28/09/2024
বিবাহিত নারীদের কত রকম দুঃখ থাকে জরায়ুর দুঃখ, ডিম্বনালীর দুঃখ, ডিম্বাশয়ের দুঃখ । এই দুঃখগুলোর কোনোটি আমার নেই ।
স্বামী-স্ত্রী একসাথে আছি তবু বাচ্চা হয়নি। দুজনেই ডাক্তার দেখিয়েছি, ডাক্তারি ভাষায় এটা ইনফার্টিলি অর্থাৎ বন্ধ্যাত্ব। ডাক্তার সমস্যা নেই বলে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ভাগ্য ভালো হলে এক সময় হতে পারে ----
ভাগ্যে সন্তান আর এল না। সন্তান নেই বলে মাতৃত্বের হাহাকার আমার বুকে নড়ে চড়ে ওঠে। বুকে মাতৃত্বের শূন্যতার সুর বাজে। স্বামীকে বললাম -একটা বাচ্চা এডাপশনের চিন্তা করলে কেমন হয়? আমার স্বামী নিরুৎসাহি হয়ে নারাজি হয়ে বললেন, না, তা হয় না । অ্যাডাপশন নিয়ে কোথাকার কোন বাচ্চাকে বড় করে নিজেদের সম্পদের ভাগীদার করব ? নিজের ভাই-বোনের ছেলেমেয়েরা আমাদের সম্পদ ভোগ করবে ।
আমি রাগান্বিত হয়ে বললাম, তাদের একজন ছেলে কিংবা মেয়ে নিয়ে আসো । আমরা নিজ সন্তান মনে করে লালন পালন করি ।
তিনি নিরস গলায় বললেন - কী দরকার ঝামেলা বাড়িয়ে -----
আমি ত্বরিৎ বলে উঠি --ঝামেলা হবে কেন আমাদের সন্তান হলে লালন পালন করতাম না ?
আমার এই কথায় তিনি কোনো জবাব দিলেন না ।
আমার আঁচল ধরে টেনে কথা বলবে, দুষ্টুমিতে মুখর করে তুলবে আমার চারপাশ । ছোট শিশুর মুখের মিষ্টি গন্ধে আমার প্রাণ জুড়াবে, আমার বুকের উষ্ণতায় ঘুমিয়ে থাকবে । এইসবের জন্য আমার মন ব্যাকুল হয় । বুকে সন্তান কামনার ঝড় উঠে ।
এই কথাগুলোই তাকে বুঝিয়ে বলি কিন্তু না সে অটল, অ্যাডাপশন নেবে না।
তার ভাই বোনের কোন ছোট ছেলে কিংবা মেয়ে আনবে না । আর তার সন্তান কে দিতে চায়?
তিনি যখন অফিসে চলে যান গৃহিণী আমি কী কাজ থাকে ? শূন্য ঘরে খাই, ঘুমাই, বিকেলে নিচে নেমে বাগানের গাছে পানি দিই । তার অফিস ছুটিতে তাকে নিয়ে আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যাই । এভাবেই কেটে গেল বিবাহিত জীবনের ১৫ বছর ।
একদিন বাড়ির খাজনার একটা জরুরি কাগজ খুঁজে পাচ্ছিলাম না । ঘরের এমন কোন জায়গা ছিল না কাগজটি খোঁজা হয়নি। খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির দলিল পত্রের ফাইল পর্যন্ত খুলে বসলাম। দলিলপত্রের ফাইল কখনো আমার ধরা হয় না। দলিলপত্রের ফাইল সে গুছিয়ে রেখে দিয়েছে। ওইগুলো আমার ধরার দরকার পড়েনি কখনো ।
দলিলপত্রের ফাইল এর মধ্যে দেখি একটা প্যাকেট তাতে ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষার দুটি কাগজ। কেন জানি হঠাৎ আমার মনে অন্যরকম চিন্তা এল, দলিলের ফাইলে ডাক্তারি পরীক্ষার কাগজ কেন? প্যাকেট সরিয়ে রাখলাম । ধীরে ধীরে মনে কৌতুহল জাগতে লাগল, কীসের রিপোর্ট ? একদিন বাসার পাশের গাইনি ডাক্তারের কাছে সিরিয়াল দিলাম। উদ্দেশ্য একটাই রিপোর্ট দুটো দেখাব। এই প্রবল আগ্রহের কারণ পরীক্ষার কাগজপত্রে তারিখ দশ বছর আগের !
