
22/07/2025
সংখ্যা কমিয়ে দেখাবার একটা রাজনীতি আছে। এটার উৎস বা ইতিহাস কি জানি না। লঞ্চ ডুবির এলাকার বহু মানুষের কাছে শুনতাম মালিকরা লাশ দূরে সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতেন। সত্যি মিথ্যা জানা নাই, যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনার বেলায় তা সত্যি এটা অনেকেই জানেন। দেশের অন্যতম প্রধান দ্রুতগামী এক বাস কোম্পানির এক লোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল একটা কাজে, তার অন্যতম কাজ ছিল দুর্ঘটনায় পরা এলাকায় ব্রিফকেস ভর্তি টাকা নিয়ে নিমিষে হাজির হওয়া, ক্রাইসিস ম্যানেজ করা। খবররের শিরোনামে প্রতিষ্ঠানের নাম না যাওয়া, মৃতের সংখ্যা কমিয়ে দেখাবার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি প্রয়োজনে স্থানীয় থানা, সাংবাদিক ইত্যাদি ব্যক্তিদের বন্দোবস্ত করে হাত পাকিয়েছিলেন।
ঠিক কী কী কারণে এটা করা হয়, নিশ্চিত না। এমন কোন ক্ষতিপূরণ এ দেশে দিতে হয় না কারও অনিয়মে প্রাণহাণি ঘটলে। হয়তো এর বাইরেও তাদের আরও অনেক বিষয় আছে। হতে পারে কয়েকদিন পর জানাজানি হলেও তখন মানুষের অতটা গায়ে লাগে না, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি কিংবা অনিয়ম নিয়ে কথা হয় কম। বেপরোয়া গতির জন্য কোম্পানির বদনাম হলে হয়তো যাত্রী সংখ্যাতেও কয়েকদিন প্রভাব পরে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে রানা প্লাজাতে উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করার চেষ্টা হয়েছিল বেশ দ্রুতই। কতদিনের মাথায় মনে নেই, তাসলিমা বা কল্লোল হয়তো আরও দিনটা বলতে পারবে, তখনও উদ্ধার কর্মীরা সংখ্যায় খুব কম হলেও জীবন্ত মানুষ কিংবা লাশ বের করে নিয়ে আসছিলেন। কয়েদিকের মাথায় প্রশাসন খুব চাপ দিচ্ছিলো উদ্ধার কাজ বন্ধ করতে হবে। উদ্ধারকর্মীরা খানিকটা বিমূঢ়ই হয়ে গিয়েছিলেন। প্রশাসনের একটা যুক্তি ছিল রানা প্লাজা যে কোন সময়ে আরও ধ্বসে যেতে পারে, তখন উদ্ধারকর্মীরাও মারা যাবেন। ওদিকে উদ্ধারকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই কাজটা করে যাচ্ছিলেন। এই সময়েও বেশ কয়েকজন মানুষকে জীবন্ত উদ্ধার করা হয়। বলা যায় অন্য যে কোন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর তুলনায় সাধারণ নাগরিকরাই মূল উদ্ধারকাজটা পরিচালনা করেছেন, কল্পনাতীত সব জায়গায়, ধীরে ধীরে ডেবে আসছে এমন সব স্তুপ থেকে চাপা পড়া মানুষকে বের করে এনেছেন।
চাপের মুখে পরা এই উদ্ধারকর্মীদের তেমন কিছু করতে হয়নি। সাধারণ মানুষই রুখে দাঁড়িয়েছিলা। রীতিমত মুখোমুখি হয় তারা নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর। এবং অবশেষে তাদের দাবির মুখে প্রশাসন পিছু হটে। জীবন্ত মানুষ কিংবা লাশ উদ্ধার অব্যাহত থাকে।
ক্ষতিপূরণ কম দিতে হবে বলে রানা প্লাজা বা তাজরিনে মৃতের সংখ্যা কম দেখাবার চেষ্টা ছিল। সংগঠকরা বিপরীতে চেষ্টা করেছেন একটা নামও যাতে না হারিযে যায়। এমনকি তারা যেন সংখ্যায়ও পর্যবসিত না হন। প্রতিটি মানুষের জীবন তো মূল্যবান।
ভুলভাবে হোক, ঠিকভাবে হোক, মানুষের আশঙ্কা ছিল এই যে প্রশাসন লাশ গায়েব করবে। একটা দেশে মানুষ প্রশাসনকে কতটা অবিশ্বাস করে, সেই দিন মর্মে মর্মে বুঝেছিলাম। বলতে গেলে জনগণ পাহারা দিয়েছিল উদ্ধারকর্মীদের।
কিন্তু এই সময়ের ছেলেমেয়েরা আরও আলাদা। এই চরম শোকের দিনেও রানা প্লাজার কথা ভাবতে গিয়ে মনে হয়, এরা যে ভাবে তাদের শিক্ষকদের ওপর সামরিক বাহিনীর নিপীড়ন নিয়ে কথা বলেছে এই শোকের সময়ে, প্রশ্ন করেছে মৃত্যু কমিয়ে দেখানো নিয়ে-- কামনা করি এই প্রশ্ন করা প্রজন্ম শহরটাকে কারা কিভাবে মৃত্যুকূপ বানিয়ে রেখেছে, সেই কথাগুলোও আরও জোরেশোরে বলবে।
সংখ্যায় খুব কম হলেও আমাকে দুয়েকজন বলেছেন এই শোকের সময়ে এসব নিয়ে রাজনীতি না করতে। তাদের আমি দোষ দেই না, হয়তো তারা আসলেই শোকে বিমূঢ়। কিংবা সম্ভবনা আছে যে তারা আসলে হাসিনাদের যুক্তির জালে আটকা পড়েছেন।
কারণ,যে মৃত্যুগুলো নিছক মৃত্যু নয়, কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড, সেই কথা আপনি কিভাবে এড়িয়ে যাবেন? কখন সেই কথাগুলো বলবেন? কখন বলবেন যে জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান কেন? কখন বলবেন লালবাগে প্লাস্টিক গুদামগুলো কেন সরাচ্ছেন না? কবে বলবেন কাঠালবাগানে দুর্ঘটনা হলে মানুষ কোথায় দাঁড়াবে?
কবে?
কালেক্টেড