17/07/2025
তাজমহল
#পর্ব_২১
প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
শাইনা বোতামগুলো টেবিলের উপর রেখে দিয়েছে। তাজদার ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে বোতামগুলো দেখলো। শাইনা পিঠের নিচে বালিশ রেখে শুয়ে প্রিমা ফারনাজ চৌধুরীর লেখা একটা উপন্যাস পড়ছে। উপন্যাসের নাম ”প্রিয় বেগম”। এটি তার পছন্দের উপন্যাস। তাজদার বোতামগুলো তুলে নিতে নিতে বলল,
"রেখে দিলাম। বোতামগুলো তুমিই একদিন সেলাই করে দেবে। আমি সেলাই করিয়ে ছাড়ব।"
শাইনা তার দিকে তাকালো। আবারও বইয়ের পাতায় চোখ রেখে বলল,"আমাদের বাড়িতে যেতে বলা হয়েছে।"
"যাব না।"
শাইনা বলল,"আমি ঠিক সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম। যাওয়ার দরকার নেই।"
তাজদার তার দিকে খেপাটে দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,"ডিজগাস্টিং!"
"ডিজগাস্টিংটাকেই কেন বিয়ে করতে হলো? আর মেয়ে ছিল না এই দেশে?"
"এরকম বজ্জাত হবে জানলে করতাম না। দেখতে তো ভালো মেয়ে মনে হয়।
"আপনাকেও দেখতে জেন্টলম্যান মনে হয়।"
তাজদার সিদ্দিকী বেশ ভাব নিয়ে বলল,"আমি তো সেটাই।"
"জি না। আস্ত একটা হনুমান।"
তাজদার চোখ সরু করে তাকালো তার দিকে। সে দেখতে হনুমানের মতো? শাইনা বেশ মজা পাচ্ছে। মনে হচ্ছে তার বহুদিনের আক্রোশ মিটছে একটু একটু করে। তাজদার সিদ্দিকী যে দেখতে হনুমানের মতোই সেটা সে বহুবছর পর মুখফুটে বলতে পেরেছে। তাজদার বলল,
"তুমি দেখতে কিরকম ছিলে সেটা এক্সপ্লেইন করব?"
শাইনা তৎক্ষণাৎ তার দিকে ঘুরে তাকাল। তাজদারের ঠোঁটের কোণে সেই চিরচেনা, তীর্যক হাসিটা যেন দাঁত কিঁচিয়ে জ্বলছে।
শাইনা তাকে অবাক করে দিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
"আপনি কেমন ছিলেন সেটা আমি এক্সপ্লেইন করব? আপনি এখানে দাঁড়াতে পারবেন?"
তাজদার গলায় টানটান আত্মবিশ্বাস,
"তাজদার সিদ্দিকীর শিরদাঁড়া এত নরম ভেবেছ?"
শাইনা একটুখানি অবাক হয়ে তাকাল। তারপর ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,"আপনার শিরদাঁড়াও আছে? জানতাম না তো। বেশ, দাঁড়িয়ে থাকুন এভাবে শিরদাঁড়া সোজা করে। এটাও মাথায় রাখুন আপনার পায়ের কাছে এসে বসার মতো মেয়েও আমি নই।"
তাজদার ঠান্ডা গলায় বলল,
"তুমি আমাকে এখনো ঠিকমতো চিনতে পারোনি শাইনা মমতাজ।"
শাইনা তার সামনে এসে দাঁড়ালো। বলল,
"আপনাকে আমও চিনতেও চাইনা। যতটুকু চিনেছি ততটুকু ভুলতে পারলেই এনাফ।"
বলেই সে চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ থেমে গেল। তাজদার তাকাতেই সে জিজ্ঞেস করলো,
"আপনাকে চেনা এখনো বাকি আছে বলছেন? মানে আপনি হুট করে আমার চোখে ভালো হয়ে যাবেন? আর আমি সেটা বিশ্বাস করবো? সত্যি? তাহলে তো বেশ ভালো। তবে একটা অনুরোধ দয়া করে নিজেকে হাসির পাত্র বানাবেন না। মানে আপনি যদি এখন আপনার সামনে বসে আমাকে প্রেম নিবেদন করেন বিষয়টা খুব হাস্যকর দেখাবে। তাজদার সিদ্দিকীর সাথে এটা যায় না। আপনাকে আমি অন্যভাবে চিনে এসেছি তাতেই আমার প্রাণ যায় অবস্থা। দয়া করে আর এমন কিছু দেখাতে যাবেন না যাতে হাসতে গিয়ে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। আপনি চিরকাল শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকুন। সামনের জনকে দেখার জন্য চোখ নিচে নামানোর দরকার নেই। কারণ আপনার সাথে ওটা যাবে না।"
তাজদার ভেজা শার্টটা তার মুখের ঝাড়া মারলো। শাইনা পিছিয়ে গেল। মুখের উপর পড়া পানিগুলো মুছে নিতে নিতো তাকাল। তাজদার তার গালে দুই আঙুল চেপে চিমটি কেটে বলল,"তোমার দিকে তাকানোর চোখ নিচে নামাতে হচ্ছে। কারণ তুমি আমার চেয়ে খাটো।"
বলেই সে বেরিয়ে গেল। শাইনা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কথায় কথায় গায়ে হাত দেয়। এত বড় বেয়াদব।
__________
বিকেলের দিকে শাইনা তাদের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিল। এক উঠোনে দাঁড়ালে আরেক উঠোন দেখা যায়। তাই রওশনআরা বললেন গাড়িটা পটিয়া থেকে ঘুরিয়ে আনতে। সবাই হাসছিল ব্যাপারটা দেখে।
শাইনা গাড়িতে বসতে বসতে তাজদার সিদ্দিকীর দিকে তাকালো। তাজদার পেছনে হাত ভাঁজ করে রওশনআরার পেছনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা চিবোচ্ছিল।
গাড়ির ছাড়ার ঠিক আগমুহূর্তে গাড়ির দরজার পাশে এসে থামল। মাথা নামিয়ে শাইনার দিকে তাকিয়ে আদেশের সুরে বলল,
"শাইনা মমতাজ কথাটা দ্বিতীয় বার যেন মনে করিয়ে দিতে না হয়। বারবার আমি এককথা বলতে পারব না।"
ড্রাইভার আছে তাই শাইনা মৃদুস্বরে স্বরে বলল,"আমি এডমিশন নেব। এটা আমার শেষ কথা।"
তাজদারের কপাল কুঁচকে উঠল। রাগ জমে থাকল চোখের ভাঁজে। সেটা শাইনার নজর এড়ায়নি। ঠাণ্ডা গলায় বলল,
"এই বাড়িতে ফিরব কি না, তা নির্ভর করবে দুই পরিবারের সম্মতির উপর। আমি তখনই ফিরব যখন নিশ্চিত হব আমার পড়াশোনায় কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।"
তাজদারের মুখের পেশি শক্ত হয়ে উঠল। চোখের কোণে জমে উঠল চাপা হিংস্রতা। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,"পড়াশোনার গুলি মার। কথা না শুনলে এই বাড়িতে ফেরার দরকার নেই। পড়াশোনা করে তুমি করবেটা কি?"
