থিংকিং

থিংকিং একাকীত্বই সুন্দর,একাকীত্বই ভয়ংকর।

গা-যা আজকেই শেষ হয়ে যাবে না, হয়তোবা তারা শহরের সকল মানুষ মে-রে ফেলবে; সকল স্থাপনা ধ্বং*স করবে। কিন্তু যতদিন এই দুনিয়া আছ...
05/04/2025

গা-যা আজকেই শেষ হয়ে যাবে না, হয়তোবা তারা শহরের সকল মানুষ মে-রে ফেলবে; সকল স্থাপনা ধ্বং*স করবে। কিন্তু যতদিন এই দুনিয়া আছে ততদিন গা-যা ও ফিলিস্তিন আছে। এটা কোরআনের ওয়াদা। এটা রাসূলের জবান। কেয়ামতের আগে পৃথিবীর রাজধানী হবে আল-আকসা, সেন্টার পয়েন্ট হবে ফিলি-স্তিন।
ইসরা*য়েল, ইহুদীরা আমাদের উম্মাহ্ উপর অনেক অ*ন্যায়, অ*ত্যাচার জুলুম করবেই কিন্তু আমাদের হারাতে পারবে না। এর মধ্য দিয়েই আমাদের আশার আলো হয়ে একজন আসবেন এবং তিনি অবশ্যই আসবেন। আর তার হাত ধরেই আমরা বিজয়ের পথে হাটবো। ইনশাআল্লাহ..
©

03/03/2025

আমি পদ্মজা - ৫
___________
লাহাড়ি ঘর দু'ভাগ করা হয়েছে চাদর টানিয়ে। একপাশের চৌকিতে হেমলতা এবং মোর্শেদ থাকেন। অন্যপাশের চৌকি পদ্মজা,পূর্ণা ও প্রেমার দখলে। লাহাড়ি ঘরের পিছনের দরজা আপাতত প্রধান দরজা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পিছনে অনেক কচু গাছ ছিল। হেমলতা মোর্শেদকে নিয়ে জায়গা খালি করেছেন। এরপর সেখানে মাটির চুলা তৈরি করা হয়েছে। বড় সড়কে উঠার জন্য ঝোপঝাড় কেটে সরু করে পথ করা হয়েছে। এতে মোর্শেদের সাহায্য ছিল না। হেমলতা দুই মেয়েকে নিয়ে একাই করেছেন। শুটিং দলে অনেক পুরুষ। পদ্মজাকে ভুলেও তাদের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করতে দেওয়া যাবে না । হেমলতার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, পদ্মজার মুখ পুড়িয়ে দিতে। পরক্ষণেই নিজের উপর ঘৃণা চলে আসে। কী করে নিজের মেয়ের প্রতি এমন মনোভাব আসতে পারে? অথচ,পদ্মজার হাতে সূচ ফুটলে হেমলতার মনে হয় নিজের শরীরে আঘাত লেগেছে। কী জন্য এতো টান পদ্মজার প্রতি? ভেতরে ভেতরে হেমলতা এই প্রশ্নের উত্তর জানেন। শুধু প্রকাশ পায় না। না জানার ভান ধরে থাকেন।

' আম্মা? আজ আমি রাঁধি?'

পদ্মজার প্রতিদিনের প্রশ্ন! হেমলতা রাঁধতে দিবেন না জানা সত্ত্বেও পদ্মজা প্রতিদিন অনুরোধ করে। হেমলতা বিপদ-আপদ ছাড়া পদ্মজাকে রান্নাঘরে পাঠান না। সোনার শরীরে মাটির চুলার কালি লাগাতে হেমলতার মায়া লাগে। তিনি হাসেন। পদ্মজা মুগ্ধ হয়ে দেখে। হেমলতার বয়স ছয়ত্রিশ। শ্যামলা চেহারা। দাঁতগুলো ধবধবে সাদা। চোখের মণি অন্যদের তুলনার বড় আর গাঢ় কালো। চোখ দুটিকে গভীর পুকুর মনে হয়। ছিমছাম গড়ন। পূর্ণা যেনো মায়েরই কিশোরী শরীর। তবে তারা তিন বোনই মায়ের মতো চিকন আর লম্বা।

'আচ্ছা,আজ তুই রাঁধবি।'
পদ্মজা ভাবেনি অনুমতি পাবে। আদুরে উল্লাসে প্রশ্ন করে, 'সত্যি আম্মা?'
'যা, জলদি। আছরের আজান কবে পড়েছে!'

পদ্মজা রান্নার প্রস্তুতি নিতে থাকে। পূর্ণা আর প্রেমা হিজল গাছের নিচে পাটি বিছিয়ে লুডু খেলছে। প্রেমা বাটপারি করে। এ নিয়ে কিছুকক্ষণ পর পর তাদের মাঝে তর্ক হচ্ছে। সকালে বৃষ্টি হয়েছে। রান্না করতে গিয়ে পদ্মজা ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ পেল। কী সুন্দর অনুভূতি!

মোর্শেদ পদ্মজাকে রাঁধতে দেখে কপাল কুঁচকে ফেললেন।
ঘরে ঢুকে হেমলতাকে মেজাজ দেখিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, 'এই ছেড়ি রাঁন্ধে ক্যান? '
হেমলতা নির্লিপ্তভাবে জবাব দেন, 'আমি বলেছি।'
'কতদিন কইছি এই ছেড়ির হাতের রাঁন্ধন আমারে না খাওয়াইতে?'

মোর্শেদের কঠিন স্বর পদ্মজার কানে আসে। মুহূর্তে খুশিটুকু ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। সে জানে এখন ঝগড়া শুরু হবে। তার আম্মা, আব্বার অনুচিত কথাবার্তা মাটিতে পড়তে দেন না। তার আগেই জবাব ছুঁড়ে দেন।

'খেতে ইচ্ছে না হলে খাবা না। '
'রাইতবেলা না খাইয়া থাকবাম আমি?'
'খাবার রেখেও যদি না খেতে চাও সেটা তোমার সমস্যা। আমি বা আমার মেয়ে কেউই না করিনি। '

মোর্শেদ কিছু নোংরা কথা শোনাতে প্রস্তুত হোন। হেমলতা সেলাই মেশিন রেখে উঠে দাঁড়ান। তিনি যেন বুঝে গিয়েছেন মোর্শেদ কী বলবেন। আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে মোর্শেদকে বললেন, 'একটা নোংরা কথা উচ্চারণ করলে আমি আজ তোমাকে ছাড় দেব না। পদ্ম তোমার মেয়ে। আল্লাহ সইবে না। নিজের মেয়ে সম্পর্কে এতো নোংরা কথা কোনো বাবা বলে না।'

মোর্শেদ নোংরা কথাগুলো হজম করে নিলেন। তবে কিড়মিড় করে বললেন, 'পদ্ম আমার ছেড়ি না।'

'পদ্ম তোমার মেয়ে। আর,একটা কথাও না। বাড়িতে অনেক মানুষ। নিজের বিকৃত রূপ লুকিয়ে রাখ।'

মোর্শেদ দমে যান। চৌকিতে বসে বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়েন। চোখের দৃষ্টি অস্থির। পদ্মজার জন্মের পর থেকেই হেমলতার রূপ পাল্টে গেছে। কিছুতেই এই নারীর সাথে পারা যায় না। অথচ, একসময় কত মেরেছেন হেমলতাকে। হেমলতার পিঠে,উরুতে, ঘাড়ে এখনো মারের দাগ আছে। সময় কোন যাদুবলে হেমলতাকে পাল্টে দিল, জানা নেই মোর্শেদের।

_____________
রাতের একটা শুট করে সবাই বিশ্রাম নিচ্ছিল। চিত্রা তখন কথায় কথায় জানাল, 'লাহাড়ি ঘরে গিয়েছিলাম। মগা যে মেয়েটার কথা বলেছিল তাকে দেখতে। '
চিত্রার কথায় লিখন আগ্রহ পেলো না। চিত্রা কখনো কোনো মেয়ের প্রশংসা করে না। খুঁত খোঁজে বের করতে ভালো জানে। নিজেকে খুঁতহীন সেরা সুন্দরী মনে করে।

'মেয়েটার নাম পদ্মজা।মগা, পুরো নাম জানি কী?'
চিত্রা মগার সাথে কথা বললে, মগা খুব লজ্জা পায়। এখনো পেল। লাজুক ভঙ্গিতে জবাব দিল, 'উম্মে পদ্মজা।'
'ওহ হ্যাঁ। উম্মে পদ্মজা।'
চিত্রার পাশ থেকে সেলিনা পারভীন প্রশ্ন করলেন,'কী নিয়ে আলাপ হচ্ছে?'
সেলিনা পারভীন চলমান চলচ্চিত্রে চিত্রার মায়ের অভিনয় করছেন। চিত্রা বলল, 'এই বাড়ির মালিক যিনি উনার বড় মেয়ের কথা বলছি। এমন সুন্দর মুখ আমি দু'টি দেখিনি। মেয়েটার মুখ দেখলেই বুকের ভেতর নিকষিত, বিশুদ্ধ ভালো লাগার জন্ম হবে। এতো শ্রী ভগবান দিয়েছেন মেয়েটাকে।'

