
09/08/2025
সেই তেলেভাজা দোকান, যেখানে ভাজা হয় মানুষের অঙ্গ – আর গ্রামের কেউ কিছু জানে না
পূর্ববাংলার নিঝুম এক গ্রাম, নাম কালীগঞ্জ। শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে, একটা পুরোনো রেলস্টেশনের পেছনের দিকটায়, একফালি রাস্তা মাটির, স্যাঁতস্যাঁতে, সারা বছর যেন কাদা লেগেই থাকে। রাস্তার একদম শেষ মাথায়, বিশাল এক তেঁতুলগাছের নিচে একটা টিনের ছাউনি দেওয়া ঘর – সেখানেই সন্ধ্যা হলেই আলো জ্বলে উঠত ছোট্ট একটা কেরোসিনের বাতিতে। সেই আলোতেই গ্রামের ছেলেরা, রিকশাওয়ালা, ক্ষেতমজুর কিংবা পাশের বাজারে কাজ করা মানুষজন জড়ো হতো—কারণ ওটাই ছিল “নাসিরের ভাজির দোকান”।
নাসির, বয়স পঁইত্রিশের মতো, মাথায় পাটকাঠি রঙের টুপি, গালে একটাই তিল, আর চেহারায় একটা অদ্ভুত নিরাসক্তি। কথা কম বলত, চোখে চোখ রাখত না কারো, কিন্তু ভাজি বানাতে ছিল অসাধারণ। তার দোকানের বেগুনির স্বাদ এতটাই অন্যরকম ছিল, যে আশেপাশের গ্রামের লোকজন পর্যন্ত সন্ধ্যায় হেঁটে চলে আসত সেখানে।
তবে একটা কথা লোকমুখে প্রচলিত ছিল—"নাসির ভাইয়ের দোকানের ভাজি খেয়ে রাতের ঘুম টান পড়ে!"
অনেকেই হেসে উড়িয়ে দিত, কেউ আবার রসিকতা করে বলত, “ও ভাই, বোধহয় ঘুমের ইনজেকশন দেয় ভেতরে!”
কিন্তু কেউ বুঝত না—ঘুমটাই যদি চিরঘুম হয়ে যায়?
রাত সাড়ে দশটা বাজে। গ্রামের সবাই প্রায় ঘুমিয়ে। দূরে মশার ভনভন শব্দ, মাঝেমধ্যে শেয়ালের হুঁকো ডাক শোনা যাচ্ছে। কিন্তু আমি—রিজু, বয়স সাতাশ, শহর থেকে এসে এখানে থেকে কাজ করছি কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পে—ঘুমাতে পারছিলাম না। কারণ তিনদিন ধরে একের পর এক লোক নিখোঁজ হচ্ছিল। প্রথমে হারাল মাঠের কামলা মন্টু। তারপর দর্জি হাকিম। এরপর কাল সন্ধ্যায় হারিয়েছে কাঁচাবাজারের রহিম কাকা। মজার কথা, তিনজনই শেষ বিকেলে নাসিরের দোকানে গিয়েছিল।
আমি চুপচাপ উঠলাম। একটা ছোট্ট টর্চ হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। মাথায় শুধু একটা জিনিস—নাসিরের দোকানটা আজ রাতে খোলা থাকে কিনা দেখতে হবে।
রাস্তায় হাঁটার সময় অস্বস্তি হচ্ছিল। কেমন যেন মনে হচ্ছিল, কেউ পেছন থেকে আমার পায়ের ছায়া অনুসরণ করছে। বাতাসটা আজ ভীষণ ঠান্ডা আর গন্ধটা... অদ্ভুত। পঁচা মাংসের মতো।
অবশেষে যখন দোকানের কাছাকাছি পৌঁছলাম, তখন কেরোসিন বাতির আলোর নিচে নাসিরকে দেখা গেল। সে একা, একটা পুরনো হাড়িতে কিছু একটা ভাজছিল। তার হাতের নড়াচড়া অনেক ধীর, নিখুঁত। কিন্তু আশেপাশে কেউ নেই। আজ তার দোকানে কেউ খেতে আসেনি।
আমি গাছের পেছনে লুকিয়ে থাকলাম। একটা সময় সে ভাজি চুলা থেকে নামিয়ে টিনের একটা ছোট বালতিতে রাখল। তারপর... যা দেখলাম, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
