23/07/2025
বিমান আকাশে উড্ডয়নের পূর্বে ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্স (Flight Clearance) পাওয়ার জন্য একাধিক ধাপে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরীক্ষা ও নিশ্চিত করা হয়। এগুলো সাধারণত তিনটি প্রধান ক্ষেত্রকে ঘিরে আবর্তিত হয়— বিমান, ক্রু এবং পরিবেশগত (ATC/নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ)।
১. এয়ারক্রাফট সম্পর্কিত চেকআপ :
▪️ প্রি-ফ্লাইট ইন্সপেকশন (Pre-flight Inspection) :
🔸বিমানের বাহ্যিক কাঠামো পরীক্ষা (wings, landing gear, control surfaces)
🔸তেল, ফুয়েল ও হাইড্রলিক লেভেল চেক
🔸 টায়ারের চাপ ও অবস্থান
🔸আলো, সেন্সর ও বিমানের দরজা/লকিং ব্যবস্থা ঠিক আছে কি না
▪️টেকনিক্যাল স্ট্যাটাস :
🔸Aircraft Maintenance Log (AML) পর্যালোচনা
🔸কোন pending maintenance issue আছে কি না
🔸 Aircraft Serviceability (বিমান উড্ডয়নের জন্য উপযুক্ত কি না)
▪️ইনস্ট্রুমেন্ট চেক :
🔸ন্যাভিগেশনাল ইনস্ট্রুমেন্ট
🔸কমিউনিকেশন ডিভাইস
🔸 অটোপাইলট ও অন্যান্য সিস্টেম
২. ক্রু ও অপারেশনাল রেডিনেস :
▪️ফ্লাইট প্ল্যান দাখিল :
🔸 রুট, ক্রুজিং অ্যাল্টিটিউড, ETA (Estimated Time of Arrival), EET (Estimated Enroute Time)
🔸Alternate Airport setup
▪️ওয়েদার ব্রিফিং :
🔸METAR, TAF রিপোর্ট
🔸 রুট ও গন্তব্যস্থলের আবহাওয়ার অবস্থা
▪️নেভিগেশনাল ও কনট্রোল প্ল্যান :
🔸রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি প্রস্তুতি
🔸 Navigational charts (Jeppesen or equivalent) প্রস্তুত
▪️ক্রু ফিটনেস :
🔸 পাইলট ও কপাইলটের লাইসেন্স, মেডিকেল সার্টিফিকেট, ডিউটি আওয়ার্স যাচাই
🔸Fatigue বা স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা নেই কি না
৩. ATC ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের ক্লিয়ারেন্স :
▪️ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্স গ্রহণ :
🔸Air Traffic Control (ATC) থেকে সুনির্দিষ্ট ক্লিয়ারেন্স : রুট, স্কোয়াক কোড, Altitude
🔸 Controlled Airspace এর ক্ষেত্রে Departure Clearance
৪. নিরাপত্তা ও লোড চেক :
🔸প্যাসেঞ্জার ও কার্গো ওজনের হিসাব
🔸 Center of Gravity (CG) ও Trim Setting
🔸 ফায়ার এক্সটিংগুইশার, অক্সিজেন মাস্ক, লাইফ ভেস্ট ইত্যাদি নিরাপত্তা সরঞ্জাম
অর্থাৎ, একটি ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্স মূলত একটি সমন্বিত প্রস্তুতির ফল—যেখানে পাইলট, গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল, আবহাওয়া অফিস ও নিরাপত্তা সংস্থার সমন্বয় থাকে। কোনো একটি ক্ষেত্রেও ঘাটতি থাকলে ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয় না।
মাইলস্টোন কলেজে ফাইটার জেট বিধ্বস্ত হওয়ার ব্যাপারে আমরা যা জানতে পেরেছি তা হলো— বিমানটি তার উড্ডয়ন যাত্রা শুরুর অল্প কিছুক্ষণ পরই বিমানটির ইলেকট্রনিক সিস্টেম ফেইল করায় পাইলটের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিমানটি লো অ্যাল্টিচিউড দিয়ে উড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে মাইলস্টোন কলেজ ভবনে বিধ্বস্ত হয়। বিমানটি লো অ্যাল্টিচিউডে উড়তে থাকায় পাইলট সঠিক উচ্চতায় ইজেক্ট করতে না পেরে বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার কিছুক্ষণ পর নিহত হয়েছে। জানা গেছে, বিমানটির রেডিও সিস্টেমও অকার্যকর হয়ে পড়েছিল যাত্রাকালে।
