28/10/2025
💙
#অভ্রায়ীনি_ঐশি
#পর্ব_১৬
জেসির রুমে পিনপতন নীরবতা। খাটের উপর বসে নখ খাচ্ছে জেসি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তিত হস্তে দ্রুত চুল বাঁধছে দোয়েল। আহিশও মাত্রই রুমে এসে বললো..
"আমি রেডি, তোদের হলো? "
জেসি বলে..
"বড় পাখি চুলটা বেঁধে নিলেই বেরোবো। "
ঐ সময় দরজার সামনে এসে বুকে দু হাত গুঁজে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো নিবিড়।...
"কোথাও যাওয়া হচ্ছে নাকি? "
দোয়েল পেছনে ফিরে তাকায়। চুল বাঁধা শেষ হতেই হাতব্যাগটা নিয়ে দ্রুত হাতে গুছিয়ে নিতে নিতে বললো...
" বোনকে কলে পাচ্ছি না। সেই সকালে বেরিয়েছে, এতক্ষণে চলে আসার কথা। কিন্তু আসেনি এখনো। ওকে খুঁজতে হবে... "
বলতে বলতেই নিবিড়ের পাশ কাটিয়ে বের হতে নিলেই নিবিড় এক হাতে দোয়েলকে আটকায়। রাগ হয় দোয়েলের, মুখ কুচকে বলে...
"কি সমস্যা আপনার? "
নিবিড় হেঁসে বলে..
"আমাকেও নিয়ে যাও? "
"তো চলুন না, আটকাচ্ছেন কেন? "
বলতে বলতেই দোয়েল আবার হাটা ধরে। নিবিড়ও তার পিছু পিছু সিড়ি বেয়ে নামে। সাথে আহিশ আর জেসিও। গাড়িতে উঠে বসে তারা। নিবিড় গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে একটু দূরে গিয়ে একটা গান চালিয়ে দিলো আরামসে। এমনিতেই চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে দোয়েলের, তার উপর নিবিড়ের এমন খাম খেয়ালিপনায় সে আরো রেগে যায়। চেচিয়ে বলে ওঠে...
"আমরা চিন্তায় মরে যাচ্ছি, আর আপনি কি শুরু করেছেন এসব? গান বন্ধ করুন এক্ষুনি। "
নিবিড়ও বলে ওঠে...
"ওমাহ, ঘুরতে যাচ্ছো, একটু মজা মস্তি হবে না? "
আহিশও বিরক্তি নিয়ে বলে...
"নিবিড় ভাই, এটা মজা করার সময়? "
"ছোটপাখি ভাইয়ের সাথে আছে। লাঞ্চ করছে বিরিয়ানি দিয়ে। ওর ফোন আর পার্স হারিয়ে গেছে তাই কলে পাওয়া যাচ্ছে না। সময় হলে চলে আসবে বাড়িতে। শান্তি? "
তিনজন একটু চিন্তা মুক্ত হলো। দোয়েল বলে উঠলো..
"তো আপনি এতক্ষণ বলেন কি কেন? আর এখন কোথায় যাচ্ছেন আবার? "
"ঘুরতে... "
আহিশ চেচিয়ে ওঠে...
"ইয়াহু, বহুদিন আউটিং এ যাই না ভাই। টাকা পয়সা তেমন নিয়ে বের হইনি। আজ সব তোর খরচ। "
জেসি বলে..
"তুই আগে বলবি না? জিসান ভাইয়ের জন্য ওয়েট করতাম.. "
"তোর ভাই, ভাবিকে নিয়ে ডেটে গেছে। আর আমরা এখন তার রোমান্টিক ডেট বাগরা দিতেই যাচ্ছি। "
তিনজন একসাথেই বলে ওঠে...
"ওয়াট!!!!"
নিবিড় হেঁসে বলে...
"ইয়েসস, তোরা কি ভদ্র হয়ে গেছিস? যেতে চাইছিস না? গাড়ি ঘুরিয়ে নিই তাহলে?"
আহিশ তারাহুরো করে বলে...
"না না না, আমরা যাবো ভাই। আজ তোর নাহ, জিসান ভাইয়ের পকেটে লাল বাত্তি জ্বালাবো। "
জেসি আপসোসের সুরে বলে উঠলো...
"ইশশ, আবির ভাই আর ছোটপাখি থাকলেও ভালো হতো। "
নিবিড় বিরবির করে বলে ওঠে...