সে চুলার নিচে থেকে তুলল একটা পলিথিন মোড়া কিছু। সেটা খুলতেই দেখলাম—মানুষের কাটা আঙুল! ঠান্ডা, সাদা হয়ে আছে। একটা, দুইটা না—পুরো দশটা! সে তাতে মশলা মাখাতে লাগল খুবই যত্নে।
আমার পেট গুলিয়ে উঠল। গলা শুকিয়ে এল। এই সময় আমি দৌড়ে চলে যেতাম পারতাম, কিন্তু ঠিক তখনই হঠাৎ... একটা শব্দ হল—“খচ্!” মনে হচ্ছিল মাংস ছিঁড়ে যাচ্ছে।
নাসির থেমে গেল। মাথা ঘুরিয়ে চাইল গাছের দিকটা।
—"কে?" তার কণ্ঠ ছিল নিস্তব্ধ, কিন্তু যেন কানে তালা লাগিয়ে দেয়ার মতো।
আমি নিঃশ্বাস আটকে গাছের তলায় বসে রইলাম। হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল কয়েকগুণ। সে আস্তে আস্তে দোকানের পেছনে গিয়ে একটা কাঠের বাক্স খুলল। আমি চোখ বড় বড় করে দেখলাম—বাক্সের ভেতরে পড়ে আছে কিছু শরীরের অংশ। কারো হাত, কারো কান, কারো একখণ্ড বুকের চামড়া!
সে এগুলো খুব যত্ন করে বেছে নিল, যেন হিরে জহরত। তারপর সেগুলো আবার ভাজিতে মিশিয়ে দিল।
ভেতরে আমার কণ্ঠ আটকাতে পারছিলাম না—"এই লোকটা কী করছে?"
ঠিক তখনই একটা পুরোনো রিকশাওয়ালা হঠাৎ করে দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল।
—“নাসির ভাই... এক প্লেট মিক্স ভাজি দেন তো। রাতে ট্রিপ মারার আগেই খেয়ে নিই।”
নাসির একটা অদ্ভুত হেসে বলল—“আজকেরটা বিশেষ, খেয়ে জানাবেন।”
রিকশাওয়ালাটা ভাজি নিয়ে খেতে লাগল। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। দৌড় দিলাম।
সকালে পুরো গ্রাম উত্তাল হয়ে উঠল। সেই রিকশাওয়ালাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার রিকশা ছিল দোকানের পেছনে দাঁড়ানো, কিন্তু সে নিজে উধাও।
আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। কাউকে বিশ্বাস করতেও পারছিলাম না। কে জানে, নাসিরের সঙ্গে আর কার কার মিলে আছে এই গা শিউরে ওঠা পরিকল্পনায়?
আমার মাথার মধ্যে তখন একটাই শব্দ ঘুরপাক খাচ্ছিল—“খাওয়া হচ্ছে... আমাদের নিজেদের শরীর।”
পরদিন সকালবেলা, সূর্য ওঠার অনেক আগে আমার ঘুম ভাঙল। মাথাটা কেমন ভার লাগছিল। রাতের দেখা ঘটনাটা যেন এক বিশ্রী দুঃস্বপ্নের মতো গলার কাছে দলা পাকিয়ে ছিল। গলা শুকনো, হাত কাঁপছে, বুকের ভেতরটা জ্বলছিল। জানলার পাশে দাঁড়িয়ে গ্রামের সেই নিরীহ সকালটা দেখে মনে হচ্ছিল—সব স্বাভাবিক, অথচ আমি জানি, এই স্বাভাবিকতার নিচে আছে এক ভয়ংকর গোপন রক্তের গল্প।
আমি সোজা হাঁটতে হাঁটতে বাজারের দিকে গেলাম। লোকজন জড়ো হয়েছে—তারা কথা বলছে মজনু রিকশাওয়ালাকে নিয়ে। তার রিকশাটা পাওয়া গেছে, কিন্তু সে নিজে গায়েব। কেউ বলছে প্রেম করে পালিয়েছে, কেউ বলে নদীতে ডুবে গেছে, আবার কেউ হেসে বলছে, "ভাজি খেয়ে ভ্যানিস!"
