12/07/2025
বোনের প্রেমিককে 'কবুল' বলতে যতটা কষ্ট সাধ্য হওয়ার কথা ভেবেছিলাম, ততটা কষ্ট হলো না শেষমেশ। তিন সেকেন্ডেরও কম সময়ে তিন কবুলে নিভ্র ভাইকে নিজের স্বামী রূপে গ্রহণ করে নিলাম আমি। পাশ থেকে ছোট চাচী টিপ্পনী কে'টে বলল, "ব্যাপার কি রে, এই তো বললি কিছু নেই, অথচ বিয়ে করতে এত অস্থির!"
আমি চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইলাম সে কথার জবাবে। কাউকে কিচ্ছু বলব না। কিচ্ছু না। আমাকে বলার সুযোগই যখন দেওয়া হয়নি তখন, এখন সাফাই গেয়ে হবে টা কি? আমার স্বপ্ন, ইচ্ছে, শখ— সেসব কি ভাঙাচোরা রূপ থেকে ফিরে জোড়া লেগে যাবে আবারও? নাকি মিথ্যে হয়ে যাবে বিয়েটা? যে বন্দীত্বের শেকল দু'টি মানুষের পায়ে জোরপূর্বক পড়িয়ে দিলো সকলে, সেই সম্পর্কের ভার বইতে গিয়ে কতখানি হৃদপীড়ণ সইতে হবে বুকের যন্ত্রটায়, সে কথা কি একবারও ভেবেছে কেউ? না তো! বরং এত আর্তনাদ, এত চিৎকার, এত বিশ্লেষণ শেষেও আমাদের পরিণতি হলো তাই, যা চাওয়ার ছিল না কখনোই। তেজী, চঞ্চল এবং দাপুটে এই আমিটার নামের পাশে যার পরিচয় যুক্ত হলো, তিনি বরাবরই আমার বিপরীত। একটুখানি চপলতা আর অনেকখানি গম্ভীরতা সমেত গুণে গুণে বারো বছরের বড় বয়সী তাঁর সঙ্গে আমি কেমন করে মানিয়ে নেবো, সে হিসেবটা আমার জানা নেই... অদৃষ্টের এই বিচিত্র পরিকল্পনায় সৃষ্টি হলো এক নতুন গল্পের রচনা, এক মহিমান্বিত প্রেমের এবং হৃদয় হরণকারী অনুভূতির— যাতে বন্দী হয়ে পড়লাম আমি...নাজমীন পায়রা!
_____________________
(ঘন্টা কয়েক পূর্বে)
রাত থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ঝড়ছে। অগ্রহায়ণ শেষ হয়েছে তিন দিবস পূর্বে। আজ পৌষের তৃতীয় দিন। যদিও প্রকৃতিতে এখনো শীত দাঁত কামড়ে বসতে শুরু করেনি। সেই শুরুর পরিকল্পনাতেই বোধহয় এই অঘোষিত বৃষ্টির আগমন। আবহাওয়ায় বলছে, আগামী তিন দিন এরকম টিপটিপানি বৃষ্টি পড়বে অবিরাম ধারায়। বৃষ্টির ফোঁটায় ভর করে শৈত্য রাণী নেমে আসবে ধরণীর বুকে। তখন মাটির বুক শুকিয়ে যাবে। গাছের পাতা ঝরে পড়বে। চারদিকে শুধুই বিরাজমান শূন্যতা থাকবে। যেন শৈত্য রাণীর সবটুকু বিষাদ ঢেলে দেওয়া হবে ভূমিতে। তার ক্রোধের শীতলতায় হু হু করে কাঁপবে পৃথিবীতে বসবাসরত প্রতিটি প্রাণীকূল! তারপর একসময় আক্রোশ মিটে গেলে যেভাবে গোপনে এসেছিল মাটির বুকে, সেভাবেই চুপিসারে বিদায় জানাবে সে।