"ওরাও তো ধরতে গেলে ডেটেই গেছে... "
--------
প্রায় দশ মিনিটের মতো জুতার সো রুমে উচু টুলের উপর বসে আছে চড়ুই। আবির একটার পর একটা জুতো এনে এনে চড়ুইকে পড়াচ্ছে আর মানায়নি বলে বলে রেখে দিচ্ছে। চড়ুই এবার বিরক্ত হয়েই বলে উঠলো...
"আরেহ এমনি এক জোড়া নিয়ে নিলেই তো হলো। এতো মানামানির কি আছে? "
আবির যেন শুনতেই পেলো না তার কথা। নিজের মতোই কাজ করতে লাগলো। বেশ অনেকক্ষণ পর এক জোড়া জুতা এনে পড়িয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ দেখে বলে..
"পার্ফেক্ট।"
চড়ুই তাকায় নিজের পায়ের দিকে। জুতো জোড়া ভীষন সুন্দর। ছেলে মানুষ হয়েও এতো ভালো চয়েজ, তারিফ না করে পারলো না আবিরের। আবির কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করে...
"প্রাইজ?"
" সিক্স থাউজেন, স্যার... "
"ওকেয়, সেইম জুতো আরেক জোড়া প্যাক করে দিন। "
জুতার দোকান থেকে বের হতেই চড়ুই প্রশ্ন করে....
"আপনি কি আপনার গার্লফ্রেন্ডের সাথে প্রায় সময়ই জুতার দোকানে আসতেন? "
অসময়ে এমন উদ্ভট প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকে তাকায় আবির। চড়ুই তার দিকে একবার তাকিয়ে বললো...
" না মানে, এতো ভালো চয়েজ কি করে হুম? "
"তোমার পছন্দ হয়েছে? "
"হুম সুন্দর তো।"
"আমি মেয়েদের অনেক কিছুই চয়েজ করে নিতে পারি। জুতো, জামা, পাজামা, ওড়না, ইনার ট...."
"এই ছিহ!! "
বলতে বলতেই আবিরের মুখ চেপে ধরে চড়ুই। আবির বাঁকা হাসে। মুখ থেকে চড়ুইয়ের হাত সরিয়ে বলে...
"তুমি চাইলে, তোমার সব কিছুও চয়েজ করে দিতে পারি। যাস্ট সাইজটা বলো... "
"আপনি একটা চরম মাত্রার অসভ্য লোক। "
হেঁসে ফেলে আবির। চড়ুই উপরে উপরে রাগ দেখালেও গাল দুটো তার লালছে আভায় ছড়িয়ে যাচ্ছে, লজ্জায় কাবু হচ্ছে সে। আবির হাফ নিশ্বাস ফেলে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে...
"এখান থেকে হেটে গেলে পাঁচ মিনিটের পথ, গাড়ি পর্যন্ত। এতক্ষণ আরামসে কোলে চড়েছো, এখন নিজের পায়ে হেটে যাবে। "
"যাবো না "
"কি যাবো না? বাড়ি যাবে না তুমি? "
"গাড়িতে করে যাবো না।"
"তো? "
"রিক্সা নিন। "
"মাথা খারাপ? রোদ দেখছো তুমি? "
"তো কি হয়েছে। শীতের রোদ ভালো তো। গেলে রিক্সায় চলুন, না হলে আপনি যান আপনার গাড়ি করে। আমি একাই চলে যাবো।"
রাস্তা ঘাটে ঝগড়াঝাঁটি করতে চাইলো না আবির। অগত্যা এই পুঁচকে মেয়ের কথা মেনেই রিক্সায় করে বাড়ির দিকে রওনা দেয় তারা।
----------
ঝিল পাড়ে জিসান বসে অপেক্ষা করছে তারার জন্য। পাশেই একগুচ্ছ লাল গোলাপ৷ তারার জন্যই নিয়েছে সে। মেয়েটার অভিমান হয়েছে জিসান এই কয় দিনে তাকে একটুও সময় দেয় নি বলে। তাই আজ দ্রুত অফিস থেকে বেরিয়ে তারার জন্য ছুটে এসেছে সে। ঠোঁটের কোনের মুচকি হাসি যেন সরছেই না তার।
বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, দূর থেকেই দেখতে পায় তারা আসছে। শার্ট ঝেড়ে ঝুড়ে উঠে দাড়ায় ফুল হাতে জিসান। তারা সামনে এসে দাঁড়াতেই জিসান হাত নেড়ে বলে..
