12/07/2025
রাডার কীভাবে কাজ করে
মানবজাতি যখন প্রথম আকাশে পাখির মতো উড়তে শিখল, তখন থেকেই আকাশের খবর জানার প্রয়োজন অনুভূত হতে থাকে। শত্রুর বিমান কখন আক্রমণ করতে পারে, কোন দিক থেকে আসছে, তার গতি কত—এসব জানতে চাই একটি নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি। ঠিক সেই প্রয়োজন থেকেই জন্ম নিয়েছিল রাডার নামক যন্ত্রটির। আজ শুধু যুদ্ধক্ষেত্র নয়, আবহাওয়া পূর্বাভাস থেকে শুরু করে বিমান চলাচল, এমনকি আধুনিক গাড়িতেও ব্যবহৃত হচ্ছে রাডার। কিন্তু এই জটিল প্রযুক্তি আসলে কীভাবে কাজ করে?
রাডার শব্দের মানে ও প্রাথমিক ধারণা
‘রাডার’ শব্দটি এসেছে ইংরেজি “Radio Detection and Ranging” থেকে, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়—রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে বস্তু শনাক্ত করা এবং তার দূরত্ব নির্ণয় করা। সহজ করে বলতে গেলে, রাডার এমন এক প্রযুক্তি যা রেডিও তরঙ্গ পাঠিয়ে, তা কোনো বস্তুতে লাগলে প্রতিফলিত তরঙ্গ ধরে, সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে বস্তুটির অবস্থান, দূরত্ব, গতি এবং আকার সম্পর্কে ধারণা দেয়।
আমরা চোখ দিয়ে যেমন আলো দেখে বস্তু চিনতে পারি, তেমনি রাডার ‘দেখে’ রেডিও তরঙ্গ দিয়ে। তবে পার্থক্য হলো, রাডার চোখের চেয়ে অনেক দূরে ও সূক্ষ্মভাবে দেখতে পারে—তা দিন হোক কিংবা রাত, কুয়াশা হোক কিংবা বৃষ্টি।
রাডারের কাজ করার মূলনীতি
রাডারের কার্যপ্রক্রিয়া খুব সরল মনে হলেও এর পেছনের বিজ্ঞান বেশ গভীর ও চমকপ্রদ। পুরো প্রক্রিয়াকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করা যায়—
১. রেডিও তরঙ্গ পাঠানো
রাডারের প্রথম কাজ হলো একটি শক্তিশালী রেডিও তরঙ্গ পাঠানো। এটি একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে হয়ে থাকে, সাধারণত মাইক্রোওয়েভ বর্ণালীর মধ্যে। এই তরঙ্গ পাঠানো হয় একটি বিশেষ অ্যান্টেনা ব্যবহার করে, যা সাধারণত একটি ডিশ আকৃতির হয়। তরঙ্গটি একধরনের সংকেত বা pulse আকারে পাঠানো হয়—মনে করুন আপনি জোরে আওয়াজ করে বললেন “হ্যালো!” আর সেই শব্দ ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন।
২. বস্তুতে প্রতিফলন
যে তরঙ্গটি রাডার পাঠিয়েছে, তা সামনে থাকা যেকোনো বস্তুর গায়ে গিয়ে লাগে। যদি ওই বস্তুটি ধাতব বা কঠিন হয়, তাহলে তরঙ্গটির বেশিরভাগই প্রতিফলিত হয়ে আবার ফিরে আসে। একে বলে Echo বা প্রতিধ্বনি, অনেকটা পাহাড়ে চিৎকার করলে যেমন শব্দ ফিরে আসে।
৩. প্রতিফলিত তরঙ্গ সংগ্রহ