মৌমিতার সকাল থেকেই মন খারাপ। আজ তার আকদের অনুষ্ঠান। ছাদে শামিয়ানা টানিয়ে সেখানেই সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে। সবাই বাড়িতে সাজতে বললেও, মৌমিতা জেদ করেই পার্লার থেকে লোক আনিয়ে দারুণ সাজে নিজেকে সাজিয়েছে। ছাদের এক কোণে ছবি তোলার জন্য সুন্দর করে ফ্রেম ও সাজিয়েছে বড় ভাইয়া। অথচ বৃষ্টির তোড়ে চারদিক ভেসে যাচ্ছে এখন। মৌমিতা এক ঘন্টা যাবত অপেক্ষা করছে। বৃষ্টি কমছে না। বৃষ্টিবিলাসী মেয়েটির তাই আজ বৃষ্টির উপর অভিমানে নাকের পাটা একটু পর পর কেঁপে কেঁপে উঠছে।
সেই সময়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করল পায়রা। ওর মেজো চাচার মেয়ে। নীল গাউনে তাকে দেখাচ্ছে স্বর্গের অপ্সরা! দু'হাতে গাউন সামলাতে তাকে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে, তা চেহারায় স্পষ্ট ফুঁটে উঠেছে। মৌমিতা ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে রইল।
পায়রা নরম বিছানাটার উপর ধপ করে বসে পড়ল। শরীরের সবটুকু ভার ছেড়ে দিলো। দু'হাত পেছনে ভর করে মুখটাকে সিলিংয়ের দিকে করল। ঘন ঘন কয়েকটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, "ডাকছিলে আপা?"
মৌমিতা গম্ভীর স্বরে উত্তর দিলো, "হুঁ।"
"আমি তখন ব্যস্ত ছিলাম, বলো, কিছু লাগবে?"
মৌমিতা এক দণ্ড সময় নিয়ে ভাবল। যে কাজটা করে দিতে হবে, সেটা এই মুহূর্তে পায়রা ছাড়া অন্য কেউ করতে পারবে না। পায়রার উপর শতভাগ ভরসা রাখা যায়। মেয়েটা বয়সে ছোট হলেও বিশ্বস্ত! এ যাবত মৌমিতার কত কান্ড দেখেছে, শুনেছে, কোনোদিন কাউকে কিচ্ছুটি বলেনি।
মৌমিতা গলার স্বর চেপে বলল, "আমার একটা কাজ করে দিবি পাখি? অনেক ইম্পর্ট্যান্ট, এন্ড সিক্রেট!"
পায়রা আধশোয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসল তড়িঘড়ি। চোখের পাতায় রাজ্যের বিস্ময়। সেই সঙ্গে আগ্রহ নাড়াচাড়া দিয়ে উঠছে মনের উঠোন জুড়ে। সেও মৌমিতার মতোই গলার স্বর চেপে রেখে বলল, "কি আপা? কি হইছে?"
মৌমিতা বার দুয়েক ঢোক গিলে শুষ্ক গলাটা ভেজানোর ঈষৎ চেষ্টা করল, পূর্বের চেয়েও চাপা গলায় বলল, "নিভ্রকে একটু স্টোর রুমে নিয়ে আসতে হবে। পেছন গেইট দিয়ে। কেউ যেন না দেখে।"
এহেন কথায় বেশ হকচকিয়ে গেল পায়রা। সেই সঙ্গে জেগে ওঠা আগ্রহ ও চাপা পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। ভেবেছিল দারুণ এডভেঞ্চারাস কিছু, কিন্তু এ আর এমন কি কাজ! নিভ্র ভাইয়াকে এ বাড়িতে অনেকেই চেনে তো। কতবার এসেছে! আপার বন্ধু মানুষ। রাস্তায় কতবার পায়রার সঙ্গে দেখা হয়েছে। পায়রার বিনুনি করা চুল টেনে জিজ্ঞেস করেছে, কিরে ব্লু বার্ড, খবর কি? পড়াশোনা করছিস না শুধু প্রেম? হুঁ?