তবে কেউ নাসিরের দোকানের দিকে আঙুল তোলে না।
আমি চুপ করে সবার মুখের ভাব দেখে গেলাম। মানুষের চোখে যেন অদ্ভুত অন্ধত্ব। কেউ কিছু দেখতে পাচ্ছে না, শুনতে পাচ্ছে না। সবাই কেবল মুখে মুখে চায়ের কাপ নেড়ে যাচ্ছিল, আর গল্পের প্যাঁচে হারিয়ে যাচ্ছিল সত্যিটাকে।
আমার ভেতর তখন একটা ভয় আর কৌতূহলের মিশ্র চাপা উত্তেজনা জন্ম নিচ্ছিল। এই লোকটা, নাসির—সে কিভাবে দিনের পর দিন এই কাজটা চালিয়ে যাচ্ছে? কেউ বুঝতে পারছে না কেন? আর তার ওই কাঠের বাক্সটা? ওই... শরীরের অংশ?
দুপুর নাগাদ আমি একা বাড়ি ফিরে এলাম। কিছুতেই কিছু গিলতে পারছিলাম না। মাথায় কেবল একটাই ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল—আমি কী করব এখন?
চুপ করে বসে থাকতে থাকতে সিদ্ধান্ত নিলাম—আজ রাতে আবারও যাব। তবে এবার প্রস্তুত হয়ে। ফোনে ক্যামেরা অন রাখব, কিছু প্রমাণ তুলব। আমি জানি, কেবল মুখে বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।
রাত দশটা নাগাদ আমি বের হলাম। পেছনের পকেটে একটা ছোট্ট পকেটছুরি, গলায় একটা পুরোনো মালা যেটা আমার মা বলেছিল ‘রক্ষা করে’। বুকটা কাঁপছিল, কিন্তু মন পাথরের মতো।
এইবার আমি একটু অন্য পথ দিয়ে গেলাম, দোকানটার উল্টোপাশ থেকে। গাছের পেছনের দিকটায় আগেই জায়গা দেখে রেখেছিলাম। সেখানে লুকিয়ে ক্যামেরা অন করলাম। বাতি জ্বালেনি এখনও, কিন্তু চুলায় আগুন জ্বলছে। নাসির হাড়িতে কিছু একটা দিচ্ছিল।
তারপর... হঠাৎ সে আবার সেই বাক্সটা খুলল।
আমি আমার চোখ বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এবার সে যা বের করল সেটা একটা কাটা পায়ের পাতার মতো দেখাচ্ছিল। নিঃসন্দেহে মানুষের। চামড়া ফাটা, নখগুলো ময়লা, ত্বকের রঙ নীলচে। সে খুব যত্ন করে ওটা ধুয়ে, মশলা মাখিয়ে হাড়িতে রাখল।
এইবার আমি মোবাইলটা একটু সামনে এনে ভিডিও করছিলাম।
ঠিক সেই সময়—পেছনে কে যেন কাশল।
আমি গা শিউরে উঠে পেছনে তাকালাম। কাঁচা অন্ধকারে দুটো চোখ দেখতে পেলাম। একজন বুড়ো লোক, মুখে দাড়ি, চোখে শূন্য দৃষ্টি।
—"তুমি কী করছো এখানে?" তার কণ্ঠে ছিল অদ্ভুত নিরাসক্তি।
আমি চুপ। গলা শুকিয়ে গেল।
সে আবার বলল, —"তুমি জানো না, এখানে রাতের পর কারও থাকার নিয়ম নেই।"
আমি কোনোভাবে বলে উঠলাম, —"নাসির... ও মানুষ ভাজি করছে। আমি ভিডিও করছি।"
সে হাসল। অদ্ভুতভাবে, মুখে কোনো হাসির রেখা ফুটল না, কিন্তু একটা হাহাকার শুনলাম।
—"ছেলেটা এখনো বোঝেনি তুমি কাদের কথা বলছো..."
