিশ্চয়ই খোঁচা মেরে সঠিক পথটার কথা বলবে সে সময়?

এগিয়ে আসতে আসতে কয়েকটা বাঁকা কথা সত্যিই বলতে ইচ্ছা করল আশফির। কিন্তু তার বদলে সে মারিশাকে অবাক করে দিয়ে মারিশার পাশ কাটিয়ে চলে গেল বাঁ দিকের পথটাই৷ যেন ওকে দেখতেই পায়নি সে!

তার কাছে পথটা অচেনা নয়। সে জানে‚ ট্রেইলটা গ্রামের বসতি পেরিয়ে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে তারপর বনাঞ্চলে গিয়ে ঢুকে পড়ে। নির্বিকারভাবে হাঁটতে হাঁটতে একবার ঘড়িতে সময় দেখল সে। ছ’টা বেজে গেছে ইতোমধ্যে। বেগনাসকোটের চূড়া থেকে যদি সূর্যদয় দেখার উদ্দেশ্যেই বের হয় মারিশা‚ তবে তা দেখার ভাগ্য ওর হবে না। আরেকটু বাদেই সূর্য উঠে যাবে। আর চূড়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সময় লাগবে আরও তিন ঘণ্টার মতো৷ রাত একটাই রওনা হলে সম্ভব ছিল ছটার মাঝে চূড়াতে পৌঁছানোর৷ পাগলটা শুধু শুধুই রাতের ঘুম হারাম করল নিজেরও‚ আর তারও৷ পথিমধ্যে যদি কোনো বিপদ হত! কী হত তাহলে? এটা ভাবতেই ঠান্ডা করা মেজাজটা আবার চটে গেল তার৷ তাই একবারও পিছু ফিরে দেখল না বেয়াদবটাকে৷ গটগটিয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকল শুধু। আর খেপা মনে ভাবল‚ সূর্যদয় দেখার সাধ আজ জনমের মতো মেটাবে সে। চূড়ায় নিয়ে গিয়ে রোদে দাঁড় করিয়ে রাখবে এমনভাবে যে‚ পাখিরাও ওর মাথায় ডিম ভাজা শুরু করবে। আর বেয়াদবটা ছায়া খুঁজতে দৌড়াবে!

মাটির পথটা গ্রামের শেষ প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে উঠে গেছে ওপরের দিকে। যেন কোনো ঘুমন্ত সাপের পিঠের মতো এঁকেবেঁকে ওপরে উঠছে রাস্তাটা। মারিশা কোনো কথা না বলে অনেকটা দূরত্ব রেখে আশফির পিছু পিছুই যাচ্ছে। পেছনে ফেলে আসছে গ্রামের চিহ্ন‚ আর সামনে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে সবুজ দিগন্ত। পথের দু’ধারে ঝোপঝাড়গুলো ভেজা‚ তাদের পাতায় লেগে আছে ভোরের শিশির। কিছু দূর এগোনোর পর শুরু হলো বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত। বসন্তের এই সময়ে বেশিরভাগ ক্ষেতেই সরিষা ফুল ফুটতে শুরু করেছে৷ আর কোনো কোনো জায়গায় গম বা ভুট্টার কচি চারা দেখা যাচ্ছে। এভাবে কিছুক্ষণ হাঁটার পর ক্ষেতগুলো এখন ছোটো আর খাড়া‚ যেন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সিঁড়ির মতো ওপরে উঠে গেছে।

গ্রামের বসতিগুলো এখন কমতে শুরু করল। আকাশটাও একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল এর মাঝেই। এরপর হঠাৎই দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করল। সূর্য উঠে গেছে আরও কিছুক্ষণ আগেই৷ তবুও হাঁটা থামাল না আশফি। মারিশাও চঞ্চলতা আর চাপা আনন্দ নিয়ে তাকে অনুসরণ করতে করতে ভুলেই গেছে‚ সে সূর্যদয় দেখার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল।

সামনে শুধু সবুজের দেয়াল। পথের দু’পাশের খোলা জায়গাগুলো ক্রমেই ঘন হয়ে এল। আর ওদের মাথার ওপর গাছের ডালপালা মিলেমিশে এক ছায়াময় ছাদ তৈরি করল। মাটির পথ থেকে সরে এসে এখন ওদের পায়ের নিচে শুকনো পাতার নরম কার্পেট। ওরা প্রবেশ করেছে বনাঞ্চলের মাঝে। এই বনাঞ্চলটি পাহাড়ের ঢাল বরাবর অনেকটা জায়গা জুড়ে বিস্তৃত৷ তবে পুরোটা ঘন নয়। মাঝে মাঝেই ফাঁকা জায়গা। যেখান দিয়ে নিচের উপত্যকার দৃশ্য দেখা যায়। সূর্যের আলোর প্রথম রেখাগুলো যখন পাতলা হয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল‚ মারিশার হাঁটা থেমে গেল ঠিক তখনই। বোধোদয় ফিরল ওর। যদিও সূর্যের প্রখর আলো সরাসরি নিচে আসতে পারে না। কারণ‚ এখানে গাছগুলো খুব কাছাকাছি না থাকলেও তাদের পাতা এবং শাখা-প্রশাখা মাথার ওপরে ছায়া তৈরি করে রেখেছে।

একটু আগের সকল চঞ্চলতা মরে গেছে মারিশার। মাথা তুলে ওপরের দিকে চেয়ে দুঃখ কণ্ঠে বলল‚ “কপাল আমার সব কিছুতেই মন্দ দেখি! কিছুই ভাগ্যে জোটে না।”

মাত্র হাত পাঁচেক দূরত্বে ছিল আশফি। মারিশার কথাটা ভালোভাবেই কানে এল তার। এতক্ষণ বাদে ফিরে তাকাল সে পেছনে৷ একই সময়ে চোখ নামিয়ে সামনে তাকাল মারিশাও। দুজনের চোখাচোখি হতেই মারিশা কাঠিন্য মুখ করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল৷ হাঁটতে লাগল আবার। আশফির কাছাকাছি আসতেই তারই মতো না দেখার ভান করে তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলো সেও৷ কিন্তু হলো না৷ শিকারী বাঘের মতো খপ করে চেপে ধরল ওর বাহুটা। একটানে নিজের কাছে এনেই ক্ষিপ্ত গলায় বলল আশফি‚ “কোথায় যাচ্ছ? চেনো… চেনো কিছু? কার ভরসায়ই বা যাচ্ছ শুনি? গুগল ম্যাপ? তো দেখাও একটু। দেখি‚ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তোমার ম্যাপ?”

“কেন দেখাব তোমাকে?” শান্ত স্বরই মারিশার। “আমি যাচ্ছি বেগনাসকোটের চূড়াতে। তারপর আশপাশের কোনো একটা ক্যাম্পে যাব। আমি আমার মতো ট্রিপটা কাটাব। কিন্তু আমি কিছু চিনি বা না চিনি‚ তাতে তোমার কী? বরং প্রশ্ন তো আমার করা উচিত‚ তুমি কেন আমার পিছু নিয়েছ? প্লিজ‚ মিরানের বোন বলে এই সো কলড সম্পর্কের দোহাই দেওয়ার চেষ্টা কোরো না।”

“শাট ইয়োর ট্র্যাপ”‚ কঠিন এক ধমক দিয়ে উঠল আশফি। সেই স্বরেই বলল‚ “ফোন লাগাও মিরানকে! এক্ষুনি ফোন করো। ও কার ভরসায় তোমাকে এখানে পাঠিয়েছে‚ আমিও জানতে চাই।”

পকেট থেকে নিজের ফোনটাই বের করল আশফি। অফশোল্ডার টপ পরা মারিশার দিকে একবার তাকাল। ওর খোলা কাঁধজোড়ার ওপর বিভৎস রাগ নিয়ে দৃষ্টি বুলিয়ে মিরানের নম্বরটা খুঁজতে শুরু করল ফোনবুক থেকে। এক হাতে তখনো শক্ত করে ধরেই রাখল মারিশার বাহু। কিন্তু কল করার সুযোগটা দিল না মারিশা। ছোঁ মেরে ফোনটা কেড়ে নিল তার হাত থেকে। আগুন চোখে চাইলো আশফি৷ তা দেখে কাঁচুমাচু মুখে ইতিউতি করতে লাগল সে। আর ভাবতে লাগল‚ আপাতত আর চটানো যাবে না এই খ্যাপা ষাঁড়টাকে। ভাইয়ের কাছে ফোন গেলে ভাই তো আর এক মুহূর্ত দেরি করবে না ওকে নিতে আসতে। এখানে আসার জন্য বহু অশান্তি‚ কত ঝগড়া করে তারপর রাজি করাতে পেরেছিল ভাইকে!

