
23/07/2025
স্বার্থের সূক্ষ্ম সুতো: মানুষ, সম্পর্ক ও সৃষ্টিকর্তা
মানুষের জীবন এক জটিল সম্পর্কের জাল। এই জালের প্রতিটি সুতো স্বার্থ দিয়ে গাঁথা—এমন একটি দাবি যা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে। সৃষ্টিকর্তা থেকে শুরু করে বাবা-মা, প্রিয় মানুষ, এমনকি আমরা নিজেরাও কি সত্যিই কেবল স্বার্থের তাগিদে চলি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা মানব প্রকৃতি, সম্পর্ক এবং আধ্যাত্মিকতার গভীরে ডুব দিতে বাধ্য হই।
#স্বার্থ: একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি
স্বার্থকে আমরা প্রায়ই নেতিবাচকভাবে দেখি, কিন্তু এটি মানুষের বেঁচে থাকার একটি মৌলিক প্রবৃত্তি। জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে, স্বার্থ আমাদের বেঁচে থাকা এবং প্রজননের জন্য প্রয়োজনীয়। একজন মা তার সন্তানের প্রতি যত্নশীল হন, কারণ এটি তার জিনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। একজন প্রিয় মানুষ আমাদের পাশে থাকেন, কারণ আমাদের সঙ্গ তাকে মানসিক তৃপ্তি দেয়। এমনকি সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, আমাদের জন্য পরকালের পুরস্কার বা মুক্তির প্রতিশ্রুতি বহন করে। তবে, এই স্বার্থ কি সবসময় সংকীর্ণ বা নীচু? নাকি এটি জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশ?
#সৃষ্টিকর্তা ও স্বার্থ:
ধর্মীয় বিশ্বাসে সৃষ্টিকর্তার প্রতি গুণগান বা ভক্তি প্রকাশের বিষয়টি প্রায়ই পরকালের পুরস্কারের সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ বলতে পারেন, এটি একটি লেনদেনের মতো—আমরা ভক্তি দিই, বিনিময়ে জান্নাত পাই। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি কি সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালোবাসা বা আধ্যাত্মিক বন্ধনের গভীরতাকে অস্বীকার করে না? অনেকে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি প্রকাশ করেন কোনো প্রত্যাশা ছাড়াই, কেবল মানসিক শান্তি বা নৈতিক দিকনির্দেশনার জন্য। এই ক্ষেত্রে, স্বার্থ কি আদৌ কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে? নাকি এটি একটি উচ্চতর উদ্দেশ্যের প্রতি আত্মসমর্পণ?
#বাবা-মা ও সন্তান: স্বার্থ না নিঃস্বার্থ ভালোবাসা?
বাবা-মা তাদের সন্তানের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। কিন্তু এই ত্যাগ কি সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ? অনেকে বলবেন, বাবা-মা তাদের সন্তানের মধ্যে নিজেদের স্বপ্ন, আশা বা ভবিষ্যতের নিরাপত্তা দেখেন। বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছ থেকে সেবা পাওয়ার প্রত্যাশা কিছুটা হলেও থাকতে পারে। তবে, এই প্রত্যাশা কি তাদের ভালোবাসাকে কমিয়ে দেয়? একজন মা যখন রাত জেগে সন্তানের জন্য খাবার তৈরি করেন বা একজন বাবা নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানের শিক্ষার জন্য অর্থ জোগাড় করেন, তখন কি এটি কেবল স্বার্থের খেলা? নাকি এটি একটি গভীর, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রকাশ?
#প্রিয় মানুষ ও সম্পর্ক
প্রিয় মানুষ—সে বন্ধু হোক, প্রেমিক হোক বা জীবনসঙ্গী—আমাদের পাশে থাকে। কিন্তু এই সান্নিধ্য কি সবসময় নিঃস্বার্থ? সম্পর্কে আমরা একে অপরের কাছ থেকে মানসিক সমর্থন, সঙ্গ বা সুখ খুঁজি। এটি একটি পারস্পরিক লেনদেন। তবে, এই লেনদেন কি সম্পর্কের সৌন্দর্যকে কমিয়ে দেয়? যখন কেউ আমাদের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দেয়, তখন কি আমরা তাকে স্বার্থপর বলতে পারি? সম্পর্কের এই সূক্ষ্ম ভারসাম্য আমাদের বোঝায় যে, স্বার্থ এবং নিঃস্বার্থতা একে অপরের সঙ্গে জড়িত।
স্বার্থ মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, কিন্তু এটি সবসময় নেতিবাচক নয়। সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি, বাবা-মায়ের ত্যাগ, বা প্রিয় মানুষের সঙ্গ—এগুলোর পেছনে স্বার্থ থাকতে পারে, কিন্তু এই স্বার্থ প্রায়ই একটি বৃহত্তর ভালোর সঙ্গে জড়িত। সৃষ্টিকর্তার গুণগান আমাদের নৈতিকতা ও মানসিক শান্তি দেয়; বাবা-মায়ের ত্যাগ সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ে; প্রিয় মানুষের সঙ্গ আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে। স্বার্থ এবং নিঃস্বার্থতার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম রেখা আছে, যা আমাদের মানব প্রকৃতির জটিলতাকে প্রকাশ করে।
জীবনের প্রতিটি সম্পর্ক ও কাজের পেছনে স্বার্থ থাকতে পারে, কিন্তু তা সবসময় সংকীর্ণ বা স্বার্থপর নয়। এটি আমাদের বেঁচে থাকার, সম্পর্ক গড়ার এবং উচ্চতর উদ্দেশ্যের সন্ধানের একটি অংশ। সৃষ্টিকর্তা, বাবা-মা বা প্রিয় মানুষ—সবাই হয়তো কোনো না কোনো প্রত্যাশা নিয়ে কাজ করেন, কিন্তু এই প্রত্যাশা আমাদের জীবনকে আরও গভীর ও অর্থপূর্ণ করে। স্বার্থকে নিন্দা করার আগে, আমাদের বোঝা উচিত যে এটি মানুষের প্রকৃতির একটি অংশ, যা নিঃস্বার্থতার সঙ্গে মিলেমিশে আমাদের জীবনকে রঙিন করে।