
27/07/2025
ধরুন, আপনি এক বিশাল হলে ঢুকলেন। আলো নিভিয়ে দেয়া হলো, ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও আলো নেই, নেই কোনো শব্দ। হঠাৎ আপনি অনুভব করলেন—এই অন্ধকারটাই যেন আপনাকে গিলে ফেলছে। অথচ, আপনি আলো বন্ধ করতে চাননি। আপনি শুধু চাইছিলেন, আলোটা বদলাক। কিন্তু যেহেতু নতুন কোনো আলো জ্বলেনি, তাই পুরনোটা নিভে যেতেই আপনি হারিয়ে গেলেন।
এটাই আজকের বাস্তবতা—যখন ইসলামপন্থী রাজনীতি শোবিজ নিয়ে কথা বলে ‘নিষেধ’ দিয়ে, কিন্তু সমমানের কোন ‘বিকল্প’ দেয় না।
--------------------------------------------------------------
বাংলাদেশের মিডিয়া ও বিনোদন খাতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই।
- বাংলাদেশের মিডিয়া ও এন্টারটেইনমেন্ট মার্কেটের ২০২৪ সালের আয় ৩.১১ বিলিয়ন ডলার
- এর মধ্যে ডিজিটাল মিডিয়ার অংশ (ভিডিও গেম, স্ট্রিমিং ইত্যাদি) ১.১১৭ বিলিয়ন ডলার
- GP Music-এর কেবল ২০১৬ সালের পেইড সাবস্ক্রাইবার: ৬ লাখ+
- Nielsen ও NMS রিপোর্ট অনুযায়ী:
o ৯০.৯% দর্শক বাংলাদেশী অনুষ্ঠান নিয়মিত দেখেন
o ৪০.৭% দর্শক ভারতীয় চ্যানেল থেকে চলচ্চিত্র উপভোগ করেন
o মাত্র ৩৬% দর্শক বাংলা ভাষার নাটক, খবর ও টকশো পছন্দ করেন
--------------------------------------------------------------
জামায়াতে ইসলামীর প্রতি শোবিজ এবং বিনোদন সংশ্লিষ্টদের প্রধান ভয়—"তারা ক্ষমতায় এলে মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি কর্মহীন হয়ে পড়বে এবং ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে যাবে"।
এই ভয় অমূলক নয়। কারণ, ইসলামী দল হিসেবে জামায়াত শোবিজ নিয়ে কখনোই স্পষ্ট কোনো পজিশন নেয়নি। বরং নেতিবাচক মনোভাবই দৃশ্যমান থেকেছে। ফলে, মিডিয়া বা এন্টারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি জামায়াতের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই অবিশ্বাসী। এই বিভ্রান্তিই জামায়াতকে গণমানুষের কাছ থেকে দূরে রাখছে, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম ও সংস্কৃতি সংশ্লিষ্ট শ্রেণির কাছে।
--------------------------------------------------------------
মিডিয়া ও বিনোদন ব্যবসা নিয়ে জামাতের জন্য সামনে দ্বিমুখী সংকট—
১। শোবিজের বর্তমান কাঠামো ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক – এটাকে জামায়াত অস্বীকার করে না।
২। তবুও তারা কোন ‘বিকল্প বিনোদন সংস্কৃতি’ গড়ে তোলেনি, যেটা ইসলামিক হলেও আধুনিক ও ট্রেন্ডি। আমি আবারো বলছি, আধুনিক ও ট্রেন্ডি।
শুধু ‘না’ বললে মানুষ থেমে যায় না। মানুষের অভ্যাস থামানো যায় না, কিন্তু বদলে দেয়া যায়—এই সত্যটা অনুধাবন না করলে, জামায়াত তরুণ সমাজের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলবেই।
--------------------------------------------------------------
কি হতে পারে সমাধান?