এবার রাডারের সেই অ্যান্টেনাই তরঙ্গ গ্রহণ করে, যেটি আগে তরঙ্গ পাঠিয়েছিল। অ্যান্টেনা আবার Receiver হিসেবে কাজ করে। রাডার ঠিকমতো বোঝে কোন তরঙ্গটি নিজের পাঠানো, আর সেটি কত সময় পরে ফিরে এসেছে।
৪. তথ্য বিশ্লেষণ
তরঙ্গ পাঠানো আর ফিরে আসার সময়ের ব্যবধান থেকেই রাডার বুঝতে পারে বস্তুটি কত দূরে আছে। কারণ, রেডিও তরঙ্গ আলোর গতিতে চলে—প্রায় প্রতি সেকেন্ডে তিন লাখ কিলোমিটার। রাডার সেই সময় মেপে হিসাব করে নেয়, কত দূর থেকে তরঙ্গটি প্রতিফলিত হয়ে ফিরেছে। এছাড়া, যদি বস্তুটি নড়তে থাকে, তবে তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সি সামান্য পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তন থেকেই রাডার বুঝে নেয় বস্তুটি কি দিকে যাচ্ছে এবং কত দ্রুত।
একটি সহজ উদাহরণ
ধরুন, আপনি একটি অন্ধকার কক্ষে ঢুকেছেন। হাতে একটি ব্যাটারি আছে, তাতে টর্চ জ্বালিয়ে আপনি সামনে আলোকছটা ছুড়লেন। আলোর প্রতিফলন দেখে বুঝলেন সামনে একটা দেয়াল আছে। রাডারও ঠিক তেমন—কেবল সে আলো নয়, রেডিও তরঙ্গ ছুড়ে কাজ করে।
রাডারের উপাদানসমূহ
একটি কার্যকর রাডার সিস্টেমে থাকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান:
ট্রান্সমিটার (Transmitter): এটি তরঙ্গ তৈরি করে এবং অ্যান্টেনার মাধ্যমে পাঠায়।
অ্যান্টেনা (Antenna): তরঙ্গ পাঠানো এবং গ্রহণ করার কাজ করে। একে রাডারের চোখ বলা যায়।
রিসিভার (Receiver): প্রতিফলিত তরঙ্গ গ্রহণ করে এবং তার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে।
সিগন্যাল প্রসেসর: এটি একটি কম্পিউটার বা অ্যানালগ যন্ত্র হতে পারে, যা তথ্য বিশ্লেষণ করে স্ক্রিনে বস্তুটির অবস্থান, গতি ইত্যাদি দেখায়।
বিভিন্ন ধরনের রাডার
রাডারেরও আবার নানা ধরন রয়েছে, প্রয়োজন ও ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে। যেমন—
Pulse Radar: এতে নির্দিষ্ট সময় পরপর শক্তিশালী তরঙ্গ পাঠানো হয়। এগুলো দূরত্ব মাপতে খুব ভালো।
Continuous Wave Radar: এখানে তরঙ্গ অবিরাম পাঠানো হয়, যা গতির নির্ভুলতা দেয়। তবে দূরত্ব মাপতে অতটা কার্যকর নয়।
Doppler Radar: এটি বস্তু চলমান কিনা তা নির্ধারণ করে ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তনের (ডপলার প্রভাব) ভিত্তিতে। আবহাওয়া পর্যবেক্ষণে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।
Phased Array Radar: এতে বহু ছোট ছোট অ্যান্টেনা থাকে, যারা একসঙ্গে কাজ করে। এটি দ্রুত গতি বিশ্লেষণে বিশেষজ্ঞ।
কোথায় কোথায় রাডার ব্যবহৃত হয়?
