আদ্যোপান্ত

আদ্যোপান্ত Welcome to Adyopanto, where we dive deep into the world of News, Geopolitics, and History.

Join us as we unpack current events, explore global power dynamics, and delve into the past to understand how it shapes our present.

Big shout out to my newest top fans! 💎 Alamin MollaDrop a comment to welcome them to our community,
19/06/2025

Big shout out to my newest top fans! 💎 Alamin Molla

Drop a comment to welcome them to our community,

30/05/2025

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ ভিয়েতনামের উত্তর পূর্ব উপকূলে রয়েছে অনন্য এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। অগভীর সমুদ্রের স্ফটিক সবুজ পানিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার পাথুরে দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত এই এলাকার নাম হা লং বে। আজকের ভিডিওতে জনপ্রিয় এই পর্যটন কেন্দ্রটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। বিশেষ করে অনিন্দ্য সুন্দর এই দ্বীপপুঞ্জ সৃষ্টির কারণ এবং এখানে গড়ে ওঠা সুপ্রাচীন জনবসতি সম্পর্কে আপনাদের বিশদ ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো। চলুন তবে আর দেরী না করে ভিয়েতনামের এই হা লং বে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আসি।

হা লং বে’র এই দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক নৈসর্গ সৃষ্টির বৃত্তান্ত জানতে আমাদের প্রায় ৫৭ কোটি বছর আগে ফিরে যেতে হবে। ঐ সময় বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলের মত ভিয়েতনামের উত্তর পূর্ব উপকূলটিও সাগরের তলে ডুবে ছিল। পৃথিবীতে তখন সবে ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের সূচনা হয়েছে। বিবর্তনের ধারায় তখন বিচিত্র সব বহুকোষী প্রাণীর আবির্ভাব ঘটছে। এই সব প্রাণীর সিংহভাগেরই দেহে আত্মরক্ষার জন্য খোলস থাকতো। এরপর কোটি কোটি বছর ধরে এইসব খোলসধারী প্রাণীগুলো মৃত্যুর পর সাগরের তলদেশে জমা হয়েছে। জমা হওয়া এই খোলসগুলো কালের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে চুনাপাথরে পরিনত হয়েছে। এরপর আনুমানিক চৌত্রিশ কোটি বছর আগে এই এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কমে যায়। বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী ততদিনে হা লং বে’র সাগরতলে সঞ্চিত চুনাপাথরের স্তরটির উচ্চতা এক হাজার মিটার বা এক কিলোমিটার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

হা লং বে’র ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যে পরবর্তী উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন শুরু হয় প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে। ঐ সময় মহাদেশীয় টেকটনিক প্লেইটগুলোর পারষ্পরিক ঘর্ষণের ফলে হা লং বে’র সমুদ্রতল ভূপৃষ্ঠের ওপর উঠে দাঁড়ায়। এভাবে বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে আসার কারণে চুনাপাথরের স্তর বাতাস এবং বৃষ্টির পানিতে ক্ষয়ে যাওয়া শুরু করে। এই প্রক্রিয়ার ফলে আনুমানিক বিশ লাখ বছর আগে হা লং বেজুড়ে বিদ্যমান পাথুরে টিলা এবং গুহাব্যবস্থাগুলোর সৃষ্টি হয়েছিল। তবে তখনো এই এলাকাটি পাথুরে পার্বত্য এলাকার অংশ ছিল। এরপর আনুমানিক ৭০ হাজার বছর আগে বর্তমান ভিয়েতনামের উত্তর পূর্ব উপকূলসংলগ্ন সাগরের উচ্চতা পুনরায় বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করে। এই উচ্চতা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় প্রায় সাত হাজার বছর আগে এই উপসাগরটি তার বর্তমান উচ্চতায় পৌছে যায়। বর্তমানে এই সাগরটি সাউথ চায়না সি নামে পরিচিত।

প্রকৃতির হাতে প্রায় ষাট কোটি বছর ধরে নির্মিত হা লং বে’র আয়তন এক হাজার পাঁচশো তিপ্পান্ন বর্গ কিলোমিটার বা প্রায় ছয়শো বর্গ মাইল। এই এলাকায় প্রায় দুই হাজারের মত ছোট বড় দ্বীপ রয়েছে। দ্বীপগুলোর সিংহভাগই চুনাপাথরের তৈরী। চুনাপাথরের এই দ্বীপগুলোকে কার্স্ট নামে ডাকা হয়। এই হা লং বে’র প্রায় সাড়ে তিনশো বর্গ কিলোমিটার বা একশো উনত্রিশ বর্গ মাইল এলাকাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদায় ভূষিত করেছে ইউনেস্কো। এখানে অবস্থিত প্রায় দুই হাজার দ্বীপের মধ্যে মাত্র চল্লিশটিতে জনবসতি রয়েছে। ২০১৭ সালে সব মিলিয়ে এই বে এলাকায় বসবাস করতেন মাত্র এক হাজার পাঁচশো চল্লিশ জন।

জনসংখ্যার বিচারে হা লং বে তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও, জনবসতি স্থাপনের সময় বিবেচনা করলে এই এলাকা অনেক জনবহুল শহরকেও লজ্জায় ফেলে দেবে। জীবাশ্ম গবেষকরা এই এলাকায় প্রায় বিশ হাজার বছর আগে স্থাপিত জনবসতির অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। তাদের ধারণা, সমুদ্র উপকূলবর্তী এই অঞ্চল দুই দফা আদিমানুষের অভিবাসন প্রক্রিয়ার স্বাক্ষী হয়েছে। প্রথম দফায় প্রায় ১৮ লাখ বছর আগে আফ্রিকা ছেড়ে বেরিয়ে আসা হোমো ইরেক্টাস প্রজাতির মানুষ ককেশাস পর্বতমালা এবং গোবি মরুভূমির মত দুর্গম সব অঞ্চল পাড়ি দিয়ে আনুমানিক আট লাখ বছর আগে বর্তমান দক্ষিণ চীন সাগরের উপকূলবর্তী বিভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিল। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী এই হোমো ইরেক্টাস মানুষের কয়েকটি গোত্র হা লং বে এলাকায় বসবাস করতো। ঐ সময় অবশ্য এই এলাকাটি পাহাড় অধ্যূষিত স্থলভাগ ছিল।

দ্বিতীয় দফায় প্রায় এক লাখ বছর আগে আফ্রিকা থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির মানুষ পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। ঐ দফায় তারা বিভিন্ন সাগর এবং মহাসাগরের উপকূল ঘেষে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী সেই অভিযাত্রীদের বংশধরেরা প্রায় পঞ্চাশ হাজার বছর আগে ভিয়েতনামের উত্তর পূর্ব উপকূলে পৌঁছে গিয়েছিল। তবে হাজার হাজার বছর পর উদ্ধারযোগ্য বিভিন্ন উপকরণ নির্মানের সক্ষমতা অর্জনে তাদের আরো প্রায় ত্রিশ হাজার বছরের মত সময় লেগে যায়। যে কারণে এই এলাকা থেকে উদ্ধারকৃত জনবসতির স্বাক্ষী বহনকারী সবচেয়ে পুরনো নমুনাটির বয়স প্রায় বিশ হাজার বছর।