কিন্তু একটা ব্যাপার মাথায় ঢুকল না। তাকে এমন লুকিয়ে চুকিয়ে চোরের মতোন এ বাড়ির স্টোর রুমে আনা কেন? চাইলে সদর দরজা দিয়েই তো আসতে পারে। কে মানা করবে?
পায়রা কিছু একটা বলতে যাবে, তন্মধ্যে মৌমিতা পুনরায় বলে উঠল, "কেউ যেন না দেখে, আই রিপিট, নো ওয়ান! জাস্ট তুই আর আমি জানবো ব্যাপারটা। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? ইটস ভেরি ভেরি ভেরি সিক্রেট! প্লিজ পাখি, কাজটা করে দে। আই কান্ট ট্রাস্ট এনিওয়ান..." আপার কণ্ঠে আকুতি।
পায়রা ভ্রু কুঁচকালো, "কিন্তু এত লুকোচুরি কেন? ব্যাপার কি আপা? সামথিং রং?"
মৌমিতার চোখমুখ কালো হয়ে এলো। কি যেন একটা গোপন করার চেষ্টা করল সে। উঠে দাঁড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের সম্মুখে বসে কপালের টায়রাটা অযথাই ঠিক করার ভান করে বলল, "এত কথা না বলে প্লিজ যা। ও বাইরেই আছে। তুই ইশারা করলেই আসবে। মনে রাখবি, ইটস আ সিক্রেট! টপ সিক্রেট!"
নিভ্র আর মৌমিতার সম্পর্কটা একটু অন্যরকম। বছর চারেক ধরে একে অপরকে চেনে। তবে মুখ ফুঁটে ভালোবাসি শব্দটা কেউ কাউকে বলেনি। তবুও দু'জনের হৃদয়ই জানে, তারা দু'জন দু'জনকে পছন্দ করে বেশ! মৌমিতার ভার্সিটির লাস্ট ইয়ার চলছে। আর নিভ্র কাজ করে একটা আইটি ফার্মে। পরিচয়টা হয়েছিল অদ্ভুত ভাবে! একদিন মৌমিতা রাস্তা পার হতে গিয়ে ছিনতাইয়ের শিকার হলো। কাঁধ থেকে টেনে ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে ছিল এক ছিঁচকে চোর! মৌমিতা হল্লা করে চিৎকার করে উঠল। আর তক্ষুনি দেখল, তাকে টপকে আরও একজন চোরের পেছন পেছন ধাওয়া করেছে। বেশ হাড্ডাহাড্ডি দৌড় চললো মিনিট পাঁচেক। কিন্তু ফলাফল শূন্য! ওসব ছেলেদের ধরা যায় নাকি! চোখের পলকে কোথায় হাওয়া হয়, কে জানে! এদের প্রচুর নেটওয়ার্ক!
নিভ্র হাঁপাতে হাঁপাতে এসে মৌমিতাকে বলল, "আপনার কাছে জল হবে? থাকলে দিন তো।"
মৌমিতা শক্ত গলায় বলল, "ব্যাগই তো নিয়ে গেল। বোতল পাব কোথায়?"