লিখন সহ উপস্থিত সবাই অবাক হলো। চিত্রার মুখে কোনো মেয়ের প্রশংসা! অবিশ্বাস্য! সবাইকে অবাক হয়ে তাকাতে দেখে চিত্রা বিব্রতবোধ করল। গলার জোর বাড়িয়ে বলল, 'সত্যি বলছি! সন্ন্যাসী ছাড়া কোনো পুরুষ এই মেয়েকে উপেক্ষা করতে পারবে না।'

পদ্মজাকে নিয়ে বেশখানিকক্ষণ আলোচনা চলল। আগ্রহ বেশি লিখনের ছিল। যখন শুনলো পদ্মজার ষোল বছর সে দমে গেল। ছোট মেয়ে! হয়তো এমন বয়সী বেশিরভাগ মেয়েরা স্বামীর ঘরে থাকে। তবুও লিখনের পদ্মজাকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। তার একটা বোন আছে, ষোল বছরের। এখনো দুই বেণি করে স্কুলে যায়। কত ছোট দেখতে! লিখন আনমনে হেসে উঠল।

__________
হিজল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মজা। রাতের জোনাকি পোকা চারিদিকে। পদ্মজা প্রায় রাতে মুগ্ধ হয়ে দেখে জোনাকি পোকাদের। মনে হয় দল বেঁধে হারিকেন নিয়ে নাচছে তারা। তবে, এই মুহূর্তে রাতের এই সৌন্দর্য পদ্মজার মনে ঢুকতে পারছে না। পদ্মজা ঠোঁট কামড়ে কাঁদছে। চোখ দু'টো জ্বলছে খুব। মোর্শেদ রান্না খারাপ হওয়ার অজুহাতে থালা ভর্তি ভাত,তরকারি ছুঁড়ে ফেলেছে পদ্মজার মুখে। চোখে ঝোল পড়েছে। তা নিয়ে হেমলতার সেকী রাগ! মোর্শেদ অবশ্য চুপ ছিলেন। তিনি তো রাগ মিটিয়েই ফেলেছেন। আর তর্ক করে কী হবে?

'পদ্ম?'
পদ্মজা তাকাল। হেমলতা ভেজা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, 'খুব জ্বলছেরে মা?'

পদ্মজা জবাব দিতে পারল না। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠল। মা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই তার। মায়ের আদর ছাড়া কারো আদর পাওয়া হয়নি। সবাই তার দোষ খোঁজে। হেমলতার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরোল। পদ্মজা ছিঁচকাঁদুনে। ছোট থেকেই কাঁদছে। তবুও জল ফুরোয় না। মন শক্ত হয় না। এমন হলে তো চলবে না! পদ্মজার কান্নার বেগ বাড়ল। হেমলতা সদ্য কাটা বড় গাছের বাকী অংশে বসলেন। চুপ করে পদ্মজার ফোঁপানো শুনছেন। পদ্মজা শান্ত হয়ে মায়ের পাশে বসল। তার মাথা নত। হেমলতা উদাস গলায় বললেন,'এভাবে চলবে না পদ্ম।

পদ্মজা তাকাল। হেমলতা বললেন,'শোন পদ্ম, কেউ আঘাত করলে কাঁদতে নেই। কারণ মানুষ আঘাত করে কাঁদানোর জন্যই। আর যখন উদ্দেশ্য সফল হয় তখন তারা শান্তি পায়। যে আঘাত করল তাকে কেন শান্তি দিবি? শক্ত থাকবি। বুঝিয়ে দিবি তুই এতো দূর্বল নয়। যারে তারে পাত্তা দিস না। হাজার কষ্টেও কাঁদবি না। কান্না সাময়িক সময়ের জন্য মন হালকা করে। পুরোপুরি নয়। যে তোকে আঘাত করবে তাকে তুই তোর চাল-চলন দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিবি। তখন তার মুখটা দেখে তোর যে শান্তিটা হবে সেটা কান্না করার পর হবে না। এই শান্তি স্থায়ী!'

হেমলতার কথা পদ্মজার উপর প্রভাব ফেলল না। সে করুণ স্বরে বলল, 'কিন্তু আব্বার ব্যবহার আমার সহ্য হয় না আম্মা। আমার সাথে কেন এমন করে আব্বা?'

'তাকে কখনো সামনাসামনি আব্বা ডাকার সুযোগ পেয়েছিস? পাসনি! তবুও কেন আব্বা, আব্বা করিস?
তাকে তুই পাত্তা দিবি না।'
'তুমি খুব কঠিন আম্মা।'
'তোকেও হতে হবে।'
'আব্বা কেন এমন করে আম্মা? আমিকি আব্বার মেয়ে না? আব্বা কেন বার বার বলেন, আমি তার মেয়ে না।'

হেমলতা চোখ সরিয়ে নেন। পদ্মজা জানে এই জবাব সে পাবে না। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। হেমলতা এক হাত পদ্মজার মাথায় রাখেন।
'কাঁদিস না আর। মায়ের রং না হয় পাসনি। মায়ের মতো শক্ত হওয়ার তো চেষ্টা করতেই পারিস।'
পদ্মজা নির্লজ্জ হয়ে আবার প্রশ্ন করল, 'আম্মা, আমি কি আব্বার মেয়ে না? বলো না আম্মা।'

পদ্মজার চোখ বেয়ে জল পড়ছে। খুব মায়া লাগছে হেমলতার। বুক ভারী হয়ে আসছে। তিনি আবেগ লুকিয়ে কণ্ঠ কঠিন করার চেষ্টা করলেন, 'মার খাবি পদ্ম। কতবার বলব, তুই আমার আর তোর আব্বার মেয়ে। '
'কি নাম আমার আব্বার?'

কী শান্ত কণ্ঠ পদ্মজার! হেমলতা চমকান তবে প্রকাশ করলেন না। মেয়েদের সামনে তিনি কখনো দূর্বল
হতে চান ন। পদ্মজার দিকে ঝুঁকে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন, 'তোর আব্বার নাম মোর্শেদ মোড়ল।'

পদ্মজা হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। মাকে খুব বিরক্ত লাগছে এখন। খুব কঠিন করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ' যাও এখান থেকে। আমার কাছে আর আসবা না। কখনো না। '

কিন্তু সে এমন ব্যবহার বাস্তবে কখনো পারবে না। কখনো না। রাতের বাতাসে ভেসে আসছে হাসনাহেনা ফুলের ঘ্রাণ। আকাশে থালার মতো চাঁদ। ঝিরিঝিরি মোলায়েম বাতাস চারিদিকে। পদ্মজার চোখের জল শুকিয়ে গেল। হেমলতা ঝিম মেরে বসে আছেন। একসময় নিস্তব্ধতা কাটিয়ে একটা অসহায় কণ্ঠ ভেসে আসল।
'মায়েরা তাদের জীবনের গোপন গল্প সন্তানদের বলতে পারে নারে পদ্ম।'

পদ্মজা তাকাল। হেমলতা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছেন। পদ্মজার কান্না পেল। মানুষটাকে এতো নরম রূপে মানায় না। পদ্মজা আশ্বস্ত করে বলল, 'আমি আর কখনো জানতে চাইব না আম্মা।'

_______________

শুটিং দলের একজনও বাড়িতে নেই। সবাই স্কুলে মাঠে গিয়েছে। কয়দিন ধরে নদীর ঘাটে যেতে না পেরে তৃষ্ণার্থ হয়ে উঠেছে পদ্মজা। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। হেমলতার অনুমতি নিয়ে সে ঘাটে চলে আসল। ঘাটের সিঁড়িতে বসল। কয়েক সেকেন্ড পর টের পেল, গান বাজছে কোথাও। গানের সুর অনুসরণ করে কয়টা সিঁড়ি নেমে আসে। ঘাটের বাম পাশে বাঁধা নৌকায় একজন পুরুষ বসে আছে। হাতে রেডিও। গানের উৎস তাহলে এখানেই। পদ্মজা বিব্রতবোধ করল। উল্টো দিকে ঘুরে ব্যস্ত পায়ে লাহাড়ি ঘরে চলে আসে। পদ্মজা এতো দ্রুত ফিরাতে হেমলতা প্রশ্ন করেন, 'কেউ ছিল?'

পদ্মজা মাথা নাড়াল। হেমলতা চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, 'কিছু বলেছে? দেখতে কেমন?'

