26/10/2023
নামাজের প্রতি যত্নবান না হওয়ার কারণ
নামাজের প্রতি যত্নবান না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, অসৎ ও মন্দ লোকদের সংস্পর্শ। যুবকদের চরিত্র ও মানস গঠনে সংস্পর্শ ও সান্নিধ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভালো ব্যক্তিদের সংস্পর্শে মানুষ ভালো ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী হয়। মন্দ ও খারাপ ব্যক্তিদের সংস্পর্শে মানুষ নষ্ট ও দুশ্চরিত্রের অধিকারী হয়। বর্তমান মুসলিম যুব ও তরুণ প্রজন্মের নষ্ট ও চরিত্রহীন হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো, অসৎ ও মন্দ লোকদের সংস্পর্শ। সংস্পর্শ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে সৎ ব্যক্তিদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে আদেশ করেছেন। রাসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুমিনদের সৎ বন্ধু নির্বাচন করতে বলেছেন। মন্দ ও অসৎ বন্ধুদের থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। সংস্পর্শের রয়েছে আশ্চর্য প্রভাব। সৎ ব্যক্তির সংস্পর্শে খারাপ মানুষ ভালো হয়ে যায়। পক্ষান্তরে অসৎ ব্যক্তির সংস্পর্শে ভালো মানুষ খারাপ হয়ে যায়। বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক রচিত হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। মুমিনের সকল কাজের লক্ষ্য হবে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি। কারো সাথে সম্পর্ক তৈরি হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আবার সম্পর্ক ছিন্ন হবে আল্লাহর জন্য। সৎ ও নামাজি ব্যক্তির সংস্পর্শে যে নামাজ পড়ে না সেও নামাজের প্রতি যত্নবান হবে। আল্লাহর বিধি-বিধান পালনের প্রতি সচেষ্ট হবে। আজ কোন জিনিস আমাদের নামাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে। মুমিন কেন নামাজের প্রতি যত্নবান হচ্ছে না? এর কারণ হলো, অসৎ ও মন্দ লোকদের সংস্পর্শ। আমরা তাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করছি যারা নামাজ পড়ে না। যারা আল্লাহর আদেশ পালন করে না। নিষেধ থেকে বেঁচে থাকে না। যাদের অন্তরে নেই আল্লাহ ও তার রাসুলের ভালোবাসা। ইসলামের বিধি-বিধান পালনের প্রতি যারা চূড়ান্ত উদাসীন। আমরা বন্ধু বানাচ্ছি তাদের যাদের অন্তর মৃত। যারা প্রবৃত্তির পূজা করছে।
হে মুসলিম যুবক! আমি তোমাদের সতর্ক করছি যেন তোমরা অসৎ সংস্পর্শ ত্যাগ করো। যেন তোমরা মন্দ লোকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করো। তুমি যার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করছ তার প্রভাব তোমার ওপর অবশ্যই পড়বে। এ কথা দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। অনেক ব্যক্তিকে বাহ্যিকভাবে অত্যন্ত ভালো মনে হয়। তার বাহ্যত চালচলন চলাফেরা দেখে মনে হয় অনেক সুন্দর। তার স্বভাব-চরিত্রকে ধারণা করা হয় নিষ্কলুশ। কিন্তু প্রকৃতার্থে তারা ভালো মানুষ নয়। এক ব্যক্তি আমাকে একটি ঘটনা শুনিয়েছেন। তিনি ছিলেন একটি কোম্পানির মালিক। তিনি বলেন, আমার একজন কর্মচারী রয়েছে যার চলাফেরা অত্যন্ত মার্জিত। তার স্বভাব-চরিত্র উন্নত। কিন্তু তার একটি সমস্যা রয়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কী সমস্যা? তিনি বললেন, সে মসজিদে যায় না এবং নামাজ পড়ে না। আমি বললাম, এ তো খুব খারাপ একটি গুণ। এটি এমন একটি মন্দ অভ্যাস যার কারণে সে আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তিদের নাম থেকে তার নাম বাদ পড়ে যায়। