15/12/2024
দেশের বাহিরে নিজ দেশকে প্রতিনিধিত্ব করা সমসময় মর্যদাসম্পন্ন। আল্লাহর রহমতে এই সুযোগ আমি যখনি পেয়েছি নিজ দেশকে ভিন্ন দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য চেষ্টা করেছি। আজ এরকম বিশেষ তিনটি অভিজ্ঞতা আপনাদের সাথে শেয়ার করবো।
প্রেক্ষাপট-১: সময়কাল অক্টোবর ২০১২: অফিসের কাজে জাপানের আমন্ত্রনে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহন করার উদ্দেশ্য জাপানে কিছুদিন অবস্থান করি। সেসময় অফিসিয়াল সুচী চুড়ান্ত করার সময় আমাকে ০১ দিন নিজের পছন্দসই জায়গা ঘুরে দেখার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়, আর এসুযোগ পেয়ে শৈশবে স্কুলে পড়াকালীন সময়ে বইয়ের পাতায় মানব ইতিহাসের পারমানবিক বোমা বিস্ফোরনের যে ঘটনা জাপানের দুটি শহরে ঘটেছিল সেই শহর দুটি দেখার লোভ সংবরন করতে পারিনি। তাই অকপটে নিজের মনের আকাংখা হিরোসিমা ও নাগাসাকি শহর দেখার কথা আয়োজকদের জানালাম। কিন্তু শহর দুটি আমার অবস্থানের স্থান হতে দুরে হওয়ায় প্রথমে রাজী হচ্ছিল না, কিন্তু আমিও নাছোড়বান্দার মতো বললাম এর বাহিরে আমার আর কোন অপশন নাই। সবশেষে আমাকে জানানো হলো হিরোশিমায় যাওয়া অনুমোদন করা হবে যদি আমি দুটি শর্ত মানতে পারি শর্ত দুটি হলো ১। ফুকোওকা হতে কিয়োটো ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রামে যোগদানের পথে একা একা হিরোশিমায় যেতে হবে এবং সর্বচ্চ একরাত অবস্থান করতে পারবো ২। এই ভিজিটের কথা জাইকা টোকিও অফিস পরিদর্শনের সময় বলা যাবে না। আমি সাথে সাথে এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলাম। ১৫ অক্টোবর ২০১২ আমি সকাল 6:21 মিনিটে জাপানিজ বুলেট ট্রেনে Kodama 840 (যা সিনকানসেন নামে বহুল পরিচিত জাপানে) চড়ে ঘন্টায় 200 মাইলের বেশি গতিতে ১ ঘন্টা 40 মিনিট সময়ের মধ্যে 285 km দুরুত্ব পাড়ি দিয়ে হিরোশিমায় পৌছে যাই। পরিচ্ছন্ন গোছানো শহর দেখে কোনভাবেই আচ করা যাবে না যে এই শহর পারমানবিক বোমার আঘাতে ধ্বংস প্রাপ্ত একটি শহর যার আনবিক রেডিয়েশনের ক্ষতি এখনো এখানকার মানুষ প্রজন্ম হতে প্রজন্ম বহন করে চলছে। ট্রামে চড়ে সোজা Motoyasu নদির ধারে গড়ে উঠা হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্কে চলে গেলাম এবং বিস্ময়ভরাদৃষ্টিতে চারিদিক দেখতে লাগলাম আর ছোট বেলায় বইতে পড়া ইতিহাসের সাথে মেলাতে চেষ্টা করতে থাকলাম। কিন্তু মিলের মাঝে নদিটি পেলাম আর পেলাম ধ্বংষাবশেষের মাঝে একমাত্র টিকে থাকা Atomic Bomb Dome যার পূর্ব নাম ছিল Hiroshima Prefectural Industrial Promotion Hall । এলাকাটি এখন সম্পূর্ন একটি টুরিষ্ট স্পটে পরিনত হয়েছে যেখানে মূলত পার্ক এবং মিউজিয়াম অবস্থিত। যা হোক পুরো এলাকাটি ঘুরে দেখতে দেখতে একদল স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে দেখা তারা মূলত শিক্ষা সফরের অংশ হিসাবে হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্ক এবং মিউজিয়া দেখতে এসেছে। জাপানের ছাত্র-ছাত্রীদের একটি কমন ম্যানার হলো বিদেশি কাউকে দেখলে তাকে সম্মান জানানো এবং কুশল বিনিময় করা। আর এর অংশ হিসাবে আমার সাথে তাদের সাথে পরিচিতি হয়। যেহেতু এ সফরে আমি একা ছিলাম তাই পরিচয়ের পর অমার নিজের কিছু ছবি তুলতে তাদের সহায়তাগ্রহনকরি। এভাবে তাদের সাথে আমার একটা আন্তরিকতা তৈরি হয়ে যায়। যেহেতু আমি একদিন সময় হাতে নিয়ে এসেছি তাই আমি আমার মতো হিরোশিমাকে দেখার জন্য তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। হিরোশিমা হতে কিয়োটো হয়ে আরো ২ দিন পর আমি টোকিওতে পৌছাই। টোকিওতে আমার জাপানিজ সহকর্মীরা আমাকে গ্রহণ করে, টোকিওতে পরদিন আমাদের সূচি ছিল জাইকা টোকিও অফিসে আনুষ্ঠানিক সভা। সভার প্রস্তুতি নিয়ে পরদিন সকালেই জাইকা অফিসে যাই সেখানে আনুষ্ঠানিক