' না আম্মা, কিছু বলেনি। আমাকে দেখেনি। মাথার চুল ঝাঁকড়া। মুখ খেয়াল করিনি।'

'এইটাই তো লিখন শাহ। নায়ক।'

পূর্ণা পুলকিত হয়ে বলল। হেমলতা আর কিছু বললেন না।

_____________

পূর্ণা সারাক্ষণ শুটিং দলটার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। হেমলতা বিরক্ত হয়ে পূর্ণাকে কড়া নিষেধ দিয়েছেন, আর না যেতে। যদি যায় মার একটাও মাটিতে পড়বে না। পূর্ণা ভয় পেয়েছে। কিন্তু লিখন শাহ আর চিত্রা দেবী জুটিটা এতো ভাল লাগে তার যে শুটিং না দেখলে দম বন্ধ লাগে। তাই সে চুপিসারে টিনে একটা ছিদ্র করেছে। হেমলতা সেলাই মেশিন লাহাড়ি ঘরের পিছন বারান্দায় রেখেছেন। সারাক্ষণ সেখানেই থাকেন। সে সেময় পূর্ণা ছিদ্র দিয়ে উঁকি দেয়। শুটিং দেখে। পূর্ণাকে সবসময় দেখতে দেখে পদ্মজার আগ্রহ জাগল। সে উঁকি দিল।

ঝাকড়া চুলের মানুষটা একজন অতি সুন্দরী মেয়েকে কোলে তুলে নিয়েছে। দৃষ্টি মোহময়। প্রেমময় গানের সুরধ্বনি বাড়ি জুড়ে। ক্যামেরা ধরে রেখেছেন কেউ কেউ। গানের শুটিং বোধহয়! পদ্মজা অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করল। লজ্জা পেল। চোখ সরিয়ে নিল।

চলবে....
®ইলমা বেহরোজ

03/03/2025

আমি পদ্মজা - ৪
___________
দিনটাকে পদ্মজার অলক্ষুণে মনে হচ্ছে। সকালে উঠে দেখল, লাল মুরগিটার একটা বাচ্চা নেই। নিশ্চয় শিয়ালের কারবার। রাতে মুরগি খোপের দরজা লাগানো হয়নি। আর এখন আবিষ্কার করল, দেয়াল ঘড়িটার কাঁটা ঘুরছে না। ঘড়িটা রাজধানী থেকে হানি খালামণি দিয়েছিলেন। গ্রামে খুব কম লোকই হাত ঘড়ি পরে। দেয়াল ঘড়ি হাতেগুণা দুই-তিনজনের বাড়িতে আছে। পদ্মজা সূর্যের দিকে তাকিয়ে সময়ের আন্দাজ করার চেষ্টা করল। পূর্ণা, প্রেমা দুপুরে খেয়েই ঘুম দিয়েছে। পদ্মজা মায়ের রুমে উঁকি দিল। হেমলতা মনোযোগ দিয়ে সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাই করছেন। আটপাড়ায় একমাত্র হেমলতাই সেলাই কাজ করেন। প্রতিটি ঘরের কারো না কারো পরনে তার সেলাই করা কাপড় আছেই।

'লুকিয়ে দেখছিস কেন? ঘরে আয়।'
হেমলতার কথায় পদ্মজা লজ্জা পেল।
'না আম্মা। কাজ আছে। '
'পানি দিয়ে যা।'
হেমলতা জগ বাড়িয়ে দেন। পদ্মজা জগ হাতে নিয়ে বলল, 'আম্মা,ছদকা কোন মুরগিটা দেব?'

হেমলতা গতকাল স্বপ্নে দেখেছেন বাড়িতে আগুন লেগেছে। তাই তিনি ছদকা দিবেন বলে মনস্থির করেছেন। সকালেই পদ্মজাকে মনের কথা জানালেন।

' সাদা মোরগটা দিয়ে দিস। মুন্না কি আসছে?'
'না। প্রতিদিন বিকেলবেলা তো পানি নিতে আসে। কিছুক্ষণ পরই আসবে।'

হেমলতা আর কথা বাড়ালেন না। পদ্মজা কলপাড় থেকে পানি নিয়ে আসে। আছরের আযানের সাথে সাথে মুন্না আসল। গ্রামে সচ্ছল পরিবার নেই বললেই চলে। হাতে গোনা কয়েকটা পরিবারে সচ্ছলতা আছে। হেমলতার পরিবারটা টিকে আছে, হেমলতার তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং পরিশ্রমের জন্য। পুরো আটপাড়ায় টিউবওয়েল মাত্র পাঁচটা। পদ্মজাদের টিউবওয়েল থেকে পানি নিতে প্রতিদিন অনেকেই আসে। তার মধ্যে নিয়মিত একজন মুন্না। দশ বছরের একটা ছেলে। মা নেই। বাবা পঙ্গু। সদরে বসে ভিক্ষা করে। পদ্মজা মোরগ নিয়ে কলপাড়ে এসে দেখে মুন্না নেই। একটু সামনে হেঁটে এসে ঘাটে মুন্নাকে দেখতে পেল। ডাকল,'মুন্না।'

মুন্না ফিরে তাকায়। পদ্মজার হাতে সাদা মোরগ দেখে মুন্না খুব খুশি হয়। পদ্মজা না বললেও বুঝে যায়, ছদকা পাবে আজ। মুন্না এগিয়ে আসল। দাঁত কেলিয়ে হাসল।

'হাসিস কেন? নে মোরগ। তোর আব্বাকে নিয়ে খাবি।'

মুন্না যে খুব খুশি হয় তা দেখেই বোঝা গেল। খুশিতে গদগদ হয়ে মোরগটাকে জড়িয়ে ধরল। পদ্মজার ঠোঁট দুটি নিজেদের শক্তিতে প্রশান্তির হাসিতে মেতে উঠল। কী সুন্দর মুন্নার হাসি! পদ্মজা বলল, 'খুব খুশি?'
'হ।'
'দোয়া করবি আমরা যেন ভাল থাকি।'
'করবাম আপা।'
'আচার খাবি মুন্না?'
'হ,খাইবাম।'

পদ্মজা আবার হাসল। মুন্না পেটুক। খাওয়ার কথা শুনলেই চোখ চকচক করে উঠে। পদ্মজা আচার নিয়ে আসে। মুন্নার সাথে বসে আরাম করে খায়। মুন্না একটু একটু করে খেতে খেতে বলল, 'আপা, তুমি খুব ভালা।'
'তাই?'
'হ।বড় হইয়া তোমারে বিয়া করবাম আমি।'

পদ্মজা বিষম খেল। দ্রুত এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল কেউ শুনল নাকি। বিয়ে তার কাছে খুব লজ্জাজনক শব্দ। বিয়ে নামটা শুনলেই লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে যায়। ফিসফিসিয়ে মুন্নাকে জিজ্ঞাসা করল, 'বিয়ের কথা কোথায় শিখলি?'
' আব্বা কইছে।'
' আর বলবি না এসব। যা,বাড়িত যা।'

পদ্মজা তড়িঘড়ি করে বাড়ির ভেতর চলে যায়।

রান্নাঘরে ঢুকে দেখল, হেমলতা রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সন্ধ্যার পর বিদ্যুৎ থাকে না। হারিকেন জ্বালিয়ে রান্না করতে হয়। প্রতিদিন ঘরে একটা হারিকেন আর রান্নাঘরে একটা হারিকেন জ্বালানো অনেক খরচের ব্যাপার। তাই তিনি বিকেলে রাতের রান্না সেড়ে ফেলেন।

'আম্মা আমি রাঁধি?'
'লাগবে না। সাহায্য কর শুধু।'

পদ্মজা চোখ ঘুরিয়ে দেখল, কী কাজ করা যায়। কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই। হেমলতা নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, ' লাউ নিয়ে আয়।'
'ছিড়ে আনব? না লাহাড়ি ঘরে আছে?'
'লাহাড়ি ঘরে নাই।'

পদ্মজা মায়ের আদেশ পেয়ে যেন চাঁদ পেয়েছে। এমন ভাব ধরে দ্রুত ছুটে যায় লাউ আনতে। লাউ,বরবটি, ঢেঁড়স, কাঁকরোল, করলা, চিচিঙ্গা, পটল, ঝিঙা.. ইত্যাদি, ইত্যাদি সব রকমের সবজির মেলা বাড়ির চারপাশ ঘিরে। পদ্মজা সাবধানে ঘাসের উপর দিয়ে লাউ গাছের দিকে এগোয়। বর্ষাকাল হওয়াতে জোঁকের উপদ্রব বেড়েছে। জোঁকের ভয় অবশ্য নেই তার।

হেমলতা পদ্মজার যাওয়া পানে ঝিম মেরে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। মেয়েটাকে দেখলে তার মন বিষণ্নতায় ভরে উঠে। পদ্মজার চুল দেখলে মনে হয়, এই সুন্দর ঘন কালো রেশমী চুল পদ্মজার একেকটা কাল রাত। পদ্মজার ছিমছাম গড়নের দুধে আলতা দেহের অবয়ব দেখলে মনে হয়, এই দেহ পদ্মজার যন্ত্রণা। এই দেহ ধ্বংস হবে। পদ্মজার ওষ্ঠদ্বয়ের নিম্নে স্থির হয়ে থাকা কালো সূক্ষ্ম তিল দেখলে মনে হয়, এই তিল পদ্মজার এক জীবনের কান্নার কারণ। হেমলতা পদ্মজার রূপের বাহার নিতে পারেন না। কেন কৃষ্ণকলির ঘরে ভুবন মোহিনী রূপসীর জন্ম হলো! জন্ম,মৃত্যু, বিয়ে কারো হাতে থাকে না। যদি থাকতো, হেমলতা মোর্শেদকে বিয়ে করতেন না এবং পদ্মজার মতো রূপসীর জন্ম দিতেন না। আল্লাহর কাছে,রূপসী মেয়ে ভুলেও চাইতেন না। হেমলতার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

___________
আজ শুক্রবার। স্কুল নেই। ফজরের নামায পড়ে তিন বোন পড়তে বসেছে। প্রেমা নামায পড়তে চায় না। ঘুমাতে চায়। হেমলতার মারের ভয়ে নামায পড়ে। সে ঝিমুচ্ছে আর পড়ছে। তা দেখে পদ্মজা আর পূর্ণা ঠোঁট টিপে হাসছে। হেমলতা বিরক্ত হোন। প্রেমার তো পড়া হচ্ছেই না। সেই সাথে পদ্মজা, পূর্ণার মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে। তিনি কর্কশ কণ্ঠে ধমকে উঠলেন, 'প্রেমা,ঘুমাচ্ছিস কেন? ঠিক হয়ে পড়।'