এই গাইনি ডাক্তার আমার বন্ধ্যাত্বের খবর জানেন না । কারণ তার কাছে আমার কখনো যাওয়া হয়নি। আমি তো সব আশা ছেড়ে দিয়ে বসে আছি কত বছর ধরেই। তিনি বললেন , কী সমস্যা বলুন ?
আমি বললাম, আমার সমস্যা নিয়ে আসিনি । এসেছি রিপোর্টে কী আছে? কীসের রিপোর্ট ?
তিনি ভালোভাবে কতক্ষণ দেখে বললেন, সিমেন মানে বীর্যে শুক্রাণুর অবস্থা । এই রিপোর্টধারীর এজোস্পার্মিয়া অর্থাৎ এর বীর্যে শুক্রাণু নেই । শুক্রাণু না থাকা এই পুরুষদের দ্বারা বাচ্চার জন্ম হয় না ----কিন্তু এত বছর পর এই রিপোর্ট নিয়ে এলেন কেন ? কার এই রিপোর্ট?
আমার দাঁত খিল ধরে গেল ! কি বলব বুঝতে পারলাম না। শুধু বললাম, আমার স্বামীর ------
আমি বুঝে গেলাম তার বীর্যে শুক্রাণু নেই এটা ধরা পড়েছে আমাদের বিয়ের পাঁচ বছরের সময় মানে আজ থেকে দশ বছর আগে ! আমার কাছে গোপন রেখেছে। তাহলে পরবর্তীতে পরীক্ষায় তারও সমস্যা নেই এইরকম রিপোর্ট এল কেমন করে ? খুব বড় রকমের এক গোপন খেলা আমার সঙ্গে খেলা হয়েছে ?
আমার মনে পড়তে লাগল তার কত রকম আচরণের কথা৷ পরোয়াহীন দাম্ভিক স্বামীর আচরণ কেমন হয় তেমন ভাব নিয়েই তো চলত, এখনো চলে। রিপোর্ট লুকিয়ে একটুও অন্যায় করেনি এমন মানসিক শক্তি নিয়ে চলেছে বরং আমারই যেন অসম্পূর্ণতা, অপারগতা নিঃশব্দে এমন একটি ভাব নিয়ে চলেছে এতগুলো বছর । নিজের ত্রুটি গোপন রেখে দায়িত্বশীল স্বামীর ভূমিকা পালন করে এসেছে । তার দাদি একদিন বলেছিলেন, সন্তান না হলে কত পুরুষই তো দ্বিতীয় বিয়ে করে সন্তানের জন্য । তুই কী করবি চিন্তা করেছিস?
উত্তরে সে সাধু পুরুষের মতো উত্তর দিয়েছিলেন, তা কী করে সম্ভব ?
তার এই হঠকারিতা, চাতুর্য আমার হৃদয়ের গভীরে গিয়ে আঘাত করল । তার প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা কর্পূরের মতো নিমিষে আমার মন থেকে উড়ে গেল । এই বিষয়ে তার সঙ্গে কোনো কথা না বলে ছুটে গেলাম বাবার বাড়ি । বাবা মা তো ওইপারে গিয়ে সকল দায়িত্ব থেকে ছুটি নিয়েছেন । মায়ের মতো বড় ভাবির কাছে সব খুলে বললাম এবং আমার সিদ্ধান্তের কথাও জানালাম। ভাবি বিস্মিত কন্ঠে বললেন, এটা কেমন করে হয়? কখনো কোনো মেয়ের বেলায় এমন হয়েছে, তুমি শুনেছ?
আমি দৃঢ় গলায় জবাব দিলাম --আমি প্রথা ভাঙতে চাই, পাল্টাতে চাই । পুরুষ যা করেছে এতকাল, আমি তা করতে চাই ।
ভাবির বিস্ময় যেন কিছুতেই কাটছে না তেমনি আশ্চার্য কন্ঠে বললেন --সন্তান নেই তো কি হয়েছে? ভালোই তো আছ । নিজেদের বাড়িতে থাকো। স্বামী চাকরিজীবী। অভাব নেই, সন্তানের অভাব নাহয় থাকল। সবাই কি সব পায় ?