তারপর সে ঘুরে গেল অন্ধকারের মধ্যে। একবার ঘাড় ফেরাল না।
আমি কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকলাম। শরীরের সব অঙ্গ যেন জমে গেল।
এরপর দোকান থেকে গন্ধ আসতে লাগল, পাঁঠার মাংসের মতো, আবার যেন জ্বলে ওঠা মানুষের চামড়ার গন্ধ—ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে যেন একটা মানুষের কান ঝুলে ছিল হাড়ির মুখে!
আমি বুঝলাম, আর থাকা যাবে না। ভিডিও যতটুকু পেলাম সেটাই যথেষ্ট। আমি ধীরে ধীরে পেছন ঘুরে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।
পরদিন সকালে সাহস করে থানায় গেলাম। ঘটনাটা জানালাম, মোবাইলে ভিডিও দেখালাম।
এসআই সোহেল সাহেব ভিডিওটা দেখে কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন, তারপর বললেন,
—"তুমি যদি নিশ্চিত হও, তবে চল আমরা একবার গিয়ে দেখি। তবে মিথ্যা হলে কিন্তু জামিনে ছাড়া পাবা না!"
আমি রাজি হলাম। তিনজন পুলিশ, আমিও সঙ্গে গেলাম দোকানে।
কিন্তু... দোকানে পৌঁছে দেখি জায়গাটা ফাঁকা। টিনের ছাউনি নেই, চুলা নেই, হাড়ি নেই, নাসির নেই—একফোঁটা ছাইও না! শুধু পেছনের মাটিতে আঁচড়ের দাগ, একটা পলিথিনের টুকরো, আর কয়েক ফোঁটা শুকনো কিছু লাল-বাদামি দাগ।
এসআই ধমক দিয়ে বললেন, —"তুমি আমাদের耍 করছো নাকি? এই ভিডিও ফেক হইতে পারে!"
আমি মোবাইল বের করে দেখালাম। কিন্তু অবাক হয়ে দেখি—ভিডিও প্লে হচ্ছে না। লেখা আসছে—“File corrupted.”
আমার গলা শুকিয়ে গেল। মাথা ঘুরছিল।
—"আপনারা বিশ্বাস করুন, আমি মিথ্যা বলছি না!" আমি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলাম।
তারা আর কিছু না বলে চলে গেল।
তিনদিন পর, আমি খবর পেলাম—এসআই সোহেল নিখোঁজ।
পাঁচদিন পরে তার একটা হাত পাওয়া গেল খালের পাশে। বাকি শরীর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
গ্রামে এখন কেউ আর নাসিরের নাম নেয় না। তার দোকানের জায়গাটা এখনো খালি পড়ে থাকে। সন্ধ্যার পর কেউ আর যায় না তেঁতুলগাছটার দিকে।
আর আমি? আমি এখনো সেই চোখের ভেতরের গন্ধ ভুলতে পারি না।
তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জিনিসটা কি জানেন?