প্রেমা সচকিত হলো। চট করে চোখ খুলে, ভয়ে তাড়াতাড়ি পড়া শুরু করল। হেমলতা কিছুক্ষণ পর স্বাভাবিক গলায় বললেন, 'পড়তে হবে না। ঘরে গিয়ে ঘুমা।'

প্রেমা একটু অবাক হয়। পরেই খুশি হয়ে ছুটে যায় ঘরে। পূর্ণা মুখ ভার করে ফেলল। তার ও তো পড়তে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু, মা কখনো তাকে ছাড় দেন না। হয়তো ছোটবেলা ছাড় দিতেন। মনে নেই। সে আবার খুব দ্রুত সব ভুলে যায়। ব্রেন ভাল প্রেমার। যা পড়ে মনে থাকে। পূর্ণা খুব দ্রুত ভুলে যায়। পদ্মজার সবকিছুই স্বাভাবিক। শুধু রূপ বাদে।

সূর্য উঠার সাথে সাথে মোর্শেদ বাড়িতে ঢুকেন। হাতে ঝাকি জাল আর বড়শি। কাঁধে পাটের ব্যাগ ঝুলানো। ভোরে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। মোর্শেদ বাড়ি ফিরলে পূর্ণা আর প্রেমা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়। মাছ খেতে পারে অনেক। অর্থের জন্য হেমলতা খুব কম মাছ আনেন। মোর্শেদ বাড়িতে যতদিন থাকেন ততদিন মাছের অভাব হয় না। মোর্শেদ বলার পূর্বেই পূর্ণা ও প্রেমা গামলা নিয়ে ছুটে আসে উঠানে। মোর্শেদ কাঁধের ব্যাগ উল্টে ধরেন গামলার উপর। পুঁটি, ট্যাংড়া, পাবদা,চিংড়ি মাছের ছড়াছড়ি। হেমলতা ভারী খুশি হোন। পদ্মজা লতা দিয়ে চিংড়ি খেতে খুব পছন্দ করে। আর প্রেমা, পূর্ণা পছন্দ করে পাবদা মাছের ভুনা। মেয়েগুলো খুব খুশি হয়েছে মাছ দেখে। তিনি জানেন, মোর্শেদ বাড়ি থেকে বের হতেই পদ্মজা ছুটে যাবে বাড়ির পিছনে লতা আনতে।

'হুনো, লতা। আমার আম্মারারে পাবদা ভুনা কইরা দিবা। সবজি টবজি দিয়া রাঁনবা না।'
'আব্বা,আপনি বাড়িতে থাকবেন? তাইলে তো প্রতিদিনই মাছ খেতে পারি।'

মোর্শেদ আড়চোখে পদ্মজাকে একবার দেখে তীক্ষ্ণ চোখে হেমলতার দিকে তাকান। এরপর পূর্ণাকে জবাব দিলেন, 'কোনোরহম অশান্তি না হইলে তো থাকবামই।'

গামছা নিয়ে তিনি কলপাড়ে চলে যান। পদ্মজার মুখটা ছোট হয়ে যায়। প্রতিবার বাড়ি ছাড়ার পূর্বে মোর্শেদ পদ্মজাকে রাগে কটুকথা শোনান। তখন, হেমলতা মোর্শেদকে শাসান। ফলস্বরূপ মোর্শেদ বাড়ি ছাড়েন।

'মোর্শেদ নাকি? বাড়ি ফিরলা কোনদিন?'

মোর্শেদ গোসল সেড়ে রোদ পোহাচ্ছিলেন। সকালের মিষ্টি রোদ। ঘাড় ঘুরিয়ে রশিদ ঘটককে দেখে হাসলেন।

'আরে মিয়া চাচা। আহেন, আহেন। পূর্ণারে চেয়ার আইননা দে। খবর কী?'

পূর্ণা চেয়ার এনে দিল। রশিদ এক দলা থুথু উঠানে ফেলে চেয়ারে বসলেন আরাম করে। প্রেমাকে উঠানে খেলতে দেখে ফরমায়েশ দিলেন, 'এই মাইয়া যা পানি লইয়া আয়। অনেকক্ষণ ধইরা দমডা আটকাইয়া আছে।'

প্রেমা পানি নিয়ে আসে। রশিদ পানি খেয়ে মোর্শেদকে বললেন, 'খবর তো ভালাই। বাবা ছেড়িডারে কী বিয়া দিবা না?'
'দুই বছর যাক। পড়তাছে যহন,মেট্রিকটা পাশ করুক। কী কন?'
'মেজোডা না। বড়ডা। তোমার বউ তো মরিচের লাহান। কোনোবায়ও রাজি অয় না। তুমি বোঝাওছেন। পাত্র খাঁটি হীরা। বাপ-দাদার জমিদারি আছে। '

মোর্শেদ আড়চোখে হেমলতা এবং পদ্মজার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেন। নেই তারা। তিনি জানেন, পদ্মজার উপর কোনোরকম জোরজবরদস্তি তিনি করতে পারবেন না। হেমলতা তা হতে দিবেন না। এসব তো আর বাইরের মানুষের সামনে বলা যায় না। মোর্শেদ রশিদ ঘটককে নরম গলায় বললেন, 'থাকুক না পড়ুক। মায়ে যহন চায় ছেড়ি পড়ুক। তাইলে পড়ুক৷'

রশিদ নিরাশ হলেন। ভেবেছিলেন, মোর্শেদ রাজি হবে। তিনি মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে ছিলেন। এরপর বড় অসুখে পড়লেন। তাই মোর্শেদ বাড়ি ফিরেছে শুনেও আসতে পারেননি। আজ একটু আরামবোধ হতেই ছুটে এসেছেন অনেক আশা নিয়ে। কিন্তু মোর্শেদের জবানবন্দিতে তিনি আশাহত হলেন। কটমটে গলায় বললেন, 'যুবতী ঘরে রাহন ভালা না। যহন বংশে কালি পড়ব তহন বুঝবা। হুনো মোর্শেদ, এই বয়সী মাইয়াদের স্বভাব চরিত্র বেশিদিন ভালা থাহে না৷ পাপ কাম এদের চারপাশে ঘুরঘুর কর। বেলা থাকতে জামাই ধরাইয়া দেওন লাগে। বুঝছোনি? তোমার বউরে বোঝাও।'

রশিদ, পাত্রের অনেক প্রশংসা করলেন। জমিজমা, বাড়িঘর সবকিছুর বাড়াবাড়ি রকমের বর্ণনা দিলেন। ফলে,মোর্শেদের মস্তিষ্ক কাজ করা শুরু করল। রশিদ ঘটক যেতেই তিনি হেমলতার পাশে গিয়ে বসেন। ইনিয়েবিনিয়ে পদ্মজার বিয়ের কথা তুলেন। হেমলতা সাফ নাকচ করে দেন। তিনি শান্তকণ্ঠে বুঝিয়ে দেন, পদ্মজার বিয়ে তিনি দিচ্ছেন না। আর মোর্শেদকে পদ্মজার ব্যাপারে নাক গলাতে না করেছেন। শেষ কথাটা বেশ কঠিন করেই বলেন, 'আগে বাপ হও। পরে বাপের কাজ করতে আসবা।'

মোর্শেদের তিরিক্ষি মেজাজ। তিনি রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। রগে রগে রাগ টগবগ করছে। পদ্মজাকে বারান্দায় দেখে তিনি ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, 'ছেড়ি যহন রূপ দিয়া নটি হইব। তহন আমার ঠ্যাংও পাইবা না। এই ছেড়ি মজা বুঝাইবো। '

পদ্মজার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। হেমলতা রান্নাঘর থেকে বের হলেন মোর্শেদকে কিছু কঠিন কথা শোনাতে। পদ্মজা তখন দৌড়ে আসে। হেমলতার হাতে ধরে রান্নাঘরের ভেতরে নিয়ে যায়। মোর্শেদ যতক্ষণ বাড়িতে থাকে তারও খুব ভাল লাগে। পূর্ণা,প্রেমা কত খুশি হয়। বাড়িটা পরিপূর্ণ লাগে। সে চায় না তার বাবা ঝগড়া করে রাগ নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাক। হেমলতা রাগে এক ঝটকায় মেয়ের হাত সরিয়ে দেন। তার সহ্য হয় না মোর্শেদকে। মানুষের কথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া বদমেজাজি একজন মানুষ মোর্শেদ। ভালটা কখনো বুঝে না। মানুষের কথায় নাচে। সারাক্ষণ মস্তিষ্কে একটা বাক্যেরই পূজা করে, 'মানুষ কী বলবে? '

____________

মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। মাথার উপর বৃষ্টি নিয়ে মোর্শেদ বাড়ি ফেরেন। মুখ দেখে বোঝা গেল, তিনি খুব খুশি। হেমলতাকে ডেকে বললেন, 'এক মাসের লাইগগা ঘরটা ছাইড়া লাহাড়ি ঘরে উইঠঠা পড়।'
'কীসের দরকারের জন্য?'
'শুটিং করার লাইগগা মাতব্বর বাড়ির যারা আইছে, তারার বুলি আমরার বাড়ি পছন্দ অইছে। বিরাট অংকের টেকা দিব কইছে। আমিও কথা দিয়া আইছি। কাইলই উঠতে কইয়া আইছি।'

