Ginni pandey

Ginni pandey Funny and daily content

25/11/2023
19/07/2023

ভার্সিটির হোস্টেলে উঠার দুই সপ্তাহ পর আমার রুমে আসে রায়হান।
তখন ভোর ছয়টা৷ দুই তিন টা ব্যাগ নিয়ে সজোরে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। আমি ভেবেছিলাম সিনিয়ররা ডাকছে। তড়িঘড়ি করে দরজা খুলতে গিয়ে লুঙ্গি প্রায় খুলেই যাচ্ছিলো।
রায়হানের কাঁধে দুইটা আর হাতে দুইটা ব্যাগ।

মেয়েরা এত ব্যাগ নিয়ে আসে জানতাম। ছোট থেকেই মামার বাসায় বড় হওয়ার বিভিন্ন হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছি। অনেক রুমমেট পেয়েছি। কিন্তু এত ব্যাগ পত্তর নিয়ে হোস্টেলে আসতে এই প্রথম রায়হান কে দেখলাম।তাও সব নিজের কাপড় চোপড়।

আমি তাকিয়ে আছি দেখে, চুইংগাম চিবোতে চিবোতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-তাকিয়ে আছিস কেন? আগে নিজের লুঙ্গি ধর তারপর আমার ব্যাগ ধর।
আর রুমে নাস্তা পানি কিছু আছে? নইলে চল হোটেলে গিয়ে নাস্তা করে একটা ঘুম দিবো।

হাতের ব্যাগ গুলো আমার হাতে দিয়ে কাঁধের ব্যাগ গুলো ওর জন্য রাখা অন্য বেডের উপর ফেলল।
ব্যাগ রেখে বসতে না বসতে ওর ফোন এলো। খাটে বসা অবস্থায় ফোন ধরে ধপাস করে বেডে পড়ে গেল। আর বলল,
- হ্যাঁ আম্মু, আমি পৌঁছেছি। এইবার চিন্তা করিও না। সারারাত ঘুমাও নি। জেগে ছিলে আমার সাথে। এইবার ঘুমাও। আমিও ঘুমাব।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, নাস্তা করেই ঘুমাব। টেনশন করিও না।
রুমমেট? হ্যাঁ আছে আছে৷ ভালো হবে না কেন? অবশ্যই হবে, নইলে ভালো করে ফেলব। তুমি চিনো না তোমার ছেলে কে?
রাখো। ঘুমাও কিছুক্ষন।

আমি হাসি দিলাম। হোস্টেলে এলে প্রথম প্রথম সবাই মাম্মাস বয় থাকে। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতে এরা মাকে ফোন দিতেই ভুলে যায়৷
কিন্তু রায়হানের ব্যাপারে এই ধারণা টা আমার ভুল ছিলো।

রায়হান সারাদিন ক্লাস শেষে আড্ডা দিয়ে নয় টা থেকে দশটা অবধি একঘন্টা ওর মায়ের সাথে কথা বলতো৷
হে হে করে হাসতো, ওর ঘরের টপের কথা,বিড়ালের কথাও জিজ্ঞেস করতো। সারাদিন কুল হয়ে চলা, রাজনীতির আলোচনা, বির্তক কিংবা গানের আসর জমিয়ে রাখা যে ছেলেকে আমি বাইরে দেখতাম রুমে ঢুকার পর যখন সে তার মায়ের সাথে কথা বলত এই ছেলের সাথে আমি মেলাতে পারতাম না।
শুধু আমি নয় অনেক ছেলেই ওর এই ব্যাপার টা দেখতো।

আমাদের তিন টা শার্ট, দুইটা গেঞ্জি আর দুইটা জিন্স দিয়ে পুরো বছর চলে যায়। এই গুলো দিয়ে ক্লাস, অনুষ্ঠান , প্রাইভেট সব চলতো৷
কিন্তু রায়হানের সব গুলোর জন্য আলাদা আলাদা শার্ট, গেঞ্জি ছিলো।
একটা কাপড় ও সে ধুতো না। এক মাস পরে সব ব্যাগে ভরে বাড়িতে নিয়ে যেত।
আবার এক ব্যাগ ভর্তি ধোয়া, আয়রণ করা শার্ট প্যান্ট নিয়ে আসতো।
আর আসতো একটা সুটকেস। লালচে মেরুন রঙের মাঝারি সাইজের একটা সুইটকেস।
ওটাতে কোন কাপড় চোপড় থাকতো না। থাকতো নানা রকমের খাবারের জিনিস।
বিভিন্ন রকমের শুকনা পিঠা, নানা রকমের আচারের বয়াম, বিস্কিট, বাদাম, চকলেট, ড্রাই ফ্রুটস আরো কত কি। মাছ ভাজা, ভুনা করা মাংস।

আমি প্রথম দিন দেখে বলেছিলাম,
-এইটা কি?