এবং একমাত্র আশফির ভরসাতেই শেষমেশ রাজি হয়েছিল মিরান। কারণ সে খুব ভালোভাবে জানে‚ তার বোনের প্রতি যতই রাগ বা ঘৃণা থাকুক ওর‚ দায়িত্বের বেলাতে কোনোভাবেই অবহেলা করবে না ও মারিশাকে—সেটা তার জন্যই হোক‚ কিংবা নিজের ফুপুর জন্যই হোক। এখন যদি সেই দায়িত্বশীল মানুষটাই ফোন করে নালিশ করে তাকে‚ নেপালে আজকের দিনটাই হবে তবে শেষ দিন মারিশার।

কিন্তু এখন কীভাবে শান্ত করবে আশফিকে? এটা ভাবতে ভাবতেই মারিশা গম্ভীর গলায় বলল‚ “আমি কোনো স্ট্রেস দিতে চাইনি তোমাকে। খুব অস্থির লাগছিল রুমে৷ মন টিকছিল না আর ওখানে। তাই ভাবলাম সানরাইজটা দেখব বেগনাসকোট এসে৷ এর জন্য তো তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়তে হবে। আমি তোমাকে এই সময়েই জানাতাম ফোন করে‚ আমার চলে আসার কথাটা৷ আশপাশের কোনো একটা ক্যাম্পে গিয়ে থাকতাম তারপর। ওখানেরই কোনো একটা দলের সঙ্গে ট্রেকিঙে বের হতাম‚ ঘোরাফেরা শেষ হলে চলে যেতাম মায়ের কাছে। না না‚ এটা ভেবো না আবার‚ যে তোমার কাছাকাছি থাকার জন্য তোমার ফুপুর কাছে যাব৷ এখানে এসেছি জানার পর থেকে মা কান্নাকাটি করছে খুব। তাই যেতে হবে। টেনশন কোরো না একদম। আমি গেলে মা তোমাকে কখনোই ডাকবে না আমার কাছে আসার জন্য।”

“তোমার মায়ের কাছে তুমি যাবে‚ তা নিয়ে আমাকে কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না”‚ চড়া গলায় বলল আশফি‚ “আমার ফুপু ভালো করেই জানে‚ আমার সঙ্গে তার মেয়ের সম্পর্কটা শেষ। তাই তুমি চাইলেও আমার কাছে ঘেঁষতে পারবে না। সে নিজ দায়িত্বেই তোমাকে আটকাবে। সে তোমার মা হওয়ার আগে আমার ফুপু। তুমি তার কাছে মানুষ হওয়ার আগে আমি তার কাছে বড়ো হয়েছি। তোমার ওপর তার যতটা টান‚ ভালোবাসা‚ তার চেয়ে কিছু কম নয় আমার জন্যও। বরং তোমার থেকে বেশিই। তাই এসব ফালতু কথা বাদ দাও।”

“আচ্ছা বুঝলাম‚ এবার আমাকে ছাড়ো। ব্যথা পাচ্ছি।”

ছুড়ে ফেলার মতো হাতটা ছাড়ল আশফি। মারিশা রাগ‚ অভিমান‚ জেদ নিয়ে শেষবারের মতো তাকে দেখল। তারপর এগোল সামনের দিকেই। তা দেখে চেঁচিয়ে উঠল আশফি‚ “মাথার সাথে চোখও খারাপ হয়ে গেছে? ওদিকে আর কী জন্য যাচ্ছ? দেখতে পাচ্ছ না সূর্য উঠে গেছে?”

“আমি সেটাই দেখব৷ তোমার সমস্যা?” না থেমে চেঁচিয়েই উত্তরটা দিল মারিশা। তারপর এও জানাল‚ “আমার গন্তব্যে আমি যাচ্ছি। তুমি তোমার পথে হাঁটো।”

আশফির তখন খেয়াল হলো—একটু আগেই সে বলছিল ক্যাম্পে গিয়ে থাকার কথা‚ আর সেখান থেকেই নাকি ট্রেকিঙে বের হবে কোনো দলের সাথে! ব্যাপারটা নিয়ে আপাতত কিছু বলল না। ওর পিছু নিল চুপচাপ। বনের ভেতর পথটা মোটেও সমতল না৷ বেশ উঁচুনিচু আর পাথুরে। কোথাও বড়ো বড়ো গাছের শিকড় মাটির উপর বেরিয়ে এসে সিঁড়ির মতো ধাপ তৈরি করেছে‚ আর কোথাও ভেজা মাটির পথ ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। হালকাভাবে পিচ্ছিলও সে পথ। প্রতিটি পদক্ষেপেই তাই সতর্ক থাকতে হচ্ছিল আশফিকে৷ না‚ নিজের জন্য নয়। এক হাত সামনে চলা পাগলটার জন্য। ওরা একে অপরের সঙ্গে কোনো কথাই বলছিল না। কারণ শুধু নিজেদের মাঝের রাগ‚ অভিমান আর আক্রোশই নয়। এই নীরব বনের ঐশ্বরিক পরিবেশ ওদের কথা বলার প্রয়োজনই কেড়ে নিয়েছে যেন।

পায়ে পায়ে ওরা বনের আরও গভীরে প্রবেশ করল যখন‚ তখন ফুটে উঠল বনের অসাধারণ রূপটা। বড়ো বড়ো ওক‚ পাইন‚ দেবদারু গাছের কাণ্ডে লেপটে আছে শ্যাওলার সবুজ নরম চাদর। কিছু কিছু ওক গাছ অনেক পুরনো এবং আকারে বিশাল। যা এই অঞ্চলের প্রাচীন বনভূমির পরিচয় বহন করে। নিচে ডালপালা আর ফার্নের মতো গুল্ম ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আর বাতাসটা এখানে তুলনামূলকভাবে শীতল আর আর্দ্র। ভেজা মাটির গন্ধ‚ শ্যাওলা পড়া পাথরের সুবাস আর দূর থেকে ভেসে আসছিল এক অজানা পাখির গান। মনের ভারটা ধীরে ধীরে দুজনেরই হালকা হয়ে আসছিল। বহুদিন পর মারিশা প্রকৃতির আপন জগতে এল৷ ওকে তাই একটু বেশিই প্রাণোচ্ছল দেখাচ্ছিল।

বসন্তের এই সকালে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করছিল মারিশাকে গুরাস ফুলগুলো। ঘন সবুজ পাতার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ জ্বলে উঠেছে সাদা আর হালকা গোলাপি রঙের ফুলের ঝাড়‚ ফুলের চারপাশে নানা রঙের প্রজাপতি‚ আর কিছু কিছু ডালে মৌমাছির ঝাঁক দেখা গেল। তা দেখতে দেখতে মারিশার মনে হলো‚ এটা কোনো শিল্পীর রং তুলিতে আঁকা ক্যানভাস৷ আর সেই ক্যানভাসের মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে ও। সকালের প্রথম আলোয় ফুলগুলো আর ফুলের চারপাশে রঙিন প্রজাপতির উড়াউড়ি দেখতে এত ভালো লাগল যে‚ প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বেরই আশফির দিকে ছুড়ে মারল সে। চঞ্চল গলায় বলল‚ “স্ন্যাপ টু লাভলি শটস ফর মি‚ ইয়াহ?”

আশফির উত্তর শোনার প্রয়োজন মনে করল না৷ সঙ্গে সঙ্গেই ছবি তোলার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল একটা গাছের নিচে৷ চুলটা একটু নেড়েচেড়ে ঠিকঠাক করে টপের বেলুন স্লিভটা কাঁধের ওপরে উঠে আসায় টেনে আরেকটু নিচে নামাল। তারপর বলল‚ “আমার পায়ের নিচ থেকে একদম গাছের মাথার ওপর অবধি ছবিতে আসবে‚ সেভাবে তুলবে। অবশ্য তোমাকে বলার প্রয়োজন নেই। সরি!” বলা শেষে ওপরে মুখ তুলে ফুলগুলো দেখতে লাগল৷ এমন ভঙ্গিতেই ছবিটা তুলবে সে।

ফোনটা হাতে নিয়ে গাম্ভীর্যপূর্ণ‚ শীতল দৃষ্টিতে ওকে দেখে যাচ্ছিল আশফি। হঠাৎ আমুদে গলায় বলে উঠল সে‚ “স্লিভ আরও খানিকটা নিচে নামাবে‚ ইয়াহ?”

মারিশা চোখ নামিয়ে তাকালে আশফি তখন ঠোঁটের দু কোণ বাঁকাল প্রশংসার ভঙ্গিতে‚ “আই সুএয়ার‚ তোমার ক্লিভেজে পুরো ভিউটাই ব্লাডি মাস্টারপিস হয়ে যাবে… ফরেস্টও হাত তালি দেবে!”

সূক্ষ্ম ব্যঙ্গটা ধরতে একটুও সময় লাগল না মারিশার। ধমকে উঠল তাকে‚ “একদম সার্কাজম করবে না! বেশি কথা বললে খুলেই ফেলব কিন্তু!”