হেমলতা বিরক্ত হতে গিয়েও পারলেন না। সত্যি অর্থের খুব দরকার। পদ্মজার সামনে মেট্রিক পরীক্ষা। কত খরচ। কলেজে পড়াতে ঢাকা পাঠাতে হবে। তিনি মোর্শেদকে বললেন, 'টাকার ব্যাপারটা নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করতে বলবা। নয়তো জায়গা হবে না।'
'আরে..বলামনে। এখন সব গুছাইয়ালাও ।'

পূর্ণা আড়াল থেকে সবটা শুনেছে। সাত দিন হয়েছে লিখন শাহ আর চিত্রা দেবী এই গ্রামে এসেছে। অথচ, সে দেখতে পারল না। হেমলতা যেতে অনুমতি দেননি। পূর্ণা নামাযের দোয়ায় খুব অনুনয় করেছে আল্লাহকে। যেন লিখন শাহ আর চিত্রা দেবীকে স্বচক্ষে দেখতে পারে। আর এখন শুনলো, তাদের বাড়িতেই নাকি আসছে ওরা! পূর্ণার মনে হচ্ছে সে খুশিতে মরে যাচ্ছে।

______________
'এই মগা? আমাকে এক কাপ চা দাও তো।'

মগা ঝড়ের গতিতে চা নিয়ে আসে। লিখন চিত্রার পাশের চেয়ারটায় বসল। এরপর মগাকে বলল, 'দারুণ চা করো তো তুমি।'

মগা কাচুমাচু হয়ে হাসল। ভাবে বোঝা গেল, প্রশংসা শুনে সে ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। চিত্রা মগার ভাবভঙ্গি দেখে হেসে উঠল। চিত্রা হাসলে মগা মুগ্ধ হয়ে দেখে। মাতব্বর বাড়ির কামলা সে। চিত্রনায়ক লিখন শাহ এবং চিত্র নায়িকা চিত্রা দেবীর সেবা করার দায়িত্ব মগাকে দেয়া হয়েছে। মগা এতে ভীষণ খুশি। চিত্রার সুন্দর মুখশ্রীর সামনে সবসময় থাকতে পারবে ভেবে। চিত্রা বলল, 'তোমার ভাইয়ের নাম জানি কী বলছিলে?'

চার ফুট উচ্চতার মগা উৎসাহ নিয়ে জবাব দিল, 'মদন।'

চিত্রার হাসি পায়। অনেক কষ্টে চেপে রাখল। মগা,মদন কারো নাম হয়?

শুটিংয়ের মাঝে হুট করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। তাই আপাতত শুটিং স্থগিত আছে। সবাই বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছে। হাতে সবার রং চা । ডিরেক্টর আবুল জাহেদ দারুণ খিচুড়ি রান্না করেন। বৃষ্টি দেখেই তিনি রান্নাঘরে ঢুকেছেন।

' আচ্ছা, মগা এই বাড়ির দুইটা মেয়ে কোথায়? আসার পর একবার এসেছিল। এরপর তো আর এলো না।'
চিত্রা প্রশ্ন করল। মগা বলল, 'ওই যে লাহাড়ি ঘর। ওইডাত আছে।'
'লাহাড়ি ঘর মানে কি?'

মগার বদলে লিখন বলল, ' যে ঘরের অর্ধেক জুড়ে ধান রাখা হয়। আর অর্ধেক জায়গায় চৌকি থাকে কামলাদের জন্য ওই ঘরকে লাহাড়ি ঘর বলে এখানে। বোঝা গেছে?
চিত্রা চমৎকার করে হাসল।
' বোঝা গেছে। মগা, বৃষ্টি কমলে লাহাড়ি ঘরে যাব। ঠিক আছে?'
'আইচ্ছা আপা।'
'এই লিখন যাবা? ওইতো সামনেই। আলসেমি করো না।'
মগা হৈহৈ করে উঠল, 'না না, বেঠা লইয়া যাওন যাইত না। বাড়ির মালিকের মানা আছে। '
লিখন মগার না করার ভাব দেখে ভীষণ অবাক হলো। চিত্রা প্রশ্ন করল, 'মানা কেন?'
'বাড়ির বড় ছেড়িডারে তো আপনেরা দেহেন নাই। আগুন সুন্দরী। এই লিখন ভাইয়ের লাহান বিলাই চোখা। ছেড়িডারে স্কুল ছাড়া আর কোনোহানো যাইতে দেয় না। বাড়ি দিবার আগে কইয়া রাখছে লাহাড়ি ঘরে বেঠামানুষ না যাইতে। এই ছেড়ি লইয়া বহুত্তা কিচ্ছা আছে।'

চিত্রা বেশ কৌতুহল বোধ করল। লিখন তীক্ষ্ণ ঘোলা চোখে লাহাড়ি ঘরের দিকে তাকাল। দেড় দিন হলো এখানে এসেছে। উঠানের শেষ মাথায় থাকা লাহাড়ি ঘরটা একবারো মনোযোগ দিয়ে দেখা হয়নি।
সামনের দরজাটা বন্ধ। দুটো ছোট মেয়ে এসেছিল ঘরটার ডান পাশ দিয়ে। ঘরটার ডানে-বামে পিছনে গাছপালা। বাড়িটা পুরনো হলেও দারুণ। তবে এই মুহূর্তে তাঁর অন্যকিছুর প্রতি তীব্র কৌতূহল কাজ করছে।

চলবে....
®ইলমা বেহরোজ

03/03/2025

আমি পদ্মজা - ৩
___________
'আপা,স্কুলে যাবা না?' পূর্ণা পদ্মজাকে জিজ্ঞাসা করল।
'যাব।'
'তাড়াতাড়ি করো।'

তাড়া দিয়ে পূর্ণা বাড়িতে ঢুকল। পদ্মজা বাড়ির পিছনের নদীর ঘাটে উদাসীন হয়ে বসে আছে। এ নদীর নাম মাদিনী (ছদ্মনাম)। গ্রীষ্মকাল বিদায়ের তিন সপ্তাহ চলছে। এখন বর্ষাকাল। মাদিনী জলে কানায় কানায় ভরে উঠেছে। সে যেন স্রোতস্বিনী। ঘোলা জলের একটানা স্রোত বয়ে যায় সাগরের দিকে। উজান থেকে ভেসে আসছে ঘন সবুজ কচুরিপানা। পদ্মজার এই দৃশ্য দেখতে বেশ লাগে। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে মাদিনীর স্বচ্ছ জলের দিকে। মাদিনীর বুকের উপর দিয়ে একটা লঞ্চ যাচ্ছে। লঞ্চ দেখে এক মাস আগের ঘটনা মনে পড়ল তাঁর। সেদিন রাতে হেমলতা ছুরি ধার দিয়ে রুমে ঢুকে গেলেন। পদ্মজা কাঁপা পায়ে রুমে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। এরপরদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে নামায পড়ে খেতে বসল। তখন হিমেল হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ঢুকে। হিমেল হচ্ছে হেমলতার ছোট ভাই।

' আপা? এই পদ্ম, আপা কই? ' হিমেলের কণ্ঠ।
' কি হইছে মামা?' জবাব দিল পদ্মজা।
পদ্মজার প্রশ্ন উপেক্ষা করে হেমলতাকে হিমেল ডাকল,' আপা,এই আপা।'
হেমলতা বাড়ির পিছন থেকে ব্যস্ত পায়ে হেঁটে আসেন।
' কি হয়েছে?'
হিমেল হেমলতাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
' আপা, ভাইজান খুন হইছে। রাইতে কে জানি মাইরা ফেলছেরে আপা..."

হিমেল কাঁদতে কাঁদতে হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল। পদ্মজা তাৎক্ষণিক সন্দিহান চোখে মায়ের দিকে তাকাল। হেমলতাকে দেখে মনে হলো, তিনি চমকেছেন। অথচ, তার চমকানোর কথা ছিল না। নাকি হিমেলের সামনে অভিনয় করলেন?