শাইনা শক্ত হয়ে বসে রইলো। কথা বলার রুচি চলে গেছে তার। রওশনআরা এসে তাজদারের পেছনে দাঁড়াল। আস্তে করে বলল,
"এখন ওর যাওয়ার সময়। কথাবার্তা পরে বলা যাবে।"
তাজদার একবারও পেছনে না তাকিয়ে গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল সেখান থেকে। শাইনা তার যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো। তারপর রওশনআরার দিকে তাকাল। রওশনআরা এসে মাথায় হাত রেখে বলল,
"ওর কথা কানে নেওয়ার দরকার নেই। সব কথা কানে নিলে পাগল হয়ে যেতে হবে।"
________
গাড়িটা পটিয়া থেকে ঘুরে এসে শাইনাদের উঠোনের সামনে থামলো। দাদীমা উঠোনে নেমে এলেন। শাইনা গাড়ি থেকে নামলো। কালো বোরকা আর সোনালী রঙের একটা হিজাব পরেছে সে। নাকের মাথায় জ্বলজ্বল করছে স্বর্ণের নাকফুল। বাচ্চা, বুড়ো সবাই এসে তাকে ঘিরে ধরলো। শাইনা সোজা ঘরে চলে গেল। সবাই বলাবলি করলো,"কাউকে সালামটুকু করলো না মেয়েটা।"
শাহিদা বেগম সবাইকে চুপ করিয়ে দিল,
"আহা দোষ ধরো না তো আর।"
ঘরে ঢুকতেই ভাবি, আপা সবাই এগিয়ে এল তাকে দেখে। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল কেমন টেমন আছে। শাইনা কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা ঘরে চলে গেল। সবাই হকচকিয়ে গেছে। ওই বাড়িতে কিছু হলো নাকি?
শাইনা নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শাড়িটাড়ি ছুঁড়ে ফেলে সালোয়ার কামিজ পরে নিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিল।
তারপর নিজের বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। কি শান্তি নিজের ঘরটায়! কতক্ষণ ঘুমিয়েছে নিজেরও খেয়াল নেই। মনে হচ্ছিল সে কতদিন পর শান্তির ঘুম দিয়েছে।
তাকে কেউ বিরক্তও করেনি।
ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে যাওয়ামাত্রই পরিবারের সবাইকে একসাথে দেখলো। রান্নাঘরে খাবারের আয়োজন নতুন জামাইয়ের জন্য। শাহিদা বেগম, সাবিনা, শারমিলা ভারী ব্যস্ত। ওই বাড়ি থেকে ভাত, মাংস পাঠানো হয়েছে। সেগুলো প্রতিবেশীদের বিলি করে এসেছে শাওন।
সবাই তাকে দেখে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা থামিয়ে দিল। শাহিদা বেগম তাকে দেখে বলল,"মুখটা শুকিয়ে গেছে। কিছু খাবি?"
"ছোট ভাইয়া কই?"
"কোথায় গেছে কে জানে। ও সারাদিন বাড়িতে থাকে?"
সাবিনা বলল,"শাইনা এইমাত্র নুডলস করলাম। দেব একটু?"
শাইনা বলল,"গরুর গোস্ত দিলে খাব না। এলার্জি বেড়ে গেছে আমার।"
"মুরগীর। খেতে পারবে।"
"তাহলে অল্প করে দাও।"
শাহিদা বেগম বলল,"এলার্জির ঔষধ আছে? না থাকলে তোর আব্বাকে স্লিপটা দিয়ে দিস। নিয়ে আসবে।"
শাইনা জবাবে কিছু বললো না। সাবিনা তাকে বাটিতে করে নুডলস দিল। শাইনা টেবিলে গিয়ে বসলো। মাথায় কাপড় টেনে চামচে করে অল্প করে নুডলস মুখে তুলে রান্নাঘরের চারিদিকে ছড়ানো ছিটানো রান্নার আয়োজন দেখলো। প্রশ্ন করলো,
"কবুতর কার জন্য আনিয়েছে?"