বিজ্ঞানীরা এই জনবসতি স্থাপনকারী গোত্রগুলোর সামষ্টিক নাম দিয়েছেন সোই নু সভ্যতা। এই সভ্যতার বাসিন্দাদের আমিষের প্রধান উত্স ছিল বিভিন্ন প্রজাতির শামুক এবং ঝিনুক। খাবার পর এদের পরিত্যক্ত খোলসের একাধিক স্তুপ খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এছাড়া মাছ ধরার জন্য বন্য মুরগীর হাড় দিয়ে তৈরী বড়শি এবং ছোট ঝিনুকের খোলস দিয়ে তৈরী সাদামাটা অলংকারও খুঁজে পেয়েছেন তারা। ভিডিওর প্রথম অংশে জেনেছেন এই সময়টায় ভিয়েতনামের উত্তর পূর্ব উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বিশেষ করে ১৩ থেকে ১৫ হাজার বছর আগে সর্বশেষ বরফ যুগের সমাপ্তি হওয়ায় উচ্চতা বৃদ্ধির এই হার আরো বেড়ে গিয়েছিল। যার ধারাবাহিকতায় সোই নু সভ্যতা বিবর্তিত হয়ে আমিষের চাহিদা মেটাতে খোলা সমুদ্রের বিভিন্ন প্রজাতির মাছের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আনুমানিক সাত হাজার বছর আগে এই সভ্যতা তার পূর্বসূরীর তুলণায় এতটাই ভিন্ন হয়ে যায় যে বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার সুবিধার্থে তার ভিন্ন নাম দিতে বাধ্য হন। চাই বেয়ো নামক এই সভ্যতা সোই নু এবং বর্তমান হা লং সভ্যতার মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে এখানে বিদ্যমান হা লং সভ্যতাটি তাদের বর্তমান চেহারা ধারণ করে। অর্থাত এই সভ্যতার বয়স মিশরীয়, হরপ্পা এবং ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সাথে তুলনীয়। এই উপকূলে বর্তমানে কয়েকটি ভাসমান জনবসতির অস্তিত্ব রয়েছে। সাগরের ওপর কয়েকশো ভেলার সমন্বয়ে গঠিত একেকটি জনবসতির গড় বাসিন্দা সংখ্যা দুইশোর মত।

ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ভিয়েতনামের এই অঞ্চলে আক্রমন চালাতে হানাদারদের নৌবাহিনী ব্যবহারের কোন বিকল্প ছিল না। কারণ এই বে এলাকার উত্তর, দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিকে দুর্ভেদ্য জঙ্গল এবং পর্বতমালা প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। জেনে অবাক হবেন, চতুর্দশ শতকে আবিষ্কৃত বারূদ এবং আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার শুরু হবার আগ পর্যন্ত এই এলাকায় বহির্শত্রুর চালানো সব হামলাই সফলভাবে মোকাবেলা করেছে স্থানীয়রা। এখানে হামলাকারীদের মধ্যে দুর্ধর্ষ মোঁগল সেনাপতি চেঙ্গিস খানের নাতি কুবলাই খান অন্যতম। ১২৮৮ সালে কুবলাই খানের শক্তিশালী নৌবাহিনী হা লং বে উপকূল দখলের চেষ্টা চালিয়েছিল। সেই হামলা ঠেকাতে এই এলাকার স্থানীয়রা বাগ নদীর মোহনায় পানির তলে বড় বড় গাছের গুড়ি লুকিয়ে রাখেন। গুড়িগুলোর ডগা ধাতুর তৈরী তীক্ষ্ম আবরণ দিয়ে মুড়ে দেয়া ছিল। ফলে এর ওপর দিয়ে যাবার সময় খোলস ফেটে জাহাজগুলোর সলিল সমাধি হয়েছিল।

ভিয়েতনামের জনসাধারণের সেই সাফল্যের ধারা বিংশ শতকে এসেও অটুট ছিল। মাঝে উনবিংশ শতকের শেষ দিকে অর্ধ শতাব্দীর জন্য ফ্রান্সের উপনিবেশে পরিনত হলেও, বিংশ শতকের মাঝামাঝি স্থানীয়দের সশস্ত্র বিরোধের মুখে পিছু হঁটতে বাধ্য হয় ফরাসীরা। এরপর ১৯৫৫ সালে সমাজতন্ত্র ঠেকানোর দোহাই দিয়ে ভিয়েতনামে সেনা পাঠায় বিশ্বের শীর্ষ সামরিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র। বিশ বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনীও স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে পরাজয় স্বীকার করে নেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর ফেলে যাওয়া বিপুলসংখ্যক জলমাইনের কারণে হা লং বে এলাকার কিছু নৌপথ এখনো জাহাজ চলাচলের উপযুক্ত না।

স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন প্রাচীন কালে এই উপকূলে হানাদার নৌবাহিনীর হামলা ঠেকাতে ভিয়েতনামের রাজা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। তার প্রার্থনা অনুযায়ী স্বর্গের দেবতারা তিনটি শক্তিশালী ড্রাগন পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। ড্রাগনগুলো এখানে এসে এই পাথুরে দ্বীপগুলো সৃষ্টি করেছিল। যার ফলে এই এলাকায় জাহাজ চালানো বেশ কঠিন কাজ। বিশেষ করে বিদেশীদের জন্য। সেই ড্রাগনগুলোর নিশ্বাসের সাথে ছড়িয়ে পড়া বিপুল পরিমান জেইড রত্নের কারণেই এখানে সমুদ্র জলের রং এমন স্ফটিক সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে।

সময়ের সাথে সাথে বিদেশী পর্যটকদের কাছে এই হা লং বে’র জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে পর্যটকদের জন্য স্কুবা ডাইভিং এবং কায়াকিং এর ব্যবস্থা রয়েছে। কেউ চাইলে কোরাল রিফ এলাকায় দুর্লভ মাছ ধরতে পারেন। রাবারের ছোট ভেলায় চড়ে সাগরে অর্ধেক ডুবে থাকা কার্স্ট এবং তাতে বিদ্যমান গুহাগুলোও ঘুরে দেখতে পারেন। আর আকাশ থেকে এই এলাকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাইলে ছোট সি প্লেইনে ঘোরার সুুযোগও আছে। পর্যটন খাত চাঙা হবার ফলে এই এলাকার অর্থনীতিতে জোয়ার এলেও সেই পর্যটকদের থাকা, খাওয়া এবং ভ্রমনের সুবিধার্থে নির্মিত অবকাঠামোগুলো পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাড়াচ্ছে। তাছাড়া কোরাল রিফগুলোয় উত্সাহী পর্যটকদের নির্বিচার মাছ শিকারের ফলে অনেক দুর্লভ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বিশ্ববাসীর আশা হা লং বে’র মত এমন নান্দনিক ও সুপ্রাচীন এলাকার জীববৈচিত্র এবং ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যগুলো সংরক্ষণে ভিয়েতনাম সরকার অচিরেই আরো উদ্যোগী হয়ে উঠবে।

30/05/2025

খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থানের মত মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে মানুষ সুপ্রাচীন আমল থেকেই বিভিন্ন প্রাণী শিকার করে আসছে। আদিম মানুষ এই কাজে প্রথম ভারী পাথরের টুকরো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছিল। তারপর সময়ের সাথে সাথে মানুষ শিকারের জন্য তীর ধণুক এবং বর্শা জাতীয় অপেক্ষাকৃত উন্নত অস্ত্রের উদ্ভাবন করে। তবে এমন সরঞ্জামের পাশাপাশি মানুষ প্রাণীজগতের কিছু সদস্যকেও প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে শিকারের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে হিংস্র প্রাণী শিকারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর ব্যবহারের কথা অনেকেই জানেন। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের মরূ এলাকায় খরগোশ জাতীয় প্রাণী শিকারে বাজ পাখিও ব্যবহার করা হয়। তবে অস্ত্র হিসেবে প্রাণী ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন মধ্য এশিয়ায় বসবাসকারী এক দল যাযাবর। কাজাখস্থান, কিরগিজস্তান এবং চীনের উত্তরাঞ্চলে এদের দেখা মিললেও, অধিকাংশ যাযাবর মূলত মঙ্গোলিয়ার আলটাই পর্বতমালাসংলগ্ন মরু এলাকায় বাস করেন। এই ভিডিওতে আপনাদের প্রাণী শিকারে ঈগল ব্যবহারকারীদের সম্পর্কে জানাবো। ভিডিওটি থেকে আপনারা এমন অভিনব উপায়ে শিকারের উদ্ভাবন থেকে শুরু করে একবিংশ শতকের আধুনিকতার স্পর্শে ঐতিহ্যবাহী এই চর্চার ভবিষ্যত সম্পর্কে ধারণা পাবেন। চলুন তবে আর দেরী না করে রোমাঞ্চকর এই বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আসি।

সংশ্লিষ্ট গবেষকদের ধারণা অনুযায়ী, প্রাণী শিকারে ঈগল পাখির ব্যবহার প্রথম শুরু হয়েছিল ইউরেশিয়ান স্টেপ নামে পরিচিত তৃণভূমি এলাকায়। পশ্চিম দিকে ইউরোপের বুলগেরিয়া থেকে শুরু করে পুবে চীনের মাঞ্চুরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল এই তৃণভূমি এলাকায় একাধিক বিখ্যাত সভ্যতার জন্ম হয়েছে। এর মধ্যে ইন্দো ইউরোপিয়ান বা আর্য সভ্যতা অন্যতম। আনুমানিক প্রায় দশ হাজার বছর আগে এই সভ্যতাভূক্ত গোত্রগুলো ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া শুরু করেছিল। এই অভিবাসীদের পূর্বমূখী দলটির বংশধরেরা এক পর্যায়ে আলটাই পর্বতমালাসংলগ্ন এলাকায় উপস্থিত হয়েছিলেন। এই অঞ্চলের পরিবেশ ভীষণ রুক্ষ হওয়ায় এখানে চাষাবাদ সম্ভব ছিল না। আর মরূ আবহাওয়ার কারণে এখানে গাছপালা না থাকায় ফলমূল আহরণেরও উপায় ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই খাদ্যের চাহিদা মেটাতে তারা প্রাণী শিকারের পথ বেছে নিয়েছিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে এই শিকারে তারা বিভিন্ন প্রজাতির বাজপাখি ব্যবহার করতেন। কিন্তু আকারে ছোট হওয়ায় এই পাখিগুলোর পক্ষে বড় কোন প্রাণী শিকার করা সম্ভব হতো না। তাই এই বেদুইন শিকারীরা ধীরে ধীরে ঈগল পাখির দিকে ঝুকে পড়েন।

শিকারী পাখি হওয়ায় যে কোন প্রজাতির ঈগলই প্রাণী শিকারে ব্যবহার করা যায়। তবে পেশাদার ঈগল শিকারীরা এই কাজে শুধু গোল্ডেন ঈগল প্রজাতির পাখির ব্যবহার করে থাকেন। এই প্রজাতির ঈগল পাখিগুলোর পালকের রঙ গাঢ় বাদামী হয়। তবে ঘাড়ের কাছে পালকের রঙ কিছুটা হালকা হয়ে তাতে সোনালী আভা যুক্ত হয়েছে। যে কারণে এদের নাম দেয়া হয়েছে গোল্ডেন ঈগল। অন্য সব প্রজাতির ঈগলের মত পুরুষ গোল্ডেন ঈগলের আকারও স্ত্রী পাখিদের তুলনায় ছোট হয়ে থাকে। তাই প্রাণী শিকারে সাধারণত আকারে বড় স্ত্রী পাখিদেরই ব্যবহার করা হয়। প্রাপ্তবয়ষ্ক অবস্থায় এই প্রজাতির একেকটি স্ত্রী ঈগল পাখির ওজন সাড়ে ছয় থেকে আট কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এদের চঞ্চুর অগ্রভাগ থেকে লেজের শেষ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য হয় সাড়ে তিন ফুটের মত। আর ছড়ানো অবস্থায় দুই ডানার ব্যাপ্তি দাড়ায় প্রায় আট ফুটের মত। এদের দুই পায়ে চারটি করে ধারালো নখ রয়েছে, যার একেকটি আড়াই ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় গোল্ডেন ঈগলটির ওজন ছিল বারো কেজির বেশী। আর ছড়ানো অবস্থার দুই ডানার বিস্তৃতি ছিল প্রায় সাড়ে নয় ফুট। এই প্রজাতির ঈগলগুলো ৩৫ থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।

ইতিহাসের পাতায় প্রাণী শিকারে ঈগল পাখির ব্যবহারের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় দশম শতকে। খৃষ্টাব্দ ৯৩৫ সালে মাঞ্চুরিয়ার অধিবাসী কিছু গোত্রের শিকারীরা এই পন্থায় শিকার করতেন। সম্মিলিতভাবে খিটান নামে পরিচিত এই গোত্রের সদস্যরা ছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। এদের চীনের সীমানায় হামলা চালানো থেকে নিবৃত্ত করতে চীনা সম্রাটরা নিয়মিত খিটানদের বিপুল অংকের অর্থ উপঢৌকন হিসেবে পাঠাতে বাধ্য হতেন। ইতিহাসবিদদের বর্ণনা অনুযায়ী এই খিটান শিকারীরা আলটাই পর্বতমালার বিভিন্ন শৃঙ্গে গোল্ডেন ঈগল পাখির বাসার সন্ধানে অভিযান চালাতেন। বাচ্চাসহ কোন বাসা পেলে তারা সেখান থেকে বাচ্চাটিকে চুরি করে নিয়ে আসতেন। এরপর ধীরে ধীরে পাখিটিকে মানবশিকারীর আদেশ মানার প্রশিক্ষন দেয়া হতো। পাখিটির বয়স এক বছর হলে তাকে বাইরে নিয়ে শিকারের প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হতো। এই সময় মানবশিকারীর সাথে পাখিটির বন্ধন আরো মজবুত করার লক্ষ্যেও দুজনকেই বিভিন্ন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যেতে হতো। এভাবে টানা পাঁচ বছর নিবিড় প্রশিক্ষন শেষে পাখি এবং তার চালক উভয়েই প্রাণী শিকারের আনুষ্ঠানিক অনুমতি লাভ করতেন। শিকারী ঈগল পাখিটিকে বছর পাঁচেক পর মুক্তি দেয়া হতো। ফলে পাখিটি প্রজনন এবং বংশবিস্তারে সক্ষম হতো।

মূল শিকারের সময় ঈগল শিকারীরা দল বেধে শেয়াল এবং খরগোশের মত প্রাণীর খোঁজে পাহাড়ি এলাকাগুলো চষে বেড়াতেন। এসময় প্রত্যেকের সাথে একটি করে ঈগল পাখি থাকতো। ভারী এই পাখিগুলো সহজে পরিবহনের জন্য ঘোড়ার পিঠে বাধা চামড়ার আসনের সাথে কাঠের তৈরী একটি দণ্ড লাগানো থাকতো। যার ওপর রাখা আরোহীর হাতে ঈগল পাখিটি অনায়াসে বসে থাকতে পারতো। এই অভিযানে পাহাড়ের ওপর থেকে নীচের উপত্যকায় কোন প্রাণীর দেখা পাওয়া গেলে ঈগলগুলোর মাথায় পরিয়ে রাখা ঢাকনা সরিয়ে তাদের সেই প্রাণীটিকে ধাওয়া করতে পাঠানো হতো। সফল শিকারের পর ঈগলগুলোকে পুরষ্কার হিসেবে নিহত প্রাণীটির মাংস কেটে খাওয়ানো হতো। আর যে শিকারীর ঈগল পাখিটি প্রাণীটিকে হত্যা করেছে তিনি ঐ প্রাণীটির চামড়ার দখল লাভ করতেন। শিকার করা প্রাণীগুলোর লোমশ চামড়াটাকে সাধারণত শীতবস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

প্রাণী শিকারে ঈগল পাখি ব্যবহারের প্রচলন শুরু হওয়ার সমসাময়িক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বুঝতে পারবেন, মধ্য এশিয়া এবং মঙ্গোলিয়ার পরিবেশ ও ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যগুলো এর প্রসারের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বিশেষ করে মঙ্গোলিয়ার ভৌগলিক বিবরণ শুনলে বিষয়টা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বর্তমানে মঙ্গোলিয়া রাষ্ট্রটির আয়তন প্রায় ১৬ লাখ বর্গ কিলোমিটার। আয়তনের হিসেবে বিশ্বের ১৮তম বৃহত এই দেশের জনসংখ্যা মাত্র তেত্রিশ লাখ। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বর্গ কিলোমিটারে সবচেয়ে কম সংখ্যক মানুষ এই মঙ্গোলিয়াতে বসবাস করেন। এই দেশটি এমন জনবিরল হবার অন্যতম কারণ এর দক্ষিণ ভাগের প্রায় পুরোটাই রুক্ষ গোবি মরুভূমির দখলে রয়েছে। আর উত্তর পশ্চিমের পুরোটা জুড়ে আলটাই পর্বতমালা অবস্থিত। আগেই জানিয়েছি, এই অঞ্চলের আবহাওয়া এবং পরিবেশ চাষাবাদের জন্য একেবারেই উপযুক্ত না। তাছাড়া পাথুরে স্থলভাগের কারণে ঘোড়া ছুটিয়ে বা অন্যান্য প্রচলিত পন্থায় এই অঞ্চলে শিকার করাও অসম্ভব। এ ধরণের ভূপৃষ্ঠে দ্রুতগতি সম্পন্ন খরগোশ বা শেয়ালের মত প্রাণী শিকার করতে চাইলে আকাশ পথে হামলা চালানোই সবচেয়ে মোক্ষম উপায়। মূলত এই সব নিয়ামকের সম্মিলিত প্রভাবেই বিশ্বের এই অঞ্চলে শিকারের এমন অভিনব পন্থা প্রচলিত হয়েছিল। বর্তমানে বিশ্বে মধ্যপ্রাচ্যের মরু দেশগুলোতেও বাজপাখি ব্যবহার করে প্রাণী শিকার বেশ জনপ্রিয়। এই দুই অঞ্চলের মধ্যে বিদ্যমান ভৌগলিক সাদৃশ্যগুলোই সম্ভবত উভয় এলাকায় এই বিষয়টির প্রসারে ভূমিকা রেখেছে।

মঙ্গোলিয়ার ঐতিহ্যবাহী এই সংস্কৃতি বিশ্বের অধিকাংশ ঐতিহ্যবাহী সংষ্কৃতির মতই একবিংশ শতকের আধুনিকতার প্রসারের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে। ঈগল পাখি ব্যবহারকারী অধিকাংশ পেশাদার শিকারীর বয়স এখন ষাটের ঘরে। এদের পরবর্তী প্রজন্মের প্রায় সবাই অপেক্ষাকৃত সচ্ছল জীবনের খোঁজে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকা জন্মভূূমি ছেড়ে রাজধানী অথবা বিদেশের মাটিতে থিতু হয়েছেন। আর অধিকাংশ নারীই এখনো যথারীতি কৈশোর না পেরুতেই সংসার, সন্তান উতপাদন এবং তাদের লালন পালনে মনোনিবেশ করতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজাল ভেঙে কেউ কেউ ঈগল শিকারী হিসেবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। যদিও অধিকাংশ পেশাদার শিকারী বিষয়টি সমর্থন করেন না।

এমন বিপ্লবী এক কিশোরীর পেশাদার ঈগল শিকারী হয়ে ওঠার ঘটনাটি দি ঈগল হান্ট্রেস নামক একটি তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। আইশোলপান নুরগায়েভ নামের এই মঙ্গোলীয় কিশোরী মাত্র ১৩ বছর বয়সে তার পিতার কাছে ঈগল শিকারী হবার সখের কথা জানিয়েছিলেন। পিতা আগালাই নুরগায়েভ নিজে ছিলেন একজন পেশাদার ঈগল শিকারী। ঈগল পাখি ব্যবহার করে প্রাণী শিকার কেবল পুরুষদের পক্ষেই সম্ভব, সমাজের এই প্রচলিত কুসংস্কার ভেঙে নিজ কন্যাকে ঈগল শিকারী হবার প্রশিক্ষন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তথ্যচিত্রটিতে বাবা ও মেয়ে দুজনে মিলে কিভাবে আলটাই পর্বতমালার একটি চূড়ায় অবস্থিত গোল্ডেন ঈগলের বাসা থেকে একটি বাচ্চা পাখি সংগ্রহ করেন তা দেখানো হয়েছে। এরপর মেয়ে আইশোলপানকে নিবিড় প্রশিক্ষন দেয়া শুরু করেন আগালাই। প্রথম দিকে পাঁচ কেজি ওজনের ঈগল পাখিটিকে হাতের ওপর বসাতেই হিমশিম খেতেন এই কিশোরী। কিন্তু কঠোর প্রশিক্ষনের ফলে মাত্র তিন বছরের মাথায় স্থানীয় একটি স্কুল কর্তৃপক্ষের আয়োজিত ঈগল পাখি ব্যবহার করে শিকার প্রতিযোগিতার শিরোপা জিতে নেন আইশোলপান। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ঐ প্রতিযোগিতায় বাকি সব প্রতিযোগীই ছিলেন পুরুষ। কিশোরী আইশোলপানের এই সাফল্যে মঙ্গোলিয়ার তরুন প্রজন্মের অনেকেই ঈগল পাখি ব্যবহার করে প্রাণী শিকারের প্রশিক্ষণ নেয়ায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন। সংশ্লিষ্টদের আশা এর ফলে ঐতিহ্যবাহী এই প্রথাটি তার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে সাফল্য অর্জন করবে।