' পূর্ণা,প্রেমাকে ওদিক আসতে দিস না পদ্ম। আমি আসছি।'

হেমলতা বাড়ির বাইরে মিলিয়ে যান। হিমেল পাশে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। ছেলেটা বোকাসোকা, জন্মগত প্রতিবন্ধী। বাইশ বছরের হিমেল এখনো শিশুদের মতো আচরণ করে। কথায় কথায় খুব কাঁদে। সেখানে তার ভাই খুন হয়েছে। এক মাস তো প্রতিদিন নিয়ম করে কাঁদবে।

পদ্মজা রাতেই ভেবেছিল এমন ঘটনা ঘটতে পারে। তবুও এখন ভয় পাচ্ছে খুব। পুলিশ কী এসেছে? মাকে কী ধরে নিয়ে যাবে? ভাবতে গিয়ে, পদ্মজার বুক ধক করে উঠল। গ্রামের কাছেই শহর, থানা। পুলিশ নিশ্চয় চলে এসেছে। পদ্ম ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। সে ঘামছে খুব। নাক,মুখ,গলা ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে। পূর্ণা খুনের কথা শুনেই খুব ভয় পেয়েছে। তার মনে হচ্ছে সেও খুন হবে। খুব বেশি ভীতু পূর্ণা। পদ্মজার শরীর কাঁপতে থাকে। চোখে ভাসছে, হেমলতাকে পুলিশ শিকল দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে। তার খুব কান্না পাচ্ছে। আর সময় নষ্ট না করে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াল পদ্মজা। মাথায় ওড়নার আঁচল টেনে নিয়ে পূর্ণার উদ্দেশ্যে বলল,
' প্রেমারে দেখে রাখিস বোন। '

বাড়ি ভর্তি মানুষ। আরো মানুষ আসছে। হেমলতা মানুষজনকে ঠেলে হানিফের লাশের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তখন ফর্সা রঙের দুই জন মহিলা ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। আকস্মিক আক্রমণে হেমলতা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। খেয়াল করে দেখেন, দুজন মহিলা তাঁর মা আর বোন। তারা হাউমাউ করে কাঁদছে। কিন্তু হেমলতার তো কান্না পাচ্ছে না। ব্যাপারটা লোকচক্ষু ঠেকছে না? একটু কী কান্নার অভিনয় করা উচিৎ? হানিফের মৃত দেহ দেখে মনে হচ্ছে কেউ ইচ্ছেমতো কুপিয়েছে। হেমলতার তা দেখে শান্তি লাগছে! এমন শান্তি অনেকদিন পাওয়া হয়নি। পদ্মজা সেখানে উপস্থিত হয়। হেমলতার নজরে পড়ে। ভীতু চোখে মায়ের চোখের দিকে তাকাল পদ্মজা। হেমলতা ভ্রু কুঞ্চিত করে আবার স্বাভাবিক করে নেন। পদ্মজা চোখ ঘুরিয়ে দেখছে পুলিশ এসেছে নাকি। চারিদিকে এতো মানুষ। পদ্মজাকে এদিক ওদিক উঁকি দিতে দেখে হেমলতা এগিয়ে আসেন। চোখমুখ শক্ত করে পদ্মজার মুখ ঘুরে দেন। পদ্মজা দ্রুত ওড়নার আঁচল মুখে চেপে ধরে গোয়ালঘরে ঢুকে পড়ল। তার মা চায় না সে কখনো এতো মানুষের সামনে থাকুক।
হেমলতা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, পদ্মজা গোয়ালঘর থেকে উঁকি দিয়ে বাইরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ আসল। জিজ্ঞাসাবাদ করে হানিফের লাশ নিয়ে গেল। লোকমুখে শোনা যায়, হানিফ খুন হয়েছে শেষ রাতে। এরপর নদীতে ফেলা দেওয়া হয়। লঞ্চ ঘাটে লাশ ভাসে।
হেমলতাকে পুলিশ নিয়ে যায়নি বলে পদ্মজা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। মানুষের ভীরও কমে গেছে। হেমলতার মা কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে উঠোনের এক কোণে বসে আছেন। পদ্মজা গুটি পায়ে গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে আসল। হেমলতা পদ্মজার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসেন। সেই হাসি দেখলেন হেমলতার মা মনজুরা। তিনি কিছু একটা ভেবে নেন। হেমলতার কাছে এসে কিড়মিড় করে বলেন, 'তুই খুন করছস?'

' তোমার কেন মনে হচ্ছে এমন?'

হেমলতার কণ্ঠ স্বাভাবিক। অথচ, পদ্মজা এই প্রশ্ন শুনে ভয় পেয়েছে খুব। যদি নানু পুলিশকে বলে দেয়? পুলিশ তো তার মাকে নিয়ে যাবে!

' কাইল রাইতে তুই আইছিলি হানিফের ঘরে। আমি দেহি নাই?' রাগে কাঁপছেন মনজুরা।
' হুম আসছি।' হেমলতার নির্বিকার স্বীকারোক্তি।
'কেন মারলি আমার ছেড়ারে? তোর কি ক্ষতি করছে? '
' আসছি বলেই আমি খুন করেছি?'
' এতো রাইতে তুই তার কাছে আর কী দরকারে আইবি?'
'আমি তাকে মারতেই যাব কেন?'

মনজুরা আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন হেমলতার দিকে। হেমলতার চোখ মুখ শক্ত। নিস্তব্ধতা কাটিয়ে মনজুরা চেঁচিয়ে উঠলেন, ' পুলিশের কাছে যামু আমি।'

পদ্মজা কেঁদে উঠল। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে, 'নানু এমন করো না।'

হেমলতা নীচু স্বরে কঠিন করে বললেন, ' আমার মেয়েদের থেকে আমাকে দূরে সরানোর চেষ্টা করো না আম্মা। ফল খুব খারাপ হবে।'

পদ্মজার মনে হলো মনজুরা ভয় পেয়েছেন। মনজুরা সবসময়ই হেমলতাকে ভয় পান। তিনি চুপসে যান। শুধু ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে হেমলতার দিকে তাকিয়ে থাকেন। পদ্মজা বুঝে উঠতে পারে না, তার নানু কেন ভয় পায় মাকে? মায়ের অতীতে কী ঘটেছে? কেন তিনি এমন কাঠখোট্টা? ছেলের খুনীকে কোনো মা ছেড়ে দেয়? নানু কেন ছাড়লেন? মেয়ে বলে? নাকি অন্য কারণ? কোনো উত্তর নেই। এসব ভাবলে উল্টো মাথা ব্যাথা ধরে। অন্য আট-দশটা পরিবারের মতো কেনো না তারা? নাকি গোপনে সব পরিবারেই এমন জটিলতা আছে? প্রশ্ন হাজারটা! উত্তর কোথায়?

সেদিন রাতে খাওয়ার সময় হেমলতা নিম্নস্বরে পদ্মজাকে বললেন, 'পদ্ম?'
'জ্বি,আম্মা।'
'আমি হানিফকে খুন করিনি। কারা করেছে তাও জানিনা।'

কথাটি শুনে পদ্মজা খুব চমকায়। তার মা মিথ্যে বলে না। তাহলে কারা খুন করল? পদ্মজা প্রশ্ন করল, 'তাহলে শেষ রাতে মামার কাছে কেন গিয়েছিলে আম্মা?'

হেমলতা জবাব দেননি। খাওয়া ছেড়ে উঠে যান।

পদ্মজার ভাবনার সুতো কাটল কারো পায়ের আওয়াজ শুনে। ঘাড় ঘুরিয়ে মোর্শেদকে দেখতে পেল। মোর্শেদ পদ্মজাকে ঘাটে বসে থাকতে দেখে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকান।

' এই ছেড়ি যা এন থাইকা। '

পদ্মজার কান্না পায়। খুব খারাপ লাগে। নিঃশব্দে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। তা আড়াল করে ব্যস্ত পায়ে বাড়ির ভেতর চলে যায়।

____________

কয়েক মাস পর পদ্মজার মেট্রিক পরীক্ষা। তিন বোন বই নিয়ে সড়কে উঠল। পদ্মজার কোমর অবধি ওড়না দিয়ে ঢাকা। পূর্ণা একনাগাড়ে বকবক করে যাচ্ছে। স্কুলে যাওয়া অবধি কথা বন্ধ হবে না। মাঝে মাঝে জোরে জোরে হাসছে। মেয়েটার হাসির রোগ আছে বোধহয়। একবার হাসি শুরু করলে আর থামে না। পদ্মজা বার বার বলছে, 'আম্মা রাস্তায় কথা বলতে আর হাসতে মানা করছে। চুপ কর না।'

তবুও পূর্ণা হাসছে। বাড়ির বাইরে এসে সে মুক্ত পাখির মতো আচরণ করে। তাকে দেখে মনে হয়, খাঁচা থেকে মুক্ত হয়েছে।

' পদ্ম... ওই পদ্ম। খাড়া।'

পদ্মজা ক্ষেতের দিকে তাকাল। লাবণ্য ক্ষেতের আইল ভেঙে দৌড়ে আসছে। লাবণ্য আর পদ্মজা এক শ্রেণীতে পড়ে। লাবণ্য কাছে এসে হাঁপাতে থাকল। শান্ত হওয়ার পর চারজন মিলে স্কুলের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করল।

' বাংলা পড়া শিখে এসেছি আজ?'

পদ্মর প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে লাবণ্য বলল, 'আরে ছেড়ি বাড়িত শুদ্ধ ভাষায় কথা কইলে বাইরেও কইতে হইব নাকি?'

'আমি আঞ্চলিক ভাষা পারি না।'

লাবণ্য অসন্তোষ প্রকাশ করল। সে অলন্দপুরের মাতব্বর বাড়ির মেয়ে। তাদের বাড়ির সবাই শিক্ষিত। তবুও তাঁরা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। পরিবারের দুই-তিন জন সদস্য ছাড়া। আর পদ্মজার চৌদ্দ গুষ্ঠি মূর্খ,দুই-তিন জন ছাড়া। তবুও এমন ভাব করে! আঞ্চলিক ভাষা নাকি পারে না!