শাহিদা বেগম অবাক হয়ে বললেন,"কেন তাজদারের জন্য। নতুন জামাই না?"
"মাছ কি কি এনেছ?"
"রুই, চিংড়ি, তেলাপিয়া।"
"দুই রকম দিলে মানসম্মান যাবে? কবুতর না দিলে তোমাদের বদনাম হবে? এত ঢং করার কি আছে? এতগুলো খাবার একসাথে খাওয়া যায়? সবকিছুতে তোমাদের বাড়াবাড়ি। না খেলে তখন আমার কানের কাছে প্যাঁচাল পাড়বেনা কেউ। "
শাহিদা বেগমের মুখ চুপসে গেছে। ঠিকই তো। এত খাবার না খেলে তখন?
শারমিলা বলল,"আম্মা ওর কথা কানে নিওনা তো। না খেলে না খাক। দেখার জন্য হলেও তো দিতে হয় এসব। ও কি জানে এসবের? বন্ধু বান্ধব নিয়ে আসবে। সব না দিলে কেমন দেখায়?"
_________
রাত তখন দশটা পেরিয়ে গেছে।
তাজদার আসবে কি আসবে না এই অনিশ্চয়তায় সবাই অস্থির হয়ে উঠেছে। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সঙ্গে সবার ধৈর্যও ক্ষয়ে যাচ্ছে। কে যেন পাশ থেকে বলল, "আসবেনা বোধহয়। এলে এতক্ষণে চলে আসতো।"
শাহিদা বেগম কপাল চাপড়ে বললেন,
"তাহলে এত আয়োজন কেন করলাম ?"
শারমিলা বিরক্ত গলায় বলল,
"নিয়মকানুন মানতে হবে না? এ কেমন লোক!"
দাদীমা বললেন,
"ব্যাটার ইচ্ছে হলে তবেই আসবে।"
শাবরিন মুখ কুঁচকে বলল,
"আসবে না সেটা আগে বলে দেবেনা ওরা? এত আয়োজন করিয়ে এখন না আসার মানেটা কি?"
সবাই কথা বলছে, শুধু শাইনা চুপচাপ।
তার নীরবতা চোখে পড়তেই শাহিদা বেগম তাকে উদ্দেশ করে বললেন,
"তুই একবার ফোন করে দেখ না। হয়তো ভুলে গেছে বা ব্যস্ত…"
শাইনা শান্ত কণ্ঠে বলল,
"যার ইচ্ছে নেই তাকে ফোন দিয়েও কিছু হবে না। তোমরা আগে নিশ্চিত হওনি কেন?"
শাহিদা বেগম চিন্তায় পড়ে গেলেন।
শারমিলা নিচু গলায় মুখের ভেতর কী যেন বিড়বিড় করে বলছে। স্পষ্ট নয়, কিন্তু বিরক্তি টের পাওয়া যাচ্ছে।
ওই বাড়িতে লোক পাঠানো হয়েছে।
সেখান থেকে খবর এসেছে তাজদার বাড়িতে নেই, ফিরতে দেরি হবে।
শাইনা অবাক।
সে জানে আজকের আয়োজন তার জন্যই।
সবাই তাকে ঘিরেই এত প্রস্তুতি নিচ্ছে, সব জেনেও এত নির্বিকার কি করে? একটা ফোন পর্যন্ত করল না। জানালও না আসবে কি আসবে না।
মা আর বোনদের চিন্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে তার ভেতরে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দও হচ্ছে। এবার বুঝুক ওরা।
_____________
"শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছ?"
তাজদার হাতের কব্জিতে ঘড়িটা পরতে পরতে দাদীমার দিকে তাকাল। বাড়ি ফিরে দ্রুত গোসল নিয়েছে সে। একটা মেরুন রঙের নতুন পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েছে। তাড়াহুড়ো করছে। রাত এগারোটা বাজে এখন। দাদীমার প্রশ্ন শুনে সে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। বলল,"হ্যাঁ।"
"এত দেরীতে কেন? ওরা কি মনে করবে?"
"মনে করবে কেন? এগারোটা অত গভীর রাত নয়। মানুষের সমস্যা থাকতে পারে।"
"ফোন দিয়ে জানাতে পারতে। ওরা ভাবছিল তুমি যাবেনা।"
"মহিলারা দুটো কথা বেশি বুঝে ফেলে। সমস্যা সেখানে।"
"আর তুমি দেরী করেছ সেটা দোষ নয়?"
"ইচ্ছে করে কেউ দেরী করেনা।"
"তাও সেটা তোমার উদাসীনতা। আজ যেহেতু জামাই আদর। তোমার উচিত ছিল বন্ধু বান্ধব নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া। ওরা ভাতের পাশাপাশি নাশতারও আয়োজন করেছে। ওগুলো বরবাদ হবেনা?"
