23/06/2025
ছবি আর্ট এর দিনগুলো ১
টি. এ. সেলিম
২০০১ সালে মহাখালীর ছোট একটি মেচে থাকতাম। আমি, পায়েল ও রুমেন। পায়েল ও রুমেন আপন মামা ভাগিনা, রুমেন সিটি ইউনিভার্সিটিতে অধ্যায়ন করতো আর পায়েল তিতুমীর কলেজ, আমি একটি আর্ট একাডেমীতে সার্টিফিকেট কোর্স করতাম ও মাঝেমধ্যে ছবি আর্ট এর কাজ করতাম। আমাদের সাথে আরো একজন থাকতেন উনার নাম লিমন।
লিমনএর চেহারা নাদুসনুদুস, মুখমন্ডল গোলআকৃতি, গায়ের রং ফর্সা।
লিমন সবসময় পরিপাটি থাকেন । লিমন এর দুই মেয়ে ও এক ছেলে। লিমন এর স্ত্রী ও সন্তানরা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। লিমনএর ছেলেটি বড়। ছেলেটি নবম শ্রেণীতে পড়ে।
তখনকার সময় কারো কাছে একটি বাটন মোবাইল মানেই অনেক কিছু। এখনকার মতো তখন সবার হাতে হাতে মোবাইল ছিল না।
মোবাইলের কল রেট তখন মিনিট প্রতি ৭ টাকা ছিল।
একদিন একটি দৈনিক পত্রিকায় নিউজ দেখলাম আমাদের বাংলাদেশের মোবাইল কলরেট প্রতি মিনিট ৭ টাকা অথচ আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে মাত্র কয়েক পয়সা। নিউজটি তখন দেখে আমি খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম। ভাবলাম হয়তো নিউজটি ভুল ছিল।
নরসিংদীর মনোহরদী, শিবপুর ও পলাশ উপজেলার বেশ কয়েকটি স্কুলে আমি আইডিয়াল প্রকল্পের শ্রেণিকক্ষ সজ্জিতকরন আর্টের কাজ করেছিলাম।
আমারও একটি মোবাইল ক্রয় করার ইচ্ছে হয়েছিল।
বাজারে বেশিরভাগ সিটিসেল মোবাইল বিক্রি হতো, সিটিসেল মোবাইল কোম্পানি তাদের নিজস্ব সিম ঢালাই করে সেট সহ একসাথে বিক্রি করতো। সিটিসেল কল দেওয়ার সাথে সাথ অপরপ্রান্তে রিং হওয়ার সময় মিনিট কাউন্ড হতো।
এবং এই সিটিসেল মোবাইল দিয়েই গ্রামগঞ্জের বাজারে কিছু সংখ্যক লোক ভালোই ব্যবসা করতো।
বিদেশ থেকে আসা ইনকামিং কল মিনিট প্রতি ১০ টাকা করে নিতো এবং বিদেশের বিভিন্ন দেশে কলরেট বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম নিতো, আমিরিকাতে কল মিনিট প্রায় একশত টাকা নিতো।। বিদেশ থেকে কল আসার লোকের আত্মীয় থেকেও আত্মীয়কে খবর পৌঁছানোর জন্য বাড়তি একশত টাকার বেশি নেওয়া হতো।
সিটিসেল এরপর আসলো গ্রামীণফোন। তবে গ্রামীণ ব্যাংক তাদের ঋণগ্রহীতা গ্রাহকদের গ্রামীণফোনের পল্লী ফোন নামক একটি বাটন মোবাইল সহ পোস্টপেইড মোবাইল দিতো।যার মূল্য নিত পায় ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা।যা পরবর্তীতে গ্রহীতাকে কিস্তিতে পরিশোধ করতে হতো।
প্রতিটি রিসার্চ মোবাইল কার্ডের মূল্য ছিল তিন শত টাকা। তার মধ্যে ২১ দিনের মেয়াদ নির্ধারণ করে দেওয়া হতো। গ্রামীণফোনের তখন লোগো ছিল একটি মোবাইলসহ পুরুষ ও মহিলার মুখ।
পরবর্তীতে গ্রামীণফোন তাদের লোগো পরিবর্তন করেছে।
গ্রামীণফোনের সাথে নতুন করে আসলো একটেল। পরবর্তীতে একটেল নাম পরিবর্তন করে রবি নাম ধারণ করলো।
যাই হোক আমারও একটি মোবাইল ক্রয় করার ইচ্ছে হইলো।