'সত্যি আমি পারি না। ছোট থেকে আম্মা শুদ্ধ ভাষা শিখিয়েছেন। উনিও বলেন। তাই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেই আরাম পাই।'
' পূর্ণা তো পারে। '
'আমার চেষ্টা করতে ইচ্ছে হয় না।'
' আইচ্ছা বাদ দে। শুন, কাইল আমরার বাড়িত নায়ক-নায়িকারা আইব।'

পূর্ণা বিগলিত হয়ে প্রশ্ন করল, 'কেন আসব? কোন নায়ক?'

' শুটিং করতে। ছবির শুটিং।'

পদ্মজা এসবে কোনো আগ্রহ পাচ্ছে না। পূর্ণা খুব আগ্রহবোধ করছে। সপ্তাহে একদিন সুমিদের বাড়িতে সাদাকালো টিভিতে সে ছায়াছবি দেখতে যায়। তাই অভিনয় শিল্পীদের প্রতি তার আগ্রহ আকাশছোঁয়া। পূর্ণা গদগদ হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল, 'কোন নায়ক নায়িকা? বল না লাবণ্য আপা!'

' দাঁড়া! মনে করি। '

পূর্ণা কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। লাবণ্য চোখ বুজে মনে করার চেষ্টা করল। এরপর মনে হতেই বলল, 'লিখন শাহ আর চিত্রা দেবী।'
'তুমি আমার ছবির নায়ক-নায়িকা?'
'হ।'

স্কুলের যাওয়ার পুরোটা পথ লাবণ্য আর পূর্ণা ছায়াছবি নিয়ে আলোচনা করল। মূল বক্তব্যে ছিল লিখন শাহ।

চলবে...
®ইলমা বেহরোজ

03/03/2025

আমি পদ্মজা - ২
___________
বাড়িটা মোড়ল বাড়ি নামে পরিচিত। পদ্মজার দাদার নাম ছিল মিয়াফর মোড়ল। তিনি গ্রামের একজন সম্মানিত লোক ছিলেন। ছয় কাঠা জমির উপর টিনের বিশাল বড় বাড়ি বানিয়েছিলেন চার ছেলের জন্য। দুই ছেলে ষোল বছর আগে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে নিহত হয়েছে। দুজনই টগবগে যুবক ছিল। আর একজন আট বছর বয়সে কলেরা রোগে গত হলো। বাকি রইল মোর্শেদ মোড়ল। বর্তমানে এই বাড়ি মোর্শেদের অধীনে। যদিও তিনি থাকেন না সবসময়। পুরো বাড়ির চারপাশ জুড়ে গাছগাছালি। বাড়ির পিছনে নদী। রাত নয়টা বাজলেই পরিবেশ নিশুতি রাতের রূপ ধারণ করে। রাতের এই নির্জন প্রান্তর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে ছেয়ে গেছে। ঝিঁঝিঁ পোকার সাথে পদ্মজার ভাঙ্গা কান্না মিলেমিশে ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। মনে হচ্ছে, কোনো আত্মা তার ইহজীবনের না পাওয়া কোনো বস্তুর শোকে এমন মরা সুর ধরেছে। হেমলতা পদ্মজাকে টেনে পাশে বসান। পদ্মজা ডান হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের জল মুছে হেমলতাকে বলল, 'মামা সৌদিতে যাওয়ার আগের দিন আমাদের সবার দাওয়াত ছিল না নানাবাড়ি? খালামণি, ভাই-বোনেরা এসেছিল। সেদিন ঢাকা থেকে যাত্রার লোক আসছিল স্কুলে মনে আছে আম্মা?'

'আছে।'

উঠোনে ধপ করে একটা আওয়াজ হয়। হেমলতা,পদ্মজা কেঁপে উঠল। পূর্ণা, প্রেমা দরজায় কান পেতে রেখেছিল মা-বোনের কথা শুনতে। হুট করে কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ হওয়াতে দুজন ভয় পেয়ে যায়। দরজা ঠেলে হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে পড়ে। হেমলতা বড় মেয়ের সাথে গোপন বৈঠক ভেঙে দ্রুত পায়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ান।
উঠানে বিদ্যুৎ নেই। হারিকেন জ্বালান। পিছনে তিন মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। একজন মায়ের তিন মেয়ে নিয়ে একা এতো বড় বাড়িতে বাস করাও যুদ্ধ বটে! হেমলতা গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন করলেন, 'কে? কে ওখানে?'

'আমি।'

চির পরিচিত এই কণ্ঠ চিনতে হেমলতার বিড়ম্বনা হলো না। তিনি ব্যস্ত পায়ে উঠোনে নেমে আসেন। গেইটের পাশে মোর্শেদ মোড়ল পড়ে রয়েছেন। গায়ে চাদর। হাঁপড়ের মতো বুক উঠা-নামা করছে তার। যেন দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। হেমলতা দু'হাতে মোর্শেদকে আঁকড়ে ধরলেন। পদ্মজা,পূর্ণা, দৌড়ে আসে। মোর্শেদের এমফাইসিমা রোগ আছে। এ রোগে অল্প চলাফেরাতেই শ্বাসটানের উপক্রম হয় এবং দম ফুরিয়ে যায়। শ্বাস নেবার সময় গলার শিরা ভরে যায়। তিন মা-মেয়ে মোর্শেদকে ধরে রুমে নিয়ে আসে। মোর্শেদ এভাবেই হুটহাট করে বাড়ি ফেরে। কখনো কাকডাকা ভোরে, কখনো নিশুতি রাতে বা কখনো কাঠফাটা রোদে।

______________
মোর্শেদ মোড়লেই এমফাইসিমা রোগটা ধরা পড়ে সাত বছর আগে। মোর্শেদের অ্যাজমা ছিল। আবার ধূমপানে খুবই আসক্ত ছিলেন। ফলে ফুসফুসের এই রোগটি খুব দ্রুত আক্রমণ করে বসে। মোর্শেদ খানিকটা সুস্থ হয়ে রাত একটার দিকে ঘুমালেন। পূর্ণা, প্রেমা রুমে গিয়ে শুয়ে পড়েছে। পদ্মজা বারান্দার রুমে ঝিম মেরে বসে আছেন। জানালার বাইরে চোখের দৃষ্টি। জোসনা গলে গলে পড়ছে! কি সুন্দর দৃশ্য! পদ্মজার মন বলছে, মা আসবে তাঁর খোঁজে। পুরোটা ঘটনা শুনতে আসবেই। সত্যি তাই হলো। কিছুক্ষণ পরই হেমলতা আসলেন।

'আম্মা, বাতিটা নিভিয়ে দাও।' বলল পদ্মজা। কণ্ঠ খাঁদে নামানো। হেমলতা বাতি নিভিয়ে পদ্মজার পাশে বসেন। পদ্মজা তৈরি ছিল তবুও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। খুব অস্বস্তি হচ্ছে। সে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

পদ্মজা তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। বয়স দশ ছিল। খুব কম বয়সেই তাকে স্কুলে পাঠানো শুরু করেন হেমলতা। সেদিন, নানাবাড়িতে সবার দাওয়াত পড়ে। হানিফ চলে যাবে সৌদিতে। তাই এতো আয়জন। পরিবারের মিলন আসর বসে। স্কুল মাঠেও সেদিন নাচ-গান অনুষ্ঠিত হয়। বাড়ির সবাই সেখানেই চলে যায়। বাড়িতে থাকে শুধু পদ্মজা, পদ্মজার বৃদ্ধ নানা, আর হানিফ। পদ্মজা ঘুমে ছিল তাই বাকিদের সাথে যেতে পারেনি। যখন ঘুম ভাঙে আবিষ্কার করল বাড়িতে কেউ নেই। মোর্শেদ হঠাৎ করে অসুস্থ হওয়াতে হেমলতা বাপের বাড়িতে উপস্থিত ছিল না।

' পদ্ম নাকি?'
পদ্মজা বাড়ি থেকে বের হওয়ার উপক্রম হতেই কানে আসে হানিফের ডাক। পদ্মজা মিষ্টি করে হেসে মাথা নাড়াল। হানিফের লোলুপ দৃষ্টি তখন পদ্মজার সারা শরীর ঘুরে বেড়াচ্ছে। এইটুকু মেয়ের ফর্সা চামড়া বিকৃত মস্তিষ্কের হানিফকে যেন বড্ড টানে!

'আয় তো, আমার ঘরে আয়।'

সহজ সরল শিশুসুলভ পদ্মজা মামার ডাকে সাড়া দিল। সে শুনেছে, মামা-ভাগনে যেখানে আপদ নেই সেখানে। অথচ, সেদিন সে মামাকেই ঘোর বিপদ হিসেবে জানল।

পদ্মজা রুমে ঢুকতেই হানিফ দরজা লাগিয়ে দিল।পদ্মজার মন কেমন করে উঠে হানিফের অদ্ভুত চাহনি আর দরজা লাগানো দেখে। হানিফ কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করতে থাকে। পদ্মজার দেখতে খুব খারাপ লাগছে। ভয় করছে।

' এদিকে আয় তোর লগে গল্প করি।'

হানিফ বিছানায় বসে পদ্মজাকে কাছে ডাকে। পদ্মজা কাছে যেতে সংকোচ বোধ করে। হানিফ পদ্মজার ডান হাতে ধরে টেনে কোলে বসায়।

' তুই জানোস? তুই যে সবার থাইকা বেশি সুন্দর?'