"ও আচ্ছা। সরি সরি। আসলে এত দৌড় দৌড়ালাম! বাপরে...শেষ বোধহয় কলেজ লাইফে এমন দৌড়েছিলাম বুঝলেন.." বলতে বলতে বেশ স্পষ্ট চোখেই মৌমিতার মুখের আদল মুখস্থ করে ফেলল লোকটা। ছোট্ট একটা মুখ, হালকা লম্বাটে, তবে বেশ মানিয়ে গেছে। চোখজোড়া জলে থৈ থৈ। ব্যাগে কি খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল? কাঁধের উপর ছোট করে কা'টা চুল, বাম হাতে রিস্টওয়াচ, সুতির সালওয়ার কামিজে বেশ গোছানো পরিপাটি একটি তরুণী...নিভ্র'র ভালো লাগল। সেই ভালো লাগা কখন যে ভালো বাসায় রূপান্তর হলো, নিভ্র জানে না। মন উজাড় করে দেওয়া ভালোবাসার সবটুকু সে ঢেলে দিলো মৌমিতার নাম করে। বিনিময়ে মৌমিতাও মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। ভার্সিটি চত্বরে হেঁটে বেড়ানো, ফুচকা খাওয়ার প্রতিযোগিতা, হঠাৎ চায়ের আবদার, রাত জেগে গল্প রচনা করা, হুটহাট বৃষ্টিতে ভিজতে— সবকিছুতেই নিভ্রকে পাশে পাশে রেখেছে। নিভ্র ধরেই নিলো, মৌমিতার এই নীরব সম্মতিই তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। দু'জন কেউ কাউকে কথা না দিলেও তাদের হৃদয় যেন একে অপরকে কথা দিয়ে ফেলল, আমি তোমার, তুমি আমার!
সেই মানুষটির হঠাৎ বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। নিভ্র কতবার চেষ্টা করল, এ বাড়ির সবাইকে জানাতে তাদের ব্যাপার খানা। মৌমিতার বাবা কে ধরে বলতে। দরকার হলে তার পায়ে পড়বে সে। তবু মৌমিতাকে হারাতে দেবে না। মৌমিতা ওর ভালোবাসা! কিন্তু মৌমিতা কিছুতেই তার কথা না বাড়ির কাউকে বলল, আর না নিভ্রকে এ বাড়িতে আসার অনুমতি দিলো। একটা অজানা ভয় সরিসৃপের মতো করে একটু একটু করে জাপটে ধরল তার গোটা শরীর। মন বাড়ির বারান্দায় নামালো আতংকের ঝড়। বাবা ভীষণ রাগী মানুষ! জানতে পারলে খু-ন করে ফেলবে।
তবে শেষ বারের মতো একটিবার দেখা করার অনুরোধ মৌমিতা কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারল না। অনুমতি দিলো এ বাড়িতে আসার। তবে লোক সমাগমে জন সম্মুখে নয় বরং চোরের মতো চুপিচুপি। নিভ্র মেনে নিয়েছে। শুধু একবার দেখা হোক, এইটুকুই চাওয়া তার...
ছাদে প্রচুর কোলাহল। বৃষ্টির তোরজোর কমলেও তার ঝরে পড়া থেমে নেই। টিপটিপ, টিপটিপ.... পড়ছে তো পড়ছেই! বড় আব্বু, বাবা, ছোট চাচ্চু, বড় ভাইরা, সবাই এখানে। তারা সব সরঞ্জাম সরিয়ে গ্যারেজে নিচ্ছে। কিছুতেই ছাদে অনুষ্ঠান করা যাবে না। ঘরের ভেতরই আকদ পড়িয়ে, গ্যারেজে সবার খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে আপাতত। পায়রা ছাদে পা রাখতেই নোংরা কাদাপানিতে তার গাউনের অনেকখানি ভিজে গেল। সে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বলে উঠল, "ইশ!"