আমি বললাম কী আর ভাবি আমাকে সান্ত্বনা দিলেন কী দিয়ে? আমি আবারও বললাম, আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল, আপনি আমার পক্ষে থাকবেন।
ভাবি যেন আকাশ থেকে পড়লেন ! বলো কী পাগল হয়েছ? তোমার ভাইকে আমি এই কথা বলব কীভাবে? তোমার সাথে আমিও পাগল হয়েছি সে এ কথাই বলবে ।
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম -পাগল হব কেন ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করেছি। আমার বয়স এখন ৩৫ । এই বয়সে কি সন্তান ধারণ সম্ভব নয় ? আমি তো সন্তান ধারণের জন্য সক্ষম তবে কেন সন্তান আমার ভাগ্যে থাকবে না?
মানুষ বলবে কী ? -- ভাবির এই কথায় আমি ক্ষেপে গেলাম , মানুষ বলবে কী ? এই চিন্তা করে সন্তান হয় না বা হবে না এমন স্ত্রী নিয়ে সন্তানহীন সংসার করার সাহস কয়জন স্বামী দেখায়?
ভাবি হঠাৎ রেগে গেলেন। বললেন তার সংসার করবে না সে কথা তোমার ভাইকে বলতে পারব কিন্তু তুমি যা বলছ এইকথা বলা সম্ভম নয় ।
ভাবির সাথে কখনো রাগ হয়ে কথা বলিনি । সেদিন প্রচণ্ড রেগে প্রশ্ন করলাম, আপনাদের মান ইজ্জতে লাগবে আমি এই স্বামীকে ত্যাগ করে আবার অন্যত্র বিয়ে বসলে? পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের এই আমাকে কেউ বিয়ে করবে না এই তো?
এইবার ভাবি হাত চেপে নরম গলায় বললেন, তারা পুরুষ হিসেবে নিজের দুর্বলতা, নিজের অক্ষমতা লুকিয়ে দাম্ভিকতার সঙ্গে স্ত্রীকে শাসন করে দাবিয়ে রাখতে পেরেছে এবং রাখছে। আমরা যে মেয়ে মানুষ ------
আমি ভাবিকে থামিয়ে দিলাম, হয়েছে ----হয়েছে আর বলতে হবে না মানে এই স্বামীর অভাবহীন সংসারই আমাকে করে যেতে হবে। তাকে ত্যাগ করে সন্তান কামনায় আবার অন্যত্র বিয়ে বসলে আপনাদের ইজ্জত চলে যাবে আর এটা করা আমার পক্ষে অসম্ভব !!
ভাবি চুপ করে রইলেন। তবে বিষয়টি আমার বড় ভাইকে জানিয়েছেন। বড় ভাই রাতে আমার ঘরে এলেন, দরজা বন্ধ করে খাটের ওপর বসলেন। আমার মাথায় হাত রেখে কেঁদে ফেললেন আর বললেন, বোন তোর কষ্ট বুঝি। এত বড় সত্য লুকিয়ে তোকে সে আঘাত করেছে। সে হয়তো তোদের সংসার রক্ষা করার জন্যই করেছে।
সংসার রক্ষা করা সন্তান হওয়ার চেয়ে কম জরুরি নয়। মানুষ চায় এক , হয় আরেক। চাইলেই কি তুই তোর মতো জীবন যাপন করতে পারবি ?
আমার স্পষ্টই মনে হলো, আমার ভাই পুরুষ, তাই পুরুষ শাসিত সংসারের পুরুষের পক্ষেই দাঁড়িয়ে আমাকে সান্তনা দিয়েছেন । সমঝোতা করে সংসার করতে বলেছেন ।
পরের দিন আশাহত ব্যথা নিয়ে যুগে যুগে আদর্শ নারীদের রেখে যাওয়া ধৈর্য আর আদর্শতার চাদরখানি শরীরে জড়িয়ে সংসারে ফিরে এসেছি ।
রান্না, খাওয়া, আর স্বামীর দায়িত্ব পালন করেই ৪০ বছর নিঃসন্তান থেকে তার সংসারে তার সঙ্গে আছি । শেকরহীন এক সম্পর্কের মাঝে গোপন গহিন দহন বুকে নিয়ে ------