সাহিত্য অঞ্জলি - Shahitto Anjoly

সাহিত্য অঞ্জলি - Shahitto Anjoly 'সাহিত্যের চর্চা করুন, বাংলা সাহিত্যকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করুন'

'সাহিত্য চর্চা করুন, বাংলা সাহিত্যকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করুন' এই স্লোগানকে ধারণ করে প্রকাশিত হচ্ছে 'সাহিত্য অঞ্জলি'। সর্বস্তরের মানুষের কাছে আধুনিক সাহিত্যকে পৌছে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই আমাদের এই প্রয়াস।

07/07/2025

অনেক দৌড়ঝাঁপ, অস্থিরতা, ছটফটানির শেষে একটা বয়স আসে! বা ম্যাচিউরিটি! ওখানে চারপাশে নিজের তোলা বাউন্ডারি! ভেতরে একটা বাগান... সে বাগানে কেবল নিজের পছন্দের ফুলগুলো! মানুষগুলো!

বাকি কোন কিছুই আর সেভাবে ম্যাটার করে না! বাউন্ডারি বেয়ে উঠতে চাওয়া উটকো পরগাছা ফেলে দেয়া নিঃসংকোচে! কে কি বললো, ভাবলো সেগুলো মাঝে মাঝে দেয়ালের এপাশেও পৌঁছে কিন্তু ছুঁতে পারে না আগের মতো!

আগের নরম, কোমল চামড়া একটু করে শক্ত হয়! গায়ে যার তার কথা লাগে কম! শুধু নির্দিষ্ট কিছু মানুষের জন্য ভেতরটা নরম কাঁদামাটির মতো থাকতে দিতে হয় তখন... তাদের দেয়া আদর, মায়া, কষ্ট সবটুকু শুষে নেবার মতো নরম থাকতে হয়...

ওটুকু কখনো ফুরিয়ে দিতে নেই... পৃথিবী আমাকে শক্ত করুক কিন্তু অমন পাথর কখনো বানিয়ে না ফেলুক যে আমি বাউন্ডারির ভেতরের মানুষগুলোর জন্যেও দু ফোঁটা চোখের জল ফেলতে পারবো না!

ওটুকু থাকতে দিতে হয়! একটু পুড়তে হয় মাঝে মাঝে! তাতে সোনা নাকি আরো খাঁটি হয়!

যা বলছিলাম ওই বয়সটায় পৌঁছেছি বোধহয়! বাইরের chaos বাইরে থাকতে দিচ্ছি! ভালো লাগছে সময়টা! ❤️

©️Sincerely, Zana
Toronto, Canada 🍁

05/07/2025
05/07/2025
21/06/2025

রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে
একটি অসাধারণ লেখা।

রবি ঠাকুর
--সাবিনা ইয়াসমিন রিঙ্কু

রবি ঠাকুর না জন্মালে আমাদের ছোটবেলায় সাধারণ মুসলিম ফ্যামিলিগুলোতে কিচ্ছু যায় আসত না। কারণ তখন কাজী নজরুল ইসলাম মুসলিম পরিবারগুলোতে ‘রাজ’ করতেন। ভদ্র ভাষায় বলা যায় বিরাজ করতেন। রেডিওতে ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ বাজলে নব ঘুরিয়ে আওয়াজটা জোরে দেওয়া হত। রবীন্দ্রনাথের ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার কোনও ভাবে বাড়িতে এসে পড়লে খুব মুশকিল হত। দেওয়ালে ‘ঠাকুর’ এর ছবি টাঙালে গুনাহ হবে....এই সলিড ধর্মীয় কারণে রবি ঠাকুর ঢুকে যেতেন কাঠের আলমারিতে। মুসলিম পরিবারে শুধু ঠাকুর নন, যে কোনও মানব মহামানবের ছবি টাঙানোতেও ভয়ংকর নিষেধাজ্ঞা ছিল।

তখন সেই মুসলিম পরিবারটির কাছে রবি ঠাকুর মানে একজন মানুষ। অতিমানব নন। গান লেখেন। কবিতা লেখেন। গল্প উপন্যাস লেখেন। নোবেলও পেয়েছেন। তাতে কী! রেডিওতে তাঁর গান বাজলে ঘুম লাগে।