সামিউল ওকে দেখেই ধমকা ধমকি শুরু করল।
"তুই এখানে আসছিস ক্যান? এইখানে কি কাজ তোর? বৃষ্টির ভেতর এই ভোটকা জামা পড়ে... এখন একটা আছাড় খেয়ে পড়লে কে তুলবে তোকে? এই নাম, নাম বলছি।"
পায়রার বিরক্তির পারদ আরেকটু বাড়ল তাতে। কোঁচকানো কপালে বলল, "আমি পড়লে আমিই উঠব। আমাকে উঠানোর চিন্তায় তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না ভাইয়া। আমি আসছি আকাশের অবস্থা কি, তাই দেখতে। অকাজে তো আসিনি।"
"ওরি বাবা! আবহাওয়া অধিদপ্তরের বড় ম্যাডাম সাহেবা, আকাশের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে আসছেন। এই ছোটন, সর সর, ম্যাডাম কে এদিক আসতে দে। ম্যাডাম দেখুক, বৃষ্টিটা থামানো যায় নাকি।"
সামিউলের কণ্ঠে মশকরা। পায়রা কিছু বলল না। ছোটন কে একটা চ'ড় দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে গটগট পায়ে নিচে নেমে গেল। নামতে গিয়ে দু'বার হাই হিলের এলোমেলো পদক্ষেপে পড়তে পড়তে আবার সামলে নিলো। সামিউল উপর থেকে দেখল কিনা তাও একবার তীক্ষ্ণ নজরে পরখ করল। দেখলে পরে আবার কথার খোঁচা হজম করতে হবে!
বাড়ির ভেতরে রাজ্যের সব আত্মীয় স্বজন গিজগিজ করছে। সবার ভেতর বিয়েবাড়ির মতোন আমেজ,উল্লাস। ছোটরা ছোটাছুটি করছে এদিক ওদিক। বড়রা একেক ঘর দখলে নিয়ে গল্প করে যাচ্ছে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে। সবাই পুতুলের মতো সেজেগুজে আছে। কাজিনদের আড্ডা চলছে দোতলায়। পায়রার মনটা সেখানে যাবার জন্য ছটফট করলেও আপাতত বড় আপার কাজ করে দেওয়াই তার মূল লক্ষ্য!
এ বাড়িটা চার তলা। চার তলায় তিন ভাই মিলেমিশে থাকে। নিচ তলাটা একটা কোচিংয়ে ভাড়া দেওয়া। পায়রারা থাকে তিন তলায়। পায়রা সেখানে একবার উঁকি দিয়ে দেখল। ভেতরে ওর খালা মামুরা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প আড্ডায় ব্যস্ত। তাকে দেখতে পাবার আগেই সে সটকে পড়ল। দোতলায় উঁকি দিলো একই ভাবে। সবার গতিবিধি লক্ষ্য করে নেমে এলো নিচ তলায়। আজ কোচিং সেন্টারটা বন্ধ। বড় একটি তালা ঝুলছে সেখানে। পায়রা গ্যারেজে চোখ রাখল। এখানেও মানুষের গিজগিজ! টেবিল চেয়ার ফ্যান সব ফিটিং করা হচ্ছে। লাইট বসানো হচ্ছে। পায়রা সরে এলো। পেছনের দিকটা একদম ফাঁকা। একদম মানে একদম। পায়রার এতক্ষণ ধরে আঁটকে রাখা নিঃশ্বাসটা এবার বেরিয়ে এলো। তড়িঘড়ি করে পেছনের গেইট টেনে খুলতেই একটু দূড়ে কারেন্টের পোলের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মানুষটিকে...