"হাই তারা.. "
সাথে সাথেই জিসানের পোছন থেকে সমোচ্ছ স্বরে ভেসে আসে...
"হাই ভাবি... "
ব্যস, চোখ গুলো গোল গোল হয়ে গেলো জিসানের। পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলো আহিশ, জেসি, দোয়েল আর নিবিড় দাত কেলিয়ে হাসছে৷ জিসান কিছু বলতে নিলেই তারা আবার হাত নাড়িয়ে একটি সুরে জিসানকে বলে উঠলো...
"হাই জিসান ভাইয়া..."
-------
বাড়ি ফিরেই ফ্রেশ হয়ে নিলো আবির। রুম থেকে বের হয়ে এসে নিবিড়ের রুমে একবার চেক করলো নেই সে। নিচ তলায় এসে খোলা বারান্দার কাছে যেতেই দেখলো সাবিহা হাতে বই নিয়ে বসে সেখানটায়। আবির গিয়ে আরেকটা চেয়ার টেনে বসে...
" ভাই ফেরেনি আম্মু? "
"ফিরেছে তো। বাকিদের নিয়ে ঘুরতে গেছে একটু। "
"আচ্ছা। "
বলেই আবির চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। সাবিহা বই থেকে মুখ তুলে আবিরকে এক পলক দেখে জিজ্ঞেস করে..
" কিছু বলবি? "
"হ্যা আম্মু... "
সাবিহা বইখানা বন্ধ করে টেবিলের উপর রাখে। সরাসরি আবিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে..
"বল না কি বলবি? "
"আম্মু, নিবিড় বড় পাখিকে ভালোবাসে৷ "
সাবিহার মুখে হাসি ফুটে উঠে। চমৎকার হেসে বলে...
"সে তো খুব ভালো কথা। আমারও পাখিদের খুব পছন্দ। ভীষন লক্ষ্মী মেয়ে দুটো। "
" ভাই স্টেবল এখন আম্মু। আমি চাইছি তুমি আব্বুর সাথে কথা বলো, দোয়েলের পরিবারকে জানিয়ে ওদের বিয়ের ব্যবস্থাটা করে রাখতে৷ "
সাবিহা খুশি হয়ে বলে ওঠে...
"আলহামদুলিল্লাহ, আমি আজই তোদের আব্বুর সাথে কথা বলবো। আমার দুই ছেলে বড় হয়ে গেছে, পছন্দ সই পাত্রীও বেছে নিয়েছে। এর থেকে বড় আর কি হতে পারে। পাখিদের আব্বুর সাথে কথা বলতে বলবো আমি, যেন উনারা উনাদের দুই মেয়েকে আমার দুই রাজপুত্রের জন্য দিয়ে দেয়... "
এতক্ষণ সব ঠিক থাকলেও আবির এবার মুখ তুলে তাকায় সাবিহার দিকে। আপত্তি জানিয়ে বলে...
"তোমার বুঝতে ভুল হচ্ছে আম্মু। আমি ভাই আর দোয়েলের কথা বলছি। আমি এই মুহুর্তে বিয়ে করছি না। "
সাবিহা এবারও হেঁসে বলে...
"আচ্ছা বাবা, তোরা নিজেদের সময় দে। এখন না হয় তোদের এঙ্গেজম্যান্টটা করিয়ে রাখবো, তারপর সময় দেখে বিয়ে..."
"আম্মু, আমি তা বলতে চাই নি। "
সাবিহার ভ্রু কুঁচকে যায়..
"তা হলে? "
"আমি শুধু বলতে চাইছি, ভাই দোয়েলকে ভালোবাসে। এতে আমায় কেন আনছো? আচ্ছা, তোমাদের যদি মনে হয় যে আমরা এক সাথে বিয়ে করি, তাহলে এখন ভাই আর দোয়েলের এঙ্গেজম্যান্টটা করিয়ে রাখো, তারপর আমার মেয়ে পছন্দ হলেই বিয়েটা একসাথে...
" মেয়ে পছন্দ হলে মানে? তুই ছোট পাখিকে পছন্দ করিস না? "
"আম্মু কি সব যা তা বলছো। ওই মেয়ে বিয়ে করার মতো নাকি? ওকে কেন আমি পছন্দ করবো। "
সাবিহার চোখ সরু হয়, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায় তিনি। জিজ্ঞেস করে...
