23/09/2025
সমুদ্র আর বৃদ্ধের গল্প
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বৃদ্ধ জেলে নৌকাটা ঠেলে দিল সমুদ্রের বুকের দিকে। বয়সের ভারে তার শরীর ক্লান্ত, হাত কাঁপে, চোখ ঝাপসা হয় বারবার। কিন্তু মন? মনটা যেনো এখনও তরুণ, এখনও জেদী।
সেদিন সমুদ্র অস্বাভাবিকভাবে নীরব ছিল। হাওয়ায় এক ধরনের শূন্যতা, ঢেউ যেন গভীর কিছু লুকিয়ে রেখেছে। বৃদ্ধ জানত, দীর্ঘদিন ধরেই সে কোনো মাছ ধরতে পারেনি। গ্রামে অনেকেই বলত, "ওর সময় শেষ।" কিন্তু বৃদ্ধ হাসত, মুচকি ঠোঁটে বলত—
“মাছ যদি আসে, আমার হাতই ধরবে। যদি না আসে, তবুও আমি চেষ্টা করব।”
ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, হঠাৎ দড়ি টান মারে। নৌকাটা দুলে ওঠে, যেনো সমুদ্র নিজেই শ্বাস নেয়। বিশাল এক মাছ—সমুদ্রের রাজার মতো—আঁকড়ে ধরেছে তার টোপ। বৃদ্ধ বুঝল, এ তার জীবনের সবচেয়ে বড় লড়াই।
শক্তি দিয়ে সে পারবে না, তা সে জানে। তাই সে ধৈর্যকে হাতিয়ার বানাল। এক হাত দিয়ে দড়ি আঁকড়ে ধরল, অন্য হাতে নৌকার কাঠ চেপে রাখল। রোদ মাথায় আগুন ঢালে, লবণাক্ত পানি ঘামের সাথে মিশে চোখ ঝলসে দেয়। কিন্তু বৃদ্ধ ছাড়ল না।
দিন গেল, রাত এল, আবার ভোর হলো। মাছ টানে, নৌকা টানে, শরীর টানে—কিন্তু বৃদ্ধের মন ভাঙল না। তার ঠোঁট শুকিয়ে যায়, আঙুল ফেটে রক্ত ঝরে, তবুও সে মনে মনে বারবার বলে—
“মানুষ হেরে যেতে পারে, কিন্তু হার মানতে পারে না।”
অবশেষে ক্লান্ত মাছ ধীরে ধীরে উঠে এলো জলের উপর। সূর্যের আলোয় তার শরীর ঝলমল করে উঠল। বৃদ্ধের চোখ ভরে গেল জল আর গর্বে। সে জানে, এই জয় শুধুই মাছ ধরার নয়। এই জয় হলো নিজের ভেতরের ভয়, দুর্বলতা আর মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে টিকে থাকার জয়।
নৌকা ফিরল গ্রামে। জেলেটির শরীর ভাঙাচোরা, কিন্তু চোখে আগুনের মতো দীপ্তি। মানুষজন কিছু বলল না, শুধু তাকাল। তারা বুঝল—এই বৃদ্ধই শেখাল, সমুদ্রের মতো বিশাল সংগ্রামও হার মানাতে পারে না একজন মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে।