17/07/2025
গল্পের নাম: "অভিশপ্ত বৃক্ষের কান্না"
চাঁদের আলোয় মোড়া এক নির্জন বন। সময় ছিল অমাবস্যার আগের রাত। কুয়াশা ঘিরে রেখেছে পুরো বন, আর তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল, ভয়ানক গাছ—যার শিকড় মাটি ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে, আর ডালের মাথায় ঝুলছে সবুজ জ্বলজ্বলে আগুনের মতো আলো। গাছটির কাণ্ডে এমন এক মুখ খোদাই হয়ে আছে, যা যেন দুঃস্বপ্নের মতো: চোখে অন্ধকার শূন্যতা, আর মুখ থেকে যেন চিৎকার বেরিয়ে আসছে।
এই গাছটির নাম "অভিশপ্ত বৃক্ষ", আর বনটির নাম কালভয়।
---
গল্প শুরু
অনেক বছর আগে, এই বন ছিল এক সুন্দর রাজ্যের অংশ। রাজ্যের নাম ছিল আরনভীলা, যার রাজা ছিলেন এক নিষ্ঠুর ও লোভী ব্যক্তি—রাজা দুরন্ত রায়। তিনি একবার জানতে পারেন যে কালভয় বনের কেন্দ্রে এক গোপন শক্তির উৎস রয়েছে—এক চিরজীবী আত্মা, যাকে বলা হতো "অমর সত্তা"।
রাজা দুরন্ত তার সৈন্যদের পাঠান বনের গভীরে। তারা খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছায় এক বিশাল বটগাছের কাছে। গাছটি তখনও জীবন্ত ছিল, ডালে পাখি বাসা বানাতো, নিচে হরিণ ঘাস খেত। কিন্তু গাছের ভেতরে ছিল সেই আত্মা—এক দয়ালু সাধুর আত্মা, যিনি শত বছর আগে এখানে প্রাণ ত্যাগ করেন এবং বনের রক্ষক হয়ে থাকেন।
রাজা দুরন্ত সেই গাছকে কেটে ফেলতে আদেশ দেন, কারণ গাছ কাটলেই নাকি শক্তি বেরিয়ে আসবে। কিন্তু যখন কুড়াল চালানো হয়, গাছ থেকে রক্ত বের হতে শুরু করে! আর ঠিক তখনই, বাতাস ঘূর্ণি আকারে উঠতে থাকে, মেঘ জমে যায়, আর আকাশে বাজ পড়ে।
গাছের আত্মা তখন ভয়ানক অভিশাপ দেয়:
> “যে আমার শরীর কেটে রক্ত ঝরাল, তার বংশে আর কেউ সূর্য দেখবে না। আমার কান্না গাছের গায়ে থাকবে চিরকাল। আমি হব এক ভয়ঙ্কর রূপে, যেখানে রাত হলেই আমার আত্মা জেগে উঠবে, আর প্রতিশোধ নেবে!”
গাছটি মুহূর্তেই রূপান্তরিত হয়—চোখে ভয়, মুখে মৃত্যু, আর চারপাশে কুয়াশা। তখন থেকে, রাত হলেই সেই গাছ থেকে শোনা যায় কান্নার শব্দ, ফিসফিসানি, আর ভয়ার্ত চিৎকার।
---
বর্তমান সময়
সাতশো বছর পরে।
গ্রামের নাম নবছায়া, যেখানে কেউ কখনও কালভয় বনের ধারে যায় না। গ্রামের এক কিশোর—রিদয়—ছিল খুব কৌতূহলী। সে শুনেছিল গাছের গল্প, আর তার মনে একটাই প্রশ্ন—“গাছ কি সত্যিই কথা বলে?”
এক রাতে, সে একাই যায় সেই বনের গভীরে। চাঁদ ছিল পূর্ণ, কুয়াশা জমে ছিল ঘাসে। সে পৌঁছায় সেই গাছের সামনে, আর গাছের চোখ যেন তাকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রিদয় হঠাৎ দেখে, গাছের শিকড় যেন নড়ছে... যেন দম নিচ্ছে!
তখনই এক কণ্ঠ ভেসে আসে—
> “আমার কান্না শুনেছো... কিন্তু কেউ কখনো শুনেনি আমার সত্যি কথা...”
গাছ বলতে শুরু করে তার অভিশপ্ত অতীত, রাজা দুরন্তের নির্মমতা, আর তার প্রতিশোধের যন্ত্রণা। রিদয়ের চোখে পানি চলে আসে। সে বলে, “আমি তোমার কষ্ট শেষ করতে চাই, গাছদাদা।”
গাছ তখন বলে, “তুমি যদি আমার কান্নার শেষ করতে চাও, তবে রাজা দুরন্তের রক্তের শেষ উত্তরাধিকারীকে এনে দাও এখানে।”
রিদয় ভাবে, এটা অসম্ভব। কিন্তু সে ইতিহাস ঘেঁটে ঘেঁটে জানতে পারে, গ্রামের জমিদার পরিবারের বংশই ছিল রাজা দুরন্তের উত্তরসূরি। সে জমিদারের এক নাতিকে, আরিব নামের এক ছেলেকে নিয়ে আসে এক রাত।
গাছ তখন বলে, “এই ছেলের রক্তেই আমার অভিশাপ কাটবে, কিন্তু তার জীবন যাবে... সে কি রাজি?”
আরিব অবাক হয়ে বলে, “আমার দাদুর দাদার পাপের জন্য আমি দায়ী না... কিন্তু এই গাছ যদি সত্যিই কষ্ট পাচ্ছে, আমি রক্ষা করব।”
আরিব সামনে এগিয়ে যায়, গাছের শিকড় তাকে জড়িয়ে ধরে, সবুজ আলোতে ঢেকে ফেলে। কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “অভিশাপ শেষ... আমার আত্মা মুক্ত...”
গাছের চোখ বন্ধ হয়ে যায়, মুখ মুছে যায়, কাণ্ডে শান্ত একটা রেখা দেখা যায়। তারপর কুয়াশা হালকা হয়ে আসে, আকাশ পরিষ্কার হয়, পাখিরা ডাকে।
আরিব কোথায় যেন হারিয়ে যায়... সে যেন গাছের আত্মার সাথে মিলিয়ে যায়।
---
শেষ দৃশ্য
বছরখানেক পরে, কালভয় বন নতুন করে সবুজে ভরে যায়। সেই ভয়ঙ্কর গাছ এখন হয়ে গেছে এক শান্ত, ছায়াময় গাছ—যেখানে পাখি বাসা বাঁধে, শিশুরা খেলে।
কিন্তু রাত হলে, গাছের ডালে মাঝেমধ্যে জ্বলতে দেখা যায় সবুজ এক একটি আলো...
লোকেরা বলে—“ওগুলো গাছের কান্না নয়, ওগুলো আত্মার শান্তি।”
---
শেষ।