"কি বলতে চাইছিস তুই? "
"আম্মু আমি এটাই বলতে চাই যে, দোয়েল যথেষ্ট বুঝদার মেয়ে, ভাইয়ের জন্য ও পার্ফেক্ট। কিন্তু চড়ুই পুরোটাই উল্টো। কোনো ম্যাচিউরিটি নেই, কথা বার্তার ধরন ঠিক নেই, সারাক্ষণ বাচ্চাদের মতো লাফালাফি, এসব আমার সাথে একদম যায় না আম্মু। আমার ওকে সহ্যই হয় না, রইলো তো বিয়ে। "
"তাহলে ঐ দিন রাতে ফার্ম হাউজে শিউলি তলায় ওটা কি ছিলো? "
থমকে যায় আবির। চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে চোখ তুলে তাকায় সাবিহার দিকে। অবাক হয়ে বলতে নেয়...
"আম্মু তুমি... "
"সেদিন বারান্দা থেকে আমি সবটা দেখেছি। তুই আর ছোটপাখি শিউলি তলায় একে অপরের সাথে.... "
কথা থেমে যায় সাবিহার, দৃষ্টি আটকায় বারান্দার প্রবেশদারে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা চড়ুইয়ের দিকে। খোলা সিল্কি চুলগুলো মৃদু বাতাশে উড়ছে। হাত থেকে চিরুনিটা ইতোমধ্যেই ফ্লোরে পড়ে শব্দ হয়, সেই শব্দেই কথা থামে সাবিহার। মাত্রই হেলেদুলে আয়েশার কাছে আসছিলো চুল বেধে দেওয়ার জন্য সে। কিন্তু এমন কিছু শুনে ওখানেই থেমে যায় ছোট্ট পাখিটা। আবির আর সাবিহার দৃষ্টি তার দিকে পড়তেই মাথা নত করে নেয় মেয়েটা লজ্জায়, নিজের প্রতি ঘৃণায়।
সাবিহা এক পলক আবিরের দিকে তাকিয়ে আবার তাকায় চড়ুইয়ের দিকে। কিছুটা রাগী গলায়ই বললো...
"এদিকে আয়..."
চড়ুই মুখ নিচু করেই এগিয়ে যায় সাবিহার কাছে। কিছু একটা হচ্ছে তার ভেতর, কিছু ভয়, কিছু হারিয়ে ফেলার আশঙ্কায় হাত কাঁপছে তার। কম্পমান হাতের চুরি গুলো রিনরিনে আওয়াজ তুলছে। সেদিকে ধ্যান দেয় না চড়ুই পাখি। তবে সাবিহার চোখ যায় সেথায়। আস্থা দিয়ে মেয়েটার হাত আঁকড়ে ধরতে নিলেই চড়ুই নিজেই দু হাতে সাবিহার এক হাত আঁকড়ে ধরে। মাথা তুলে তাকানোর সাধ্যি নেই তার, ভাঙা গলায় বলে ওঠে...
"আ্ আমি জানি তুমি এখন কি ভাবছো। আ্ আমি উনাকে সিডিউজ করেছি, এটাই তো ভাবছো তুমি তাই না?... "
সাবিহা করুন কন্ঠে ডেকে ওঠে...
"ছোটপাখি... "
"হ্যা, ছ্ ছোটপাখি খারাপ। খুব খারাপ আমি। সেদিন আমার কি হয়েছিলো, আ্ আমি নিজেও জানি না। কিন্তু আমি এটা জানি, যা হয়েছে তা মোটেও ভালো কাজ নয়। ত্ তুমি তো আমার মা নও, উনার মা। তাই উনার কোনো দোষ দিবেও না তুমি। সবটা আমারই দোষ। আমার ম্ মা থাকলে এখানে তোমার মতোই আমার দোষ দিতো না, বলতো সবটা উনার দোষ। এখন তো আমার মা নেই, আমাকে নিয়ে লড়ার মতোও কেউ নেই। ত্ তাই আমি শিকার করে নিচ্ছি যে আ্ আমারই দোষ। আমিই খারাপ। তুমি, তোমরা সবাই আমাকে ঘৃণা করবে, আমাকে পঁচা মেয়ে বলবে আমি তাও জানি। কিন্তু আন্টি... আ্ আমার বোনের এতে কোনো দোষ নেই, বিশ্বাস করো। আ্ আমার বোন এসবের কিচ্ছু জানে না। বারণ করার পর আমি কাউকে কিচ্ছু জানাইনি, বোনকেও জানাইনি। আমার বোন খুব ভালো আন্টি, আমি খারাপ।... "
সাবিহার হাতের উপর একের পর এক টুপ টুপ করে চড়ুইয়ের অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়ছে। সে বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে, এই বাচ্চা মেয়েটা এত কথা বলছে তাকে। কেন বলছে এসব?