"কাল সকালে খাব।"
দাদীমা জানে এই ছেলের সাথে কথায় পারা যাবেনা। তাজদার টিস্যু দিয়ে ফোনের স্ক্রীনটা আলতো করে মুছতে মুছতে তৌসিফকে ডাক দিল।
"তৌসিফ বের হ।"
তৌসিফ বলল,"পায়জামাটা পরতে দাও। ওটা না পরে যাব নাকি? নিজে দেরী করে ফেলেছে। এতক্ষণ পর এসে আমাকে তাড়া দিচ্ছে।"
তিতলি আর তাসনুভা হাসছে তার কথা শুনে। তিতলি চিল্লিয়ে বলল,
"ভাইয়ে আমার জন্য একটা লেগপিস নিয়ে আসবে।"
তৌসিফ তার ঘর থেকে জবাব দিল,"মুরগীর লাস্ট পিস নিয়ে আসব তোর জন্য।"
সবাই একসাথে হাসছে। তিতলি রেগে বলল,"যা ব্যাটা না আনলে ঘরে ঢুকতে দেব না। তোমরা খাবে নাকি সব? আমাদেরও হক আছে।"
তাজদার হেঁটে এল সেখানে। বলল,"এখানে দাঁড়িয়ে কথা না বলো কাজটা তো করতে পারো। মিষ্টি, নিমকি আর সন্দেশের কার্টনগুলো বারান্দায় রেখে আসো। পানসুপারি আর ইত্যাদি ইত্যাদি সব দিয়েছে কিনা চেক করো।"
তিতলি আর তাসনুভা চলে গেল মাথা দুলিয়ে।
রওশনআরা এসে থামলেন তাজদারের সামনে। বললেন,"তুমি সকালে চলে এসো। শাইনা দুইদিন থাকবে ওখানে। চুলটা বোধহয় আঁচড়ানো হয়নি। আরেকটু মোছা দরকার।"
তাজদার চুলে হাত দিল। দাদীমা পেছন থেকে বলল,"শ্বশুরবাড়ির তোয়ালে দিয়ে মুছিও। যাও যাও। এত রাত করে শ্বশুরবাড়িতে যেতে আর দেখিনি। তাড়াতাড়ি বের হও। ওরা সারাদিন খাটছে নতুন জামাইয়ের খাবার দাবার নিয়ে।"
রওশনআরা বললেন,"চুল আঁচড়ে নিলে ভালো হতো।"
তাজদার ঘরে চলে গেল। চুলটা পরিপাটি করে বেরিয়ে পড়লো।
রওশনআরা তৌসিফের ঘরের সামনে এসে বলল,
"তৌসিফ বের হ বাবা। আর কতক্ষণ?"
তৌসিফের মা বলল,"মেয়েদের মতো সময় লাগে ওর।"
তৌসিফ চেঁচিয়ে বলল,"আশ্চর্য যে দেরী করেছে তাকে কিছু বলছো না। আমার পেছনে পড়েছ কেন সবাই?"
____
তৌসিফ আর ফুপাতো, খালাতো ভাইসহ মোট ছয়জন গিয়েছে শাইনাদের বাড়িতে। শাইনার দাদীমা মাজেদা বেগম ঘুরঘুর করছিলেন। মিষ্টি নিয়ে তৌসিফ ঘরে ঢুকে এল সবার আগে। বড় করে দাদীমাকে সালাম দিয়ে বলল,
"সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?"
দাদীমা বললেন,"আমরা না ঘুমাইলেও বউ ঘুম গেছেগা।"
তৌসিফ ঠোঁট উল্টে বলল,"নাতিন জামাইয়ের দোষ। দেরী করে বাড়ি ফিরেছে।"
তাজদার আশরাফের সাথে ভেতরে ঢুকতেই দাদীমাকে সালাম দিল। দাদীমা সালাম নিয়ে বলল,"ওমাগো আমার নাতিন জামাই রাস্তায় গাড়ি পায়নি।"
তাজদার বলল,"হু, ট্র্যাফিক জ্যাম।"
"এখন সব খাবার ঠান্ডা হয়ে গেছে।"
"ঠান্ডাই ভালো।"
"কিন্তু একজন গরম হয়ে আছে।"
তাজদার আশ্বস্ত করে বলল,"ঠান্ডা করার দায়িত্ব আমার।"
দাদীমা হাসলেন।
_____
সাবিনা শাইনাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো।
"শাইনা ওঠো। উনারা এসেছেন। শাইনা?"
শাইনা ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙে বলল,"ক'টা?"
"সাড়ে এগারোটা পেরিয়ে গেছে।"
"এতরাতে কীসের জন্য আসছে?"
সাবিনা চুপ করে সরে গেল। শাহিদা বেগম ছোটাছুটি করছেন। আনিস বলল,"ভাত দিয়ে দাও। ওরা নাশতা খাবেনা।"
শাহিদা বেগমের মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে। সারাদিন সবাই মিলে কতগুলো নাশতার আইটেম বানিয়েছে । আনিস রাগারাগি করছে। বলছে আজকাল মানুষ এত নাশতা খায়? কেক, কলা, মিষ্টি আর সন্দেশ দিলে হতো না? এতকিছু কি দরকার ছিল? সবকিছুতে তোমাদের বাড়াবাড়ি না করলে চলেনা?
শাইনার দুলাভাইরা তাকে সরিয়ে নিয়েছে। অফিস থেকে এসে এত ঝামেলা দেখে তার মেজাজ বিগড়ে যাওয়া স্বাভাবিক।
শাইনা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিল একবার। সালাম আদানপ্রদান হতেই শাইনা তৌসিফের উদ্দেশ্য করে বলল,"আমি ভেবেছি আপনারা সেহরির সময় আসবেন। একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন।"
সবাই হেসে ফেললো তাজদার সিদ্দিকী ছাড়া। সে ঠোঁটের কাছে হাত রেখে শাইনার দিকে তাকিয়ে আছে।
তৌসিফ বলল,"আমি তো সেই এশার পর থেকে রেডি আছি।"
তাজদার তাকে ধমকে উঠল,"মিথ্যেবাদী, এত রেডি থাকলে আসার আগে তাড়াহুড়ো করে পায়জামা পরছিলি কেন?"