গতকাল রাতে, আমার দরজার নিচে একটা ছোট্ট কাগজ পাওয়া গেছে।
তাতে লেখা ছিল—
"আগামী সপ্তাহে আবার দোকান খুলবে। এবার আপনি চাইলে অতিথি হোন।"
সেদিন রাতেই আমি ঘুমাতে পারিনি। দরজার নিচ দিয়ে আসা কাগজটার লেখা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল—
"আগামী সপ্তাহে আবার দোকান খুলবে। এবার আপনি চাইলে অতিথি হোন।"
আমি জানতাম এটা কোনো সাধারণ কৌতুক নয়। আমি জানতাম, এটা একটা সরাসরি হুমকি।
ঘরটা তখন নিঃশব্দ, বাইরের বাতাসে তালপাতার ঘর্ষণে একরকম শুঁয়োপোকার সরসর শব্দ হচ্ছিল। জানালার ফাঁক দিয়ে তেঁতুলগাছটাকে অনেক দূর থেকে দেখাচ্ছিল কালো, স্থির, কিন্তু যেন দেখছিল আমায়—জেগে থাকা কোনো জীবন্ত কিছু।
পরদিন আমি একটানা সারা দিন কারও সঙ্গে কথা বলিনি। মাথা নিচু করে রাস্তা দিয়ে হেঁটেছি। গ্রামের মানুষজন যেন আমাকে আলাদা নজরে দেখছে এখন। ছোট বাচ্চারা খেলা থামিয়ে তাকায়, বুড়োরা মুখ ঘুরিয়ে নেয়, আর কয়েকজন চেনা মুখ দূর থেকে চোখাচোখি হতেই পেছন ফিরে হাঁটা দেয়।
আমার বুকের ভেতর ততক্ষণে জমে উঠেছিল এক ধরনের নির্লজ্জ আতঙ্ক। মনে হচ্ছিল আমি কোথাও একটা ভুলে ঢুকে পড়েছি—এমন কোনো লুকানো চক্রের মধ্যে, যেখানে একটা গ্রামের মানুষজন সবাই মিলে একটা বিকৃত গোপনতা লুকিয়ে রেখেছে।
আমি একদিন সাহস করে গ্রামের এক পুরনো লোক, হাফেজ মকবুল সাহেবের কাছে যাই। উনি একা থাকেন মসজিদের পেছনে, পঁচাত্তর বছর বয়স, খুব বেশি কারও সঙ্গে মেশেন না।
আমি খুব সতর্কভাবে বললাম, —"চাচা, আপনি কি আগে কখনও নাসিরের দোকান নিয়ে কিছু সন্দেহ করেছেন?"
উনি একটু থেমে বললেন, —"তুই কেন এইসব বলছিস?"
—"কারণ আমি নিজে নিজের চোখে দেখেছি, সে মানুষ ভাজি করে।"
উনি হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন, দরজার বাইরে তাকালেন, তারপর আমার গলা চেপে ধরে বললেন, —"বাঁচতে চাইলে এ কথা আর কাউকে বলিস না। গ্রামের যা আছে, থাকতে দে। তুই চলে যা এখান থেকে। কিছু জিনিস চোখে দেখা যায়, ব্যাখ্যা হয় না, কিন্তু তাও বলা যায় না।"
আমি হতভম্ব হয়ে ওনার হাত ছাড়িয়ে এলাম।
ঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করলাম কেউ যেন আমার পেছন পেছন আসছে। আমি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম—কেউ নেই। কিন্তু একটা অদ্ভুত গন্ধ যেন ধাওয়া করে আসছে—কাঁচা মাংস, পঁচে যাওয়া হাড় আর পোড়া মশলার গন্ধ।
রাত ১২টা নাগাদ আমার জানালার গরাদে আঙুলের ছায়া পড়ল। আমি লাইট বন্ধ করে কাঁপতে কাঁপতে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করলাম।
হঠাৎ জানালার কাঁচে ‘টুক…টুক…টুক…’ করে কেউ যেন টোকা দিতে লাগল। ধীরে ধীরে টোকাটা জোরালো হলো। কাঁচ ভাঙবে কি না সন্দেহ হচ্ছিল।
তারপর হঠাৎ—একটা নারীকণ্ঠ!
—"ভেতরে আছেন আপনি? রিজু ভাই? দরজা খুলেন… আমার ভাই নিখোঁজ… আমাকে সাহায্য করুন…"
আমি ধরা গলায় বললাম, —"কে আপনি?"
—"আমার নাম রুহি। মজনুর ছোট বোন।"
আমি একটু দ্বিধা করে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বললাম, —"আপনি জানেন আপনার ভাই শেষ কোথায় গিয়েছিল?"