চড়ুই মুখ তুলে চায় সাবিহার দিকে। কিন্তু তার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে মেয়েটার ভয় যেন আরো এক ধাপ বেড়ে যায়। হুট করেই চড়ুই নিচে বসে পড়ে, সাবিহার দু পা জড়িয়ে ধরে সে। আবির হতভম্ব হয়ে যায় চড়ুইয়ের এমন কাজে, কি করছে মেয়েটা...
চড়ুইয়ের কান্নার বেগ বেড়ে যায়। মেয়েটা হাইপার হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সাবিহার পা জড়িয়েই বলে উঠলো...
"আ্ আমি বোনকে নিজের মতো বুঝিয়ে এ্ এখান থেকে চলে যাবো আন্টি, আর কখনো তোমাদের কারোর সামনে পড়বো না সত্যি বলছি। তুমি আমার বোনকে কিছু বলো না প্লিজ। ব্ বোন এসব জানলে খুব কষ্ট পাবে, আ্ আমার সাথে সাথে বোনেরও অসম্মান হবে, আমার বোন তো ভালো, ওর তো কোনো দোষ নেই। ওর অসম্মান আমি চাই না আন্টি। তোমার পায়ে পড়ি আন্টি, দয়া করে বোনকে কিছু বলো না। বোনও যদি আ্ আমাকে ভুল বুঝে আমি কি নিয়ে থাকবো আর, আমার তো কেউ নেই ও ছাড়া। ত্ তোমরা হয়তো ভাবছো, আমরা অনাথ, মা ছাড়া বড় হয়েছি, বাবা তো থেকেও না থাকার মতো, ত্ তোমরা ভাবছো মা বাবার থেকে শিক্ষা পাইনি আমরা, বিগড়ে গেছি, খারাপ মেয়ে হয়েছি। কিন্তু তা মোটেও না আন্টি, আ্ আমি খারাপ হলেও আমার বোন একটুও বাজে মেয়ে না। আ্ আমরা তো তোমার ক্ কেউ না, তাই এসব বলেও তোমাকে বিশ্বাস করাতে পারবো না আমি, কিন্তু আমায় একটু দয়া করো আন্টি, প্লিজ তুমি বোনকে এসব বলো না ও ভেঙে পড়বে, আমি ওর ঘৃণা সহ্য করতে পারবো না আন্টি, ওর চোখে খারাপ হতে পারবো না আমি, আমি আজই চলে যাবো এখান থেকে, প্লিজ আন্টি... প্লিজ বোনকে এসব কিছু বলো না.... "
চড়ুইয়ের কন্ঠ মিলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে... কান্নার বেগ, হেচকি সব মিলিয়ে যেন একাকার অবস্থা তার। সাবিহা চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে যেন। বুক ভার হয়ে আসছে তার। ছলছল চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য স্বরে বলে উঠলো...
"ও্ ও কি বললো? আ্ আমি ওকে বিশ্বাস করবো না? আমি ওর মা না? কেউ না আমি ওর? এই মেয়েটা এ্ এসব বলতে পারলো? এত গুলো কথা বলতে পারলো ও...?"
আবির উত্তর দিতে পারে না। নিটেল দেহে শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। সাবিহার পা আলগা হতে থাকে চড়ুইয়ের হাত থেকে। এতক্ষণের উতলা কন্ঠ মিলিয়ে গেছে একেবারেই। মুহুর্তেই ঝনঝন আওয়াজ তুলে জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে চড়ুই। সাবিহা তাকাতেই আৎকে উঠে, ' আম্মুরে.." বলে চেচিয়ে বসে চড়ুইয়ের কাছে। আবিরও ছুটে আসে দ্রুত, চড়ুইয়ের মাথাটা দ্রুত নিজের কোলে তুলে নেয়।
চোখের পানিতে এলোমেলো চুল গুলো সারা মুখে লেপ্টে আছে তার। আবির দ্রুত হস্তে মুখ থেকে চুলগুলো সরিয়ে দেয় তার। গালে আলতো চাপড় দিয়ে ত্রস্ত কন্ঠে বার কয়েক ডাকে...