তৌসিফের মুখটা দেখার মতো হয়েছে। সবাই এবার শব্দ করে হাসলো। শাইনা চলে গেল ভেতরে। ভাতের থালাবাসন সাজানো হচ্ছে। প্লেটে মাছ, মাংস বাড়ছে সাবিনা।
শাওন মিষ্টি আর সন্দেশ নিয়ে এসে বলল,
"তাজ ভাই নাশতা দিচ্ছি না। কিন্তু মিষ্টি খাওয়া যেতে পারে।"
"আমি মিষ্টি খাব না, সরি।"
তৌসিফ বলল,"আরেহ জামাই না খাক আমরা তো আছি।"
শাওন বলল,"দাঁড়া।"
কাঁটাচামচ দিয়ে একটা মিষ্টি তৌসিফের দিকে বাড়িয়ে দিল সে। বলল,
"বেয়াই মিষ্টি পুরোটা খেতে হয় কিন্তু।"
শাওন হেসে কাঁটাচামচ নাড়াচ্ছে, তৌসিফ মিষ্টিটা মুখে নিতে পারছেনা। শাওন তৌসিফের মুখের সামনে নিয়ে গিয়ে পরে মিষ্টিটা নিজে খেয়ে নিল। তৌসিফ বলল,"ধুর শালা।"
শাওন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। আনিস ঘরে উঁকি দিয়ে ডাকল,"শাওন?"
শাওন সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে দিয়ে ভেতরে গেল। আনিস বলল,"টেবিল সাজানোর সময় ওখানে গিয়ে রংতামাশা করছিস কেন?"
শাওন বলল,"রংতামাশা কেন করব? আশ্চর্য!"
শাহিদা বেগম বলল,"তুই অফিস থেকে এসেছিস একটু রেস্ট নে আনিস। আমরা সামলে নেব। রান্নাঘরের ঝামেলা কমে আসবে কিছুক্ষণ পর। তোকে এত মাথা গরম করতে হবেনা।"
আনিস বলল,"ঘরে মেহমান রেখে আমি ঘরে শুয়ে থাকব? আজব কথা বলো।"
____
টেবিল ভর্তি খাবার দাবার। শাইনার দুলাভাইদেরও বসিয়ে দিয়েছে আনিস। বাড়ির সব জামাই একসাথে। খাওয়াদাওয়া শুরু হলো। ঘরের দরজার সামনে পর্দার ওপাশে সব মহিলারা দাঁড়িয়ে। শাইনার ছোট মামি হঠাৎ করে বলল,
"আপা বড় জামাই দুটো একদম মানিক পেয়েছে। হাসিখুশি সহজসরল। শাইনার জামাইয়ের মুখে হাসি কম। গরম মাথার মানুষ সেটা চেহারায় বোঝা যায়। ওটা বড় জামাইগুলোর সাথে মিলেনি।"
সবাই একে একে বলল,"ঠিক বলেছ।"
শাইনার বোনেরা বরদের প্রশংসা শুনে খুশিতে গদগদ করছে। শাহিদা বেগম পেছনে শাইনাকে দেখে বলে উঠল,"থাক থাক এসব আর বলো না। সব মানুষ তো আর এক না।"
শাহিদা বেগমের কথাটা এমন শোনালো যে সবাই একলহমায় বুঝে গেল যে শাইনা শুনে ফেলেছে কথাটা। মামি তাকে দেখামাত্রই সুর পাল্টে বলল,
"বউকে দেখতে পারলেই হয়েছে। এরকম লোকরা মনের দিক দিয়ে সরল হয়।"
শাইনা কাউকে কিছু বললো না। কত সরল সেটা সে ভালো করেই জানে। এরাও জানবে কিছুদিন পর। দাদীমা বলল,"ব্যাটা হাসবেনা কেমনে? দাঁড়া কাতুকুতু দিয়ে আসি।"
শাইনা দাদীমার দিকে তাকালো। শান্ত দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল সেখান থেকে।
খাওয়াদাওয়ার পর সবাই আর ঘন্টাখানেক বসে গল্পসল্প করলো। সেখানে শাইনার লন্ডন যাওয়া নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল। আশরাফ বলল,
"ওকে তো মাস্টার্সের পর বিয়ে দেব ভেবেছিলাম যেহেতু ও পড়তে চেয়েছে। এখন মাঝপথে পড়াশোনা থেমে গেলে ও কষ্ট পাবে। বিষয়টা ভালো দেখাবে না। দুটো বছরই তো। তারপর না হয় যাবে।"
শাইনা পাশের ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিল তাজদার সিদ্দিকীর চেহারার হাল। আগের মতো পরিস্থিতি থাকলে এত শান্ত হয়ে বড় ভাইয়ার কথা শুনতো না সে।
আনিস বলে উঠলো,"পড়াশোনা থামাবে কেন? পড়াশোনা যেভাবে চলছে চলুক। দরকার পড়লে মাস্টার্সটা ওখানে কমপ্লিট করবে। এত সহজ একটা ব্যাপারকে এত টানাহেঁচড়ার কোনো দরকার নেই। তাছাড়া বিয়ের সময় কথাটা ভালো করে তোলা না গেলেও পড়াশোনা বন্ধ করতে হবে এমনকিছুও বলা ছিল না। মাত্র দুই বছরের জন্য হুট করে পড়াশোনা কেন বন্ধ করবে?"
আনিসের কথা তাজদারের পছন্দ হয়নি সেটা তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে। আশরাফ তাজদারের বড়। আনিস সমবয়সী। তুই তুকারির সম্পর্ক। সে আনিসকে বলল,
"তোর কথাটা ঠিক। কিন্তু দুই বছর সময় দেওয়া পসিবল না আমার। ফেলে দেয়ার মতো কথা আমি বলব কেন?"