“ওয়াও… “‚ চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলল আশফি‚ “ইট উইল বি হিট ডিফ্রেন্ট।” যেন খুশিই হয়ে গেল সে।

“প্লিজ খোলো…”‚ কপট প্রলুব্ধ কণ্ঠে বলল‚ “আমার অভাগা চোখদুটো তাহলে আরও একবার সুযোগ পাবে তোমার টিটেড টপ প্রপারলি দর্শনের!”

ফোনের মধ্যে তেমন কিছু মনে না হলেও এভাবে সরাসরি কথাটা শুনতেই বিশম লজ্জা পেল মারিশা। সুন্দর করে দুটো ছবি তুলে দিলেই হয়। অথচ তা না‚ কী বিচ্ছিরি করে বিদ্রূপ করছে ওকে শয়তানটা! খেপাটের মতো পায়ের নিচ থেকে একটা নুড়ি পাথর কুড়িয়েই সেটা ছুড়ে মারল সে আশফিকে। মাথায় এসে লাগার আগেই মাথাটা দ্রুত ডানে সরাল আশফি।

চেঁচিয়ে বলল তখন মারিশা‚ “ছবিই তুলব না তোমার থেকে!” ভারী ব্যাগপ্যাকটা আবার কাঁধে চড়িয়ে পাতার ওপর মচমচ শব্দ তুলে হাঁটতে শুরু করল জোরে জোরে৷

চোখে চোরা হাসিটা নিয়ে আশফি আবার পিছু নিল। হঠাৎ পেছন থেকে ওর মেসি বানটা ধরে টান দিয়ে বলল‚ “বেকুব! পাহাড়ের ট্রেকিং রুট এদিকে না। ওদিকে…” বলেই ওকে ঘুরিয়ে দিল ডান দিকের পথে।

তার চুল ধরা হাতটা ঝাড়ি দিয়ে ফেলে সেদিকে হাঁটতে শুরু করল মারিশা। কিছু বুঝে ওঠার আগে আবার আশফি এগিয়ে এসে পেছন থেকে ওর টপের স্লিভ টেনে উঠিয়ে দিল কাঁধের ওপর। ক্রুদ্ধ হয়ে মারিশা ফিরে তাকাতেই সে নির্বিকারভাবে হেঁটে চলে গেল ওকে পার করে৷

হাঁটতে হাঁটতে কিছু দূর এসে হঠাৎ আশফি হাতের ইশারায় ওকে থামিয়ে দিল। রডোনডেনড্রন গাছের ডালে ফুলের থোকার মাঝে বসে আছে একটি পাখি। সেটাকে আঙুলের ইশারায় দেখাল সে৷ জিজ্ঞেস করল নিচুস্বরে‚ “চেনো ওই পাখিটাকে?”

তার ইশারা অনুসরণ করে মারিশা দেখল‚ পাখিটির মাথা আর গলা কুচকুচে কালো। কালো মাথার পেছনে ঘাড়ের কাছে একটি সাদা ছোপ‚ ঠোঁট আর পা'টা উজ্জ্বল হলুদ। পাখিটার পুরো শরীর গাঢ় নীল রঙের। ডানাগুলোও নীল ছিল‚ যার মাঝে মাঝে সাদা ও কালো ছোপ দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু পাখিটার সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিসটা হলো তার লেজ। শরীরের তুলনায় লেজটা অস্বাভাবিক লম্বা‚ আর সেই লেজটা হালকা বাতাসে মনের সুখে নাড়িয়ে যাচ্ছে সে। মারিশা মুগ্ধ হয়ে পাখিটির দিকে তাকিয়ে রইল। পাখিটা অচেনাই। এই সুন্দর পাখিকে এত কাছ থেকে এর আগে কখনো দেখেনি সে।

“কী পাখি ওটা? ওয়াট আ স্টানার!” আশফির মতোই মৃদুস্বরে বলল।

“হিমালয়ান ব্লু পাইট বা ব্লু ম্যাগপাই”‚ জানাল আশফি‚ “নেপাল আর হিমালয় অঞ্চলের জাতীয় পাখি।” বলতে বলতে আবার হাঁটা শুরু করল সে।

মারিশাও আর দাঁড়াল না। পথিমধ্যে দুয়েকটা বানরও দেখতে পেল সে। তবে যা দেখল না তা হলো ওক গাছের একটা নিচু ডালে ঝুলতে থাকা বড়ো এক সাপ। সাপে কিছুটা ফোবিয়া কাজ করে ওর৷ সাপটা দেখে আড়চোখে ওকে দেখল আশফি। যাতে খেয়াল না করে‚ তাই আরও দুয়েকটা অচেনা পাখি চেনাতে লাগল ওকে।

এক পর্যায়ে গাছের সারি যখন পাতলা হতে শুরু করল‚ তা দেখে জিজ্ঞেস করল মারিশা‚ “যাত্রা কি শেষের পথে?”

কোনো উত্তর দিল না আশফি। একটু পর বনের ছায়া সরে যেতেই বেলা বেড়ে যাওয়ায় প্রখর রোদ সরাসরি এসে গায়ে পড়ল ওদের। বনাঞ্চলের ভেতরের পথটি শেষ। সামনে এখন দিগন্তবিস্তৃত উন্মুক্ত এক দৃশ্য। বনের শান্ত শীতল বাতাস এক নিমেষে বদলে গেল সতেজ‚ তীব্র বাতাসে। সামনের পথটা এবার পাথুরে আর খানিকটা ঢালু। এখানে আর গাছের সারি নেই। আছে কেবল ছোটো ছোটো ঝোপ আর রুক্ষ ঘাস। পথটা যেন এক অদৃশ্য রেখা ধরে সরাসরি আকাশকে ছুঁতে চাইছে। পায়ের নিচে শুকনো পাতা আর মাটির বদলে এখন শুধু নুড়ি পাথরের ঘষা লাগছে। কিছু কিছু জায়গায় পাথরগুলো আলগা। তাই সাবধানে হাঁটতে হয়।

মারিশা বিমুগ্ধ চোখে শুধু সামনে চেয়ে হাঁটছে দেখে আশফি টিটকারি মেরে বলল‚ “হাঁ টা বন্ধ করে একটু নিচে তাকাও। নিচে তাকিয়েও হাঁটো।”

বিরক্ত হয়ে ফিরল মারিশা তার দিকে‚ “হাঁ করে আছি কোথায়?”

“ওই হলো… কানার মতো একদিকে না চেয়ে নিচে দেখেও হাঁটতে হয়।”

বলার পর হাত ঘড়িতে সময়টা দেখল আশফি৷ বেলা বাজে ন'টা। কী ধীরে ধীরে এসেছে তাহলে ওরা! রোদের তেজও বেড়ে গেছে দেখে খু্বই বিরক্ত লাগল তার। এদিকে ক্ষুধাও লেগে গেছে৷ তখন ফিরে না গিয়ে এই রোদের মধ্যে চূড়াতে যাওয়ার কী দরকার ছিল? ফিরতে ফিরতে তো দুপুর গড়িয়ে যাবে। আজকের দিনটাই একদম মাটি! এত রাগ হলো আশফির‚ ইচ্ছা করল মারিশাকে কটা কঠিন ধমক দিয়ে কথা শুনাতে। তারপর ঘাড় ঠেসে ধরে রিসোর্টে ফেরত নিয়ে যেতে। এত বেয়াড়া বেয়াদবটা!

মারিশা নিজেও টের পাচ্ছিল আশফির রাগ আর বিরক্তি। কিন্তু তাতে ওর কী? ও তো আর বলেনি সঙ্গে আসতে! যদিও কাঁধের ভারী ব্যাগপ্যাকের কারণে একটু ক্লান্তই লাগছে ওর। তবুও সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাঁটতে লাগল। যত উপরে উঠছিল‚ ততই ওদের পেছনে ফেলে আসা উপত্যকার দৃশ্য স্পষ্ট হতে শুরু করল। চারপাশে খোলা বাতাস আর মাথার ওপরে বিস্তৃত আকাশ। পায়ের কাছে মাটির সঙ্গে নিজেদেরকে আঁকড়ে ধরে রাখা ঝোপগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ফুটে আছে কিছু বুনো ফুল। তাদের কোনো পরিচিত নাম নেই। ছড়িয়ে থাকা গাঢ় বেগুনি‚ উজ্জ্বল হলুদ আর সাদা নাম না জানা ফুলগুলো যেন রোদের ঝলমলে আলোতে ছোটো ছোটো তারার মতো জ্বলজ্বল করছে। তাদের স্নিগ্ধ সুবাসে বাতাস ভরে উঠেছে।