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা সে-সমস্ত লোকদের প্রকৃত রিজাল তথা ব্যক্তি বলে মনোনিত করেছেন যারা নামাজ আদায় করে। কিছুক্ষণ পর সে কর্মচারী শরীরচর্চা করে জিম থেকে বেরিয়েছে। মালিক আমাকে ইশারা করে তাকে দেখালেন। আল্লাহ তায়ালা এমন লোকদের লক্ষ্য করেই পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন,
'তুমি যখন তাদের দেখো তাদের দেহ তোমাকে মুগ্ধ করে এবং তারা যদি কথা বলে তুমি তাদের কথা শোনো। তারা দেয়ালে ঠেকানো কাঠের মতো। তারা প্রতিটি আওয়াজকে তাদের বিরুদ্ধে মনে করে। তারাই শত্রু; অতএব তাদের সম্পর্কে সতর্ক হও। আল্লাহ তাদের ধ্বংস করুন, তারা কীভাবে বিভ্রান্ত হচ্ছে। (সুরা মুনাফিকুন ৪)
আমি তাকে সালাম দিয়ে বললাম, হে যুবক! তোমার মালিক আমার নিকট তোমার অনেক প্রশংসা করেছে। এ শুনে সে বেশ খুশি হলো। তার চেহারায় আনন্দের আভা ছড়িয়ে পড়ল। অতঃপর আমি বললাম, তবে একটি দোষের কথা বলেছে। এ কথা শুনে সে ভারি চমকে উঠল। বলল, কী সে দোষ? আপনি বলুন আমি তা সংশোধন করে নেব। তখন তার অবস্থা দেখে আশ্চর্য হলাম। মালিকের সামনে মাত্র একটি দোষ সংশোধন করার জন্য সে কত পাগলপ্রায় হয়ে উঠল। তার মধ্যে কত সচেতনতা পরিলক্ষিত হলো। কিন্তু প্রকৃত মালিক যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন, প্রতিনিয়ত যিনি তার খাদ্য পানীর ব্যবস্থা করছেন সে মালিকের সামনে তার বহু দোষ রয়েছে, সেগুলো সংশোধনের প্রতি তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি তাকে বললাম, তুমি নাকি মসজিদে যাও না এবং নামাজ পড় না? সে বলল, হে শাইখ! আপনি সত্য বলেছেন। আমি মসজিদে যাই না এবং নামাজ পড়ি না। এটি আমার ব্যর্থতা। আমি বললাম, না, এটি তোমার ব্যর্থতা নয়। ব্যর্থতা ও ক্ষতির মাঝে পার্থক্য রয়েছে। তুমি স্পষ্ট ক্ষতি ও ধ্বংসের মাঝে রয়েছ। ব্যর্থতা তো সেটি যে, আমি তাকবিরে তাহরিমা পেলাম না। জামাতের সাথে ফজরের নামাজ পড়তে পারলাম না, তারপর একাকী পড়ে নিলাম। ব্যর্থতা হলো সেটি যে, কোনো কারণে সময়মতো নামাজ পড়তে পারলাম না, পরে তার কাজা আদায় করে নিলাম। এর নাম ব্যর্থতা। কিন্তু তুমি তো মসজিদেই যাও না, নামাজই পড় না। এর অর্থ তো ব্যর্থতা নয়। এ হলো ধ্বংস। তুমি স্পষ্ট ধ্বংসের মাঝে আছ। জেনে রেখো! তোমার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।
বর্তমানে অধিকাংশ মানুষের অবস্থাই এমন। তাদের ভালো মনে করা হচ্ছে কিন্তু তাদের প্রকৃত অবস্থা হলো এই যুবকের মতো। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
'করুণাময় আল্লাহর স্মরণ থেকে যে বিরত থাকে তার জন্য আমি শয়তানকে নিয়োজিত করি। অতঃপর সেই হয় তার সহচর। শয়তানের মানুষকে সৎপথ থেকে বিরত রাখে; আর মানুষেরা মনে করে যে, তারা সৎপথে আছে। (সুরা যুখরুফ: ৩৬)