ক্যালেন্ডারে রবি ঠাকুরের ছবি দেখে আমার দাদির সে কী আক্ষেপ! ‘কী সোন্দর দাড়ি! ঠিক য্যান পীর পয়গম্বর! গায়ে মোলবি সায়েবের মতুন ঢুলা জামা। সব ঠিক আছিল। কিন্তু মোচখানের জন্য মোসলমান হতে পারল না মানুষটা!’ দাদি মাঝেমাঝে ক্যালেন্ডারটা বের করে রবি ঠাকুরকে দেখতেন আর বলতেন লোকটার মুখে কী য্যান একটা আছে! শান্তি লাগে। ক্যানে যে মোচটা থুতে গেল! ঝুলা মোচখান না থাইকলে এ লোক একেবারে খাঁটি মোসলমান। আমাগো ঘরের লোক।

ইতিমধ্যে বড় ওয়ানে উঠলাম। সহজ পাঠ হাতে এল। এত সহজ ভাবে জীবনের রস গ্রহণ করতে করতে বানান এবং বাক্যগঠনও শেখা যায়! কবিতা নয়, যেন ছবি!
— ‘পথের ধারেতে একখানে
হরি মুদি বসেছে দোকানে
-- বিধু গয়লানী মায়ে পোয় সকালবেলায় গোরু দোয়।
আঙিনায় কানাই বলাই
রাশি করে সরিষা কলাই।’

পাশে বসে বুড়ি দাদি ফুটুস করে ফুট কাটেন, ‘এ তো পুরাই হিঁদু পাড়ার বন্ননা! ও ময়না, মোসলমানদের নিয়া কিছু ল্যাখা পেলে শুনাবা।’

আমি পড়ি, ‘বামি ঐ ঘটি নিয়ে যায়। সে মাটি দিয়ে নিজে ঘটি মাজে।’ দাদি বলেন, ‘রোবিন্দনাত পীর মানুষ তো! ঠাকুর। সারাজীবন আল্লার কথা ভেবিছে। তাই ঘর সনসারের কথা ভুলভাল লিখেছে। মাটির সাথে এট্টু ছাই মিশায়ে না মাইজলে ঘটি সুনার মতুন ঝকমকা হওয়া মুশকিল।’ এ সব কথা শুনে আমি বিরক্ত হতাম। মা মুখ টিপে হাসত।

এরপর সংসারে যা হয় ... ভাইয়ে ভাইয়ে ঝামেলা, হাতাহাতি, দায়িত্ব এড়ানোর প্রচেষ্টা... এ সব অশান্তির মাঝখানে বাবা ‘ভেন্ন’ হলো এবং একটা ভাড়া বাড়িতে আমরা উঠে এলাম। তারপর কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের নিজের বাড়ি হল। বাগানওয়ালা বাড়ি। আমার মায়ের জীবনে খুশি নেমে এল। রেডিওতে জোরে জোরে ‘প্রাত্যহিকী’ শোনা হত রোজ। প্রাত্যহিকীর পর ১৫ মিনিটের জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রোগ্রাম হত। বাংলাদেশের শিল্পীদের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতও বাজত সেই অল্পক্ষণের অনুষ্ঠানে। আমার পড়া মুখস্থর সঙ্গে জোরে বাজানো রবীন্দ্রসঙ্গীতের কোনও বিরোধ ঘটত না। মা-ও গলা মেলাত। মা গান না শিখলেও সুর জ্ঞান ভালোই ছিল।
নতুন বাড়িতে ছোট্ট মতো লাইব্রেরি তৈরি হল।

