
19/08/2025
অন্য পত্রিকা থেকে: সাক্ষাৎকার
জন্মদিনে জহির রায়হানের অগ্রন্থিত সাক্ষাৎকার
‘আশা ছিল একজন ক্যামেরাম্যান হব’
কাজী জাহিদুল হক
জহির রায়হানের ছবি: গুগল
কিংবদন্তিতুল্য চলচ্চিত্রকার ও লেখক জহির রায়হানের (১৯ আগস্ট ১৯৩৫—৩০ জানুয়ারি ১৯৭২) জীবনকাল মাত্র ৩৬ বছরের। এই স্বল্পায়ু জীবনেই তিনি সৃষ্টি করে গেছেন কালজয়ী কথাসাহিত্য ও চলচ্চিত্র। সাংবাদিক, সম্পাদক, কথাসাহিত্যিক, চিত্রপরিচালক, প্রযোজক, চিত্রগ্রাহক, কাহিনিকার ও চিত্রনাট্য রচয়িতা, বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী, বীর ভাষাসংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা—সবই এই একটিমাত্র লোকের পরিচয়।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জহির রায়হান চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর প্রামাণ্যচিত্র স্টপ জেনোসাইড মুক্তিযুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় দলিল। ছবিটি তাসখন্দ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ১৯৭২-এ পুরস্কার অর্জন করে।
স্বাধীনতার পর ঢাকায় ফিরে তিনি জানতে পারেন অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সার ১৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ। বড় ভাইয়ের সন্ধানে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকার মিরপুরে গিয়ে নিজেই নিষ্ঠুর পরিণতির শিকার হন। তাঁর আর খোঁজ মেলেনি।
জহির রায়হান সম্পর্কে কৌতূহল দিন দিন বাড়ছে। তাঁর কাজই তাঁকে চেনার শ্রেষ্ঠ উপায়। তবু আত্মকথা আর সাক্ষাৎকারে শিল্পীর মনের গভীরতর খবর পাওয়া যায়।
হাজার বছর ধরে উপন্যাসের জন্য জহির রায়হান আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪) পান। কাঁচের দেয়াল চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৬৩ সালে পান নিগার পুরস্কার। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে কাঁচের দেয়াল চারটি ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করে উৎসবের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়। জহির রায়হান শ্রেষ্ঠ পরিচালকসহ একাধিক পুরস্কার অর্জন করেন।
প্রয়াণের পর জহির রায়হান বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার ইত্যাদিতে সম্মানিত হন। তাঁর চলচ্চিত্র ও সাহিত্যের বিষয় তাঁকে সমাজ ও রাজনীতিসচেতন শিল্পী হিসেবে অভিষিক্ত করেছে।
জহির রায়হান সম্পর্কে কৌতূহল দিন দিন বাড়ছে। তাঁর কাজই তাঁকে চেনার শ্রেষ্ঠ উপায়। তবু আত্মকথা আর সাক্ষাৎকারে শিল্পীর মনের গভীরতর খবর পাওয়া যায়। পুরোনো পত্রিকা থেকে জহির রায়হানের কয়েকটি আত্মস্মৃতিমূলক লেখা ও সাক্ষাৎকারের খোঁজ পাওয়া গেছে। সেগুলোতে ব্যক্তি জহির রায়হানের অনুভূতির খবর পাওয়া যায়।
আজ জহির রায়হানের জন্মদিন। সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিল ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে, আন্ওয়ার আহমদ সম্পাদিত রূপম: একটি অনুপম সংকলন নামের সাহিত্যপত্রে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন চলচ্চিত্র সাংবাদিক এফ কবীর চৌধুরী। সাক্ষাৎকারটি কোনো বইয়ে এখনো অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
জনাব জহির রায়হানও মূলত সাহিত্যিক। সাহিত্যিকদের ভাষা যে প্রাণের ভাষা, মনের ভাষা। আর ছায়াছবি তো মানুষের মনে দোলা জাগিয়ে অনুভূতিপ্রবণ করে তোলার একটি বড় মাধ্যম।
‘তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। একটা “ফাংশন” উপলক্ষে দাওয়াত করতে গেছি সাহিত্যিক ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ সাহেবকে। বিশ্ববিদ্যালয়েরই “ফাংশন”। ওই সময়েই চিত্রপরিচালক জনাব কারদারের (কিংবদন্তিতুল্য পরিচালক এ জে কারদার) সঙ্গে আমাকে তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন। কথায় কথায় উনি আমাকে চিত্রপরিচালনায় আসার কথা বললেন। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। পূর্ব পাকিস্তানের নির্মিত ছবি জাগো হুয়া সাভেরাতে পরিচালকের সহকারী হয়ে কাজ শুরু করলাম। এটা ১৯৫৭ সনের কথা। তারপর সালাউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে যে নদী মরুপথেতে সহপরিচালকের ভূমিকা গ্রহণ করি। বইটির চিত্রনাট্যও আমি তৈরি করেছিলাম। ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শেষ পরীক্ষায় পাস করে ১৯৬১ সনে কখনো আসেনি চলচ্চিত্রটি নিজস্ব পরিচালনায় শেষ করি।’
ওপরের কথাগুলো বললেন আজকের সবচেয়ে ব্যস্ত জনপ্রিয় পরিচালক জনাব জহির রায়হান সাহেব।
আপনার চিত্রপরিচালনার পূর্ববৃত্ত তো শুনলাম। কিন্তু আপনি যে চিত্রপরিচালক হবেন, এ কথা আগে থেকেই ভাবতেন?