অবশেষে চূড়ার শেষ ধাপে পৌঁছাল ওরা। পায়ের নিচে এখন মাটির বদলে এক নরম‚ ঘাসময় চত্বর। পাহাড়ি হাওয়ায় দুলে যাচ্ছে তা। চোখ নামিয়ে বাম দিকে তাকাতেই মারিশা দেখতে পেল সেই বিখ্যাত রূপা লেক। লেকটির জল এত শান্ত ছিল যে মনে হচ্ছিল এটা উপত্যকার বুকে শুয়ে থাকা এক বিশাল আয়না। তার উলটো দিকে ডান পাশে দেখা গেল বেগনাস লেক‚ রূপা লেকের মতোই উজ্জ্বল নীল। এই উচ্চতা থেকে লেক দুটিকে দেখতে মনে হয় যেন পৃথিবীর চোখ। আর তার চারপাশে সবুজের নরম গালিচার মতো বিছিয়ে আছে ফসলের ক্ষেত। কোথাও সরিষা ফুলের হলুদ গালিচা‚ কোথাও গমের কচি সবুজ চারা‚ আর কোথাও ভুট্টার চারাগুলো নতুন জীবনের বার্তা দিচ্ছে। এই ক্ষেতগুলোর মাঝে মাঝে গ্রামের ছোটো ছোটো ঘরগুলো ছড়ানো ছিটানো বিন্দুর মতো দেখাচ্ছিল।

মুগ্ধতার আবেশে দেখতে দেখতে অস্ফুটে কিছু একটা বলে উঠল মারিশা। আশফিরও কিছুটা ভালো লাগছে এখন। মারিশার কাছ ঘেঁষেই গম্ভীর মুখে পকেটে হাত পুরে দাঁড়িয়ে দেখছিল প্রকৃতির এই ঐশ্বরিক সজ্জা৷ দৃশ্য যে কেবল শুরু। চোখ যখন আরেকটু ওপরে উঠল ওদের‚ তখন দেখা গেল সবকিছুর উপরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই চিরন্তন সৌন্দর্য—হিমালয়ের চূড়া। সাদা বরফে ঢাকা চূড়াগুলো আকাশের সঙ্গে মিশে আছে। সূর্যের আলো সেই চূড়ায় পড়ে এক স্বর্গীয় আভা তৈরি করেছে। সবচেয়ে কাছে ছিল তীক্ষ্ণ শিখরওয়ালা মাছাপুছরে। এই পুরো উপত্যকার অভিভাবক সে। তার পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল অন্নপূর্ণা পর্বতমালা। যেখানে অন্নপূর্ণা এক‚ অন্নপূর্ণা সাউথ এবং হিমচুলির মতো চূড়াগুলো মাথা তুলে আছে। তাদেরই একটি অংশ হলো লামজং হিমাল৷ যে তার পিরামিডের মতো আকৃতির জন্য সহজেই চোখে পড়ে। আবহাওয়া পরিষ্কার হওয়ায় সুদূর দিগন্তে ওরা দেখতে পেল ধৌলাগিরি পর্বতমালাকেও। যে তার বিশালতা নিয়ে হিমালয়ের অন্যান্য চূড়া থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছে।

“ভোরবেলা পৌঁছাতে পারলে ভিউটা অন্যরকম সুন্দর দেখাত‚ তাই না?” ঘোর চোখে চূড়াগুলো দেখতে দেখতে ফিসফিস করে উঠল মারিশা।

আশফি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তখন ওর দিকে। হঠাৎ করে তার মানসপটে ভেসে উঠল‚ ওদের দুজনের প্রথম দেখা হওয়ার দিনটা। এমনই এক চূড়াতেই দাঁড়িয়ে দিনের প্রথম আলোয় ওকে দেখতে দেখতে কিছু একটা হয়ে গিয়েছিল তার সেদিনই৷ একে একে আরও অনেক ফেলে আসা স্মৃতি ধরা দিল আশফির কল্পনায়৷

অন্নপূর্ণার বরফ চাদরে মোড়া চূড়াতে চেয়ে ঠিক তখনই মারিশা ঘন স্বরে স্বগতোক্তি করল‚ “আমি কি চার বছর আগে হারিয়ে যাচ্ছি?”

কথাটা কানে পৌঁছাতেই নস্টালজিয়া থেকে বেরিয়ে এল আশফি৷ কিছু একটা ভেবে মুহূর্তেই চোয়ালদুটো শক্ত হয়ে উঠল তার। অনেকটা সময় পর আচমকা কড়া স্বরে বলে উঠল‚ “কী জন্য ডিভোর্স করেছ তোমার কাজিনকে? শুধুই আমার কাছে ফেরার জন্য?”

এমন সময়ে অকস্মাৎ এ প্রশ্নে মারিশা চমকে উঠে চাইতেই আশফি ওর চোখে চোখ রেখে একইভাবেই জিজ্ঞেস করল‚ “কিন্তু চার বছর পরই কেন ফিরতে ইচ্ছে হলো‚ মাহি?”

“তোমাদের বাংলাতে একটা কথা আছে‚ আশফি। মিথ্যার চেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর হলো অর্ধ সত্য”‚ মৃদুস্বরে বলল মারিশা‚ “আমার ফেরার পথ চার বছর পর খুলেছে বলেই আজ ফেরা।”

“বন্ধ ছিল বলছ?” শ্লেষাত্মক হেসে চোখ ফিরিয়ে সামনে চাইলো আশফি‚ “থাক‚ আর কিছু বোলো না।”

“কীই বা বলব? যখন সবটা জেনেও…” কথাটা আর শেষ করল না মারিশা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ চুপ থাকল।

বেগনাসকোট পৌঁছাতেই ওদের এত সময় লাগল যে সামনে আর এগোতে পারলাম না। আমার ঘনঘন মুড সুয়িং করার মতো গল্পের স্টোরিলাইনও সুয়িং করেছে। আরও কয়েকটা পর্ব পরে গিয়ে অতীতে ঝাঁপ দেব৷

 #মনাকাশে_ধ্রবতারা_বেশে—নতুন পাঠক যারাই আসছে পড়তে‚ মাঝ পর্বগুলোতে গিয়ে দেখি সবারই মন্তব্য‚ “শারফানকে একদম সহ্য হচ্ছে না....
15/09/2025

#মনাকাশে_ধ্রবতারা_বেশে—নতুন পাঠক যারাই আসছে পড়তে‚ মাঝ পর্বগুলোতে গিয়ে দেখি সবারই মন্তব্য‚ “শারফানকে একদম সহ্য হচ্ছে না... বিরক্ত লাগছে... ও নায়ক হওয়ার যোগ্যই না...” (আসলেই ও কোনো নায়ক না৷ কেবল এই গল্পের একমাত্র কেন্দ্রীয় চরিত্র বলা যায়। নায়কের বৈশিষ্ট্য ওর মাঝে সীমিত।)

কেউ কেউ তো আবার ফারনাজকে শুরু থেকে নায়ক ভেবে পরে গিয়ে হতাশ। এমনকি ওর চূড়ান্ত অপরাধের পরও ওকেই নায়ক হিসেবে কামনা করেছে। কিন্তু.... কিন্তু গল্পের শেষ অবধি গিয়ে মন্তব্য বদলে গেছে তাদের শারফানকে নিয়ে 🤗 ....।

মজাই লাগছে সবার ফিডব্যাক। ফালাক তাজের পর দ্বিতীয়বার পাঠকের এমন মিশ্র অনুভূতি পাচ্ছি এই চরিত্রকে নিয়ে। মানে এক চরিত্রকে ঘিরেই ঘৃণা‚ রাগ আবার ভালো লাগাও৷

#নোট – আচ্ছা অনেক পাঠকই ভাবছেন‚ আশফি – মাহিকে যেমন বারবার লিখছি‚ তেমন ❝শারফান – সানাকেও❞ আবার লিখব৷ কিন্তু আপনাদের বোঝাতে পারিনি‚ শারফান – সানা বইয়ের পাতাতে ইতোমধ্যে নাম লিখিয়ে ফেলেছে৷ ওরা আর দ্বিতীয়বার ফেসবুকের‚ ই-বুকের কোথাও আসবে না। অর্থাৎ বইয়ের পাতাতে উঠে আসা চরিত্রকে আমি আর দ্বিতীয়বার নতুনভাবে লিখি না৷ ২০১৯ সাল থেকে সমুদ্র - কান্তা‚ মেহফুজ - খেয়ামকে নিয়ে বহু পাঠক অনুরোধ করে এসেছে আবারও কিছু লেখার জন্য। সে অনুরোধ আমি রাখিনি... রাখতে পারিনি৷ কারণ‚ তাদের নিয়ে লেখার মতো আর কিছু বাকি ছিল না। আশফি – মাহি এতদিনেও বই হয়নি বলেই ওরা বারবার এসেছে। তাও অসমাপ্ত সেসব কাহিনি। কিন্তু বুনো মেঘের হাতছানি’র পর ওরাও আর রিপিট হবে না। কেবল আমি অভিশাপ পৃথ্বীর বই হয়নি বলে এটার চরিত্রদের নিয়ে ই-বুক পরিকল্পনা করে রেখেছি। এমনটা কখনো মনাকাশে ধ্রুবতারা বেশে নিয়ে হবে না। আশা করছি এ ব্যাপারটা এবার সবার কাছে পরিষ্কার?