রবীন্দ্রনাথ সাড়ম্বরে এলেন। অনেক লেখকের বইয়ের সঙ্গে সঞ্চয়িতা, গীতবিতান, উপন্যাস সমগ্র, ছোটগল্প এল। আরও এল রেকর্ড প্লেয়ার। চারকোনা বক্স। তার উপর গোল রেকর্ড। কালো রঙের। পিন চাপিয়ে গান শুনতে হয়। সারাদিনে রবীন্দ্রসঙ্গীত দু’তিনবার তো বাজতই! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সাগর সেন, অর্ঘ্য সেন, সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, সুমিত্রা সেন আমাদের মন ভালো রাখতেন। আরও ছিল সিনেমার গানের রেকর্ড। মণিহার, লালকুঠি সিনেমার গান। সন্ধ্যা মুখার্জির গান। ছিল সিরাজদ্দৌলা নাটক। আমার দাদি আমাদের সঙ্গে থাকতেন না। মাঝে মাঝে এসে এক দু’মাস করে থাকতেন। কাপড় চোপড়ের সঙ্গে জায়নামাজ, তসবিহ...সব আনতেন। আর আনতেন দাড়িওয়ালা ফেরেস্তার ছবিখানা। কেউ জানত না। আমি আর মা-ই শুধু জানতাম। পরে অবশ্য সবাই জেনেছিল।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায় ‘রোদনভরা এ বসন্ত’ শুনে দাদির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। রেকর্ডের উল্টো পিঠে ছিল ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও’... সেটা শুনেও কাঁদতেন। ‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো’র দুর্দান্ত মিউজিকে আমি যখন মাথায় গামছা বেঁধে নকল খোঁপা বানিয়ে ধিতিং ধিতিং করে নাচতাম, দাদি দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে উদাস ভাবে অন্যদিকের দেওয়ালটার দিকে তাকিয়ে থাকত।

চোখ দিয়ে অবিশ্রান্ত অশ্রু ঝরত। গানের সব কথার মানে যে ঠিকমতো বুঝতেন না, সেটা আমার মতো বাচ্চা মেয়েও বুঝতে পারত। এক দাড়িওয়ালা পীর টাইপের মানুষের সঙ্গে এই গানগুলো জুড়ে দিয়ে আমার নিরক্ষর দাদি কখন যেন তাঁকে নিভৃত প্রাণের দেবতা বানিয়ে ফেলেছিলেন নিজের অজান্তেই। নইলে যে বার বাবার ভয়ঙ্কর টাইফয়েড হল, তখন দাদি কেন নামাজ শেষ করে বাবার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে দোয়া পড়ে গায়ে মাথায় ফুঁ দিতেন আর গোল করে পাকানো রবি ঠাকুরের ছবিওয়ালা ক্যালেন্ডারটি বাবার মাথায় স্পর্শ করাতেন?

দাদির মৃত্যুর সময় ছেলের বউরা চামচে করে বেদানার রস আর জমজমের পানি খাওয়াচ্ছিল। অশীতিপর বৃদ্ধার মুখ থেকে বাইরের দিকে গড়িয়ে পড়ে গিয়েছিল সব তরল। গেলবার শক্তিটুকুও ছিল না। অথচ হাতের মুঠোয় মুড়িয়ে রাখা রবি ঠাকুরের ছবি ছাপা সেই ক্যালেন্ডারটি শক্ত করে ধরে রেখে ছিলেন। ঘরে উপস্থিত সবাই ক্ষীণস্বরে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ বিড় বিড় করছিল। দাদি আমার মায়ের দিকে ঘোলাটে চোখে তাকানোর চেষ্টা করে কী যেন বলার চেষ্টা করছিলেন। একবার নয়। বার বার। ঘরে উপস্থিত থাকা মানুষগুলো দোয়া পড়ার আওয়াজ বাড়িয়ে দিয়েও বুড়িকে শান্ত করতে পারছিল না। দাদি একভাবে মায়ের দিকে তাকিয়ে ডান হাতের কাঠির মত তর্জনিটা নাড়িয়ে কাঁপিয়ে চলেছিলেন। মা কি বুঝল জানি না। বাবাকে একদিকে ডেকে কিছু একটা বলতেই বাবা সবাইকে বুঝিয়ে বাইরে নিয়ে গেল। ব্যাপারটা সহজ ছিল না। গ্রামেগঞ্জে মৃত্যু চাক্ষুষ করা একটা নিয়মের মধ্যেই পড়ে। ক্লাইম্যাক্স মুহূর্তে আত্মীয় এবং প্রতিবেশীরা ভীষণ বিরক্ত হয়ে বাইরে উঠোনে গিয়ে দাঁড়াল। তখন ঘরে মা, আমি আর আমার দাদি। দরজা বন্ধ করে মা দাদির খুব কাছে গিয়ে কানের কাছে মুখ লাগিয়ে গাইতে শুরু করলো....রোদন ভরা এ বসন্ত, সখী কখনো আসেনি বুঝি আগে....
মায়েরও চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। মা-কে কাঁদতে দেখে আমিও কাঁদছি। সে এক মুহূর্ত বটে!
দক্ষিণসমীরে দূর গগনে...মা থেমে গেল। দাদির চোখের জল আঁচলের খুঁট দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে চোখের পাতা দুটো বুজিয়ে দিল। হাতের মুঠো থেকে গোল করে জড়ানো ক্যালেন্ডারখানা ছাড়িয়ে নিয়ে পুরোনো আলমারির ভিতরে তুলে রেখে দরজা খুলে দিল।
রবি ঠাকুর না জন্মালে এই দুষ্প্রাপ্য দৃশ্য কী ভাবে রচিত হত?