—"নাসিরের দোকানে। তারপর থেকে আর ফেরেনি। আমি জানি আপনি কিছু জানেন। আমি দেখেছি আপনাকে দোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে সেদিন।"
আমার গলা শুকিয়ে গেল। মেয়েটা আমাকে অনুসরণ করেছিল? না, কে জানে, তার ভাই নিখোঁজ, হয়ত হতাশা থেকে ভরসা চাইছে।
আমি দরজা খুললাম না, কেবল বললাম, —"আপনি এখান থেকে যান। এটা নিরাপদ না। আমি যা দেখেছি, সেটা আপনি জানলে ঘুমাতে পারবেন না।"
তারপর আবার সে বলল, —"আমাকে দরজা খুলে কিছু সময় কথা বলার সুযোগ দিন… আমি জানি, আমার ভাই বেঁচে নেই। আমি শুধু জানি সে কীভাবে মরেছে…"
কণ্ঠটা এবার একটু কেঁপে উঠল, এবং পরমুহূর্তে… এক অদ্ভুত কণ্ঠে সে বলল—
"আমি জানি কিভাবে নাসির রান্না করে… আমি জানি সে মাংস আগে ঝাঁঝালে ধুয়ে নেয়… তারপর…"
আমি ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলাম, দরজার পাশে পড়ে গেলাম।
যখন সাহস করে উঠে জানালার দিকে তাকালাম, দেখলাম—কেউ নেই।
পরদিন সকালে আমি জানালার পাশে শুকনো রক্তের দাগ দেখতে পেলাম। যেন কেউ আঙুল কেটে দেয়ালে কিছু লিখে রেখেছিল—
"তোমার রক্ত অনেক সুস্বাদু হবে।"
আমি এবার সত্যি আর মানসিকভাবে স্থির থাকতে পারছিলাম না। তিনদিন পর থানায় আবার গেলাম, কিন্তু এবার কাউকে পেলাম না। এসআই সোহেল নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে থানায় একজন নতুন অফিসার বসেছে, যার নাম আমি আগে কখনো শুনিনি—শওকত হোসেন।
সে আমার মুখের কথা শুনে বলল, —"আপনি বেশি রাত জাগেন মনে হয়। একটু ঘুমান, সব ঠিক হয়ে যাবে।"
তার চোখের দৃষ্টি কেমন যেন ঠান্ডা, ফাঁপা… আর হাসি ছিল একেবারে নাসিরের মতো।
আমি হাঁটতে হাঁটতে বাজারের দিকে গেলাম।
দেখি, সবাই আনন্দে কথা বলছে—“শুনছেন? নাসির ভাই আবার দোকান খুলছেন! পরশু নাকি আবার চালু হবে!”
আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলাম স্তব্ধ হয়ে। লোকজন বলছে, “এইবার নাকি নতুন এক আইটেম আনবেন—যার স্বাদ আগে কেউ খায়নি!”
আমি তখন বুঝলাম—এই গ্রামটা কেবল দর্শক না, অনেকেই জড়িত। কারও চোখে ভয় নেই, কারও কানে সতর্কতা নেই। সবাই যেন মরে গেছে অনেক আগেই, আর এখন হাঁটছে কেবল শরীর নিয়ে।
আমি চুপ করে বাজার থেকে ফিরে আসলাম। ঘরে এসে দরজা বন্ধ করলাম।
চেয়ার টেনে লিখতে বসলাম—এইসব ঘটনাগুলো রেকর্ড করে রেখে যেতে হবে। হয়তো আমি বাঁচব না, কিন্তু কেউ যদি একদিন পড়ে, বুঝবে কী ভয়াবহ এক গ্রামে আমি এসেছিলাম।
রাতে ঘুম আসেনি। প্রায় তিনটার সময় জানালার ফাঁক দিয়ে তেঁতুলগাছের নিচে আলো জ্বলে উঠতে দেখলাম—চোখের সামনেই, নতুন করে গড়ে উঠছে একটা দোকান। হাতে হাত লাগিয়ে লোকজন জড়ো হচ্ছে, কাঠ বসাচ্ছে, টিন লাগাচ্ছে, চুলা বানাচ্ছে।
আমি দেখছিলাম—তারা সবাই গ্রামবাসী।
এখন আমি জানি… আমি একা না। আমি ঘেরাটোপে বন্দী।
এখন শুধু অপেক্ষা—পরশু রাতে কী হয়। দোকান খুলবে, অতিথি ডাকা হবে…