কথাটা এমনভাবে বলা হলো যেন তার কথাটায় ফাইনাল এবং পারলে আনিস এর বিকল্প খুঁজে বের করে। যেখানে বিকল্প কোনো পথই নেই।
আফসার সাহেব বললেন,"চাকরিতে সমস্যা হবে?"
তাজদার বলল,"চাকরিসহ আরও নানান জটিলতা বাড়তে পারে। আমি কথাটা এমনি এমনি বলিনি। এখন কারো যদি আমার সিদ্ধান্ত পছন্দ না হয় তাহলে আর কি করার আছে?"
সবাই একটু চুপ গেল এবার।
শাহিদা বেগম সবটা শুনে শাইনাকে এসে বলল,"তোর খালাম্মার জায়ের মেয়েটাকে বিয়ের পর জামাই বিদেশ নিয়ে চলে গেছে। ও আর পড়াশোনা করেনাই। কত মেধাবী ছিল। ও কি এখন ভালো নাই?"
শাইনা মায়ের দিকে তাকালো অবাক চোখে।
"মানুষের কথায় যখন ওঠবস করতে হবে তখন পনের ষোল বছরে বিয়ে ফেলোনাই কেন? এত পড়াশোনা করালে কেন? যেখানে বড়আম্মু বলছে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সেখানে তুমি এসব কথা কিভাবে বলো?"
শাহিদা বেগম বলল,"যদি ওর চাকরিতে সমস্যা হয় তখন কি হবে?"
"হাস্যকর কথাবার্তা। ওই লোকটাকে তোমাদের ইমোশন নিয়ে খেলছে। বেশ ভালো করে জানে চাকরির কথা বললে তোমরা ভয় পেয়ে যাবে। আমি যাব না মাস্টার্স কমপ্লিট করার আগে।"
শাহিদা বেগম বললেন,"মানুষ জামাইয়ের সাথে যাওয়ার জন্য পাগলামি করে আর তুই?"
"পাগল বানাওনি কেন? মানুষ বানিয়ে বলতেছ পাগলের মতো আচার-আচরণ করতে। পারব না পাগলামি করতে। আমার কথাই শেষ।"
"জামাই না থাকলে ওই বাড়ির মানুষের কথায় ওঠবস করতে হবে। জামাইর সাথে যেতে ভালো লাগেনা। কিন্তু ওই বাড়ির গোলাম হতে ভালো লাগবে।"
"আমি বাচ্চা নই যে মানুষ আমাকে যা বলবে আমি তাই করব।"
শাহিদা বেগম বড় দুই মেয়ের উদ্দেশ্য বলল,
"কি বেয়াদব মেয়ে দেখলি? ওর বড়আম্মু নাকি কি বলছে সেজন্য রাজী হচ্ছে। রায়হানের মাকে আমি চিনিনা? কাজবাজ করে দিতাম বলে আমাকে দেখতে পারতো। নইলে ও আমাদের ভালো চায় কখনো? ছেলের কারণে তোকে বউ করে নিয়ে গিয়েছে। গিয়ে দেখ কলিজা ফেটে যাচ্ছে ছেলের বউয়ের জায়গায় তোকে দেখে। টাকাপয়সা লাগলে ধারটার চাইতাম, দিত তাই কথা শুনে কাজবাজ করে দিতাম। নইলে তোমার বড়আম্মু তোমাকে দেখতে পেরে উল্টায় দিচ্ছে এমন না। জামাইয়ের কথা শোন শানু। বাড়াবাড়ি করিস না।"
শাইনা পিড়িতে বসে আছে। বড় বোনদুটোর দিকে একবার তাকাল। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
"আমার না মেঝ আপার মতো হওয়া উচিত ছিল। নিজের পছন্দ অপছন্দের কথা একদম আব্বা আর ভাইয়াদের মুখের সামনে গিয়ে বলা উচিত ছিল। তোমার আর আব্বার মার না হয় খেতাম।
আব্বা আপার সাথে ছমাস কথা বলেনি। আমার সাথেও না হয় বলতো না। ভাইয়াদের সামনে আপা একবছর যেতে পারেনি। আমি না হয় একদমই যেতাম না। বেয়াদব, ঘাড়ত্যাড়া, নির্লজ্জ, বেহায়া, এইসব কথা না শুনতাম পাড়াপড়শির কাছ থেকে।
কিন্তু আমার জীবনের এই ছোটখাটো সিদ্ধান্তগুলো আজকে অন্যজনকে নিতে হতো না। তোমাদের মানসম্মানের কথা ভেবে আমি আমাকে কোরবানি দিয়ে ফেলেছি। তোমাদের মেঝ মেয়ে এখন ভালো নেই? কিন্তু তার বদনাম হয়েছিল বলে আমার উপর জোর খাটাতে শুরু করলে। এদিকে যাওয়া যাবেনা, ওইদিকে যাওয়া যাবেনা, এর সাথে কথা বলা যাবেনা, ওর সাথে কথা বলা যাবেনা। মেঝ আপা কি কি করলো তার সব শোধ তোমরা আমার উপর তুললে।"
শাবরিন বলল,"আশ্চর্য তুই আমাকে নিয়ে কেন পড়েছিস?"
শাহিদা বেগম ফিসফিসিয়ে বললেন,"তোর ওইরকম কেউ ছিল নাকি রে? কি বলছিস তুই? মাথা খারাপ হয়ে গেছে?"
"ওইরকম কাউকে আমার জীবনে থাকতে দিয়েছ তোমরা? মেঝ আপার মতো যাতে না হই সারাক্ষণ পাহারা দিয়ে দিয়ে রেখেছ। এত ভালো মেয়ে হয়ে তোমরা আমাকে কি দিয়েছ? ভালো মেয়ে হয়ে আমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছ আরও। নিজের সব ইচ্ছে আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছ। নিশানের কথা বলে আকদ পরিয়ে দিয়েছ।"
"এসব কথা বলে এখন কি লাভ? তুই সংসার করবিনা ওই ছেলের সাথে?"