রবি ঠাকুরের কাছে পৌঁছতে গেলে কত পড়াশোনা লাগে! সাধনা লাগে। আলাদা করে মনটাকে তৈরি করতে হয়। কিন্তু যার কাছে রবীন্দ্রনাথ নিজে পৌঁছে যান, তার কেবল ভালোবাসা দিতে লাগে।

-----------------------

21/06/2025

“আরে ছেলে তোমার নামটা তো বুঝলুম, তা তোমার টাইটেলটা কি? চক্কোতি না চক্রবর্তী?”

লেখক — রাজকুমার মাহাতো

“আরে ছেলে তোমার নামটা তো বুঝলুম, তা তোমার টাইটেলটা কি? চক্কোতি না চক্রবর্তী?” খবরের কাগজের ডিলার বেশ বিরক্তির সাথেই প্রশ্নটা করল শিবরাম কে।শিবরাম মাথা চুলকে, এদিক ওদিক তাকিয়ে,ছেঁড়া জুতোটা ডান পা থেকে খুলে পায়ের তেলোটা বাম হাত দিয়ে চুলকে আবার সেই হাত দিয়ে কপালের একপাশ চুলকে ভাবতে লাগলো আসলে তার টাইটেলটা কি? চক্কোতি না চক্রবর্তী?এই অবস্থা দেখে কাগজ ডিলার কি যে তার টাইটেল ফর্মে বসালেন জানা নেই। তবে তিনি নাকটা সিঁটকে বললেন “ওহে ভজা,এ কাকে তুলে এনিছিস? ছে ছে, পায়ের তেলো চুলকে আবার সেই হাত দিয়ে কপাল চুলকায়। জানিনা বাবা আর কোথায় কোথায় চুলকায় ব্যাটা। “শিবরাম বেশ খানিকটা হেসে নিয়ে বলল “উফফ, কি যে বলেন মশাই। শরীরের অঙ্গ যেমন হাত, তেমনি পা, আবার তেমনি কপাল। এবার পায়ের তেলো চুলকালে পা দিয়ে তো আর চুলকানো যায়না অথবা কপাল চুলকালে ঠোঁট দিয়েতো আর চুলকানো যায়না। যেখানেই চুলকানি হোক, সেই হাত দিয়েই চুলকাতে হবে। এবার সব যদি একসাথে চুলকায় কি করব বলুন?”ডিলার মশাই বললেন “ তা ও ছেলে চুলকানি সঙ্গে করে নিয়ে কোথা থেকে এসেছ বাবা?”শিবরাম আবার খানিকটা ভাবতে শুরু করলেন। এবং সবে জুতোটা খুলে হাতটা পায়ের চেটোতে দিতে যাবে ডিলার মশাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন “ আচ্ছা বাবা, আমার ঘাট হয়েছে তোমাকে কিচ্ছুটি বলতে হবেনা আর।তুমি এখন এসো।“ আর একটু চেঁচিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন “ ওহে ভজা একে নিয়ে যা। আর কাগজ দিয়ে দে। বেচুক ব্যাটা। আর এখানে আনলেও আমার সামনে আনিস না। ছে ছে কি গেদরা ছেলেরে বাবা।“ভজা কাগজের একটা গোছা শিবরামের হাতে ধরিয়ে বলল “চলো এবার। বেশ লোক তুমি পথ থেকে তুলে এনে একটা কাজ দিলুম সেটাও খেতে বসেছিলে। আচ্ছা ওই মন্দিরে ভিক্ষা করে খেতে ভালো লাগছিল?”শিবরাম তখনকার জন্য কিছু বলল না ভজাকে। বাড়ি থেকে পালিয়ে এই কৈশোর বয়সে কলকাতা এসে উঠেছে সে। বিনা টিকিটে ট্রেনে করে না খেয়ে না দেয়ে এসে এখানকার এক মন্দিরের বাইরে ভিখারিদের সাথে বসে ভিক্ষা করে যেটুকু জুটেছিল তাতেই রাবড়ি আর রসগোল্লা খেয়ে কাটিয়েছে দু-দিন। তিনদিনের মাথায় ভজার সাথে দেখা। তারই বয়সী একটা ছেলে।