মসজিদে যায় না, নামাজ পড়ে না, তবুও মানুষ তাকে ভালো মনে করছে। এ কেমন গুণ যে তাকে ভালো বলা হবে। অতঃপর তাকে বললাম, হে যুবক! তুমি ধ্বংসের মধ্যে আছ। তুমি মসজিদে যাও, নামাজ পড়ো। সৎ লোকদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করো। অসৎ লোকদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করো। তুমি তোমার নিজেকে জিজ্ঞেস করো, তুমি কোন পথে আছ। তুমি কি কল্যাণের পথে আছ নাকি ক্ষতি ও ধ্বংসের মাঝে আছ? সে আমার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। আল্লাহু আকবার! পরবর্তী নামাজের জন্য মুয়াজ্জিন আজান দিলেন। নামাজিগণ মসজিদের দিকে ছুটে আসছেন। আমি দেখি, সে যুবক যাকে কিছুক্ষণ পূর্বে নামাজের প্রতি আহ্বান করেছি, ধ্বংসের পথ থেকে কল্যাণের পথে ফিরে আসতে বলেছি, সে সুন্দর ও শুভ্র পোশাক পরিধান করে মসজিদের দিকে ছুটে আসছে। প্রকৃত জ্ঞানী তো তারাই, যাদের সতর্ক করা হলে তারা নিজেদের সংশোধনে ব্রতী হয়।
হে আল্লাহর বান্দাগণ! আমরা কেউ জানি না, কখন আমাদের মৃত্যু হবে। কখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবো আখেরাতে। জানি না, কখন জীবনে দুয়ারে এসে দাঁড়াবে মৃত্যুর ফেরেশতা। একদিন আকস্মিক মৃত্যু এসে কড়া নাড়বে দুয়ারে। হে নামাজের প্রতি উদাসীন ব্যক্তি! তুমি কি চাও, নামাজের প্রতি উদাসীন অবস্থায় তোমার মৃত্যু হোক? তুমি কি চাও, আল্লাহর আদেশ-নিষেধের প্রতি গাফেল অবস্থায় তোমার জীবনের অবসান হোক? না, কেউই চায় না এমতাবস্থায় তার মৃত্যু হোক। সুতরাং করণীয় হলো অবস্থার পরিবর্তন করা। নিজেকে সংশোধন করা। নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়া। এক ব্যক্তি যে নামাজের প্রতি উদাসীন ছিল, তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তুমি কি চাও, এমতাবস্থায় তোমার মৃত্যু হোক? সে বলল, না। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তুর্কি কি চাও তোমার এ অবস্থার পরিবর্তন হোক তারপর তোমার মৃত্যু হোক? সে বলল, এখনো আমার মন তৈরি হয়নি। তারপর জিজ্ঞেস করা হলো, তুমি কি জানো যে, এমতাবস্থায় তোমার মৃত্যু আসবে না? সে বলল, না। আল্লাহর শপথ! কোনো জ্ঞানী চাইবে না যে, এমতাবস্থায় তার মৃত্যু হোক। সুতরাং তুমি তোমার বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন করো। নামাজের প্রতি যত্নবান হও। উপদেশ গ্রহণ করো এবং সে অনুযায়ী আমল করো। উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। যারা উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাদের সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেছেন,
‘তাদের কী হয়েছে যে, তারা উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়? যেন তারা ভয় পেয়ে পলায়নকারী গাধা। যারা কোনো সিংহের ভয়ে পালিয়ে এসেছে। (সুরা মুদ্দাছছির: ৪৯)
এর থেকে উত্তরণ ও পরিত্রাণের উপায় হলো, বেশি বেশি মৃত্যুকে স্মরণ করা। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