ছয় ফুট দুই ইঞ্চির লম্বা মানুষটির গায়ে ঢিলেঢালা সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা। পায়ের জুতো জোড়া হাতে নিয়ে বেশ উশখুশ ভঙ্গিতে এদিকেই তাকিয়ে আছে। পায়রাকে উঁকি দিতে দেখেই হাত নাড়লো। পায়রা 'থাম্বস আপ' সাইন দেখিয়ে দিতেই তিনি গটগট পায়ে এগিয়ে এসে গেইট দিয়ে ঢুকল।
"সোজা গিয়েই ডানে, দরজা খোলা আছে।" ব্যস্ত কণ্ঠে বলল পায়রা। নিভ্র কিছুমাত্র না বলে সেদিকে ছুটলো। ভয়, পাছে কেউ দেখে না ফেলে! পায়রা দরজার এদিক ওদিক ফের একবার সতর্ক দৃষ্টিবাণ ঘোরালো। বৃষ্টি ভেজা রাস্তাটা একেবারেই ফাঁকা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পায়রা দরজা আঁটকে দিয়ে নিজেও স্টোর রুমের দিকে পা বাড়ালো।
প্রায় ঘন্টাখানেক সময় ধরে মানুষটি দাঁড়িয়ে ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে গেছে একদম। পুরো পাঞ্জাবি শরীরের সাথে এঁটে পুরুষালি পেশী উন্মুক্ত হয়ে উঠেছে। চুলগুলো লম্বা, দাঁড়ানো, সেগুলো নুয়ে পড়েছে লাজুক লতার মতো। কপালের উপর ক'গাছি এঁটে আছে বিন্যস্ত ভঙ্গিতে। নিভ্র ভেজা হাতেই চুল গুলো সরালো। স্টোর রুমে পুরোনো সব জিনিসপত্রের বোঝাই, কয়েকটি পুরোনো খাট, একটা বড় ভাঙা দেয়াল সুকেজ, লম্বা ডিভান, সিঙ্গেল সোফা যার জায়গায় জায়গায় স্প্রিং বেরিয়ে পড়েছে, আরও নানান রকমের বাতিল সামগ্রি। নিভ্র ধূলোময়লা জড়ানো ডিভানটায় টান টান হয়ে বসে পড়ল। পা ধরে গেছে। শরীর শিরশির করছে। বৃষ্টিতে ভেজা তার কম্মো নয়। মৌমিতার জেদে পড়ে জীবনে বেশ কয়েকবার ভিজতে হয়েছে, এইটুকুই!
পায়রার একটুখানি খারাপ লাগল। লোকটা এত ভিজে গেছে! ক্রমাগত হাচ্চি দিচ্ছে। একটা গামছা বা এ জাতীয় কিছু দেওয়া যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এরকম কিছু এই মুহূর্তে আশেপাশে নেই। কি করবে সে!
পায়রা নরম গলায় বলল, "আপনি ঠিক আছেন ভাইয়া? বেশি ঠান্ডা লেগে গেল বুঝি?"
নিভ্র 'হ্যাচ্চোওওও' শব্দে বিকট আওয়াজ করে একটা হাঁচি দিয়ে অপরাধী ভঙ্গিতে হাসল। পায়রার চোখে চোখ রেখে বলল, "আমার ঠান্ডার ধাঁত আছে। আর অনেকক্ষণ ভিজেছিলাম বুঝলে.." তারপর আবারও নাকটা টেনে একটুখানি শান্ত হয়ে বলল, "তোমাকে কিন্তু দারুণ দেখাচ্ছে ব্লু বার্ড। আমার দেওয়া নামটা আজ স্বার্থকতা পেল!"
পায়রার ঠোঁটে মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়ল। প্রথম দিন থেকেই নিভ্র ভাইয়া তাকে ব্লু বার্ড নামে ডাকে। কেন ডাকে, কে জানে! কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। ডাকুক না যার যা ভালো লাগে। এসব নামেও তো স্নেহ মিশে!
পায়রা বলল, "আপনি এখানে বসে থাকুন। আমি আপাকে গিয়ে বলি, আপনি এসেছেন যে।"
"না, বলতে হবে না। ও একটু পর এমনিতেই আসবে। বসো তুমি।"
পায়রা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, "কোথায় বসব?"
সেটা খেয়াল করে নিভ্র ও মাথা নেড়ে ওঠে তৎক্ষনাৎ, "ও,সবখানে তো ময়লা। গাউনে লেগে যাবে। আচ্ছা, দাঁড়িয়েই থাকো তবে।"
পায়রা মাথা কাত করে সম্মতি জানালো।
নিভ্র আবারও পরাপর দুটো হাঁচি দিয়ে নাক টেনে নিলো। নাসিকাপথ দিয়ে গলার কাছটা পর্যন্ত, জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে তার। আজ নির্ঘাত একশো ছাড়াবে জ্বর! অনেকদিন ভোগাবে! নিভ্র ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পায়রার দিকে তাকাল। উৎসুক চোখের মেয়েটা ওকেই দেখছিল তখন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে... নিভ্র তাকাতেই দৃষ্টি এলোমেলো করে হাসল। নিভ্রও হাসি ছুঁড়ে দিলো বিনিময়ে। বলল, "অবাক হচ্ছ আমাকে এভাবে চোরের মতো এখানে আসতে দেখে, তাই না?"