নরসিংদী সদরে গেলাম মোবাইল ক্রয় করার জন্য। আমি গ্রামীন সিম নিতে চাইলাম দোকানদার ছিল চালাক কৌশলে আমাকে একটা একটেল সিম ও একটি বাটন মোবাইল দিল। সিমটির মূল্য ৩ হাজার পাঁচশত টাকা ও বাটন মোবাইল টির দাম ৪ হাজার দুইশত টাকা নিল যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমারও মোবাইল ক্রয় হলো।
যেহেতু আমি স্কুলের ছবি আর্ট এর কাজ করি তাই আমি যে জেলার স্কুলে কাজ করি প্রথমে সেই উপজেলার শিক্ষা অফিসারদের সাথে পরিচিত হই।
অনেক উপজেলার শিক্ষা অফিসারদের সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক, আত্মার আত্মীয়র মত, আমি উনাদের কে শ্রদ্ধা ও সম্মান করি, উনারাও আমাকে আদর করেন।
তেমনি আমি গিয়েছিলাম নরসিংদী জেলার মনহরদী উপজেলা শিক্ষা অফিস।
কক্ষে ঢোকার আগেই দরজা দেখলাম নেমপ্লেটে লেখা শিক্ষা অফিসারের নাম জয়ন্তীদেবী উপজেলা শিক্ষা অফিসার। মনোহরদী।
সালাম দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেই আমি অবাক এত কমবয়সী একজন মেয়ে কিনা এখানকার শিক্ষা অফিসার।
তিনি আমাকে বসতে বললেন এবং জিজ্ঞেস করলেন। আমার নাম? কি করি? কোথায় থেকে আসলাম?
আমি আমার মত করেই পরিচয় দিলাম। আমি টি. এ
সেলিম ঢাকায় থাকি, চারুকলায় অধ্যায়ন করি। আপনার মনোহরদী উপজেলার একটি স্কুলে কিছু ছবি আর্ট করার কাজ করতেছি। আমার কথায় তিনি আঞ্চলিকতার ছোঁয়া পেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আপনার বাড়ি কোথায়??
আমি বললাম নোয়াখালী।
জয়ন্তদেবীঃ নোয়াখালী কোথায়?
আমিঃ সোনাইমুড়ী উপজেলায়।
জয়ন্তদেবীঃ সোনাইমুড়ীর কোথায়?
আমিঃ নান্দিয়াপাড়া।
জয়ন্তদেবীঃ সোনাইমুড়ী কলেজের সামনের রাস্তায়। দিয়েই তো নান্দিয়াপাড়া যাওয়া যায়।??
আমিঃ মৃধু হেসে বললাম জি হা।
জয়ন্তদেবীঃ তিনিও আমার সাথে হেসে উঠলেন।
আমিঃ প্রশ্ন করলাম আপনার বাড়ি কোথায়?
জয়ন্তদেবীঃ মুচকি হেসে বললেন নোয়াখালী সদর মাইজদীর পাশে।
উনার সাথে অনেক কথা হলো।
শেষে প্রশ্ন করে বসলাম আপনি কি বিয়ে করেছেন?? জয়নতীদেবীঃ উত্তরে আরে না এই বয়সে কেউ কি বিয়ে করে নাকি!!
আমিঃ বললাম এই বয়সেই তো আপনি মস্ত বড় এক উপজেলা শিক্ষা অফিসার।
অবশেষে জয়ন্তীদেবীর মোবাইল নাম্বারটি নিলাম, তিনি বললেন আমি আমার বাবা মায়ের সাথে থাকি। সন্ধ্যার পর আমাকে মোবাইলে কল করলে পাওয়া যাবে।
উনার বাসায় মোবাইল থাকে সেখানে এন্টিনার লাগানো আছে। তিনি আমাকে বললেন যে কোন প্রয়োজনে যেন আমি উনার সাথে যোগাযোগ করি। তবে কাজ ১০০% নিখুঁত করতে হবে।
আমি যে স্কুলটিতে আর্ট করলাম সেই স্কুলটির কাজ শেষ করলাম। এবং উনাকে ভিজিট করার জন্য বললাম।
উনার উপজেলার AUEO দের নিজস্ব মোটরসাইকেল ছিলো। কিন্তু উনাকে ওখানকার ব্রাক অফিস থেকে একটি প্রাইভেটকার দিতো। আমি আর্ট করা স্কুলটি ভিজিট করার যাওয়ার সময় তিনি আমাকেও উনার সাথে গাড়িতে করে নিয়ে গেলেন। স্কুলটি ছিল রাস্তার পাশেই। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বয়স্ক। গাড়ি থেকে জয়ন্তীদেবী নামার সাথে সাথেই প্রধান শিক্ষক উনাকে হাত তুলে কয়েকবার সালাম দিলেন।