29/05/2025

আয়তনের বিচারে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম দেশগুলোর একটি মালদ্বীপ। ভৌগলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থিত এই রাষ্ট্রটি ১২০০র বেশী পৃথক দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। এই দ্বীপগুলোর সম্মিলিত আয়তন মাত্র ২৯৮ বর্গ কিলোমিটার বা ১১৫ বর্গ মাইল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বিলুপ্তির আশংকায় থাকা এই মালদ্বীপ সম্পর্কে আপনাদের বিস্তারিত জানাতে এই ভিডিওটি তৈরী করা হয়েছে। চলুন তবে আর দেরী না করে এই দেশটি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আসি।

ভারত মহাসাগরের আরব সাগর নামক অংশে অবস্থিত ১২০০’র বেশী দ্বীপ সম্মিলিতভাবে মালদ্বীপ নামে পরিচিত। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী প্রায় ৬ কোটি বছর আগে এই দ্বীপগুলোর সৃষ্টি হয়েছিল। ভারত মহাসাগরের ঐ অংশে ডুবে থাকা একাধিক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুতপাতের ফলে এই স্থলভাগের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। ঐ সময় নির্গত লাভার ওপর পরবর্তীতে প্রবাল নামক এক ধরণের জীব বংশবিস্তার শুরু করে। এ্ প্রজন্মের মৃত প্রবালের ওপর পরবর্তী প্রজন্মের প্রবাল জন্ম নেয়। এভাবে প্রবালের স্তুপ উঁচু হয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠে নতুন দ্বীপের জন্ম দেয়। মালদ্বীপ নামে পরিচিত দ্বীপগুলোও এভাবেই তৈরী হয়েছিল।

২০১৯ সালের আদমশূমারী অনুযায়ী মালদ্বীপের বর্তমান জনসংখ্যা পাঁচ লাখের বেশী। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো মালদ্বীপের অন্তর্ভূক্ত ১২০০’র বেশী দ্বীপের মধ্যে মাত্র দুশটিতে জনবসতি রয়েছে। আর মাত্র বিশটি দ্বীপে এক হাজারের বেশী মানুষ বসবাস করেন। ধারণা করা হয় এই দ্বীপগুলোয় প্রথম মানুষের আবির্ভাব ঘটে অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে। খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মগধ রাজ্যের সিংহাসনচ্যুত শাসক বিজয়া উত্তর-পূর্ব ভারতের সিংহপুর থেকে তার অনুসারীদের নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সম্মিলিতভাবে সিংহলী নামে পরিচিত এই মানুষগুলো বিজয়ার নেতৃত্বে শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপ এলাকায় নতুন করে বসতি স্থাপন করেছিলেন। আবার কয়েক জন খ্যাতনামা নৃতাত্বিকের দাবী অনুযায়ী বিজয়া ও তার অনুসারীরা ভারতের পশ্চিম উপকূল থেকে মালদ্বীপে এসেছিলেন।

কালের পরিক্রমায় সিংহলীদের হাতে গড়ে ওঠা এই জনপদগুলোর সাথে আফ্রিকা এবং আরব উপদ্বীপের বেশ কয়েকটি গোত্রের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যার ধারাবাহিকতায় এই দুই অঞ্চলের কিছু মানুষও এখানে থিতু হয়েছিলেন। এই সময় প্রায় সব স্থাপনাই বাঁশ বা কাঠের মত পচনশীল উপকরণ দিয়ে তৈরী করা হতো। তাই এই সময়ে নির্মিত কোন স্থাপনাই নৃতাত্বিকদের পক্ষে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে তাদের ধারণা অনুযায়ী মালদ্বীপের আদিবাসীরা সনাতন ধর্মের অনুসারী হিসেবে সূর্যের উপাসনা করতেন। এখনো সিংহলী কিছু ধর্ম বিশ্বাসে সূর্যের উপাসনা করা হয়ে থাকে।

খৃষ্টপুর্ব তৃতীয় শতক নাগাদ মালদ্বীপের বাসিন্দাদের কাছে বৌদ্ধ ধর্মের বানী পৌছে যায়। ভারতে মৌর্য বংশের বিখ্যাত সম্রাট অশোকার শাসনামলে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মালদ্বীপে বেশ কয়েকটি উপাসনালয় তৈরী করেছিলেন। এই উপাসনালয়গুলো পাথর দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। মালদ্বীপের অনর্ভূক্ত কমপক্ষে ৫৯টি দ্বীপে এমন স্থাপনা খুজে পাওয়া গেছে। খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে আবির্ভাবের পর খৃষ্টাব্দ দ্বাদশ শতক পর্যন্ত টানা ১৪০০ বছর এই দ্বীপগুলোয় বৌদ্ধ ধর্মের আধিপত্য বজায় থাকে। এরপর ১১৫৩ থেকে ১১৯৩ সালের মধ্যে কোন এক সময় এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। দ্বাদশ শতকে আরব বনিকদের সাথে বাণিজ্য সম্পর্কের গুরুত্ব এতটাই বেড়ে যায় যে, মালদ্বীপের রাজা ধোভেমি বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ধারণা করা হয় আবু আল বারাকাত ইউসুফ আল বারবারি নামের এক মুসলিম ব্যবসায়ী বৌদ্ধ রাজাকে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। চতুর্দশ শতকে বিখ্যাত বিশ্ব পরিব্রাজক ইবনে বতুতার ভাষ্য অনুযায়ী উত্তর আফ্রিকার মরক্কোর কোন এলাকায় আবু আল বারাকাতের জন্ম হয়েছিল। তবে আধুনিক গবেষণা অনুযায়ী আবু আল বারাকাত পূর্ব আফ্রিকার সোমালিয়া অঞ্চল থেকে এসেছিলেন।

বর্তমানে মালদ্বীপই বিশ্বের একমাত্র দেশ যার শতভাগ নাগরিকই ইসলাম ধর্মের অনুসারী। কারণ বিংশ শতকে প্রণীত আইন অনুযায়ী শুধু মুসলমিরাই এই দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন এলাকার মধ্যে এই মালদ্বীপেই সবার শেষে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছিল। খৃষ্টাব্দ সপ্তম শতকেই আরব বনিকরা ভারতের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত মালাবার দ্বীপপুঞ্জে ইসলামের বানী পৌছে দিয়েছিল। প্রায় একই সময় আরব সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমও ভারতের সিন্ধু নদ অববাহিকায় অবস্থিত বিস্তীর্ণ এলাকা বিজয়ের মাধ্যমে স্থানীয়দের মধ্যে ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। সেই হিসেবে ভারতের উপকূল থেকে মাত্র এক হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মালদ্বীপে ইসলাম পৌছাতে প্রায় পাঁচশো বছর বেশী সময় লেগে যায়।

আরব এবং আফ্রিকান বনিকদের কাছে মালদ্বীপ তার সৈকতে পাওয়া বিপুলসংখ্যক কড়ির জন্য ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। ক্ষুদ্রাকৃতির এক ধরনের সামুদ্রিক শামুকের পরিত্যক্ত এই খোলসগুলোকে প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন জনপদে মূদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কালের পরিক্রমায় অনেক কিছুতেই পরিবর্তন এলেও কড়ি নির্ভর বিনিময় প্রথা মধ্যযুগ পেরিয়েও চালু ছিল। এমনকি অনেক মুঘল শাসকও বাজারে স্বর্ণ এবং রৌপ্যমুদ্রার পাশাপাশি বিনিময় মাধ্যম হিসেবে কড়ির ব্যবহার অব্যাহত রাখেন।