 #বুনো_মেঘের_হাতছানি #ইসরাত_জাহান_দ্যুতি৮. আজকের পর্বের মতো সামনের কিছু কিছু পর্ব একটু খোলামেলা কথোপকথন ও পরিস্থিতি দেখা...
13/09/2025

#বুনো_মেঘের_হাতছানি
#ইসরাত_জাহান_দ্যুতি
৮.

আজকের পর্বের মতো সামনের কিছু কিছু পর্ব একটু খোলামেলা কথোপকথন ও পরিস্থিতি দেখানো হবে। অবশ্যই শালীনতা বজায় রেখে দেখানোর চেষ্টা করা হবে৷ সতর্কতা হিসেবে হেডনোট দিলাম৷

এদিকে মারিশাকে দেখাল কিংকর্তব্যবিমূঢ়! অপ্রত্যাশিত ঘটনাটাই হতবাক সে। তারপরই এক ধমকে বলে উঠল‚ “অ্যাই স্টুপিড! ছাড়ো আমাকে!”

ধমকটা দিয়ে সে নিজেই হাতটা ছাড়িয়ে নিল। বিস্ময় ভুলে কেমন গাঢ় চাউনিতে আশফি দেখছে ওকে! স্থির চাউনিতে তার পলক পড়ছে না দেখে চাদরটা টেনেটুনে গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে মারিশা আরেকটা ধমক লাগাল‚ “আশ্চর্য! চোখ সরাও‚ ফাজিল! তাকিয়ে দেখার কী আছে?”

“কিছু নেই?”

“থাকলেই বা দেখতে হবে কেন? আমি কি তোমাকে দেখাতে চেয়েছি?”

“নাটক এবার বন্ধ করো”‚ গাম্ভির্যের সুরে কথাটা বলে সরে এল সে মারিশার থেকে। তখনই পায়ের কাছে বাঁধল ককটেলের বোতলটা৷ মারিশার দিকে চাইলো তারপর বিরক্তির সঙ্গে‚ “তুমি কী করে তোমার বাবার বিজনেস সামলাতে‚ হ্যাঁ? আমার তো সন্দেহ হচ্ছে! এখনো যার ভেতর ছেলেমানুষি‚ পাগলামি‚ সে সিরিয়াসলিই বিজনেস সামলাতে জানে?”

মারিশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল‚ “সব কিছু তুমিই জানো শুধু!”

“আমি কী জানি আর না জানি‚ সেটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ না। তুমি নিজে কী করছ আমাকে পেতে‚ একবার সেটা ভাবো!”

বিরক্ত ক্রমশ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কী একটা চিন্তাও হতে লাগল আশফির। আর চিন্তা বা প্রচণ্ড রাগ হলেই সে স্বভাবজাত অস্থিরভাবে হাঁটাহাঁটি করে। সে সময় কথা বললে হাত নানান ভঙ্গিমায় নেড়েনেড়ে কথা বলতে থাকে। এখনো তাই-ই দেখা গেল।

অস্থিরতায় দুয়েক পা হাঁটতে থাকল আর হাত নেড়েনেড়ে বলতে লাগল‚ “আমার সামনে নিজেকে অ্যালকোহোলিক দেখাচ্ছ… ড্রাঙ্ক হও না বলেও ড্রাঙ্কেননেসের মতো আচরণ করছ বারবার‚ আর সিডিউস করার চেষ্টা করতে করতে তো একদম বদ্ধ উন্মাদের মতো কাজ করে বসে আছ। এসব কী‚ মাহি? এসব কখনো তোমার মতো গর্জিয়াস‚ পশ‚ এলিট পর্যায়ের মেয়ের সঙ্গে যায়? টিনএজ মেয়েগুলোর মতো পাগলামি শুরু করেছ। আমি কি এখন সেই পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের প্রথম প্রেমে পড়া যুবকটা আছি‚ যে তোমার এমন আজব কাণ্ড কারখানায় তখনের মতো মজা পাবো… ইমপ্রেস হব… তারপর একইভাবে প্রেমে পড়ে যাব? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাবনাচিন্তা‚ পছন্দে-অপছন্দে‚ নানান সিদ্ধান্তে পরিপক্বতা আসে। তোমার না এলেও আমার তা এসেছে। আমি এখন ইমপ্রেস হওয়া তো দূর‚ রীতিমতো টেনশনে পড়ে গেছি‚ কী করে তোমাকে সামলে নিয়ে তোমার ভাইয়ের কাছে পৌঁছাব! না পারব তোমাকে ফেলে চলে যেতে‚ আর না পারব তোমার এই পাগলামি টলারেট করতে। প্লিজ‚ ফর ওয়ান্স‚ অ্যাক্ট উইদ সাম ম্যাচিউরিটি! তোমার কিছুই এখন আর ভালো লাগছে না আমার৷ তাই আমাকে অ্যাট্রাক্ট করার জন্য এসব বোকামি কাজকর্ম বন্ধ করো এবার। বরং তুমি আমাকে সব থেকে বেশি খুশি করতে পারো এখান থেকে চলে গিয়ে। তাহলে আমি কোনো চাপ ছাড়া নিশ্চিন্তে ট্যুরটা শেষ করতে পারব৷ আমি এখানে এসেছি মাইন্ড রিফ্রেশ করতে‚ এক্সট্রা স্ট্রেস নিতে না।”

আজও খালি পেটে মদ পড়ায় নেশাটা সত্যিই একটু চড়েছে মারিশার। পেছনের চারটা বছরে যা কিছুর সম্মুখীন হয়েছিল সে‚ সেসব ভাবতে ভাবতেই একাকিত্ববোধ আর রাগ-দুঃখের সংমিশ্রণে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে ছিল বিছানায়। মাথাতেও ছিল না তোয়ালেটা বদলে পোশাক পরতে হবে। ঘুম পাচ্ছিল বলে ওভাবেই চাদরের নিচে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল৷ এর মাঝে কখন তোয়ালে খুলে গেছে‚ তা তো সে নিজেও টের পায়নি। তারপরই হঠাৎ আশফির কণ্ঠ এল। বিষণ্ণ থাকা মনটা ওর কেমন ফুরফুরে হয়ে উঠল নিমিষেই‚ অকারণ হাসিও পেতে লাগল—আশফির ডাকাডাকিতে একটু দুষ্টুমিও পেয়ে বসল।

তবে এসব কয়েক মুহূর্ত আগের কথা৷ আশফির শক্ত‚ ধারাল কথাগুলোতে হালকা নেশাটা ইতোমধ্যে কেটে গেছে মারিশার। অপরাধ সে করেছে‚ এ কথা সে কোনোদিনও অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু অতীতে আশফির সঙ্গে অপরাধটা না করলেও বাবার সঙ্গে করতে হত… যে-কোনো একজনকে কষ্টটা দিতেই হত ওকে! পরিস্থিতিই তো সেভাবে তৈরি হয়েছিল৷ মাত্র বিশ বছর বয়সে ওকে সেদিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল ত্রিশ বছরের নারী রূপে। কিন্তু তা কি আর বুঝতে চাইবে আশফি? হয়তো তার জায়গাতে বাবা থাকলে আজ বাবাও ওকে বুঝতেন না। সবাই-ই নিজেদের অভিমান আর কষ্টটাই বড়ো করে দেখত। ওর কষ্ট বোঝার দায় কারও নেই৷ সত্যিই কারও নেই। থাকলে সেদিন ওর বদলে ওর ভাই-ই যেত বাবার ডাককে অবহেলা না করে। আজকে ওর এই এলোমেলো জীবনের জন্য ওর ভাইটাই কি কম দায়ী? কিন্তু আজ সবাই-ই ভালো আছে‚ নিজ নিজ জীবনে এগিয়ে গেছে সবাই। আশফিও সত্যিই সুখী আজ। কিন্তু মাঝখান থেকে সব কিছু হারিয়েছে সে‚ কেবল বাবার ছেলের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে… বাবার ভালোবাসার মূল্য চুকাতে গিয়ে।

দিনের পর দিন ভেতরে জমে থাকা কষ্টটা অটল অভিমানে পরিণত হলো ওর মুহূর্তেই৷ না‚ শুধু আশফির প্রতিই নয়। বাবা‚ ভাই‚ সকলের ওপরই কঠিন অভিমান হলো ওর। কেবল মায়ের জন্যই মনটা কোমল রইল। কারণ‚ সে যে ওর চেয়েও বড়ো ভুক্তভোগী‚ সারা জীবন সুখ হারানো নারী।

বেপরোয়া রাগটার সঙ্গে হঠাৎ জেদটাও মাথা চাড়া দিয়ে উঠল মারিশার—আজকের পর আর কখনোই সে দাঁড়াবে না আশফির সামনে‚ ফিরবেও না ইস্তাম্বুল। এই ছোট্ট জীবনে যদি কারও কাছে কোনোদিন ফিরতেই হয় ওকে‚ ফিরবে শুধু মায়ের কাছে।

চোখদুটো ভিজে উঠলেও অশ্রুটুকু বিসর্জন হতে দিল না আর। ভারী স্বরে‚ কর্কশভাবে তির্যক অপমান করে বসল আশফিকে‚ “বেরিয়ে যাও!”