: মোটেই না। আশা ছিল একজন ক্যামেরাম্যান হব। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই কলকাতায় প্রমথেশ বড়ুয়া মেমোরিয়াল ইনস্টিটিউট অব সিনেমাটোগ্রাফিকে ভর্তি হই এবং কিছুদিন পড়ালেখা করার পর ছেড়ে দিই।
: কলকাতায় ছিলেন তাহলে এর আগে?
: হ্যাঁ। কলকাতার কথা মনে হলেই মনে পড়ে বাবার কথা।
: আপনার বাবা?
: হ্যাঁ। আল্লামা কায়সার। বড় দ্বীনদার লোক ছিলেন তিনি। কলেজে শিক্ষকতা করতেন। আর আমার ধারণা ছিল, লেখাপড়া করে আমিও শিক্ষকতার ব্রতকে গ্রহণ করব। কিন্তু হলো না। আলেমের ঘরে জালেম হয়ে জন্মেছিলাম…
: আরে না না। কী যে কন! আপনারাই তো আজকের দিনে সত্যিকার গুণী লোক। অগণিত দর্শকের কণ্ঠে কণ্ঠে আপনাদের চিত্রপরিচালনার সুখ্যাতি।
: সে যাহোক, নিজের অজান্তেই চিত্রাঙ্গনে এসে পা রাখলাম। জানি না ভবিতব্য কোন দিকে নিয়ে যাবে।
: আচ্ছা আপনি তো ভালো সাহিত্য করতেন, ইদানীং তা ছেড়ে দিলেন কেন?
: না, ছেড়ে দিইনি, কাজের চাপে পেরে উঠছিনে, এই যা। নইলে ছবিতে হাত দেওয়ার আগে পত্রিকা সম্পাদনার কাজও তো শুরু করেছিলাম। এ দেশে আমিই প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করি। পত্রিকাটির নাম ছিল সাপ্তাহিক প্রবাহ।
: নিজস্ব পরিচালনায় কটি ছবি আপনার মুক্তি পেয়েছে?
: হিসেব করুন না—কখনো আসেনি, সোনার কাজল, কাঁচের দেয়াল, সংগম (প্রথম উর্দু ও রঙিন), বাহানা (প্রথম সিনেমাস্কোপ), বেহুলা, আনোয়ারা। তা ছাড়া সামনে খান দুই একই সঙ্গে শুরু করছি। শুনেছেন বোধ হয় লেট দেয়ার বি লাইট ইংরেজিতে করছি। এর থেকে সুবিধামতো আরও পাঁচ–ছয় ভাষায় ডাবিং করব। অন্য আরেকটি বই উর্দুতে করছি।
জহির রায়হান সাহেবের দুই ভাই কলেজে পড়ছেন, এক ভাই তাঁর সঙ্গে চিত্রজগতেই যুক্ত, অন্য আরেক ভাই সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার। সংবাদ–এর যুগ্ম সম্পাদকের কাজ করছেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে যথেষ্ট নাম কিনেছেন তিনি।
জনাব জহির রায়হানও মূলত সাহিত্যিক। সাহিত্যিকদের ভাষা যে প্রাণের ভাষা, মনের ভাষা। আর ছায়াছবি তো মানুষের মনে দোলা জাগিয়ে অনুভূতিপ্রবণ করে তোলার একটি বড় মাধ্যম। তাই তিনি চেষ্টা করেন তাঁদের প্রাণের ভাষায় কথা বলার জন্য। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। আমরা এই উপাদানকে ছবি তৈরির কাজে ব্যবহার করতে পারি। তাতে নতুনত্ব থাকবে, মানুষ খুঁজেও পাবে অনেক কিছু। কিন্তু সে কয়জন মানুষ? ওই ধরনের অনুভূতিশীল ছবি কয়জন লোকে দেখবে?
আমরা কি ছবি করার কলাকৌশল অন্যান্য দেশের থেকে কম জানি বা আমাদের ছবির অন্যান্য দেশের ছবি থেকে মান কোনো দিকে অনুন্নত? মোটেই না। বরং এই এগারো বছরে আমাদের দেশে যা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে উন্নত হয়েছে, সেই তুলনায়—আমাদের বাংলারই অন্য একটি অংশ তার বিশ বছর লেগেছে।
সে যাহোক, সুযোগ এবং সময় এলে আমরা তার সদ্ব্যবহার করব।প্রথম আলো’র অনলাইন থেকে