শিবরামকে দেখে প্রথমে তার দিকে মিনিট দুই তাকিয়ে ছিল ভজা। তারপর তার সামনে এসে প্রশ্ন করল “ ও ভাই। তোমাকে দেখে তো এদের বংশধর বলে মনে হচ্ছে না। কে তুমি? এখানে কেন?”শিবরাম একটু হেসে বলল “ আমার আর এদের মধ্যে কোথায় তফাৎ একটু বল দিকি।“ভজা ভ্রুটা কুঁচকে বলল “অনেক তফাৎ, সে যদি বুঝতে আজ ওদের মধ্যে থাকতে তুমি? তা ভায়া দেখে তো ভদ্র ঘরের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে। এইভাবে ভিক্ষা করে ক’দিন চলবে?”শিবরাম এবার বেশ জোড়ে জোড়ে অট্টহাসি হেসে বলল “ আচ্ছা ভাই, ভদ্রলোক কি আমার কপালে লেখা আছে? কই আমিতো কোনদিন দেখতে পেলুম না। এইতো বেশ ফাস্ট-ক্লাস আছি। কোথায় দুঃখ আর কাল দু-বেলা বাবড়ি খেয়েছি, রসগোল্লা খেয়েছি। একটা সিনেমাও দেখেছি। আর কি চাই বলো?”ভজা আর কিছু বলতে পারলনা শিবরামকে। এক-দু বার তার দিকে তাকিয়ে হাতটা ধরে বলল “ চলো,একটা কাজ করো। খেটে খাও ভগবান হাত দিয়েছে পা দিয়েছে।“শিবরাম ভজার দিকে অবসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল “ আবার কাজ? ও ভাই রেহাই দাও। এই কাজ-টাজ করতে একেবারে ভালো লাগেনা আমার।বেশ আছি দেখো একেবারে ফাস্ট-ক্লাস।“ভজা আর কিছু না বলে হাতটা ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে এই কাগজের ডিলারের কাছে নিয়ে এসেছে। সেও খবরের কাগজ ফেরি করে বেড়ায় আর তার সাধ্য অনুযায়ী শিবরামকে সে এই কাজটাই দিতে পারত। আর তাই দিলও সে।শিবরাম অবশ্য কাজের কথা যে একদম ভাবেনি তা নয়। সে ভজাকে বলল “ খবরের কাগজ মানেতো বেশ ভারী জিনিস। আচ্ছা ধূপকাঠি বেচলে কেমন হয়?”ভজা মাথা চুলকে চোখ দুটোকে গোল্লা পাকিয়ে বলল “ কি কুঁড়েরে বাবা তুমি। এত কুঁড়ে লোকের পৃথিবীতে কোন জায়গা নেই। যে কাজ’টা দিলাম করতে হয় করো আর নয়ত আবার মন্দিরের বাইরে বাটি হাতে বসে যাও। “শিবরাম আর কিছু না বলে খবরের কাগজ ফেরী করতে চলে গেল।“তুমি ভায়া শ্যামবাজারের দিকটা যাও। আমি অন্যদিকে গেলুম।“ বলে ভজা বেড়িয়ে গেল। শিবরাম শ্যামবাজারের দিকে গিয়ে “কাগজ চাই কাগজ “ বলে চেঁচাতেই কোথা থেকে চার-পাচটা লোক এসে জুটে গেল তার সামনে। তাদের হাতেও কাগজের গোছা। শিবরাম তাদেরকে দেখে বলল “ ওহে ভায়া। তোমরাও কাগজ বেচতে বেড়িয়েছ !আহা খুব জমবে চলো একসাথে সবাই মিলে চেঁচাই। কাগজ লাগবে কাগজ।