কিন্তু অপমানটা গায়ে লাগল না আশফির। অধিকন্তু বিদ্রূপ সুরে বলল‚ “এতক্ষণে তোমার সেল্ফ রেসপেক্ট সজাগ হলো!”

“আই’ম ডান টকিং”‚ চেঁচিয়ে উঠল মারিশা‚ “আউট অফ মাই রুম‚ নাউ।”

খুব রূঢ়তা ছিল এবারে। তবে আশফি রাগল না মোটেও। কারণ সে জানে‚ ঠিক এমন প্রতিক্রিয়া আসার মতোই কথাগুলো বলেছে। চুপচাপ ফিরে গেল সে বারান্দা হয়েই৷ যাওয়ার আগে অবশ্য মনে করে ককটেলটা নিয়ে যেতে ভুলল না।

সেসব দেখেও কিছু বলল না মারিশা। উঁচু করে রাখা দু হাঁটুর ওপর মাথাটা কাত করে রাখল নিঃশব্দে। প্রলম্বিত শ্বাসটা ফেলে অনেকক্ষণ পর হঠাৎ বিড়বিড় করে বলল‚ “ভালো থাকার অধিকার সবারই আছে। তুমি তোমার জায়গাতে সঠিক‚ আশফি। তোমার জায়গাতে আমি হলে তো কোনোদিনও তোমার মুখ দেখতাম না৷ তোমার মুখে শুনেই সহ্য করতে পারিনি‚ আমার বদলে তুমি আরও বহু নারীকে ডেট করেছ! সেখানে তোমার পরিচয়ের বদলে আমি অন্য পুরুষের পরিচয় বহন করেছি দীর্ঘ তিনটা বছর। সব কিছু ভোলা সম্ভব হলেও এই সত্য ভোলা কঠিন। আমিই ভুলতে পারি না। কিন্তু আমি ভুক্তভোগী‚ এও মিথ্যা না। অবশ্য এখানে তোমার কোনো দায় নেই যে‚ সব কিছু মেনে নিয়ে আমাকেই তোমার অ্যাক্সেপ্ট করতে হবে। যেখানে তুমি আমার চেয়েও বেটার অপশন পাচ্ছ।”

***

সময়টা ভোর চারটার আশেপাশে। ভোরের আলো তখনো ফোটেনি। রূপাকোট রিসোর্টের শান্ত আঙিনা ছেড়ে কাঁধে ব্যাগপ্যাক নিয়ে মারিশা সাবধানে নিচের দিকে নামতে শুরু করল। নামতে নামতে অনুভব করল রাতের জমে থাকা শিশির মাড়িয়ে যতই এগোচ্ছে‚ ততই অদ্ভুত ঠান্ডা আর ভেজা এক অজানা গন্ধ পাচ্ছে চারপাশে। বোধ হয় শিশির ভেজা রাতের শেষ প্রহরের ঘ্রাণ! পথটি কোনো সরলরেখা নয়। বরং পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একটি নিদ্রিত সাপের মতো এঁকেবেঁকে নেমে গেছে নিচের দিকে। পথের প্রথম দিকটায় ঘন গাছপালা আর ঝোপঝাড় দেখা গেল শুধু। কারণ এটা এখনো পাহাড়ের উপরের অংশের প্রাকৃতিক পরিবেশ। গাছের ফাঁক দিয়ে নিচে উপত্যকার দৃশ্য অস্পষ্টভাবে মারিশার চোখে পড়ল। বাতাসটাও অনুভব করল বেশ শীতল আর আর্দ্র। ​চারপাশ খুব নিস্তব্ধ। শুধু ওর পায়ের নিচে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ আর দূরে কোনো এক ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছিল। ভোরের কুয়াশা উপত্যকার গভীরে এক পাতলা সাদা চাদরের মতো ছড়িয়ে আছে। যার ওপর দিয়ে কেবল পাহাড়ের চূড়াগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে নিঃশেষ অপেক্ষায়। মারিশা ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগল‚ আর প্রতিটি বাঁকে কুয়াশার সেই চাদর সরে গিয়ে নিচের পৃথিবী স্পষ্ট হতে থাকল।

যখন ওর চোখে প্রথম রূপা ও বেগনাস লেকের জল পড়ল‚ তখন মনে হলো যেন উপত্যকার গভীরে দুটি বিশাল কালো আয়না স্থির হয়ে আছে। কুয়াশার আড়ালে তাদের রূপ তখনো অস্পষ্ট। কিন্তু সেই নীরব জলরাশিই যেন ভোরের প্রথম আলোর জন্য অপেক্ষা করছে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামার সময় হ্রদগুলো ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে‚ আর তাদের চারপাশের ধাপে ধাপে দেখতে পাওয়া যায় সাজানো সবুজ ফসলের ক্ষেত। যতই নিচে নামতে থাকে মারিশা‚ ততই দৃশ্যপট বদলাতে থাকে। পথের দু'পাশের ঝোপঝাড় কমে আসে আর ফসলের ক্ষেত ও লোকালয় দেখা যেতে থাকে। কুয়াশার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে পথের পাশে ছোটো ছোটো মাটির বা পাথরের তৈরি বাড়ি।

ভোরবেলার নীরবতা ভেঙে হঠাৎ জেগে উঠল পাখির কিচিরমিচির‚ দূর থেকে ভেসে আসতে লাগল কুকুরের ডাক‚ কোনো এক বাড়িতে জেগে ওঠা মোরগের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর আর তারপর বাতাসে ভেসে আসলো মানুষের প্রথম ব্যস্ততার শব্দ। মারিশা বুঝল‚ এই পথটি ওকে শুধু একটি জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে না‚ এটি তাকে পাহাড়ের নির্জনতা থেকে উপত্যকার গ্রামীণ জীবনের প্রাণবন্ততায় পৌঁছে দিচ্ছে।

***

মারিশা ছেড়ে যাওয়ার পর নির্ঘুম রাতগুলোতে যে ছটফটানি নিয়ে সারাটা রাত জেগে থাকত‚ আজ বহু দিন পর সেই ছটফটানি অনুভব করল আশফি। মনটাকে তো কবেই শিকলে বেঁধে নিয়েছিল! কিন্তু কখনো ভাবেনি‚ এত বছর পর ছেড়ে যাওয়া মানুষটা সামনে এসে দাঁড়ালে সেই মনটা বাঁধনহারা হতে ছটফটাবে।

তার মতো কাঠখোট্টা‚ দুঃসাহসিক অভিযাত্রী পুরুষ ভাইয়ের আদরের‚ বাবার আদরের আহ্লাদী স্বভাবের পুতুল পুতুল মেয়েটাকে কখনো ভালোবেসে ফেলবে সহজেই‚ আর ভালোবেসে সেও আহ্লাদেই মুড়িয়ে রাখবে‚ কোনোদিন তো সেটাও ভাবেনি। সেই আহ্লাদ দেওয়া মানুষটাকে কটা দিন ধরে কত কঠিন কঠিন কথা শুনিয়ে যাচ্ছে সে! সব থেকে বেশি আঘাতটা বোধ হয় আজকের কথাতেই ছিল। ওর পাওয়া আঘাতের কাছে এ অবশ্য সামান্যই৷ কিন্তু তবুও এক দণ্ড শান্তি পেল না আশফি৷ যাকে নিজের বর্তমান থেকে মুছেই ফেলেছে‚ যাকে নিজের অধিকার‚ অভিমান‚ ক্ষোভ‚ সব কিছু থেকে মুক্ত করে দিয়েছে—তার প্রতি রাগ প্রকাশ করা‚ কঠোর হওয়া মানে তো তাকে গুরুত্ব দেওয়া… তাকে বোঝানো যে‚ এখনো সে ওর জীবনে প্রভাব ফেলে৷ কিন্তু এমনটা তো নয়৷ মারিশাকে ওর সকল প্রশ্ন‚ ওকে কষ্ট দেওয়ার সকল অপরাধ থেকে মুক্ত করে দিয়েছে বহু আগেই৷ তাহলে কেন মেয়েটাকে এমন আঘাত করবে তিক্ত কথার বাণে?