পায়রা তরল গলায় বলল, "একটু!"
"আমি সবার সামনে দিয়ে ভালোভাবেই আসতে চেয়েছিলাম। তোমার বোন দিলো না। তোমার বড় চাচা জানতে পারলে নাকি...অনেক বড় ঝামেলা হয়ে যাবে!"
"ঝামেলা? কিসের ঝামেলা? আপনি তো এর আগেও তিনবার এ বাড়িতে এলেন!"
নিভ্র হাসল, "তুমি ছোট মানুষ, বুঝবে না।"
পায়রার ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল সঙ্গে সঙ্গে। এই একটি কথা শুনলে রাগে দুঃখে ক্ষোভে তার পিত্তি জ্বলে যায়। কিছুদিন আগেই এসএসসি শেষ করেছে সে। আর ক'দিন বাদেই কলেজ শুরু হবে। অথচ সে নাকি ছোট! সে নাকি কিছু বোঝে না! বোঝে সব উনারা.. একেকজন দামড়া হয়ে গেছে, হাহ! পায়রা দাঁত কিড়মিড় করে নিজের ক্ষোভটাকে আঁটকালো। রাগটা গিলে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, "আপনি বুঝিয়ে বললে অবশ্যই বুঝব ভাইয়া। দেখুন,আমি কিন্তু যথেষ্ট বিশ্বস্ত। নইলে আপা আমাকে পাঠাতো না!"
"হ্যাঁ, তা ঠিক, তুমি ভালো, লক্ষী একটা মেয়ে, আবার একটু পাজিও! তোমার আপা বলেছে।"
"আমি পাজি?" বিস্ময় চেপে বসল ওর দু'চোখের তারায়। তাই দেখে নিভ্র লম্বা হাসি ঠোঁটে টেনে আনলো, "মজা করছিলাম তবে লক্ষী যে, এ কথা মজা নয়। তুমি সত্যিই ভীষণ লক্ষী!"
পায়রা নরম হলো একটু। অল্পতেই মাথা গরম হয়ে ওঠা, স্বভাব ওর। তবে সামনে বসে থাকা ভিজে জবজবে গায়ের এই সুদর্শন পুরুষটি, বোকাসোকা হাবভাব যার, তার এই রাগ রাগ কথাগুলোতেই যুক্তিযুক্ত তর্কটা না করতে পারার একটা চাপা কষ্ট ওর অন্তরে ছেয়ে গেল। এ যদি ঘরের লোক হতো, এখনই এক হাত দেখে নেওয়া যেতো....হাহ!
পায়রা গম্ভীর গলায় বলল, "আপনি বসে থাকুন। কোথথাও বের হবেন না। উঁকিও দিতে যাবেন না। কেউ দেখলে কিন্তু... আমি আপাকে ডেকে আনছি।"
বাম হাতে লাগানো খয়েরি বেল্টের ঘড়িটায় তখনো সময়ের কা-টা ঘুরছে। সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠল নিভ্র। এতক্ষণে মৌমিতার চলে আসবার কথা। কিন্তু এখনো এলো না। ও কি আঁটকে গেছে কোথাও নাকি সকলের নজর ফাঁকি দিতে পারছে না? ওকে বউ সাজে কেমন লাগছে দেখতে? নিভ্র'র মনটা হঠাৎ করেই বেদনার নীল রঙে ছেয়ে গেল। আজ যেভাবেই হোক, মৌমিতাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওর বাবার সঙ্গে কথা বলতেই এসেছে নিভ্র। মৌমিতা ওর প্রেম, ওর গোপন ভালোবাসা — এত সহজে তা ছেড়ে দিতে রাজি নয় সে!