"সংসার তো এখনো অনেক দূরে। বিয়ের চারদিনও পার হয়নি তারমধ্যে যে যার ইচ্ছে চাপিয়ে দিচ্ছে আমার উপর। আমার ভবিষ্যতটা আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। জুতোপেটা করার পর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেই সেটা সংসার? আমি বলেছি সংসার করব না? নাকি বলেছি ওই লোকটার সাথে আমি বিদেশে যাব না? আমি শুধু বলেছি আমি মাস্টার্স কমপ্লিট করতে চাই। এটা অসম্ভব কিছু? এটা মেনে নিলে সব সলভ হয়ে যায় না? এটা না মানার কি আছে? তার বোনরা একেকটা ভার্সিটিতে পড়ছেনা? তাদের বোনকে তো ফাইনাল পরীক্ষার পর বিয়ে দিচ্ছে। তাহলে আমার বেলায় উল্টো কেন? আমাকে বলছে আমার চৌদ্দ গুষ্টির কারো লন্ডনে যাওয়ার সামর্থ্য আছে কিনা। কিছুদিন পর আমি গ্র্যাজুয়েটেড নয়? বলবেনা? এখন থেকে বড় বড় কথা শোনাচ্ছে। ভবিষ্যতে তো আরও শোনাবে।"
শাইনা কাঁদছে। চোখ মুছে বলল,
"তোমরা বললে না জামাইয়ের সাথে সম্পর্ক ভালো রাখ। অন্যরা নইলে কথা শোনাবে। সুযোগ খুঁজবে। যেখানে ওই লোকটা নিজেই আমাকে কথা শোনায় সেখানে বাইরের লোকজন তো অনেক ভালো। আমি ওরকম একটা মানুষের সাথে কি করে ঘর করব আম্মা? সারাক্ষণ আমাকে ভয়ে থাকতে হয় এই বুঝি কোনোকিছুর জন্য আমাকে কথা শুনিয়ে দিল। এই বুঝি আমার চৌদ্দ গুষ্টি নিয়ে কথা তুললো। কিছুদিন পর মা বাপ তুলেও দেবে। আমাকে বিয়ে না দিয়ে বিষ খাইয়ে দিলেও তোমাদের উপর এত অসন্তুষ্ট হতাম না আমি।"
শাইনা অনেকক্ষণ রান্নাঘরে বসা ছিল। ভাত খেতে বললে খেল না। শাহিদা বেগম খাইয়ে দিতে চাইলে মানা করে দিল। দাদী, মামী, চাচী, খালা সবাই তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। দাদীমা ইনিয়েবিনিয়ে বলল,
"কেউ তোকে নিয়ে যেতে বলছেন না এখন। তোকে রেখে যাবে শেষমেশ। তুই যেতে না চাইলে তোকে জোর করবে না। কথা হচ্ছে ব্যাটা আর কখন আসবে তার ঠিক নেই। বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে ফেলিস। ওটা নিয়ে তোর সময় কেটে যাবে।"
শাহিদা বেগম সেখানে ছিলেন না। ফুপু বলল,
"হ্যাঁ এখন অনেক মেয়েই বাচ্চা নিয়ে পরীক্ষার হলে যায়। এখন ঘরে যা।"
দাদীমা বলল,"ব্যাটা আজ এখানে থাকবে।"
শাইনা বলল,"সেই খুশিতে নাচতে বলছো? যাব না আমি।"
দাদীমা ফিসফিস করে বললেন,"জামাইকে পছন্দ করছিস না এসব কথা মানুষের কানে গেলে মানুষ ছিঃ ছিঃ করবে। মানুষ এককথাকে দশকথা করে। এমনিতেই সবাই জেনে গেছে বিয়েতে তুই খুশি না। মানুষ কতরকম কথা বলছে। বাচ্চাটাচ্চার কথা তুলিস। বাচ্চা কাচ্চা চলে এলে মানুষের কথাও বন্ধ হয়ে যাবে।"
শাইনার চোখজোড়ায় যেন রক্ত নেমেছে। দাদীমা তার চোখ দেখে ভড়কে গেল। বলল,
"ওই ব্যাটা বিদেশ চলে গেলে তখন তুই একা একা কি করবি? বাচ্চা টাচ্চা নিয়ে নিজের জায়গা শক্ত কর শ্বশুরবাড়িতে। তখন তোকে কেউ সহজে কিছু বলতে পারবেনা। আমার দিকে ওভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। মেয়েদের সংসার শক্ত করতে প্রথমে কষ্ট করতে হয়।"
শাইনা উঠে চলে গেল সেখান থেকে। ঘরে এসে মুখে পানির ঝাপটা দিল। তাজদার সিদ্দিকী ঘরজুড়ে পায়চারি করছে। শাইনার ঘরটা আগাগোড়া দেখছে।
শাইনা ওয়াশরুম থেকে বের হওয়া মাত্রই বলে উঠলো,
"ঘুরতে বেরোবো। একটা শাড়ি পরে নেয়া হোক।"
শাইনা তার দিকে না তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"মাথা খারাপ? কোথায় যাব এতরাতে্?"
"বলা যাবেনা।"
"আমার মুড নেই এখন। ঘুমাতে ইচ্ছে করছে।"
"গাড়িতে ঘুমানো যাবে।"
শাইনা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তাজদার সিদ্দিকী তাড়া দিয়ে বলল,
"একটু দ্রুত রেডি হয়ে নিলে ভালো হয়।"
"বসার ঘরে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে?"