“কিন্তু তাদের মনে আলাদা চিন্তা-ভাবনার বীজ রোপণ করা ছিল। ওই এলাকা বাঁচানোর লড়াই। সবাই মিলে কটকট চোখে শিবরামের দিকে তাকিয়ে থাকল খানিকক্ষন।তারপর তাদের মধ্যে একজন বলল “কান খুলে শুনে রাখো ভায়া, এ এলাকা আমাদের আগে থেকে দখল করা। তুমি নতুন লোক।এখানে এখন তোমার ঢোকা চলেনা। ভালোয় ভালোয় বেড়িয়ে পড়ো।তা না হলে খারাপ হবে।“শিবরাম বলল “ পুরো পৃথিবীটা তো একটাই এলাকা ভায়া।আমার তোমার বলে আবার ভাগ কিসের? “তাদের মধ্যে একজন চোখ দুটো বড় বড় করে বেশ রাগী মুখে তাকিয়ে বলল “ অতশত জানিনা ভায়া, কাল থেকে তোমায় যেন এই এলাকায় না দেখতে পাই।“শিবরাম বেগতিক দেখে বলল “ফাস্ট ক্লাস বলেছ ভায়া। কাল থেকে অন্য এলাকায় গিয়ে ঘাঁটি গড়ব তাহলে। আজকের দিনটা এখানেই থাকি।“লোকগুলো চলে যেতে সেদিনের মত রেহাই পেল শিবরাম। সারাদিন কাগজ বেচে যেটুকু কমিশন এলো। বিকেলে মিষ্টির দোকানে গিয়ে রাবড়ি , রসগোল্লা খেয়ে একটা সিনেমা দেখে কোন একটা ফুটপাথে শুয়ে তার সেই দিনটা কাটলো।হ্যাঁ এটাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। রাবড়ি-রসগোল্লা-কাটলেট আর সিনেমা এইক’টা জিনিস থাকলে তার আর কিছুই তার লাগেনা। তার বিশ্বাস এই ক’টা জিনিস দিয়েই তার জীবনধারণ সম্ভব।শিবরাম চক্রবর্তী কে নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম মাস দুই আগে। তারপর নানা চাপে আর লেখা হয়ে ওঠেনি। একটা রাজপরিবারের ছেলের কাহিনী লিখতে বসলে, বা সেই পরিচয়টা নাহয় বাদই দিলাম। একজন রম্য লেখকের কাহিনী লিখতে বসে কতবার যে নিজেকে অসহায় পেয়েছি জানিনা। মানুষ ওনাকে একজন রম্য লেখক হিসেবে চেনেন। বেশিরভাগ‌ই তার কলমে হাসির ফোয়ারা উঠেছে, মানুষকে ভীষনভাবে হাসতে বাধ্য করেছেন তিনি। ‌কিন্তু তার জীবন ওতটা হাসিময় ছিল কিনা সেটা কতজন জানেন? শুনেছি যে মানুষ বাইরে যত বেশি হাসে তার গভীরে তত বেশি দুঃখ বেদনা জমা হয়ে থাকে। আগ্নেয়গিরির লাভার মত জমা হতে থাকে সেগুলো। আজ ওনার মৃত্যু দিবসে আমার এই লেখাটা ওনার প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি আর ভালোবাসা। আমার মনের অনেক কাছের একজন মানুষ তিনি।ওঁর লেখার মাধ্যমে যেন কোথাও ওঁর লুকায়িত বেদনা গুলো দেখতে পাই আমি। চাঁচলের রাজবাড়ির উত্তরাধিকারী ছিলেন তিনি। ১৯০৩ সালের ১৩ই ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। এত বড় বংশ পরিচয়কে কোনদিন কোন কাজে লাগেনি। ওঁর পুরো জীবনটাই কেটেছিল মুক্তারাম স্টিটের মেসবাড়ির দোতলার ঘরে। শেষ জীবনটা গভীর