আর কেউ একজন, হয়ত আমি, হয়ত আরেকজন… ভাজি হয়ে যাবে নিঃশব্দে।
পরশুদিনের রাত। নাসিরের দোকান খুলেছে।
তেঁতুলগাছের নিচে সেই পুরোনো ছাউনিটা আবার দেখা যাচ্ছে। আবারও কেরোসিন বাতি জ্বলছে। আবারও সেই প্যাচপ্যাচে চুলার তাপে ভাজা হচ্ছে কিছু একটা। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে গা জ্বালানো এক অদ্ভুত গন্ধ, যেটা ঠিক খাবারের না, আবার গন্ধহীনও না। গন্ধটা যেন হাড়ের ভেতর ঢুকে পড়ে আর বমি করে ফেলতে ইচ্ছা করে।
আমি দূর থেকে দেখে যাচ্ছি। চোখের সামনে একেকজন গ্রামবাসী এসে দাঁড়াচ্ছে দোকানের সামনে। কেউ কেউ চেনা মুখ—হরিচরণ, বাচ্চু, বকুল কাকা… ওরা হাসছে, গল্প করছে, কিন্তু মুখের হাসিতে কোনো আলো নেই। যেন মুখে ছেঁড়া প্লাস্টার জোড়া দেয়া হয়েছে, যার নিচে আসল মুখ আর নেই।
একটু পরেই আবার সেই ভয়াবহ দৃশ্য—চুলার পাশে কাঠের বাক্স খুলে ফেলল নাসির। বাক্সের ভেতরে কাটা মাংস, একটা কাটা কবজি, আর সেই বিকৃত মাংসের টুকরোগুলো। এইবার সে এগুলোর ওপর লবণ ছিটিয়ে দিল ধীরে ধীরে, মাথা নিচু করে, যেন পুজোর থালায় ফুল দিচ্ছে।
আমার চোখ আটকে গেল তখনই—সে একজনের চামড়া ছাড়ানো মুখের তালু খুলে হাতে তুলে নিল। আমি বুঝলাম, আজকের ‘ডিশ’ এইটা।
আমি এতদিনে বুঝেছি এই গ্রামে কেউ আর মানুষ নেই। সবাই অংশীদার। সবাই এই বিকৃত কসাইখানার নীরব সদস্য। আমি একা। ভেঙে পড়া একটা কাগজের কেল্লা।
আমি ফিরে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পেছন ফিরেই দেখলাম—রুহি। সেই মেয়েটা, যাকে সেদিন দরজার বাইরে পেয়েছিলাম।
—"আপনি এখানেই থাকুন। আপনি একা না। আমি আছি," সে বলল।
—"তুমি জানো এখানে কী হচ্ছে?"
সে কাঁপা গলায় বলল, —"জানি। আমার ভাইকেও ওরা মেরে ফেলেছে। আমি কিছুদিন ধরে আপনাকে অনুসরণ করেছি, আপনি একমাত্র বাঁচার চেষ্টা করছেন। আমারও শুধু একটা উদ্দেশ্য…"
আমি ধীরে ধীরে বললাম, —"প্রতিশোধ?"
সে চোখ সরিয়ে বলল, —"না, সত্যি তুলে ধরা। একটিবার, মানুষকে দেখানো—এটা খেলাচ্ছলে নয়, বাস্তব ভয়।"
আমরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম—আজই ঢুকব দোকানে, ক্যামেরায় সব ধারণ করব, আর যদি কোনোভাবে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারি, তবে সেটা হবে প্রমাণ।
রাত ২টার দিকে দোকানের ভিড় কমে গেল। কেবল দু-তিনজন লোক ঝিমিয়ে বসে আছে। আমরা গাছের পেছন থেকে ঘুরে পেছনের রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে এগোলাম। আমি পকেটে রাখা ফোনের ভিডিও অন করে রাখলাম।
চুলার পাশে গিয়ে একটা সময় আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। নাসির তখন মুখ নিচু করে, আগুনে কিছু একটা ভাজছিল। হঠাৎ সে যেন টের পেল। মুখ তুলল। চোখে অদ্ভুত ঠান্ডা একটা শূন্যতা।
—"ভালোই করেছেন আসছেন," সে বলল। "আপনার জন্যই আজকের বিশেষ আইটেমটা রেখেছি।"
রুহি কাঁপতে কাঁপতে জবাব দিল, —"আমার ভাই কোথায়?"