রাস্তা পাশ্ব দিয়ে হাই স্কুলের মেয়েরা যাচ্ছিল। তারা তখন প্রধান শিক্ষকের এমন সালাম দাওয়াতে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এবং মেয়েরা সবাই একসাথে হেসে উঠলো।
আমার আর্ট করা ছবিগুলো দেখে সেইদিন জয়ন্তীদেবী খুশি হয়েছিলেন এবং আমাকে আরও কিছু দিক নির্দেশনা দিলেন।
এবার আসি লিমনের কথায়। ৭ টাকা কলরেটে ৩ শত টাকার কার্ড রিসার্চ করে লিমন রাতভর কথা বলতো রিমির সাথে। রিমি প্রতিদিন লিমনকে দুঃখের গান গেয়ে শোনাই তো। মোটামুটি ভালই গাইতো। লিমন রিমি কে বলেছিল সে অবিবাহিত। রিমি জানালো সে স্বামী পরিত্যাক্তা তার বিয়ে হয়েছিল। কোন সন্তান হয়নি। স্বামী থেকে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে এখন সে একটি আবাসিক মাদ্রাসার ছাত্রদের ভাত রান্না করে। রিমি আরো জানাল সে দেখতে অনেকটা কালো!! ততটা লেখাপড়া করে নাই। কোনরকম জীবন যাপন করে। রিমির এই কথাগুলোকে লিমন ভাবতো নিতান্তই সে মিথ্যে বলছে সে ভাবতে রিমি খুবই সুন্দরী স্মার্ট শিক্ষিত। রিমির কন্ঠ খুবই ভালো লেগেছে লিমনের । লিমন রিমি কে বলেছিল তুমি যেমনি হও আমি তোমাকে বিয়ে করব। দিনের পর দিন তাদের একে অপরের সাথে মোবাইলে কথা হয়েছিল । এবার একে অপরকে দেখবে!! ।
তাই তারা ঠিক করল নির্ধারিত একদিন তারা দেখা করবে লিমন তো মহা খুশি, সারারাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল। ভোরবেলা উঠে ফোমসেভ করে।চুলের সাইট কাটিয়ে আদা কাঁচাপাকা চুল গুলো কে বিদেশি কলভ মাখিয়ে। গারো কাল করলো। কালো জুতাটি কালার করল। শার্ট আয়রন করে নিল, আজ তাকে সাপোর্ট করার জন্য আগ থেকে তার কলিগ দেরকে বলে রেখেছিল। সম্পূর্ণ পরিপাটি হয়েছে। লিমন আজ দেখা করবে রিমির সাথে। মহাখালীর জলখাবার মিষ্টি দোকানে। আমি আগ্রহ দেখালাম লিমন এর সাথে যাওয়ার কিন্তু লিমন আমাকে শর্ত দিল আমি যেন দুরে বসে থাকি এবং হাসাহাসি না করি!!
এবার অপেক্ষার পালা রিমি আসার!! কিছুক্ষণ পর পর লিমন কল দিয়ে জেনে নিচ্ছে রিমি কতটুকু আসলো। সত্যিই আজকে লিমনকে খুবই স্মার্ট লাগছে হঠাৎ মোবাইল কানে কথা বলছে এক মহিলা গায়ে তার লাল শাড়ি। দুই হাতে চুড়ি। কানে লম্বা কানপাশা পায়ের ফুল করা সেন্ডেল চুলগুলো তেল দিয়ে খোপা বাঁধানো!! যেন একজন মহিলা। কানে মোবাইল দিয়ে কথা বলছে লিমন তুমি কোথায়??
এই মহিলাই হচ্ছে রিমি। লিমন দেখেতো থমকে উঠলো নিজের সব স্বপ্ন যেন নিমিষেই চুরমার হয়ে গেল চোখ দুটো লাল হয়ে গেল এই যেন এখনই কেঁদে ফেলবে। লিমন এমনটি রিমিকে ভাবি নি!!
পরিশেষে
মিষ্টি খাওয়ানো হলো। লিমন রিমিকে দেখে যতটুকু কষ্ট পেয়েছে তার চেয়ে বেশি লজ্জিত হয়েছে কলিগদেরকে সাথে এনে । আমি দূর থেকে দেখে চলে আসলাম।
লিমন আমাকে বারবার নিষেধ করেছে আমি যেন আমাদের রুমমেট পায়েল ও । রুমান কে যেন না বলি!! (চলব)