17/01/2024
সহপাঠী ও সহকর্মী
---------------------------
সিরাজুল ইসলাম দুর্জয় ছিলেন আমার সহপাঠী এবং পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিলেন সহকর্মী। দ্বিতীয়বার মাস্টার্স করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম ২০১৩-১৪ সেশনে। তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সেখানেই। তিনি এসেছিলেন দিগন্ত টিভি থেকে, আর আমি তখন কাজ করি বণিক বার্তায়। তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠার অন্যতম কারণ সম্ভবত দুইজনের একই কাজের ক্ষেত্র-- সাংবাদিকতা। ক্লাসে একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসতাম আমরা। সেই সময়ে সিলেবাস কিংবা সাংবাদিকতার বাইরে তার সঙ্গে কথা হয়েছে আরও নানা বিষয়ে। এই ধারা অব্যাহত ছিল সম্ভবত তিন থেকে চার মাস। ফুল টাইম জবের পাশাপাশি পড়ালেখা চালিয়ে নেওয়া আমার মতো অলস শিক্ষার্থীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই হুট করে একদিন নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নাম লিখে ফেললাম ড্রপ আউটের তালিকায়। আর সেখানেই সমাপ্ত হলো আমার দ্বিতীয় মাস্টার্স স্বপ্ন।
এটা সম্ভবত ২০১৩ সালের শেষ দিকের ঘটনা। কয়েকটি ক্লাসে আমাকে না দেখে দুর্জয় ভাই ফোন দিয়েছিলেন আমাকে। নানাভাবে বলেছেন এবং বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, আপনার ক্লাসে আসা উচিত। এও বলেছেন, দেখতে দেখতে দিন পার হয়ে যাবে। ক্লাস করেন, দেখবেন আপনার মাস্টার্স একদিন শেষ হয়ে গেছে। আমি অবশ্য আর কোনোদিন যাইনি ক্লাসে। তাই দুর্জয় ভাইয়ের সঙ্গে ক্লাসের ফাঁকে আড্ডা দেওয়া আর কখনও হয়ে ওঠেনি।
২০১৪ সালের মে মাসে আমি যোগ দেই নতুন চাকুরিতে। পোস্টিং প্লেস সুনামগঞ্জে হওয়ায় আমি চলে যাই সেখানে। দুর্জয় ভাইয়ের সঙ্গে তখন আমার যোগাযোগ আর তেমন হতো না। অন্যভাবে বললে, আমি তখন চিরচেনা সংবাদ মাধ্যম এবং ঢাকা শহর ছেড়ে নতুন কর্মক্ষেত্র ও নতুন মাটি ও মানুষের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অবিরত সংগ্রামে লিপ্ত। তাই যোগাযোগে ভাটা পড়েছিল তার সঙ্গে।
সেই সুনামগঞ্জে বসেই একদিন হঠাৎ দেখা দুর্জয় ভাইয়ের সঙ্গে। দেখেই জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। বললেন, আপনি এখানে? ঠিক একই জিজ্ঞাসা আমিও করলাম। আপনি এখানে কেন? তিনি বললেন, ক্যাশ রেমিটেন্স দিতে এসেছি। সিলেটে আছি। এরপর থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ পনঃস্থাপিত হলো।
তিনি জানালেন, তার মাস্টার্সের পড়ালেখা অব্যাহত আছে। সপ্তাহ শেষে ঢাকায় এসে ক্লাস করে আবার চলে যান সিলেটে। আমি একটু অবাকই হলাম। বললাম, এত ধৈর্য আপনার! কীভাবে পারেন? আমি তো কারওয়ান বাজার থেকে শাহবাগ আসতেই হাপিয়ে উঠেছিলাম। আপনি সিলেট থেকে প্রতি সপ্তাহে ঢাকা গিয়ে ক্লাস করতে পারেন? হা হা করে হেসে দিয়ে দুর্জয় ভাই বললেন, মনের বলই আসল বল ভাই। মনে বল থাকলে শরীর ও সায় দেয়। আপনি চেষ্টা করেন, পারবেন। লেকচার শীট এবং নোট যা লাগে, আমি সাপ্লাই দিব। আপনি শুধু মাঝেমধ্যে গিয়ে ক্লাসে হাজিরা দিয়ে আসবেন।
আমি বললাম, আমাকে আর বইলেন না ভাই। রবীন্দ্রনাথের কথাটা মনে আছে আপনার? অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মত বিড়ম্বনা আর নাই। এখন নতুনভাবে ক্লাস শুরু করতে গেলে যে পেরেশানি আমাকে নিতে হবে, তা আমি পারবো না। অতএব থাক। জীবনে আরো কত কী হবে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা দিয়ে কত জল গড়িয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়বে। এই মাস্টার্স শেষ না করলে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। কত মানুষের যে মাস্টার্স ডিগ্রি নেই, তাদের দিন কি চলছে না?