বিছানার কোণে বসে সিগারেটের ধোঁয়াতে ডু্বে এসবই ভাবতে ভাবতে সময় কাটাচ্ছিল আশফি৷ লম্বা পথ যাত্রা শেষে শরীরটার বিশ্রামের দরকার ছিল। ঘুম না হওয়ায় মাথাটা বেশ ব্যথাও হচ্ছে‚ কেমন ভার ভারও লাগছে। সিগারেটটা শেষ করে উঠে পড়ল হঠাৎ। বাইরে থেকে একটু হাঁটাহাঁটি করে এসে তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে। নয়তো এখন শোয়ার পর মস্তিষ্কে মারিশাই ঘুরপাক খেতে থাকবে৷ ফোনটা পকেটে ঢোকানোর সময় সময়টা দেখল—রাত সাড়ে চারটারও বেশি। মারিশা না থাকলে আর একটা ঘণ্টা পরই ওদের বেরিয়ে পড়ার কথা ছিল আজ। কিন্তু মারিশাকে ইস্তাম্বুলের ফ্লাইটে না বসিয়ে দেওয়া অবধি কোথাও যে এক পা-ও সরতে পারবে না সে।

বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। নিচে নামার পূর্বে হঠাৎ এক পলের জন্য মারিশার ঘরের সামনে পা'টা থামল ওর। কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলে নেমে এল তারপর লবিতে। জেগে থাকা রিসেপশনিস্টের চোখে চোখ পড়তেই তাকে সৌজন্যপূর্ণ মুচকি হাসি দিল সে। ওকে চিনতে পারার পর থেকে এখানে বেশ আলাদারকম সুবিধা আর যত্ন দিচ্ছে সবাই-ই। কিন্তু রিসেপশনিস্টের চোখে হঠাৎ কেমন কৌতূহল খেয়াল করল ও। কিছু বলবে না-কি লোকটা? হাঁটা থামিয়ে জিজ্ঞেস করেই বসল তাকে‚ “হ্যালো... অ্যানিথিং টু সে?”

লোকটা বিব্রত হেসে মাথা নাড়ল‚ “নো স্যার‚ আমি ভেবেছিলাম আপনিও চেক আউট করতে এলেন বোধ হয়।”

“আমিও…” প্রশ্ন চোখে চাইলো আশফি‚ “আর কার কথা বলছেন?”

রিসেপশনিস্ট নামটা মনে করতে পারল না বলে চট করে কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে নামটা দেখেই বিনয়ী হেসে জানাল‚ “আপনার ফ্রেন্ড‚ মারিশা বারিশ সুলতানের কথা বলছি।”

যতটা সহজ করে হেসে জানাল রিসেপশনিস্ট‚ ঠিক ততটা সহজে হজম করতে পারল না আশফি। চোখ-মুখ নির্বিকার থাকলেও বুকটার ভেতর ধক করে উঠল ওর। উত্তেজিত পায়ে ডেস্কের কাছে এগিয়ে এল।

“কখন চেক আউট করেছে?” চঞ্চল গলায় জিজ্ঞেস করল রিসেপশনিস্টকে।

হাসিটা সরে রিসেপশনিস্ট একটু থমকাল আশফির প্রতিক্রিয়াতে‚ “প্রায় চল্লিশ মিনিটের মতো হয়ে গেছে‚ স্যার।”

মাথা খারাপ হওয়ার যোগাড় আশফির৷ ভোর হতে এখনো কত দেরি! মেয়েটা কী করে এমন সময়ে বের হতে পারল? আর বেরিয়ে যাবেই বা কোথায়? ফিরতি ফ্লাইট ধরার হলে তো এখন বের হওয়ার কথা নয়৷

দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়লেও খুব দ্রুত নিজেকে শান্ত করে নিল আশফি। নয়তো ভাবনাচিন্তাটা ঠিকভাবে করতে পারবে না৷ ঝড়ের গতিতে দোতলায় উঠে গিয়ে পরাগদের দরজায় জোরে জোরে চপেটাঘাত করে ওদের ডাকল। ডেকেই দৌড়ে গেল নিজের ঘরে৷ পরনের পোশাকও বদলাল না৷ ঝটপট নিজের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ছোটো একটা ব্যাগে ভরে আবার বেরিয়ে এল ঘর থেকে৷ তখনই বড়ো হাঁ করে হাই তুলতে তুলতে ঘুম জড়ানো চোখে দরজাটা খোলে হৃদয়। আশফি ওকে দেখেই তড়িঘড়ি করে জানাল‚ “আমি বের হচ্ছি একটু৷ ওরা উঠলে জানিয়ে দিস।”

“অ্যাঁহ…”‚ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেল হৃদয়‚ “বের হচ্ছিস? আমাদের ছাড়াই? বাজে কত?”

“গাধার বাচ্চা”‚ মস্ত এক ধমক বসাল আশফি‚ “পরাগকে ডাক!”

ঘুমে কাতর হৃদয় যে বিছানায় শোবার পর সব ভুলে যাবে‚ তা খেয়াল হতে নিজেই ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে ডাকল সে পরাগকে। ঘুমের মধ্যে এমন চেঁচামেচিতে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো পরাগসহ দিব্য আর সৌভিকও। তাই তিনজনকেই দ্রুত বলল সে‚ “মাহি বেরিয়ে গেছে… ওকে খুঁজতে বের হচ্ছি আমি।”

“মাহি...!” অদ্ভুত কিছু শোনার ভঙ্গিতে নামটা বলে উঠল সমস্বরে পরাগ আর হৃদয়।

আশফি মোটেও ওদের কৌতূহল মেটানোর জন্য অপেক্ষা করল না। ফোনে দিশানের নাম্বারটা বের করে তাকে কল করতে করতে বেরিয়ে যেতে লাগল৷ তখনই পরাগ ডেকে উঠল পেছন থেকে‚ “ওই‚ দাঁড়া!

বিছানা ছেড়ে জলদি উঠে এসেই আশফির পথ আগলে দাঁড়াল সে‚ “মারিশার কথা বলছিস? ও বেরিয়ে গেছে? কোথায়?”

“আমাকে দেখে তোদের মনে হচ্ছে‚ তোদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থাতে আছি আমি?” প্রচণ্ড বিরক্তিতে চেঁচিয়েই উঠল আশফি। ওদিকে দিশানও কল তুলছে না! দিশানের মাধ্যমে মারিশাকে আটকানোর একটা চেষ্টা করতে চেয়েছিল সে।

পরাগ আশফির অস্থিরতা বুঝতে পারলেও সেও ধমক লাগাল‚ “মারিশা বের হয়েছে মানে কী‚ সেটা তো বোঝার মতো কিছু বলবি? যদি সিরিয়াস ম্যাটার হয়‚ তাহলে সবাই-ই বের হব আমরা।”

“আর আমি এটাও জানতে চাই এখনই‚ মারিশা তোর হয় কে?” বিরক্তস্বরে দিব্য বলে উঠল‚ “তোদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে‚ সেটা সবাই-ই বুঝছি। তাহলে এই ঘোড়ার ডিম চেপে রাখার মানে কী‚ এটাই বুঝছি না! জিজ্ঞেস করলেই বারবার ইগনোর করছিস‚ মেয়েটার সঙ্গে রুডও হচ্ছিস‚ পজেসিভও হচ্ছিস তাকে নিয়ে। আবার এখন তার চিন্তাতে মরেও যাচ্ছিস।”

দিব্যর কথা শেষ হতেই পরাগ জিজ্ঞেস করল‚ “ও কি তোর সে-ই…?”