নাসির হাসল। তারপর চুলার পাশে রাখা একটা ঢাকনা খুলে দেখাল… আধা পোড়া একটা মুখ। চোখ দুটো নেই, ঠোঁট গলে গেছে, কিন্তু চিনতে দেরি হয়নি।
রুহি হঠাৎ একটা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ল।
আমি দৌড়ে যেতে চাইলাম, কিন্তু দেখি চারপাশে হঠাৎ করেই লোকজন ঘিরে ফেলেছে। চারপাশ থেকে তারা এগিয়ে আসছে। তাদের মুখে হাসি, কিন্তু চোখে শূন্যতা।
একজন বলল, —"নতুন অতিথি পেয়েছি! দয়া করে বসুন, আপনার জন্য চুলা গরম!"
আমি আর কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একটা কাঠের বাটাম দিয়ে মাথায় বাড়ি লাগল। আমি অন্ধকারে পড়ে গেলাম।
চোখ খুলতে একটু সময় লাগল। চারপাশে গন্ধ… আগের সেই গন্ধ—পোড়া হাড়, রক্ত, মশলার ঝাঁজ। আমি বাঁধা ছিলাম একটা টিনের মাচায়, পেছনে খালি ঝোলানো মাংসের টুকরো। সামনে দাঁড়িয়ে নাসির। তার হাতে সেই পুরনো ছুরি, আর ঠান্ডা মুখ।
—"এইবার আপনি জানবেন আসল স্বাদটা কোথা থেকে আসে।"
সে আস্তে করে ছুরি চালাল আমার বাহুর চামড়ায়। রক্ত ঝরল। যন্ত্রণায় শরীর ছটফট করে উঠল, কিন্তু গলা বাঁধা।
হঠাৎ একটা কিছু ঘটল।
একটা ছায়ামূর্তি হঠাৎ করে দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়ে এক এক করে লোকগুলোকে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে চলেছে। কেবল ছায়া, মুখ নেই, শুধু একজোড়া জ্বলন্ত চোখ।
সবাই পালাতে চাইল, কিন্তু সে একে একে টেনে মাটিতে ফেলছিল।
শেষে আমি বুঝলাম… এটা রুহি না। এটা রুহির মৃত ভাই, যার আত্মা আজ ফিরে এসেছে।
দোকানটা জ্বলতে শুরু করল। তেঁতুলগাছের শেকড় থেকে আগুন উঠছে। কাঠের বাক্স ফেটে পড়ছে, ভেতর থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। আগুনের আঁচে আমার চোখ ঝলসে যাচ্ছিল।
শেষবার চোখ খুলে দেখি, সেই ছায়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
"এখনো সময় আছে। পালাও। আর কাউকে এটা ঘটতে দিও না…"
সকালে লোকজন দেখতে পায়, পুরো তেঁতুলতলা পুড়ে গেছে। দোকানের কোনো চিহ্ন নেই, শুধু একটা ছাই হয়ে যাওয়া কাঠের বাক্স। তার পাশে একটা মোবাইল, যেটা আমি রেখে গিয়েছিলাম। তার ভেতরে ছিল ভিডিও, চিত্র, গলার আওয়াজ—সব।
কিন্তু অবাক ব্যাপার—সেগুলো কেউ প্লে করতে পারছিল না।
আমি এখন বেঁচে আছি, একটা শহরের হাসপাতালের মানসিক বিভাগে।
ডাক্তার বলে আমি হ্যালুসিনেট করেছি।
কিন্তু আপনি যদি একদিন কালীগঞ্জ যান, যদি সন্ধ্যায় সেই রাস্তা দিয়ে যান, আপনি শুনতে পাবেন...
চুলার তাপে প্যাচপ্যাচে তেলে কিছু একটা ভাজা হচ্ছে।
আর বাতাসে একটা গন্ধ… পঁচা মাংস, মানুষের ত্বক, পোড়া চুলের মিশ্রিত গন্ধ।
ভাজির দোকান আবার খুলেছে।
এইবার আপনার ডাক পড়ে গেলে… আপনি ফিরবেন তো?
সমাপ্ত