30/06/2025
বর্তমান যুগে একটি সাধারণ প্রবণতা দেখা যায় যে, অনেক সাধারণ মানুষ যারা দ্বীনের প্রাথমিক ইলমও অর্জন করেননি, এমনকি মাদরাসার বারান্দাতেও কখনো যাননি, তারাও শরিয়তের জটিল মাসআলার ক্ষেত্রে সরাসরি কুরআন-হাদীসের দলিল চেয়ে বসেন। তথাকথিত আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের কিছু ভাই এমন প্রশ্ন করে, যারা নিজেরাই শরীয়তের গভীর শাখা-প্রশাখা সম্পর্কে অজ্ঞ, অথচ আলেম, মুফতি বা উস্তাযের মুখ থেকে কোনো মাসআলা শুনলেই বলেন, “এর দলিল কী?” এটি একদিকে যেমন অজ্ঞতা, অন্যদিকে শরীয়তের প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের নামান্তরও বটে।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন:
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
(سورة النحل: ٤٣)
“তোমরা যদি না জানো, তাহলে যারা জ্ঞান রাখে তাদেরকে জিজ্ঞেস করো।”
(সূরা নাহল: ৪৩)
এই আয়াত শরীয়তের মৌলিক নির্দেশনা তুলে ধরে যে, সাধারণ মানুষের জন্য দলিল তালাশ করা নয়, বরং যিনি জানেন, তার কাছে প্রশ্ন করে মাসআলা জেনে তা মেনে চলাই হল সঠিক পথ। কুরআন-হাদীস বুঝা, ক্বিয়াস করা ও ইজতিহাদ করা সকলের কাজ নয়। এর জন্য গভীর ইলম, দীর্ঘ অধ্যয়ন, উসূলে ফিকহ, হাদীস ও তাফসীরের পূর্ণ জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
সাহাবায়ে কেরামের যুগেও অধিকাংশ সাহাবী সরাসরি কুরআন-হাদীস থেকে দলিল অনুসন্ধান করতেন না। তারা দ্বীনের যে কোনো বিষয়ে ফয়সালার জন্য ফকীহ সাহাবীদের দিকে রুজু করতেন। হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রাঃ) কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়ামানে পাঠানোর সময় তার উত্তরের ধরন থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, দ্বীনের হুকুম নির্ধারণ করা কতটা দায়িত্বশীল ও যোগ্যতাসম্পন্ন কাজ।
عَنْ مُعَاذٍ قَالَ: قَالَ لِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «بِمَ تَقْضِي؟» قُلْتُ: أَقْضِي بِمَا فِي كِتَابِ اللَّهِ، قَالَ: «فَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِي كِتَابِ اللَّهِ؟» قُلْتُ: فَبِسُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ، قَالَ: «فَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللَّهِ؟» قُلْتُ: أَجْتَهِدُ رَأْيِي وَلَا آلُو، قَالَ: فَضَرَبَ فِي صَدْرِي، وَقَالَ: «الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَفَّقَ رَسُولَ رَسُولِ اللَّهِ لِمَا يُرْضِي رَسُولَ اللَّهِ»
(رواه أبو داود: ٣٥٩٢)
হযরত মুআয (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কী দ্বারা বিচার করবে?” আমি বললাম, “আল্লাহর কিতাব দ্বারা।” তিনি বললেন, “তাতে না পেলে?” আমি বললাম, “রাসূলের সুন্নাহ দ্বারা।” তিনি বললেন, “তা না থাকলে?” আমি বললাম, “আমি আমার নিজ মতামত অনুযায়ী ইজতিহাদ করব।” তখন নবীজি (সা.) আমার বুকে আঘাত দিয়ে বললেন, “সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি রাসূলের দূতকে এমন বিষয়ে সঠিক পথনির্দেশ দিয়েছেন যা রাসূলকে সন্তুষ্ট করে।”
ইমাম ইবনু আবিল ইজ্জ (রহঃ) বলেন, সকল মানুষের জন্য দলিল বিশ্লেষণ করা আবশ্যক নয়, এটি শুধু আলেমদের কাজ। ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেন, যে ব্যক্তি ফিকহ বোঝে না অথচ দলিল নিয়ে কথা বলে, সে ফেতনার কারণ হয়। দলিল চাওয়া তখনই গ্রহণযোগ্য যখন সেই দলিল বিশ্লেষণ ও অনুধাবনের যোগ্যতা থাকে। অন্যথায় তা শুধু বিভ্রান্তি ও সন্দেহের দরজা খুলে দেয়।
তাকলীদ হল এমন একজন আলেমের অনুসরণ করা যিনি শরীয়তের গভীর ইলমে অভিজ্ঞ। কুরআনে এসেছে:
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنْفِرُوا كَافَّةً ۚ فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَائِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ
(سورة التوبة: ١٢٢)
“সকল মুমিনের একসাথে বাহির হওয়া উচিত নয়। তাদের প্রত্যেক দলে থেকে কিছু লোক বের হবে, যাতে তারা দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং ফিরে এসে নিজ সম্প্রদায়কে সতর্ক করতে পারে—যাতে তারা সাবধান হয়।”
(সূরা তাওবা: ১২২)
যখন অযোগ্য লোকেরা দলিল চাইতে শুরু করে এবং নিজেরা দলিল ব্যাখ্যা করতে যায়, তখন সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ায়। হযরত আলী (রাঃ) বলেন:
إِذَا جَلَسَ الْعِلْمُ فِي غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ
(رواه الدارمي: ٢٩٧)
“যখন ইলম অযোগ্যদের হাতে চলে যায়, তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করো।”
সুতরাং একজন সাধারণ মুসলমানের জন্য করণীয় হল, দ্বীনের ব্যাপারে বিশ্বস্ত আলেমদের অনুসরণ করা এবং তাদের প্রতি আস্থা রাখা। যেমন জটিল রোগে নিজের মত করে ওষুধ না খেয়ে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক, তেমনি শরীয়তের ক্ষেত্রেও অভিজ্ঞ আলেমদের নির্দেশনা মেনে চলাই নিরাপদ ও কল্যাণকর।
শেষ কথা এই যে, দ্বীন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা ইবাদত, কিন্তু তা করতে হবে আদব, বিনয় ও শ্রদ্ধার সাথে। প্রশ্ন এমন হওয়া উচিত: “আমার জন্য করণীয় কী?” তর্ক বা বিতর্কের উদ্দেশ্যে নয়—এমন প্রশ্নই শরীয়তের আলোকে গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসনীয়।