"ওয়াইফি? এই ওয়াইফি? এই মেয়ে.... "
সাবিহা ফ্লোর থেকে চড়ুইয়ের রক্ত মাখা হাতটা তুলে নেয়। চিৎকার করে বলে উঠে...
"আবির, ওর হাত থেকে রক্ত বের হচ্ছে তো।"
আবির দ্রুত হাতে চড়ুইকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরের দিকে ছুটে যায়। খোলা বারান্দা থেকে সর্ব প্রথম সাবিহাদের রুমটাই পরে, আবির এদিক সেদিক না তাকিয়ে সেই রুমে নিয়েই চড়ুইকে শুইয়ে দেয় বিছানায়। সাবিহার চিৎকারে নিজ নিজ ঘর থেকে আয়েশা আর জুলেখাও ছুটে আসে এ ঘরে। চড়ুইয়ের এই অবস্থা দেখে তারাও বিচলিত।
সাবিহার মন মানে না, মেয়েটার মাথা নিজের কোলে তুলে নিয়ে ঘন ঘন আদুরে হাত বুলিয়ে ডাকতে থাকে তাকে। এদিকে তার হাত থেকে এক প্রকার ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। জুলেখার দেওয়া চুড়ি গুলো সেদিনের পর থেকে একবারের জন্যও হাত থেকে খুলে নি। আজ সেই চুড়ি গুলোই চুর্ণ বিচূর্ণ হয়ে আছে, মুঠো ভর্তি চুড়ির মাঝে মাত্র তিনটা চুড়ি অক্ষত হয়ে চড়ুই পাখির হাত দখল করে আছে এখনো। বাকি গুলো রক্তে রঞ্জিত হয়ে ছড়িয়ে আছে খোলা বারান্দার শুভ্র ফ্লোরে। আবির ভীষন খেয়াল নিয়ে হাতের চুড়ি গুলো খুলে রাখে টেবিলে, ইতোমধ্যে তার হাতও ভরে গেছে চড়ুইয়ের রক্তে।
নিজেকে শান্ত করে আবির, বুক কাপছে তারও, অজানা এক ভয়, কিন্তু এই সময় এসব ভাবলে চড়ুই পাখির কিছু হয়ে যেতে পারে। বুকে সাহস সঞ্চার করে ঢোক গিলে চড়ুইয়ের হাতের কাটা স্থানটা একটু ছড়িয়ে দেখে.. শিরা কেটেছে কিনা কোনোভাবে...
আবিরের এমন কান্ড দেখেই সাবিহা কান্নারত কন্ঠে চিৎকার করে ওঠে...
"আবির, কি করছিস এটা।।রক্ত পড়া বন্ধ না করে তুই... "
"আম্মু প্লিজ তুমি শান্ত হও। চাচি ফাস্টএইড বক্সটা এনে দিবে প্লিজ? "
আয়েশা ছুটে গিয়ে এনে দেয় তা। আবির প্রথমেই রক্ত পরিষ্কার না করেই হাতে চিমটা তুলে নেয়। জুলেখা চিন্তিত কন্ঠে আবিরকে বাঁধা দিতে গিয়ে বলে...
"আবির বাবা, এটা কি করছিস? "
"কাচ ঢুকে গেছে মাংসে, এটা বের না করলে পরে সমস্যা হবে। "
বলতে বলতেই চিমটার সাহায্যে ছোট্ট কাচের টুকরোটা টেনে বের করে নেয় আবির।ভাগ্য ভালো শিরায় আঘাত লাগেনি, পাশ দিয়েই অল্পের জন্য কেটে গেছে। তারপর দ্রুত রক্তপাত বন্ধ করে হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয়। সাবিহার উতলা ভাব বেড়েই যাচ্ছে, কাঁদতে কাঁদতেই বললেন...
"আম্মুকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে, আবির চল না। ওর কিছু হয়ে যাবে...."
আবির পানির গ্লাস থেকে চড়ুইয়ের পানি ছিটিয়ে দিতে দিতে বলে...
"আম্মু প্লিজ তুমি শান্ত হও, ঠিক আছে ও। একটু পরেই জ্ঞান ফরিে আসবে। চাচি আম্মুকে একটু সামলাও প্লিজ..."
আয়েশা আর জুলেখা মিলে বেশ অনেক কষ্টে সাবিহাকে বুঝিয়ে রুম থেকে বাইরে নিয়ে যায়। আবির ব্যস্ত হয় চড়ুইকে সামলাতে...
-------চলবে--------