সুনামগঞ্জে থাকতেই এরপরে আরও অনেকবার দেখা হয়েছে দুর্জয় ভাইয়ের সঙ্গে। কিন্তু তিনি মাস্টার্স কনটিনিউ করার বিষয়ে আমাকে আর কোনো কথা বলেননি। আমিও বলিনি তাকে। আমার কথায় তিনি কি মাইন্ড করেছিলেন? জানা হয়নি কখনও। শুনেছি, পপুলেশন সায়েন্স বিভাগ থেকে মাস্টার্স শেষ করেছিলেন তিনি। একজন মানুষ যে কতটা ধৈর্যশীল হতে পারেন, স্বপ্ন পূরণের জন্য কতটা অধ্যাবসায়ী হতে পারেন, এটা তার সঙ্গে পরিচয় না হলে জানা হতো না।
সুনামগঞ্জ থেকে আমি পুনরায় ঢাকায় চলে আসি ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে। একটা পর্যায়ে তিনিও চলে গিয়েছিলেন তার নিজ এলাকায়। এরপর তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। কথা হয়েছে বলেও মনে পড়ছে না। আর দেখা কিংবা কথা হওয়ার সম্ভাবনাও শেষ হয়ে গেল আজ। কর্মমুখর দিনের স্বপ্ন নিয়ে যে মানুষটি বের হয়েছিলেন ঘর থেকে, তিনি কি জানতেন আজ তার আর ফেরা হবেনা? একবারও কি ভাবতে পেরেছিলেন? শুনতে খুব নির্মম হলেও এটাই সত্য যে, প্রিয় মানুষগুলো এভাবেই এক সময় আমাদের কাছে হয়ে যান স্মৃতি। আর সেটা মুহূর্তের মধ্যেই।
আমি বিশ্বাস করি, মৃত্যুই আমাদের অনিবার্য নিয়তি। নির্দিষ্ট সময়ে অবশ্যই আমাদেরকেও একদিন ফিরে যেতে হবে। কিন্তু কথা হলো, দুর্জয় ভাই যেই বয়সে এবং যেভাবে চলে গেলেন, সেটা কি প্রত্যাশিত? এই দেশে প্রতিদিন কত তাজা প্রাণ সড়কে ঝড়ে যায়। এর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পরিবারে। কেউ কি তাদের কোনো খোঁজ খবর রাখে? দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেশি হলে মানুষ পরিণত হয় 'সংখ্যা'য়। দুর্ঘটনা এড়ানোর উদ্যোগ তো দূরে থাক, এক সময় সেই সংখ্যাটাও আমরা ভুলে যাই। কিন্তু তার পরিবারকে এর মূল্য গুনতে হয় প্রতিটি পদক্ষেপে। প্রশ্ন হলো, এভাবে মানুষ আর কতদিন 'সংখ্যা' হতে থাকবে? এটা দেখার দায় দায়িত্ব যাদের, আর কত প্রাণহানি হলে তারা সজাগ হবেন? সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নেবেন কার্যকর পদক্ষেপ? এমনভাবে মৃত্যুর সম্মুখীন যারা হন, তাদের পরিবারকে দেখভাল করার মতো উপযুক্ত উদ্যোগ কি আমরা নিতে দেখব সংশ্লিষ্টদের?
কারও মৃত্যুর পর প্রচলিত নিয়ম মেনেই আমরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পরিবার বর্গের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করি। দুর্জয় ভাইয়ের পরিবারকে, তার ফুলের মতো নিষ্পাপ সন্তানকে কীভাবে সমবেদনা জানাবো, আমার জানা নেই। ফেসবুকে সংবাদটি দেখার পর থেকে আমি জাস্ট নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছি। চোখের সামনে ভেসে উঠছে ক্লাসের ফাঁকে দুর্জয় ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার স্মৃতি। সুনামগঞ্জে অফিসের ডাইনিং রুমে তাকে চা বানিয়ে খাওয়ানোর স্মৃতি। এখন এ স্মৃতিগুলো ক্রমেই দুঃসহ হয়ে উঠছে আমার কাছে। এই দুঃসহ স্মৃতিগুলো কতদিন আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে জানিনা!
হে আল্লাহ, তুমি আমার ভাইটিকে আবৃত করো তোমার ক্ষমার চাদরে। তাকে কবুল করো জান্নাতুল ফেরদৌসের একজন মেহমান হিসেবে।