'জেনো! আমি তোমাদের কবর জিয়ারত থেকে নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু এখন তোমরা কবর জিয়ারত করো। কেননা, কবর জিয়ারত তোমাদের আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেবে।'
আজ মানুষের গাফলত ও উদাসীনতার অন্যতম কারণ হলো, মৃত্যুকে ভুলে যাওয়া। মানুষ মৃত্যুর কথা ভুলে গেছে। জেনে রাখো! প্রত্যেককেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। প্রত্যেকের জন্যই অপেক্ষা করছে মৃত্যু। আকস্মিক একদিন মৃত্যু এসে দুয়ারে হাজির হবে। যখন মৃত্যু চলে আসবে তখন যতই চিৎকার করে আল্লাহকে ডাকা হোক না কেন তিনি তখন সাড়া দেবেন না। তাই মৃত্যুর ফেরেশতা আসার পূর্বেই তোমরা তোমাদের রবের দিকে ফিরে এসো। নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করো। আর অবস্থার পরিবর্তনের জন্য অন্যতম মাধ্যম হলো, মৃত্যুর কথা স্মরণ করা। মৃত্যুর কথা তখনই বেশি স্মরণ হবে যখন কবর জিয়ারত করবে। মৃত ব্যক্তির কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। তখন হৃদয়ে জাগ্রত হবে এ কথা, একদিন যে ব্যক্তি দুনিয়াতে ছিল আজ সে অন্ধকার কবরে। তার ন্যায় একদিন আমাকেও চলে যেতে হবে। হে যুবক! আজ তুমি অন্যের কবর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করো, একদিন মানুষ তোমার কবর থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার পূর্বে।
অসুস্থ ব্যক্তিদের দেখতে যাও। দেখো, তাদের কোন কোন নেয়ামত ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। দেখো, তাদের কারো চোখ নেই। কারো পা নেই। কেউ শুনতে পায় না। তারপর নিজের দিকে তাকাও। আল্লাহ তায়ালার অশেষ। কৃতজ্ঞতা আদায় করো। এক ছিল কলি। বাজারে লোকদের ভারী ভারী বস্তু মাথায় বহন করে নিয়ে যেত। বিনিময়ে তাদের থেকে কিছু অর্থকড়ি পেত, তা দিয়ে তার সংসার চলত। সে মসজিদে যেত না। নামাজ পড়ত না। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তুমি কেন নামাজ পড় না? সে বলল, আমি আমার মন অনুযায়ী চলি। আমার নামাজ পড়তে ইচ্ছে করে না তাই নামাজ পড়ি না। এই ছিল তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাব। একদিনের ঘটনা। খুব ভারী এক বস্তু মাথায় নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ সে পা পিছলে পড়ে যায়। তৎক্ষণাৎ তার একটি পা ভেঙে যায়। তারপর দীর্ঘদিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকে। তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, তোমার এখন কী করতে ইচ্ছে করে? সে বলল, আমার নামাজ পড়তে ইচ্ছে করে। মুয়াজ্জিন আজান দিলে আমার মসজিদে যেতে ইচ্ছে করে। সে যখন সুস্থ ছিল তখন নামাজ পড়েনি। আজ যখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছে তখন তার নামাজ পড়তে ইচ্ছে করছে। তখন সুযোগ ছিল কিন্তু নামাজ পড়েনি। মসজিদে যায়নি। আজ ইচ্ছে করলেও সে মসজিদে যেতে পারছে না। সুতরাং হে যুবক! সময় থাকতেই নিজেকে পরিবর্তন করো। নামাজের প্রতি যত্নবান হও। সময় ফুরিয়ে যাওয়ার পূর্বেই সময়ের সৎ ব্যবহার করো। মৃত্যু আসার পূর্বেই মৃত্যুর প্রস্তুতি গ্রহণ করো।