ভৌগলিক অবস্থানের কারনে মালদ্বীপের ওপর নিয়ন্ত্রণ সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাণিজ্যিকভাবে মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। ফলে ঔপনিবেশিক আমলে এই অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ওলন্দাজ এবং পর্তুগিজ নৌবাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় পর্তুগিজরা ১৫৫৮ সালে মালদ্বীপের উপকূলে একটি সেনাঘাটি স্থাপন করে। সেখান থেকে স্থানীয়দের কাছে খৃষ্টধর্মের প্রচার শুরু করে তারা। এতে বিরক্ত হয়ে মাত্র ১৫ বছর পরেই ১৫৭৩ সালে স্থানীয় অধিবাসীরা ঐ ঘাটির সেনাদের তাড়িয়ে দেয়। এর আরো প্রায় একশো বছর পর সপ্তদশ শতকের মাঝমাঝি নাগাদ ওলন্দাজরা সেখানে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। তবে পর্তুগিজ ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা স্থানীয়দের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা থেকে বিরত ছিল। বর্তমানে শ্রীলংকা নামে পরিচিত ততকালীন সিলোনে অবস্থিত মূল ঘাটি থেকে ওলন্দাজরা মালদ্বীপের ওপর এই পরোক্ষ প্রভাব বজায় রেখেছিল। অষ্টাদশ শতকে বিশ্বজুড়ে স্প্যানিশ, পর্তুগিজ এবং ওলন্দাজদের ছাপিয়ে বৃটিশ সাম্রাজ্য সবচেয়ে বড় পরাশক্তিতে পরিনত হয়। সিলোন দ্বীপেও এই ধারা অব্যাহত ছিল। ১৭৯৬ সালে ওলন্দাজদের পরাজিত করে দ্বীপটির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে বৃটিশ রাজ। যার ধারাবাহিকতায় মালদ্বীপও তাদের প্রভাব বলয়ে প্রবেশ করে। সেই থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত মালদ্বীপে বৃটিশ আধিপত্য বজায় ছিল। ১৯৬৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌমত্ব লাভের পর রাজতন্ত্র বাতিল করে মালদ্বীপকে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষনা করা হয়।

মালদ্বীপের অর্থনীতি প্রাচীন আমল থেকেই সমুদ্রনির্ভর ছিল। বিষুবীয় এলাকায় অবস্থানের কারণে বিপুলসংখ্যক প্রজাতির অসংখ্য মাছ এই দ্বীপগুলোর উপকূলীয় এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। যার মধ্যে নীল কালো ডোরাকাটা অনিন্দ্যসুন্দর ওরিয়েন্টাল সুইটলিপস থেকে শুরু করে বিশ্বের বৃহত্তম মাছ হোয়েল শার্ক সবই রয়েছে। জীববিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, মালদ্বীপের উপকূলসংলগ্ন সমুদ্রে কমপক্ষে ১১০০ প্রজাতির মাছ, ৪০০ প্রজাতির শামুক ও ঝিনুক, ২১ প্রজাতির তিমি ও ডলফিন এবং পাঁচ প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ বাস করে। ধবধবে সাদা প্রবালগুড়ো দিয়ে তৈরী সমুদ্রসৈকতের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকার এই বাহারী জীববৈচিত্র্য সম্প্রতি মালদ্বীপকে একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিনত করেছে। একবিংশ শহতকে এসে দেশটির অর্থনীতিতে পর্যটন খাতের অবদান মত্স সম্পদ খাতকে ছাড়িয়ে গেছে। এর সাথে তাল মিলিয়ে দেশটির পর্যটনভিত্তিক অবকাঠামো খাতেও বিপুল উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে মালদ্বীপে থাকা খাওয়ার বন্দোবস্তসহ মাত্র দুটি পর্যটন কেন্দ্রের অস্তিত্ব ছিল। ২০০৭ সাল নাগাদ এই সংখ্যাটা বেড়ে ১০০র কাছকাছি পৌছে যায়।

মালদ্বীপের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালে দেশটিতে অন্তত ১৭ লাখ বিদেশী পর্যটক এসেছেন। এখানে উপকূলসংলগ্ন সমুদ্রে স্কুবা ডাইভিং পর্যটকদের জন্য মূল আকর্ষণ হিসেবে কাজ করে। এখানে স্কুবা ডাইভিং এর সময় মনে হবে আপনি যেন বিশাল কোন অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রবালের বনে ঘুড়ে বেড়ানো বর্নিল রঙ এবং বাহারী ডিজাইনের ছোট বড় অসংখ্য মাছের সাথে সাতার কাটার অনাবিল আনন্দ উপভোগ করার জন্য মালদ্বীপ উপযুক্ত স্থান। মালদ্বীপ ভ্রমনের জন্য আগে থেকে কোন ভিসা সংগ্রহের প্রয়োজন পড়ে না। বৈধ পাসপোর্ট এবং অবস্থানকালীন খরচ মেটানোর মত যথেষ্ট পয়সা সঙ্গে থাকলেই হবে। সরাসরি মালদ্বীপের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরনের পর কর্তৃপক্ষের হাতে পাসপোর্ট দিলেই তাতে ভিসা পাওয়া যাবে।

বর্ণনা শুনে বুঝতেই পারছেন প্রকৃতি এই মালদ্বীপকে আক্ষরিক অর্থেই দু হাত ভরে দান করেছে। কিন্তু প্রকৃতিই আবার তার দেয়া এই উপহার মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে রুষ্ট হয়ে যেন ছিনিয়ে নেবার পায়তারা করছে। এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বজুড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে চলেছে। পুরো মালদ্বীপের গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাঁচ ফুটেরও কম হওয়ায় এর ফলে পুরো মালদ্বীপ নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। এই হুমকির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণে একাধিকবার জলের তলায় বৈঠক করেছেন দেশটির সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্যরা।

জলবায়য়ু পরিবর্তন শুধু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাই বাড়াচ্ছে না, সমুদ্রের পানির তাপমাত্রাও এর ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে ঐ পানিতে বেশী পরিমান কার্ব ডাই অক্সাইড দ্রবীভূত হচ্ছে। ফলে পানির অম্লত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। যে কোন প্রবাল দ্বীপের জন্য সমুদ্রের পানির অম্লত্ব বৃদ্ধি অশনিসংকেত হিসেবে দেখা দেয়। ১৯৯৮ সালে মালদ্বীপের উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্রে পানির তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। যার প্রভাবে দেশটির নীচে অবস্থিত প্রবালের শতকরা প্রায় ৭০ ভাগই জীবশূণ্য হয়ে পড়ে। সেই পরিস্থিতি সামলে উঠলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মালদ্বীপের ভবিষ্যত এখনো অনিশ্চিতই রয়ে গেছে।

29/05/2025
28/05/2025

বিশ্বে স্থলভাগ দিয়ে ঘেরা বৃহত্তম জলাশয়টির নাম ক্যাস্পিয়ান। কিন্তু এটি সাগর না হ্রদ তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এটিকে সাগর দাবী করার কারণ এর পানি লবনাক্ত। যদিও সাগরের পানির স্বাভাবিক লবনাক্ততার তুলনায় তা তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র। আবার এটিকে হ্রদ দাবী করার কারণ এর সাথে কোন সাগর বা মহাসাগরের সংযোগ নেই। এই ভিডিওতে আপনাদের ক্যাস্পিয়ান সাগর বা হ্রদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবো। চলুন তবে আর দেরী না করে বিখ্যাত এই জলাশয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আসি।

