29/07/2025
সন্ধ্যা নামে ধীরে ধীরে। পল্লবপুর গ্রামের চারদিকে ঝোপঝাড়, পুরনো আমবাগান আর ধ্বংসপ্রায় রাজবাড়ি। স্থানীয়রা বলে, রাজবাড়িটা অভিশপ্ত। শত বছর আগে সেই রাজবাড়ির রানি চন্দ্রমুখী নাকি নিজের সন্তান হারিয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। এক রাতে তিনি নিজেই সেই রাজপ্রাসাদে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। তারপর থেকেই রাত নামলে কেউ সেদিকে যায় না।
রুদ্র, একজন শহুরে যুবক, ইতিহাসের ছাত্র। পুরনো স্থাপত্য আর লোককাহিনী নিয়ে তার প্রবল আগ্রহ। সে ঠিক করল—পল্লবপুরের রাজবাড়ি নিয়ে একটি গবেষণা করবে। গ্রামের লোকেরা সাবধান করেছিল, “ওখানে কেউ রাতে থাকলে ফিরে আসে না।” কিন্তু রুদ্র হেসে উড়িয়ে দিল। ভূতে তার বিশ্বাস নেই।
এক সন্ধ্যায় সে রাজবাড়িতে পৌঁছাল। ঘন জঙ্গল আর পাখির ডাকে জায়গাটা আরও ভৌতিক লাগছিল। রাজবাড়ির ভাঙা দরজাটা কর্কশ শব্দে খুলল। ভেতরে ধুলো, জাল আর নীরবতা। হঠাৎ বাতাসে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। রুদ্র মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে চারপাশ দেখতে লাগল।
দেয়ালের চিত্র, ছেঁড়া পর্দা, মলিন সিংহাসন—সব যেন সময়ের সাক্ষী। কিন্তু হঠাৎ করেই সে টের পেল, কেউ একজন তার পেছনে নিঃশব্দে হাঁটছে। সে ফিরে তাকাল—কেউ নেই। ভাবল, মনের ভুল। কিন্তু পর মুহূর্তেই সে শুনল, করিডরের শেষ প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে এক নারীর গুনগুন গান। গলা যেন কাঁপছে, কিন্তু সুর ভেসে আসছে স্পষ্ট।
সে সাহস করে এগিয়ে গেল। সেখানে একটি ঘর—মাঝখানে ভাঙা আয়না আর একটি পুরনো চেয়ার। চেয়ারটি ধীরে ধীরে দুলছে, অথচ বাতাস নেই। হঠাৎ আয়নায় সে দেখতে পেল এক সাদা শাড়ি পরা নারীর অবয়ব। চুল তার সামনে ঝুলে আছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না। রুদ্র ঘামতে শুরু করল। সে ফিরে তাকাতে চাইলে আয়নার নারীর হাত আয়নার ভেতর থেকে বেরিয়ে তার দিকে এগিয়ে এল।
ভয়ে সে দৌড়াতে লাগল, দরজার খোঁজে। কিন্তু রাজবাড়িটা যেন এক বিভ্রম হয়ে উঠেছে—প্রতিটা ঘর একইরকম, প্রতিটা করিডর যেন ঘুরে ঘুরে এক জায়গায় চলে আসে। ঘড়িতে রাত ১২টা। রুদ্র টের পেল, সময় যেন থেমে গেছে। হঠাৎ সে দেখতে পেল এক শিশু, হয়তো ৫-৬ বছরের। সে নিঃশব্দে হাঁটছে, পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না। রুদ্র ডাকল, “এই! তুমি কে?”
শিশু থামল না। তার শরীরটা যেন স্বচ্ছ, যেন ছায়া। এরপর সে এক দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। রুদ্রও পেছনে গেল। ঘরের দেয়ালে লেখা—"আমায় কেন নিয়ে গেলে, মা?" পাশেই একটি ছোট কাঠের কফিন পড়ে আছে। হঠাৎ দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ঘরের বাতাস হিমশীতল হয়ে গেল। দেয়াল থেকে রক্ত ঝরতে লাগল।
সেই মুহূর্তে নারীকণ্ঠে করুণ আর্তনাদ ভেসে এলো—“আমার সন্তান... ফেরাও আমার সন্তানকে...” রুদ্র দৌড়ে বের হতে চাইলে দেখল, ঘরের মেঝে ভেঙে যাচ্ছে। সে কোনোমতে বাইরে বেরিয়ে এলো, কিন্তু তখন সে এক বিশাল হলঘরে। মাঝখানে একটি মোমবাতি জ্বলছে, আর চারপাশে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ছায়া। তারা নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে রুদ্রের দিকে।
একটি ছায়া এগিয়ে এলো—তার চোখ নেই, মুখ নেই, শুধু গাঢ় অন্ধকার। সেই ছায়া বলল, “তুমি তাদের ডেকে এনেছো। যারা ঘুমিয়ে ছিল, জাগিয়ে তুলেছো। এখন তোমার ফেরার পথ নেই।” রুদ্র চিৎকার করে উঠল, “আমি কিচ্ছু করিনি!”
কিন্তু সেই ছায়া এগিয়ে এল, এক নিঃশ্বাসে বলল, “তোমার গলায় ওদের ভয় লেগেছে। তুমি বিশ্বাস করোনি—তাই ওরা তোমায় বিশ্বাস করাবে।” হঠাৎ সব ছায়া মিলিয়ে গেল। শুধু একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এল—“ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি...” যেন একটা শিশুকে ঘুম পাড়ানো হচ্ছে।
রুদ্র হঠাৎ জ্ঞান হারাল।
পরদিন সকালে গ্রামের লোকজন তাকে রাজবাড়ির দরজায় অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে। তার শরীরে ছিল নখের দাগ, চুল ছেঁড়া, চোখ স্থির হয়ে গিয়েছিল। সে কিছু বলত না, শুধু কাঁপত আর বিড়বিড় করত—“আমার সন্তান... ফেরাও... আয়নার ভেতর তারা আছে…”
রুদ্র আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরল না। তাকে শহরের মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়, যেখানে সে প্রতিদিন আয়নার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে। তার ঘরের আয়নাগুলো সরিয়ে ফেলা হয়, কিন্তু মাঝরাতে সে আয়নার ভেতরে তাকিয়ে বলে—“ওরা আসছে... ছায়াগুলো...”