ক্রুটিযুক্ত বিমানটি কীভাবে ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্স পেলো— সেটিই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। F7 ফ্লিটের মেইনটেইন্যান্স এবং ওভারহোলিং টিমকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত অবশ্যই। তবেই, দুর্ঘটনাটি কেবলই দৈবচয়নের মাধ্যমে সৃষ্ট যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঘটেছে, নাকি পরিকল্পিত উপায়ে সৃষ্ট যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ঘটেছে— সেটি জানা সম্ভব।
বাংলাদেশ চীনের তৈরি ৩৬ টি তৃতীয় প্রজন্মের F‑7 ফাইটার জেট, ১৫টি K‑8 ট্রেইনার জেট ব্যবহার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে চীনের সামরিক রপ্তানি কমাতে চায়, যাতে তারা Lockheed Martin, Boeing বা Raytheon-এর মতো প্রতিষ্ঠানের বাজার বাড়াতে পারে। মার্কিন সামরিক ইতিহাস, অর্থনৈতিক আগ্রাসন, এবং ইন্টেলিজেন্স অপারেশন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় “Accidental crashes” অনেক সময় “Intentional message” হিসেবেও ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশ বা অন্য চীন-ঘনিষ্ঠ রাষ্ট্রে এমন দুর্ঘটনা হলে মিডিয়া ও সামাজিক স্তরে এক ধরনের “মনস্তাত্ত্বিক চাপ” তৈরি করা হয়— চীনা প্রযুক্তি ঝুঁকিপূর্ণ। ইতোমধ্যেই প্রথম আলো এবং ভা*র*তের সংবাদ মাধ্যম গুলো চীনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব মূলক ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার কাজে নেমে পড়েছে, যদিও ভা*র*তের MIG-21 গুলো 'ফ্লায়িং কফিন' হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে বিশ্বব্যাপী।
কিছু পয়েন্ট আলোচনা করছি, যেগুলো হয়তো আপনাদের চিন্তার খোরাক হবে—
১. মাইলস্টোন কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনার পেছনে থাকা মূল প্রশ্ন হলো— কীভাবে একটি ত্রুটিপূর্ণ বিমানের ফ্লাইট ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হলো, এবং কারা এর দায়িত্বে ছিল?
২. এই ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়ায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যদি বিদেশি লবিং বা মানবাধিকার সংস্থার সরাসরি/পরোক্ষ প্রভাবে কাজ করে থাকেন, তবে এটি নিছক “দুর্ঘটনা” নয়— বরং পরিকল্পিত অন্তর্ঘাত।
৩. সম্প্রতি দেশে মানবাধিকার কমিশনের কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছে, যারা হয়তো বিভিন্ন সংস্থা ও বাহিনীর ওপর ‘অবজারভেশন’ ও ‘রিফর্ম’-এর নামে ঢুকে পড়ছে ইতোমধ্যেই। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে আমাদের প্রতিরক্ষা সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ভারতের আন্ডারকভার গোয়েন্দা সদস্যদের ইনফিল্ট্রেশন এর কথা আমরা সকলেই জানি।
৪. এসব সংস্থা হয়তো তথ্য সংগ্রহ ও নজরদারির নামে সামরিক ও প্রশাসনিক কাঠামোতে বিদেশি প্রভাব সৃষ্টির এক গভীর কৌশল ব্যবহার করছে ইতোমধ্যেই।
৫. বিমান সংক্রান্ত নিরাপত্তা ও ক্লিয়ারেন্স ব্যবস্থায় এমন একটি গোপন লবিং নেটওয়ার্ক কাজ করে থাকতে পারে, যা ‘স্বাধীনতা’র ছদ্মবেশে সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলে।
৬. ব্যক্তিগত লাভ, পদোন্নতি, বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ বা পরিবার-সম্পত্তি নিরাপত্তার বিনিময়ে তারা এসব সিদ্ধান্তে প্রভাবিত হয়।