ক্যাস্পিয়ান নামক জলাশয়টির অবস্থান ইউরোপ এবং এশিয়া মহাদেশের ঠিক মধ্যিখানে। এর পশ্চিম দিকে রয়েছে ককেশাস পর্বতমালা। আর পূবে মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ তৃণভূমি। এই জলাশয়টির মোট আয়তন তিন লাখ একাত্তর হাজার বর্গ কিলোমিটার বা এক লাখ তেতাল্লিশ হাজার বর্গ মাইলের বেশী। রাজনৈতিক সীমানার বিচারে জলাশয়টি বর্তমানে মোট পাঁচটি সার্বভৌম দেশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই দেশগুলো হচ্ছে কাজাখস্তান, রাশিয়া, আজারবাইজান, ইরান এবং তুর্কমেনিস্তান। অবশ্য গত শতকের শেষ দশক পর্যন্তও ক্যাস্পিয়ান জলাশয়টি রাজনৈতিকভাবে কেবল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইরান এই দুই দেশের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

ব্ল্যাক সি বা কৃষ্ণ সাগরের মত এই ক্যাস্পিয়ান সাগরেরও সৃষ্টি হয়েছিল জুরাসিক আমলে ইউরেশিয়ার বিশাল এলাকা জুড়ে বিদ্যমান প্যারাটেথিস মহাসাগর শুকিয়ে যাওয়ার ফলে। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী আনুমানিক ৫৫ লাখ বছর আগে এই জলাশয়টি পুরোপুরি আলাদা হয়ে যায়। এরপর সূর্যের তাপে পানি বাষ্পীভূত হবার ফলে জলাশয়টির লবনাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়া শুরু হয়। তবে কয়েক লাখ বছর পর উত্তর প্রান্ত থেকে একাধিক নদ-নদীর পানি জলাশয়ে আসা শুরু করায় ধীরে ধীরে লবনাক্ততা আবার কমতে থাকে। বর্তমানে ক্যাস্পিয়ান সাগরের লবনাক্ততা শতকরা এক দশমিক দুই ভাগ। যার অর্থ এই জলাশয়ের এক লিটার পানি শুকিয়ে ফেললে ১২ গ্রামের মত লবন পাওয়া যাবে। সাধারণত সাগর এবং মহাসাগরের পানির লবনাক্ততা শতকরা সাড়ে তিন ভাগের বেশী হয়।

সব মিলিয়ে মোট একশো ত্রিশটি জলধারা ক্যাস্পিয়ান সাগরে পানি সরবরাহ করে। তবে এর মধ্যে চারটি নদী এই জলাশয়ের সিংহভাগ পানি সরবরাহ করছে। এগুলো হচ্ছে ভলগা, উরাল, কুরা এবং তেরেক। এর মধ্যে ভলগা নদী এই জলাশয়ের মূল পানি সরবরাহকারী। এর বিপরীতে ক্যাস্পিয়ান সাগর এন্ডোরেয়িক ঘরানার জলাশয়। যার অর্থ সূর্যের তাপে বাষ্পীভূত হওয়া ছাড়া এই জলাশয় থেকে পানি বের হবার কোন পথ নেই।

উত্তর দক্ষিণে এই জলাশয়টির সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য এক হাজার ত্রিশ কিলোমিটার বা প্রায় সাড়ে ছয়শো মাইল। আর পূব-পশ্চিমে জলাশয়টি সর্বোচ্চ চারশো পয়ত্রিশ কিলোমিটার বা দুশো সত্তুর মাইল চওড়া। ক্যাস্পিয়ান সাগরের গড় গভীরতা দুশো এগারো মিটার বা প্রায় সাতশো ফুট। তবে এর সর্বোচ্চ গভীরতা এক হাজার পঁচিশ মিটার বা তিন হাজার তিনশো ষাট ফুট। সব মিলিয়ে এই জলাশয়ে বিদ্যমান পানির পরিমান আটাত্তুর হাজার ঘণ কিলোমিটারের বেশী, বা প্রায় উনিশ হাজার ঘণ মাইল।

ভৌগলিকভাবে এই জলাশয়টি তিনভাগে বিভক্ত। নর্দার্ন ক্যাস্পিয়ান নামক এর উত্তরাঞ্চলের গড় গভীরতা মোটে ৫ থেকে ৬ মিটার বা ১৬ থেকে বিশ ফুটের মত। মধ্য ক্যাস্পিয়ান এলাকায় এই গভীরতা বৃদ্ধি পেয়ে গড়ে ১৯০ মিটার বা ছয়শো বিশ ফুটে দাঁড়ায়। আর সবচেয়ে গভীর দক্ষিণ ক্যাস্পিয়ানে জলাশয়টির তলদেশের গড় গভীরতা এক হাজার মিটার বা তিন হাজার তিনশো ফুটের বেশী। গড় গভীরতায় এমন বিশাল তারতম্যের ফলে ক্যাস্পিয়ান সাগরে থাকা মোট জলের শতকরা মাত্র এক ভাগ উত্তর ক্যাস্পিয়ানে অবস্থিত। মধ্য ক্যাস্পিয়ানে রয়েছে শতকরা তেত্রিশ ভাগ আর দক্ষিণ ক্যাস্পিয়ানে শতকরা ছেষট্টি ভাগ জল।

অন্য যে কোন সাগরের মত এই ক্যাস্পিয়ানের বুকেও একাধিক দ্বীপ বিদ্যমান। তবে এই জলাশয়ের সবগুলো দ্বীপই উপকূলের কাছাকাছি অবস্থিত। অপেক্ষাকৃত গভীর এলাকায় কোন দ্বীপ নেই বললেই চলে। এই দ্বীপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টির নাম ওগুরিয়া অ্যাডা। এর আয়তন সাইত্রিশ বর্গ কিলোমিটার। এই দ্বীপে মানব বসতি থাকলেও ক্যাস্পিয়ান সাগরের অধিকাংশ দ্বীপই জনশূণ্য। একাধিক পরিযায়ী প্রজাতির পাখি এমন কয়েকটি দ্বীপকে নিজেদের সাময়িক বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করে। এই সাগরের উপকূলে গুরূত্বপূর্ণ একাধিক জনপদ অবস্থিত। এর মধ্যে আজারবাইজানের রাজধানী বাকু, ইরানের আস্তারাবাদ এবং রাশিয়ার দাগেস্তান নামক শহরগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মানুষ এবং পরিযায়ী পাখির বাইরে এই ক্যাস্পিয়ান এলাকায় বসতি স্থাপনকারী আরেকটি প্রাণী হচ্ছে সীল। ক্যাস্পিয়ান সীল নামক এই প্রাণীগুলো শুধু এই জলাশয়ের তীরেই পাওয়া যায়। একশো বছর আগেও এই এলাকায় প্রায় দশ লাখের মত সীল বসবাস করতো। মানুষের নির্বিচার শিকারের ফলে এই সংখ্যাটা এখন এক লাখেরও নীচে নেমে এসেছে। এছাড়া ব্যাঙের পোনার মত দেখতে ট্যাডপোল গোবিজ নামক এক ধরণের মাছও শুধু এই ক্যাস্পিয়ান সাগরেই পাওয়া যায়। প্রত্মতাত্তিকদের গবেষণা অনুযায়ী এই জলাশয়ে এক সময় কয়েক প্রজাতির তিমি এবং ডলফিন গোত্রের জলচর স্তণ্যপায়ী প্রাণী বসবাস করতো। কিন্তু কালের পরিক্রমায় এই প্রাণীগুলো পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। জলচর বিভিন্ন প্রাণীর পাশাপাশি এই ক্যাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী এলাকা বিলুপ্তপ্রায় একাধিক স্থলচর প্রাণীর জন্যও সুপরিচিত। এই প্রাণীগুলোর মধ্যে ক্যাস্পিয়ান বাঘ, এশিয়াটিক সিংহ, এশিয়াটিক চিতা এবং পারশিয়ান চিতাবাঘ অন্যতম।