অর্থসংকটের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত পশ্চিম বঙ্গ সরকার তার মাসিক খরচের ব্যবস্থা করেছিলেন। কলেজে পড়ার সময় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সঙ্গে আন্দোলন আর তার জন্য জেল খাটা। তারপর লেখালেখি চালু করা। প্রথম লেখা ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। শোনা যায় তার প্রথম লেখা তিনি আমাদের অনিলা দেবী মহাশয় কে দেখাতে নিয়ে গেছিলেন। এবং তিনি গ্রিন সংকেত দিতে সেটি একটি ততক্ষনাত পত্রিকাতে ছাপা হয় কিন্তু সেখানে লেখকের নাম ছিল শরতচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এটা দেখে মুচরে পড়েছিলেন তিনি কিন্তু ভেঙে জাননি। আবার উঠে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। এমনকি শিশির ভাদুড়ী তার রচনা নিয়ে একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। তার এক টাকাও পাননি তিনি। শরৎচন্দ্র বাবু এসে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই টাকার থলে। বলে গিয়েছিলেন " ওর বৌ নেই, বাচ্চা নেই, সংসার নেই। অবিবাহিত ছেলে। কি করবে টাকা নিয়ে?" জেল খেটে বেরিয়ে এসে শোনেন তার একমাত্র ভালোবাসার মানুষ রিনির বিয়ে হবে। সেই থেকে কিছুদিন ফুটপাতে কাটিয়েছিলেন, আর জীবন থেকে ভালোবাসা নামক জিনিসটা মুছে গিয়েছিল চিরতরে। বিয়ে করেননি আজীবন। এখন একটু কিছু হলেই আমরা বলি মন ভেঙে গেছে। আর তারপর জোড়া লাগিয়ে আবার নতুনকে জায়গা করে দিই। কিন্তু মন ভাঙা মনে হয় এটাকেই বলে। আর জোড়া লাগেনি। শেষ জীবনটা নিঃসঙ্গ কেটেছিল তার। দেখাশোনার মত কেউ ছিলনা তার পাশে। তবুও সংগ্রাম করে গেছেন আজীবন। আজকের দিনে ১৯৮০ সালে তার সংগ্রাম শেষ হয়। সারাজীবনটা মেস বাড়িতে থেকে নিজেকে সবার থেকে আড়াল রেখেছিলেন তিনি। অনেক অভিমানে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন প্রতিনিয়ত। তবুও লেখা ছাড়েননি। লিখে গেছেন আর সেই কলমের মাধ্যমে আজও আমাদের মধ্যে জীবিত তিনি। মৃত্যুর পাঁচ মিনিট আগেও তিনি বলেছিলেন "আমি ফার্স্ট ক্লাস আছি।" লেখায় প্রতারণা প্রাচীন কালের প্রথা। চলে আসছে, আগামী দিনেও চলবে হয়ত। কিন্তু তবুও জন্মাবে শিবরাম যুগে যুগে, বাংলার বুকে। কবির ভাষায় " তুমি রবে নীরবে".........

Address

Fulbaria

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when সাহিত্য অঞ্জলি - Shahitto Anjoly posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share

Category