এমন সময়ে এদের এত জেরা দেখে আশফির ইচ্ছা করল সব কটাকে ঘরে বন্দি করে রেখে বেরিয়ে পড়তে। কেউ-ই ওর অবস্থাটা বুঝতে পারছে না। উপরন্তু মারিশার ওপর রাগ চড়ে ওঠায় রেগেমেগে উত্তর দিল‚ “ও আমার কোনো সে-টে না। আমার ফুপুর স্টেপ ডটার ও। তাই সম্পর্ক একটাই‚ আমার কাজিনের বোন ও। আর একটা কোনো প্রশ্ন করবি না এরপর। তোদের কারও লাগবে না আমার৷ একাই খুঁজে নিতে পারব আমি।”

কাউকে কোনো উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে‚ কারও কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে গটগটিয়ে হেঁটে নেমে এল সে লবিতে৷ তখনই খেয়াল হলো‚ মারিশার ফোন নম্বরটাই তো নেই ওর কাছে৷ পরাগদের কারও কাছেও নেই৷ দ্রুত রিসেপশনিস্টের কাছ থেকে মারিশার নম্বরটা চেয়ে নিল৷ তাকে ফোন করতে করতে দৌড়ে রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে পড়ল৷ তবে বের হওয়ার মুহূর্তে সিকিউরিটি গার্ডদের কাছে জিজ্ঞেস করল মারিশার কথা৷ তারা জানাল‚ কোনো ট্যাক্সি আসেনি ওই সময়ে৷ হেঁটেই যেতে দেখা গেছে তাকে।

আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগোতে লাগল আশফি দ্রুত পা চালিয়ে। কল ধরছে না মারিশা৷ ও-ও থামল না৷ লাগাতার কল করতে করতেই এগোতে লাগল। কিন্তু কোথায় খুঁজবে মেয়েটাকে? ট্যাক্সি যেহেতু নেয়নি‚ তার মানে কি গ্রাম থেকে বের হয়নি? না-কি সামনে গিয়ে ট্যাক্সি নিয়েছে? এমন অসময়ে অনলাইনে ট্যাক্সি বুকিং দিলেও আসতে তো সময় লাগার কথা। প্রায় একটা ঘণ্টার মতো হলো বেরিয়েছে সে। এতক্ষণে যদিও পৌঁছে যাওয়ার কথা ট্যাক্সি৷ কিন্তু আশফির মন বলছে‚ ট্যাক্সি ধরেনি মেয়েটা। আর অধিকাংশ সময়ই মারিশাকে নিয়ে ভাবা ওর মনের কথা ঠিক প্রমাণিতই হয়।

ভোরের আলো এখনো ঘন হয়ে নামেনি। হিমালয়ের কোলে রূপাকোট গ্রামের ঘুম ভাঙছে ধীরে ধীরে। আশফি দৌড়াতে দৌড়াতে লোকালয়ের কাছাকাছি এসেই থামল—রাস্তার ধারে৷ ভোর পাঁচটা বেজে দশ মিনিট। কোথায় যাবে‚ কোনদিকে খুঁজবে‚ দিব্যদের ডাকবে কিনা‚ এসবই ভাবতে ভাবতে ফোনটা কানে ধরে মারিশাকে বিরতিহীন কল করতে থাকল৷ একটা মেসেজও পাঠিয়েছে এর মাঝে। আশা করছে মেসেজটা দেখে রেগে গিয়ে কটা কথা শোনানোর আশায় হলেও কলটা ধরবে মারিশা!

তারপর মাত্র তিন মিনিট অপেক্ষা করতে হলো আশফিকে৷ ফোনের ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই চেঁচিয়ে উঠে বৃটিশদের অশ্লীল গালিতে অশ্রাব্য গালাগাল করতে লাগল মারিশা‚ “ইউ ব্লাডি আর্সহোল! ইউজলেস টোয়াট! হাউ ডেয়ার ইউ স্নিয়ার অ্যাট মাই চেস্ট! কজন মেয়ের ক্লিভেজে ঘুমিয়ে এসে তুলনা করছ আমার সঙ্গে? নিজেকে খুব পারসোনালিটি ফিলড ভাবো‚ না? বাট ইউ আর অ্যাক্টিং জাস্ট লাইক এভরি ব্লাডি এক্স।”

গালিগুলো শুনেও খুব ধীরে স্বস্তির প্রশ্বাসটা ছাড়ল আশফি। তারপর দুষ্টু হেসে যোগ দিল মারিশার আপত্তিজনক কথোপকথনে। একটু ফিসফিসানির মতো বলল‚ “ইয়েস‚ মাই ব্লাডি এক্স। আমি সত্যি বলতে দ্বিধা করি না। ইয়োর বুজম লুকস কিউট টু মি‚ বাট ইট ডাজেন্ট মেক মি ফিল অ্যাট্রাক্টেড।”

“শাট ইয়োর গব‚ আশফি! আমি তোমার মুখ ভেঙে দেব নয়তো। এসব শোনানোর জন্য ফোন করেছ তুমি? ইউ ফিলদি ক্যাড! শেইম অন ইউ!”

মারিশার চেঁচামেচির মাঝেই মোরগের ডাক ভেসে এল ফোনের ভেতর। আশফি চুপ থেকে খুব সতর্কভাবে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করল আশপাশের আওয়াজগুলো। পাখির কিচিরমিচিরও হালকা শুনতে পেল। বুঝে ফেলল তারপরই‚ গ্রামের পথে ঢুকেছে মারিশা। আর গ্রামের পথে ঢোকার উদ্দেশ্য কী হতে পারে? কেবল বেগনাসকোট পাহাড়? ভাবতে ভাবতেই একটু থমকাল আশফি। তারপরই চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর। এই এলাকার একটি জনপ্রিয় হাইকিং রুট হলো বেগনাসকোট পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার পথ। এটা রূপাকোটের কাছাকাছি আর এই পথটা পর্যটকদের জন্য খুবই সহজগম্য। বেগনাসকোট পাহাড়ে যাওয়ার জন্য গ্রামের মাঝ দিয়ে যাওয়া হাঁটার পথটিই ব্যবহার করতে হয়। আর ​এই পথটা কোনো যানবাহন চলাচলের রাস্তা নয়‚ বরং এটা একটা ট্রেকিং রুট। যা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠেছে। এবং পথটা সরাসরি ফসলের ক্ষেত‚ ছোটো ছোটো গ্রাম আর বনাঞ্চলের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়।

আশফির আর দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজন হলো না। ফোনটা কানে চেপে মারিশার যাত্রাপথেই এগোতে লাগল। আর ফোনটা যাতে না কাটে সে‚ এজন্য আর রাগানোর চেষ্টা করল না তাকে। বরং পুরনো দিনগুলোর মতো কণ্ঠে দুষ্টুমি মেশানো ফ্লার্টি কথা শুরু করল‚ “আমি তো ফোন করেছিলাম তোমার ঘরে আরেকবার আসার পারমিশন পাবো কিনা‚ সেটা জিজ্ঞেস করতে। তুমি তো আর জানো না‚ তোমাকে একেবারে বম্বশেল লাগছিল! তোমাকে দেখে আসার পর আমি কেমন এলোমেলো হয়ে আছি! চোখ বুজলেই শুধু তোমাকে দেখতে পাচ্ছি৷ না চাইতেও দুষ্টু দুষ্টু চিন্তা মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। এভাবে কি ঘুমানো যায়?”

ফোনের ওপাশে মারিশা চুপ করে রইল এক মুহূর্ত। তাকে না দেখেও আশফি কল্পনাতে দেখতে পেল‚ পাগল বৈজ্ঞানিকের মতো ভ্রুজোড়ার মাঝে ভাঁজ ফেলে সে ভাবছে‚ হঠাৎ করে কেন ফ্লার্টিং শুরু করল ও!

ব্যাপারটা ঘটেছেও তেমনই৷ ভ্রু কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়ে মারিশা গম্ভীর কণ্ঠ বলে উঠল‚ “আমার সঙ্গে একদম চিজি ফ্লার্ট করার চেষ্টা করবে না! আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি তুমি হাঁপাচ্ছ। মনে হচ্ছে দৌড়াদৌড়ি করছ।”

সত্যিই আশফি হাঁপাচ্ছে। মারিশাকে যাতে ধরতে পারে তাড়াতাড়ি‚ তাই কখনো দৌড়াচ্ছে‚ কখনো দ্রুত হাঁটছে। ওর বিশ্বাস‚ খুব বেশি দূর এগোতে পারেনি সে। কারণ‚ রুট তো আর চেনা নয় তার। এবং নিশ্চয়ই গুগল ম্যাপের সাহায্য নিয়ে নিজেকে বিশাল এক বুদ্ধিমতী ভাবছে ছিটিয়ালটা? কিন্তু প্রধান সড়ক ছাড়া গ্রামের ভেতরের পথগুলো অনেক সময় ম্যাপে সম্পূর্ণ তথ্য সংযোজন করা থাকে না। স্থানীয় কোনো গাইড বা স্থানীয় মানুষের সাহায্য নিতে হয়। নয়তো পথ হারানো বা অন্য কোনো অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রবল। হাফ বৃটিশটা কি আর সেসব মাথায় নিয়ে বেরিয়েছে? বেরিয়েছে তো খ্যাপা রাগ আর জেদ নিয়ে।

“পুশআপ দিচ্ছি”‚ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল আশফি‚ “তোমাকে ছোঁয়ার পর থেকেই শরীর গরম হয়ে আছে৷ কিন্তু কাছে পাওয়ার সুযোগ তো আর নেই। তাই মন-মগজ ডাইভার্ট করতে এক্সারসাইজ করছি।”

অতীতে জাম্প করা হবে আগামী পর্ব থেকে৷ তবে অতীত‚ বর্তমান এক সাথেই চলমান রাখা হবে।

Address

Gazipur

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Israt Jahan Dyuti posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Israt Jahan Dyuti:

Share