রাডারের ব্যবহার এত বিস্তৃত যে আমরা অনেক সময় না জেনেই রাডারের সুবিধা ভোগ করি।
সামরিক ক্ষেত্রে
যুদ্ধক্ষেত্রে রাডার এক অনন্য আবিষ্কার। শত্রুপক্ষের বিমান বা ক্ষেপণাস্ত্র কখন আসছে তা আগে থেকেই শনাক্ত করা যায় রাডারের সাহায্যে। এজন্য বিভিন্ন দূরত্বে সতর্কতামূলক রাডার বসানো থাকে। এমনকি সাবমেরিনের অবস্থানও জানা যায় সনার ও রাডার একসঙ্গে ব্যবহার করে।
আবহাওয়া পর্যবেক্ষণে
আমরা আজ বৃষ্টির পূর্বাভাস, ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ, বজ্রপাতের সম্ভাবনা এসব জানতে পারি রাডার প্রযুক্তির মাধ্যমে। বিশেষ ধরনের Doppler রাডার ব্যবহার করে মেঘের ঘনত্ব, বৃষ্টির গতি, এমনকি বরফপাত পর্যন্ত নির্ণয় করা যায়।
বিমানবন্দরে
আকাশে শত শত বিমান একসঙ্গে চলাচল করে। এসব নিয়ন্ত্রণের জন্য এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল টাওয়ারে রাডার থাকে। প্রতিটি বিমানের গতিবিধি, উচ্চতা, গতি নজরে রাখা হয় রাডার দিয়ে। এমনকি বিমান নিজেও রাডার ব্যবহার করে সামনের দিকের প্রতিবন্ধকতা বা আবহাওয়ার অবস্থা জানে।
নৌ-চালনায়
সমুদ্রের বুকে জাহাজ চলাচলের সময় রাডার খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষত রাতের অন্ধকারে বা ঘন কুয়াশায় যখন চোখে কিছুই দেখা যায় না, তখন রাডার জানায় সামনে কোন জাহাজ, পাথর বা ভূমি আছে কিনা। বড় জাহাজগুলোতে ঘূর্ণায়মান ডিশ রাডার প্রায় সব সময় সচল থাকে।
সাধারণ যানবাহনে
আজকের আধুনিক গাড়িতে রাডার প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে গতি নিয়ন্ত্রণ ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে। সামনে হঠাৎ কোনো কিছু আসলে রাডার সংকেত দেয়, এমনকি স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্রেকও করে ফেলে। অনেক গাড়িতে রয়েছে Adaptive Cruise Control—যেখানে রাডার অন্য গাড়ির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখে।
আইন প্রয়োগে
পুলিশ অনেক সময় রাস্তায় গাড়ির গতি পরিমাপ করতে রাডার গান ব্যবহার করে। গাড়ির দিকে রেডিও তরঙ্গ পাঠিয়ে তা ফেরত এসে বলছে গাড়িটি কত দ্রুত চলছে। গতি সীমা লঙ্ঘন করলে তাৎক্ষণিকভাবে ধরা যায়।
রাডারের কিছু চমৎকার বৈশিষ্ট্য
দিন-রাত সমান কাজ: রাডার আলো বা অন্ধকারে কোনোটির ওপর নির্ভর করে না।
খারাপ আবহাওয়ায় কার্যকর: মেঘ, কুয়াশা বা বৃষ্টির মধ্যেও রাডার ঠিকভাবে কাজ করে।
দূর থেকে তথ্য প্রদান: অনেক কিলোমিটার দূরের বস্তুও সনাক্ত করতে পারে।
গতি নির্ণয়ে দক্ষ: বস্তু সামনের দিকে আসছে না কি পেছনের দিকে যাচ্ছে, রাডার ঠিকমতো বোঝে।
রাডার প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ
দিন দিন রাডার আরও উন্নত হচ্ছে। আজকের রাডার শুধু বিমানের গতিপথ নয়, এমনকি একটি ক্ষুদ্র ড্রোনের উপস্থিতিও শনাক্ত করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযুক্ত করে রাডার এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিদ্ধান্তও নিতে পারে। এমনকি চিকিৎসাক্ষেত্রেও রাডার ব্যবহার শুরু হয়েছে—বুকের স্পন্দন, নিঃশ্বাস ইত্যাদি পর্যবেক্ষণের জন্য।