হানিফের প্রশ্ন পদ্মজার কানে ঢুকেনি। সে মোচড়াতে থাকে হানিফের কোল থেকে নামার জন্য। আপত্তিকর স্পর্শ গুলো পদ্মজার খুব খারাপ লাগছে। কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।

'মোছড়াস ক্যান রে ছেড়ি। শান্তিমত বইয়া থাক। মামা মেলা থাইকা সাজনের জিনিষ কিইননা দিমু।'

হানিফ শক্ত করে দু'হাতে ধরে রেখেছে পদ্মজাকে। পদ্মজা কিছুতেই নামতে পারছে না।

'মামা, আমি চলে যাব।' কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল পদ্মজা।

'কই যাবি? মামার ধারে থাক।' বলল হানিফ।

হানিফের শক্তপোক্ত হাতের স্পর্শগুলো শুধু অস্বস্তি দিচ্ছে না,স্পর্শকাতর জায়গাগুলো ব্যাথায় বিষিয়ে উঠছে। পদ্মজা কেঁদে উঠে। ভেজা কণ্ঠে বলল,
' বাড়ি যাব আমি। ব্যাথা পাচ্ছি মামা।'

হানিফ হাতের বাঁধন নরম করে আদুরে গলায় বলল,
' আচ্ছা, আর ব্যাথা দিতাম না। কান্দিস না।'

পদ্মজা চট করে কোল থেকে নেমে পড়ে। হানিফকে তার আজরাইল মনে হচ্ছে। মায়ের কাছে সে আজরাইলের অনেক গল্প শুনেছে। আজরাইল যখন জান নিতে আসবে তখন শরীরে খুব কষ্ট অনুভব হবে। এই মুহূর্তে যেন ঠিক তেমনই অনুভূতি হলো। তাহলে তার হানিফ মামাই আজরাইল। পদ্মজা দরজা খুলতে পারবে না। তাই হানিফকে ভীতিকণ্ঠে অনুরোধ করল,
' মামা দরজা খুলে দাও।'
'ক্যান? আমি তোরে যাইতে কইছি?'

হানিফের কর্কশ কণ্ঠের ধমকে পদ্মজা ভয়ে কেঁপে উঠল। তার চোখ বেয়ে জল পড়তে থাকে। হানিফ পদ্মজাকে জোর করে কোলে তুলে নেয়। পদ্মজা কাঁদছে। তার খুব ভয় লাগছে। বার বার বলছে, 'মামা আমি বাড়ি যাব।'

হানিফের তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। বাড়িতে কেউ নেই। বৃদ্ধ সৎ বাবা কানে শুনে না। পদ্মজা হানিফকে কিল,ঘুষি দিতে থাকে। সেই সাথে জোরে জোরে কান্না শুরু করে। এভাবে কাঁদলে পাশের বাড়ির যে কেউ চলে আসবে। হানিফের রক্ত টগবগ করছে উত্তেজনায়। সে দ্রুত ওড়না দিয়ে পদ্মজার মুখ, হাত, পা বেঁধে ফেলল। পদ্মজার দু'চোখের পানি হানিফের চোখে লাগেনি। হানিফ ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে। পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে! সে সিগারেট জ্বালায়। খুব আনন্দ হলে তার সিগারেট টানতে ইচ্ছে হয়। সিগারেট টানতে গিয়ে মাথায় আসে নৃশংস ইচ্ছে। নাক,মুখ দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে সিগারেট দুই আঙ্গুলের মাঝে রেখে পদ্মজার বাম পায়ের তালুতে চাপ দিয়ে ধরে রাখে।

পদ্মজা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। হেমলতা দু'হাতে শক্ত করে মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেন। পদ্মজা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ' আম্মা, তখন আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার দমটা বেরিয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছিল। আমি তোমাকে খুব ডাকছি আম্মা। তুমি আসোনি। '

পদ্মজার কথাগুলো হেমলতার বুক রক্তাক্ত করে দেয়। এ যেন ১৯৭১ সালের পাকিস্তানিদের নৃশংসতা। নিজের চোখে তিনি দেখেছেন পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুরতা। হানিফ আর তার দেখা অত্যাচারী পাকিস্তানিদের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। হেমলতা নির্বাক,বাকরুদ্ধ। শুধু অনুভব হচ্ছে, তার বুকে পড়ে আদরের পদ্মজা হাউমাউ করে কাঁদছে। সর্বাঙ্গ যেন কাঁপছে। হানিফকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে হাত নিশপিশ করছে। সেদিন একটুর জন্য পদ্মজা ধর্ষণ হয়নি। বাড়িতে সবাই ফিরে এসেছিল। পদ্মজা পোড়া স্থানের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অচেতন হয়।

বাকিটুকু আর পদ্মজাকে বলতে হয়নি,হেমলতা জানেন। পদ্মজার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে। একুশ দিন বিছানায় ছিল। ততদিনে হানিফ দেশ ছেড়ে চলে যায়। পদ্মজা ভয়ে, লজ্জায় ঘটনাটি কাউকে বলেনি। পায়ের পোড়া দাগ দেখে যখন হেমলতা প্রশ্ন করেছিল, 'পা এমনভাবে পুড়ল কি করে?'

পদ্মজা সহজভাবে জবাব দিয়েছিল, ' চুলার কাছে গিয়েছিলাম। চুলার লাকড়ির আগায় পা লাগছিল।'

কথাটা পদ্মজা সাজিয়েই রেখেছিল। সাথে অনেক যুক্তি। তাই মিথ্যে বলতে একটুও কাঁপেনি। পুরো ঘটনাটা পদ্মজার বুকে তাজা হয়ে আছে। এই ছয় বছরে লুকিয়ে কতবার কেঁদেছে সে। সবসময় চুপ করে কোথাও বসে থেকেছে। হেমলতা মেয়ের নিশ্চুপতা দেখে মাথা ঘামাননি। কারণ,পদ্মজা ছোট থেকেই চুপচাপ ছিল। কিন্তু আজ হেমলতার খুব আফসোস হচ্ছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। তিনি ভেবেছিলেন, তার তিনটা মেয়েই তার কাছে খোলা বইয়ের মতো। চাইলেই পড়া যায়। বিশেষ করে পদ্মজাকে বাড়ির পিছনের নদীর বুক দিয়ে তরতর করে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ টলটলে পানির মতো মনে হতো। যার জীবনে অস্বচ্ছ বলতে কিছু নেই। সবই সাদামাটা, সহজ সরল। অথচ, পদ্মজার জীবনেই কত বড় দাগ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে! কতবড় ঘটনা লুকিয়ে ছিল! মেয়েরা কথা লুকিয়ে রাখার সীমাহীন ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। কথাটি নিজের মেয়েদের ক্ষেত্রে মাথায়ই আসেনি। পদ্মজা শান্ত হলে হেমলতা বললেন, 'পা টা দেখি।'

পদ্মজা বাঁ পা বিছানায় তুলল। হেমলতা পদ্মজার পা কোলে নিয়ে পোড়া দাগটা দেখেন মনোযোগ দিয়ে। রক্ত টগবগ করে উঠে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে হিংস্রতা যেন লুটোপুটি খাচ্ছে।

'এই পোড়া দাগ হানিফের রক্ত দিয়ে মুছবো।'

কথাটি কত সহজ করে বলেছেন হেমলতা। তবুও পদ্মজা কেঁপে উঠল। কী যেন ছিল কথাটিতে! শরীরের পশম দাঁড়িয়ে পড়ে। হেমলতা বারান্দার রুম ছেড়ে বড় ঘরে ঢুকেন। মিনিট কয়েক পর, রামদা, ছুরি হাতে নিয়ে উঠোনে যান। উঠোনের এক পাশে শক্ত পাথর আছে। ছুরিটা পাথরে ঘষতে থাকলেন সাবধানে। ঘষতে ঘষতে পাথর গরম হয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখা দেয়। মানে ধার হয়ে গেছে। পদ্মজা বারান্দা থেকে দেখছে। অজানা আশঙ্কায় তার বুক কাঁপছে। হেমলতা বারান্দা পেরিয়ে রুমে ঢুকতে যাবে তখন পদ্মজা উৎকণ্ঠিত গলায় ডাকল, 'আম্মা!'

'আন্নার চাচার এক মেয়ে নিখোঁজ শুনেছিস তো বড়দের মুখে? সেই মেয়ের ধর্ষক হানিফ। ধর্ষণের পর পুঁতে ফেলেছে। অলন্দপুরের এই একটা মানুষই এতোটা নৃশংস। আমি তখন ঢাকা পড়তাম। বাড়ি এসে জানতে পারি ঘটনা। আম্মার অনুরোধ আর কান্নায় আমি সেদিন মুখ খুলিনি। এত বড় পাপ চেপে যাই। সেই শাস্তি আমি ধীরে ধীরে পাচ্ছিলাম। আজ পুরোপুরি পেয়ে গেলাম। আমার পাপের শাস্তি শেষ হয়েছে।'

হেমলতা কথা শেষ করে জায়গা ত্যাগ করলেন। কী ধারালো প্রতিটি বাক্য! হেমলতার মুখ দিয়ে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে। পদ্মজার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে পড়ে।

চলবে....
®ইলমা বেহরোজ

Address

Fulbaria

Telephone

+8801321659807

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when থিংকিং posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to থিংকিং:

Share