১। রাজনৈতিক দল হিসেবে ইতিবাচক ও স্পষ্ট নীতি ঘোষণা:
জামায়াতকে সাহস করে বলতে হবে—"আমরা শোবিজ বন্ধ করবো না। প্রচলিত ঘরনার পাশাপাশি আমরা বেটার অল্টারনেটিভ প্রপোজ করব যেন মানুষ তা থেকে ভালোটা বেছে নিতে পারে। এতে করে যারা শোবিজ ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবসা করছেন তারা ইসলামী কন্টেন্ট মেকিং এর প্রতি ঝুঁকে যাবেন এবং খুবই অরগানিক্যলি একটা শিফট মানুষ লক্ষ্য করবেন। এভাবেই আমরা সবার অংশগ্রহণে একে সংস্কার করবো। মানুষের চাহিদা আমরা বুঝি, কিন্তু আমরা তার দিকনির্দেশনা পরিবর্তন করতে চাই, সময়ের সাথে, সবাইকে সাথে নিয়ে।"
২। ইসলামি মিডিয়া হাব গঠন:
অনলাইন স্ট্রিমিং, শর্ট ফিল্ম, ওয়েব সিরিজ, অ্যানিমেশন ও ভিডিও গেম—সবই ইসলামি আদর্শে ভিত্তি করে নির্মাণ করা সম্ভব। কিন্তু হতে হবে বিনোদনমূলক, মানসম্পন্ন, এবং বর্তমান সময়ের ট্রেন্ড অনুযায়ী। একটা বাস্তবতা বোঝা জরুরি যে, জামায়াত সমর্থিত যেসকল মিডিয়া এসব কাজ করে সেগুলো বর্তমান পৃথিবীর স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী অত্যন্ত নিম্নমানের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা জামায়াতের নিজস্ব রুচি স্যাটিস্ফাই করলেও যখন তা মুক্ত সংস্কৃতির মাঝে ছেড়ে দেয়া হয় তখন তা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে।
৩। ইসলামি সাংস্কৃতিক উৎসব:
গান, আবৃত্তি, শর্ট ফিল্ম, থিয়েটার সবই ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উৎসাহিত করে আলাদা ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করা যেতে পারে। সে আয়োজনের জন্য বিশ্বমানের ট্রেন্ডিং কোয়ালিটি বোঝা লোককে সাথে নিয়ে কাজটা করতে হবে। উন্মুক্ত সংস্কৃতির যুগে আপনি জোর করে আপনার রুচিকে বেঞ্চমার্ক বানাতে পারবেন না। বরং আপনাকে সত্যি সত্যিই কোয়ালিটি কাজ করতে হবে।
৪। Digital Platforms:
ইসলামি কনটেন্ট ভিত্তিক OTT প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে, যাতে ইসলামি মূল্যবোধ বজায় রেখে মানুষ বিনোদন উপভোগ করতে পারে।
৫। Influencer & Content Creator তৈরির ইনিশিয়েটিভ:
ইসলামি মূল্যবোধসম্পন্ন সৃজনশীল তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ইসলামী ইউটিউবার, শর্ট ফিল্ম মেকার, পডকাস্টার তৈরি করতে হবে।
--------------------------------------------------------------
ভোটের হিসাবে শোবিজের প্রতি স্পষ্ট অবস্থান মানেই তরুণদের প্রতি অবস্থান। কেবল মাদ্রাসা কিংবা দলীয় ইসলামপন্থী ছাত্র নয়, ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম–এই প্ল্যাটফর্মে সময় কাটানো কোটি তরুণ-তরুণীই আগামী নির্বাচনের ভোটব্যাংক। শোবিজে গড়ে তোলা ইতিবাচক বার্তা এবং বাস্তবসম্মত ইসলামি বিকল্পই জামায়াতকে তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারে।
"মানুষ গান চায়, নাটক চায়, গল্প চায়—কারণ এতে তারা জীবনের রং খুঁজে পায়। ইসলাম সেই রং কে কালো নয়, বরং অর্থপূর্ণ ও নূরানী করে তুলতে পারে। জামায়াত যদি সেই নূরের পথ দেখাতে চায়, তবে তাকে পথচলার জন্য লাইটহাউসও নির্মাণ করতে হবে—কেবল নিষেধের দেয়াল দিয়ে চলবে না।"