ক্যাস্পিয়ান সাগর এখান থেকে আহরিত ক্যাভিয়ারের জন্য বিশ্বখ্যাত। এই ক্যাভিয়ার মূলত স্টার্জন নামক বিশেষ এক গোত্রভূক্ত মাছের ডিম। তবে বিশ্বের কিছু দেশে স্যামন মাছের ডিমও ক্যাভিয়ার হিসেবে খাওয়া হয়। স্টার্জন ক্যাভিয়ার কালো রঙের হলেও স্যামন ক্যাভিয়ারের রঙ কমলা রঙের হয়ে থাকে। সাধারণত রুটি বা বিস্কুটের ওপর এটি জেলির মত মাখিয়ে খাওয়া হয়। বিশ্বের সবচেয়ে দামী ক্যাভিয়ার বেলুগা স্টার্জন নামের এক প্রজাতির মাছের পেট থেকে সংগ্রহ করা হয়। এই বেলুগা স্টার্জন প্রজাতির মাছ কেবল ক্যাস্পিয়ান সাগরেই পাওয়া যায়। এক কেজি বেলুগা স্টার্জন ক্যাভিয়ার কিনতে আপনার খরচ হবে প্রায় বিশ লাখ টাকা।

ক্যাভিয়ারের পাশাপাশি এই ক্যাস্পিয়ান সাগর ও তার উপকূলবর্তী এলাকা জ্বালানী তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মত বিভিন্ন খণিজ সম্পদে বেশ সমৃদ্ধ। এই ক্যাস্পিয়ান সাগরের শুধু ইরানের নিয়ন্ত্রণে থাকা অংশেই বিদ্যমান অপরিশোধিত জ্বালানী তেলের পরিমান প্রায় দেড়শো বিলিয়ন ব্যারেল। যা থেকে দেশটি দৈনিক গড়ে চার মিলিয়ন ব্যারেলের মত অপরিশোধিত জ্বালানী তেল আহরন করছে। এছাড়াও সাগরের এই অংশে রয়েছে প্রায় এক হাজার ট্রিলিয়ন ঘণফুট প্রাকৃতিক গ্যাস। যা পুরো পৃথিবীর মোট মজুদের শতকরা ১৬ ভাগ। এছাড়া রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন অংশেও বিপুল পরিমান জ্বালানী তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ রয়েছে। জেনে অবাক হবেন বিশ্বের প্রথম অফ শোর প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয় এই ক্যাস্পিয়ান সাগরের বুকেই। ১৮৭৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাকু শহরের উপকূলে এই প্ল্যান্টটি স্থাপন করেছিল। বর্তমানে এটি অবশ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে সৃষ্টি হওয়া আজারবাইজানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

ক্যাস্পিয়ান সাগর ও তার উপকূলবর্তী এলাকায় এমন একাধিক তেল ও গ্যাস উত্তোলন প্রকল্প চালু থাকায় স্থানীয় পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এসব প্রকল্পের আওতাধীন কারখানার বর্জ্য এই সাগরে ফেলায় পানি দূষনে অনেক প্রজাতির মাছ এবং জলচর প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ঝুকির মুখে থাকা এই প্রজাতিগুলো সংরক্ষণে অবশ্য একাধিক সংস্থা চেষ্টা করছে। তবে আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার অভাবে এসব সংরক্ষণ চেষ্টার কর্মকাণ্ডে খুব একটা গতির সঞ্চার সম্ভব হচ্ছে না।

ইতিহাস অনুযায়ী ক্যাস্পিয়ান সাগরের জলপৃষ্ঠের উচ্চতা নিয়মিত ওঠানামা করে থাকে। ১৯২৯ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে এর জলপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় তিন মিটার বা দশ ফুট কমে গিয়েছিল। এরপর ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৫ সালের মধ্যে তা আবার তিন মিটার বা দশ ফুট বৃদ্ধি পায়। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী ক্যাস্পিয়ান সাগরের এই প্রবণতা জলাশয়টির সৃষ্টিলগ্ন থেকেই ছিল। এর জলপৃষ্ঠের উচ্চতা মূলত ভলগা নদীর সরবরাহকৃত পানির সমানুপাতে বৃদ্ধি পায়। তবে বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী এই স্বাভাবিক ওঠানামার বাইরে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে ক্যাস্পিয়ানের জলপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর গড়ে ছয় সেন্টিমিটারের বেশী বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজারবাইজান জাতীয় বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা ২০১৯ সালে এই গবেষণা চালান।

আগেই জানিয়েছি বর্তমানে এই ক্যাস্পিয়ান জলাশয়ের তীরে মোট পাঁচটি দেশ অবস্থিত। কিন্তু গত শতকের পঞ্চাশের দশকে যখন জলাশয়টির সীমানা বন্টন করা হয়েছিল তখন এটি স্রেফ ইরান এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এই দুটো দেশের নিয়ন্ত্রণে ছিল। পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক রুশ সাম্রাজ্য ভেঙে ঐ এলাকায় নতুন তিনটি দেশের সৃষ্টি হয়। ফলে প্রাক্তন সোভিয়েত অংশটুকু রাশিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান এবং তুর্কমেনিস্তানের মধেই খণ্ডিত হয়ে যায়। এই কারণে এই জলাশয়টির বৃহত্তম অংশ ইরানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

ক্যাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী পাঁচটি দেশের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্প্রীতি বজায় থাকলেও সবগুলো দেশের নৌবাহিনীই এই জলাশয়ে নিয়মিত টহল দেয়। তবে এ ক্ষেত্রেও রাশিয়া এবং ইরানের নৌবাহিনীর আকার বাকি দেশগুলোর কয়েক গুন হওয়ায় এখনো এই জলাশয়টির ব্যাপারে ইরান এবং রাশিয়াই মোড়লের মত আচরন অব্যাহত রেখেছে।

ইরান এবং রাশিয়া ক্যাস্পিয়ান এলাকায় নিজেদের মোড়লসদৃশ ভূমিকা পরিহার না করলে, এই এলাকার প্রকৃতি, জনসম্পদ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ দিন দিন আরো কঠিন হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে আশার ব্যাপার হলো, এই লক্ষ্যে এরিমধ্যে দেশ পাঁচটি একটি সংগঠন তৈরী করেছে। এছাড়া প্রতি দুই বছর পরপর ক্যাস্পিয়ান সামিট নামক একটি শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হচ্ছেন পাঁচটি দেশের সরকারপ্রধানরা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ধীরে ধীরে এই অঞ্চলে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর গঠনমূলক সমাধানে পৌছুনো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

Address

Fulbaria

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when আদ্যোপান্ত posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to আদ্যোপান্ত:

Share

Category