৭. তাদের মাধ্যমে সামরিক ও বেসামরিক দপ্তরের মধ্যে এক ধরণের ‘ডিপ স্টেট’ গড়ে ওঠে, যারা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করে।
৮. আন্তর্জাতিক মিডিয়া, এনজিও ও কূটনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে এমন ঘটনা পরে রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারে ব্যবহার করা হয়।
৯. এই বিমানের দুর্ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা ছিল কিনা, না কি এটি মানবাধিকার কমিশন-ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পরিচালিত একটি গভীর অন্তর্ঘাত— এটি এখন তদন্তের প্রধান প্রশ্ন হওয়া উচিত।
যদি ধরে নেওয়া হয়, মাইলস্টোন কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পেছনে কোনও ষড়যন্ত্র ছিল না, নিছক উড্ডয়নজনিত যান্ত্রিক ত্রুটি, যেটির সম্ভাবনাই হয়তো বেশি। তবুও, ভুলে গেলে চলবে না, দিল্লী-ওয়াশিংটন জোট এমন প্রতিটি দুর্ঘটনাকেই কাজে লাগায়— নিজেদের অস্ত্র বিক্রি, প্রভাব বিস্তার ও চীনবিরোধী প্রচারে, আমাদের প্রতিরক্ষা খাতের দুর্বলতাকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারে। মার্কিন তাবেদার ড. ইউনূসের মাধ্যমে তারা তুলে ধরবে: “চীনা প্রযুক্তি অনির্ভরযোগ্য”, “নতুন জেনারেশনের যুদ্ধবিমান প্রয়োজন”, “ উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংগ্রহে আমরা সাহায্য করতে পারি”।
আপনাদের জানা থাকা উচিৎ, প্রচণ্ড রকমের একপেশে এবং জটিল নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা চুক্তি ব্যতীত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতি উচ্চমূল্যের সমরাস্ত্র ক্রয় সম্ভব নয়। উপরন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র সাধারণত তার কৌশলগত মিত্রের বিরুদ্ধে ব্যবহারের অনুমতি থাকে না। যেমন, পা*কি*স্তা*নের সিঙ্গেল ইঞ্জিন F-16 ফাইটার জেটগুলো ভা*র*তের বিরুদ্ধে ব্যবহারের অনুমতি নেই। তাই, ভা*র*তের বিপক্ষে যেকোনো সামরিক সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সংগ্রহ করা সমরাস্ত্রগুলো কোনো কাজেই আসবে না আমাদের।
বেদনাদায়ক আরেকটা দিক হলো— দুর্ঘটনায় কতজন মারা গেছে, তা নিয়ে সামরিক বাহিনী, মিডিয়া ও সরকার একসঙ্গে মৃতের সংখ্যা গোপন করছে। রাষ্ট্রীয় এবং সামরিক বাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষায় আজকে নাহয় আমরা কেবল মৃতের সঠিক সংখ্যা গোপন করতে পারি, আগামীতে এমন দিন আসবে— যেদিন ভা*র*তের এয়ার স্ট্রাইক মোকাবেলা করতে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ হবে আমাদের দূর্বল আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সেদিন মৃতদেহ গোনারও কেউ থাকবে না, লাশ শনাক্ত করারও কেউ থাকবে না।
দুঃখজনক সত্য হলো, আমাদের মনোযোগ যেখানে থাকা দরকার— রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা, উন্নত প্রজন্মের আধুনিক ফাইটার জেট, শক্তিশালী মাল্টি লেয়ারড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম গড়ার দাবিতে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা— সেখানে করে আমরা স্বজন হারানোর আহাজারিতে ডুবে আছি। আমরা নিজেরাই নিজেদের সমাধি রচনা করছি।
মাইলস্টোন দুর্ঘটনা— এটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা, প্রতিরক্ষা খাতের প্রতি নিদারুণ অবহেলা এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে পরিচালিত শাসনব্যবস্থার এক নির্মম প্রতিচ্ছবি।