সভা শেষে অফিস ঘুরে দেখার সময়ই হিরোশিমায় যে ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে দেখা হয়েছিল তাদের সাথে দেখা, স্বভাবতই আমি নিজেকে আড়াল করার চেস্টা করছিলাম যেহেতু হিরোশিমার বিষয়টি অফিসিয়াল ছিলো না। কিন্ত ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে দেখে উচ্ছাসিত এবং তারা আমার কাছে ছুটে আসে ফলে বিষয়টি আর গোপন রইলো না। যাইহোক বিষয়টি শেষ পর্যন্ত জাইকাকে আমার জাপানিজ সহকর্মীরা বুঝিয়ে বলে। এরপর জাইকার যিনি সাউথ -ইস্ট এশিয়ার প্রধান তিনি আমাকে অনুরাধ করলেন বাংলাদেশ সর্ম্পকে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে একটি সংক্ষিপ্ত বর্ননা তুলে ধরার জন্য জাইকা কিভাবে বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশিদার হিসাবে কাজ করে। আমিও সানন্দে তা গ্রহন করলাম ছাত্র-ছাত্রীরা আমাকে ঘিরে দাড়ালো আমি প্রথমেই তাদের কাছে প্রশ্ন ছুড়লাম যে তোমরা কে কে আগে বাংলাদেশের নাম শুনেছো হাত তোলো? কিন্তু দুখেঃর বিষয় কেউ হাত তুললো না। আমিও খুব মর্মাহত হলাম। আমার মাথায় কি কাজ করলো আমি জানি না, আমি আমার সবচেয়ে কাছে থাকা একজন ছাত্রকে টেনে আমার সামেনে নিয়ে এসে ওর শার্টের কলারের পেছনে দেখতে চাইলাম আর বিস্ময়করভাবে লেখা দেখলাম মেইড ইন বাংলাদেশ। আমি সাথে সাথে বললাম এটাই বাংলাদেশ। এরপর তাদের সাথে আরো অনেক বিষয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু মনে দাগ কেটে রইলো আমার যা কিছু সময় পূর্বে ঘটেছে।
প্রেক্ষাপট-২: সময়কাল জুলাই ২০২৪: আল্লাহর রহেমতে ০১ জুলাই হতে ০৭ জুলাই ২০২৪ আমি আইএফআরসি এবং এশিয়া প্যাসিফিক ডিজাস্টার রেসপন্স সেন্টারের আমন্ত্রনে আরবান কোলাবোরেশন প্লাটফরমে ৭০ টি দেশের মাঝে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ও দেশেরে হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাই। এই অংশগ্রহন ছিলো আমাদের জন্য মর্যদাসম্পন্ন যেহেতু বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি পূর্ব ঘোষনা অসুসারে ৭০ টি দেশের মাঝে যে দুটি দেশ আরবান স্ট্রেটেজি প্রনয়ন করতে সক্ষম হয়েছে তার মাঝে একটি ছিলো অপরটি হলো হংকং। যেহেতু আরবান স্ট্রেটেজিটি প্রনয়নে আমি সরাসরি লিড দিয়েছিলাম তাই বিষয়টি আমার জন্য সস্তিদায়ক ছিলো। পুরো কনফারেন্স সময়ে এবং কোরিয়ার যেখানেই গিয়েছি বাংলোদেশকে আর নতুন করে পরিচয় করার প্রয়োজন পড়েনি বিশ্বের অন্যতম দ্রুত অগ্রগামী অর্থনিতির দেশ, কোভিড-১৯ সহ বড় বড় দুর্যোগ মোকাবেলায় এক সফল দেশ হিসাবে বাংলাদেশ তার স্বমহিমায় পরিচিত, যা নিজের মাঝে এক ভালো লাগার অনুভতি সৃষ্টি করেছে। ১২ বছর পূর্বে আমার জাপান ভিজিটের সময় তা ছিল অনুপস্থিত।
প্রেক্ষাপট-৩: সময়কাল ৯ ডিসেম্বর-১৩ ডিসেম্বর ২০২৪: মহান আল্লাহর রহমতে চায়না রেড ক্রসের আমন্ত্রনে চিনের গুয়াজু প্রদেশের গুইয়াং শহরে এ আইএফাারসি, আইসিআরসি সহ ১০ টি দেশের রেজিলিয়েন্স কমিউনিটি বিষয়ের উপর একটি আর্ন্তজাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহন ও বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাই। সম্মেলনের রাউন্ড টেবিল এবং প্লানেরি সেশনের বাইরে সাইড টেবিল এবং ডিনারে যেখানেই নিজের পরিচয় দিয়েছি সবার উৎসক দৃষ্টি এবং জিঞ্জাসা তোমাদের দেশের অবস্থা কি এখন স্বাভাবিক? ল এন্ড অর্ডার অবস্থা কি? তোমাদের দেশের মূল্যস্ফিতির কি অবস্থা? দারিদ্রতার হার কি আবার বাড়ছে? প্রশ্নগুলি শুনতেও ভালো লাগেনি এবং জবাব দিতে গিয়েও খুব কষ্ট পেয়েছি। যাই হোক দেশকে সবসময় সবার আগে প্রাধান্য দিয়েছি তাই উত্তরছিলো সবকিছু এখন স্বাভাবিক এবং পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
পুনশ্চঃ বাংলা বানান এবং যথাযথ ভাষারীতি মেনে লিখতে না পারার অপরাগতার জন্য দুঃখিত।