"কি হলো, কি ভাবছেন?"
পায়রার আকস্মিক গম্ভীর স্বরটা ভাবনার জগতকে কাঁচের টুকরোর মতো চূর্ণবিচূর্ণ করে দিলো হঠাৎ। নিভ্র ছিঁটকে বাস্তবে বেরিয়ে আসে। উপর-নীচ মাথা দুলিয়ে বলে, "না, কিছু না। তুমি যাও। তোমার আপাকে নিয়ে জলদি এসো। আমার হাতে সময় খুব কম।"
পায়রা নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবল। বুঝে গেল। ঠোঁটের কোণে হাসি নয় বরং কপালে বেশ কয়েকটি ভাঁজ সৃষ্টি হলো তার। নিভ্র ভাইয়া আর মৌমিতা আপুর সম্পর্কের নামটা হঠাৎ করেই পায়রার মন বাগানে উঁকি দিয়েছে। যদি ওর ধারণা সত্যি হয়, তবে সামনে বেশ দুর্বিষহ সময়! বড় চাচা প্রেম-পিরিতি, ভালোবাসা— এসবের খেলাফে! দৃঢ় চিত্তে দাঁড়িয়ে সে মেয়ে কোরবানি করে দেবে তবু মেনে নেবেন না... তারচেয়েও চিন্তার বিষয়, যদি জানতে পারেন, নিভ্র ভাইয়াকে এখানে আনবার পেছনে ওর হাত রয়েছে...তবে...তবে...
পায়রা আর ভাবতে পারল না। চিন্তার গতিপথে লাগাম টেনে বার দুয়েক ঢোক গিললো। বুকটা শুকিয়ে উঠছে। একটা ফণা তোলা সাপের মতোন আতংক মন বাগিচার উঠোন বসে হিঁসহিঁস শব্দ তুলছে। এই বুঝি কিছু একটা হলো...
সে পড়িমরি করে চাপিয়ে রাখা দরজার দিকে পা বাড়ালো এবং হাই হিলের তাল হারিয়ে কাত হয়ে ওখানেই বসে পড়ল। পা টা পড়ল ভীষণ বেকায়দায়, একেবারে ফ্রাকচার... পায়রার ঠোঁট চিঁড়ে বেরিয়ে এলো চাপা স্বরের আর্ত চিৎকার, "ও...মা..."
নিভ্র ভয় পেয়ে ডিভান ছেড়ে উঠে এসে দৌড়ে ওর পাশে নিচু হয়ে বসে পড়ে। এক হাতে পায়রার কাঁধ আঁকড়ে তাকে ব্যালেন্স করবার চেষ্টা করে। কপালে চিন্তার ভাঁজ, কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা, "ব্লু বার্ড...ব্লু বার্ড, আর ইউ ওকে?"
জবাবটা দিতে পারল না পায়রা। তার আগেই ভেজানো দরজাটা সটান খুলে গেল। করিডোরের উজ্জ্বল আলোর খানিকটা ছঁটা এসে পড়ল পায়রার চোখেমুখে। চোখজোড়া সঙ্গে সঙ্গে মুঁদে নিয়ে আবারও মেলে তাকাল এবং ভয়ের শিহরণে হৃদযন্ত্র ও ঠান্ডা হয়ে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি আর কেউ নন... তার শ্রদ্ধেয়, গুরুগম্ভীর, বিক্ষুব্ধ বড় চাচা...
(চলবে)
#প্রেমবন্দী_পায়রা
#পর্ব_১
#মৃধা_মৌনি
(এইটা নিয়মিত দেওয়া হবে। তবে পর্ব গুলো একটু ছোট হবে, আগেই বলে দিচ্ছি। যারা পড়বেন দয়া করে লাইক কমেন্ট করবেন প্লিজ। আইডির রিচ তলানিতে...)