তাজদার দায়সারাভাবে বলল,
"বাচ্চা হয়ে গেলে আমি একাই লন্ডনে ফিরে যাব।"
শাইনা কপাল কুঁচকে তাকালো। মোটেও এই ধরণের কথাবার্তা হয়নি। কিন্তু দাদীমার কথার সাথে মিলে গেল কিভাবে? দাদীমা বলেছে? নাকি এই লোকটাই দাদীমাকে সেটা শিখিয়ে দিয়েছে বলার জন্য?
তাজদারও তার চোখের দিকে তাকালো তখুনি। বুক টানটান করে দাঁড়িয়ে বলল,
"শাইনা মমতাজ তোমার সামনে এখন দুটো রাস্তা।"
শাইনা তার দিকে চোখ তুলে তাকাল। চোখ সরিয়ে নেবে তক্ষুণি তাজদার বলল,
"যাইহোক আমি চাই এখন তুমি আমার সাথে চলো।"
শাইনা ক্লান্ত হয়ে বলল,"আমি খুব টায়ার্ড। শরীর খারাপ লাগছে। দয়া করে ঘুমান। আমাকেও ঘুমাতে দিন। এত কথা বলতে ভালো লাগছেনা। এটা আপনার বাড়ি নয় যে বড় বড় কথা বললেও কেউ শুনতে পাবেনা।"
তাজদার গলার আওয়াজ বড় করে বলল,"আমি তোমাকে বলেছি বেরোতে। তোমার হাতে সময় জাস্ট পাঁচ মিনিট। সাজগোছ দরকার নেই। শুধু শাড়িটা পরবে।"
শাইনাকে নিজের পছন্দমতো একটা শাড়ি বের করে দিল সে। শাইনা শাড়িটা হাতে নিয়ে বলল,
"একটু বের হোন।"
"এটা শ্বশুরবাড়ি। বের হওয়া যাবেনা। আমার সামনে পাল্টাও। আমি পরপুরুষ নই।"
শাইনা শক্তকণ্ঠে বলল,"দেখতে চান সেটা বললেই হয়ে যেত।"
তাজদার তার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। শাইনা ব্লাউজ, পেটিকোট বের করে বলল,
"আপনি ঘর থেকে বেরোবেন না?"
"না।"
শাইনা ঘরের আলো নিভিয়ে দিল। ওড়না রেখে দিল। তারপর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াটার দিকে একবার তাকালো।
অপ্রস্তুত অবস্থায় আবারও ফিরে তাকালো। এই লোকটার নজর এত বাজে যে বিবাহিত সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েও সেই চাহনি তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। চাইলেও সে স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারছেনা। এই যে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। শাইনা যদি ভুল না হয় তাহলে এদিকেই তাকিয়ে আছে।
"হয়েছে?"
তৎক্ষনাৎ ঘরের আলো জ্বলে উঠলো। শাইনা আঁচল কাঁধে টেনে এনে বলল,
"হিজাব বাঁধব। আরও সময় লাগবে।"
তাজদার সিদ্দিকী লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এসে তার চুলের ক্লিপ খুলে দিতেই চুলগুলো ঝাঁপিয়ে পড়লো পড়লো পিঠে। শাইনা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
"আমি খোলা চুলে বেরোইনা।"
"আমার সাথে বেরোনো যাবে। রাস্তাঘাটে মানুষ নেই এখন। যাওয়া যাক।"
শাইনা চুলগুলো খোঁপা করে নিল ঢিলে করে। তাজদার তাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পড়তে দাদীমাকে বলল,
"ফাইনালি।"
দাদীমা, শাইনা খালা, ফুপুরা আড়াল থেকে দেখল শাইনা সোজা গাড়িতে গিয়ে বসেছে। তারা সবাই ফিসফিস করছে। বউ নিয়ে ব্যাটা যাচ্ছে কই?
তাজদার গাড়ির দরজা খুলে গাড়ির ভেতর মাথা ঢুকিয়ে বলল,
"সামনে এসে বসা হোক।"
শাইনা বলল,"পেছনে বসলে কি সমস্যা?"
"পেছন থেকে কেউ বউ নিয়ে পালালে টের পাব না এটাই সমস্যা।"
শাইনা সামনে এসে বসলো। তাজদার ড্রাইভিং সিটে বসলো। গাড়ি ছেড়ে দিল। বাজার পার হতেই নির্জন রাস্তা ধরে গাড়ি এগোতে লাগলো। তাজদার খুব গুরুতর ভঙ্গিতে বলল,
"ধরো সাদা পোশাক পরা, লম্বাচুলো, বড় বড় নখ আছে এমন একটা পেত্নী হুট করে আমাদের গাড়ির সামনে এসে থেমে গেল!"
বলতে বলতে না বলতেই হুট করে ব্রেক কষলো গাড়িটা। শাইনা ভয়ানক একটা চিৎকার দিয়ে তাজদার সিদ্দিকীর বুকের উপর এসে পড়লো।
তাজদার সিদ্দিকী তাকে টেনে এনে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে তার মুখের উপর শ্বাস ছেড়ে কাঠকাঠ গলায় বলল,"তুমি নিজ থেকে আমার কাছে এসেছ তাই আমি তোমাকে আজ ইচ্ছেমতো ছুঁবো। নো হাংকিপাংকি মিসেস শাইনা মমতাজ। আমার সাথে লন্ডনে যাবে নইলে......
বাকিটা বলার আগেই শাইনা ছটফটিয়ে উঠলো।
চলমান..........