রায়হান একগাল হেসে বলেছিলো,
- আম্মুর সুটকেস।

রায়হানের এই আম্মুর সুটকেস আমার কাছে ছিলো গুপ্তধনের মতো, ছাপোষা মামার বাড়িতে বড় হওয়ায়, মা কোন দিন ভালোমন্দ দিতে পারে নি। হোস্টলে হোস্টলে বড় হয়েছি , ভালো খাবার আর নাস্তা বলতে টিউশনিতে মাঝেমধ্যে যা পেতাম তাই দুনিয়ায় সেরা খাবারের একটা মনে হতো।

রায়হান একা কিছু খেতো না। আমাকে দিতো। আর বলত যখন খিদে লাগবে খেয়ে নিবি।
তালা থাকত না শুধু চেইন টানা থাকতো। প্রথম প্রথম সংকোচ হলেও পরে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো।
রায়হানের আম্মু সুটকেস টা আমার আর ওর বেডের মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় থাকতো। এইটা আমাদের আলনা হিসেবেও ব্যবহার হতো।

মাসের শেষের দিকে সুটকেস খালি হতো৷ রায়হান মাসের শেষ বৃস্পতিবার বাড়িতে যেত। যত কাজ, ক্লাস অনুষ্ঠান থাকুক না কেন ওকে যেতে হতো। ওর পুরো মাসের ময়লা কাপড় আর ওর আম্মুর সুটকেস টা নিয়ে বাড়ি ছুটতো।
এত বড় বড় ব্যগ নিয়ে সে কীভাবে যেত কীভাবে আসতো আমি জানতাম না।
একবার ভার্সিটির সিনিয়রদের ফেয়ারওয়েল ছিলো। সবাই নাচে গানে ব্যস্ত।
সে রাতের এগারোটায় ব্যাগ আর সুটকেস টা নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত রাতে কই যাস?দরকার হলে কাল চলে যাবি।

ভীষণ ব্যস্ত ভাবে বলে,
-আম্মুকে জানানো হয় নি যাবো না এইটা। কল ও যাচ্ছে না। সারারাত বসে থাকবে আমার জন্য। আমি ভোরে পৌঁছে যাব।

সে চলে গিয়েছিল। সেদিন রাতে আমার ঘুম হয় নি৷ শুধু মনে হচ্ছিলো রায়হান অনেক ভাগ্যবান। মায়েরা সন্তান দের তো ভালোবাসে আমরা এইটা স্বাভাবিক ভাবে নিই। কিন্তু সন্তানরেরা মাকে এইভাবে ফিরতি ভালোবাসতে পারে এইটা ভাগ্যের ব্যাপার।
কিছু ভাগ্যবান মানুষ ফিরতি ভালোবাসার ভাগ্য নিয়ে জম্মায়।
রায়হানের থেকে দেখে আমিও মাকে প্রায় ফোন দিতাম।
প্রথম প্রথম কথা খুঁজে পেতাম না কি বলব, আস্তে আস্তে বলতে বলতে মনে হলো মাকে অনেক কথায় বলা যায়।
শনিবার সকালে রায়হান ঠিক তার আয়রণ করা কাপড়ের ব্যাগ আর রায়হানের আম্মুর সুটকেস নিয়ে ফিরে আসে।

রায়হান বলে এইবার তোর জন্যেও আলাদা আলাদা সব দিয়েছে আম্মু।
খুলে দেখলাম যা যা দিয়েছে সব দুইটা করে পাঠিয়েছে।
আস্তে আস্তে তা নিয়ম হয়ে গেল। রায়হানের আম্মুকে আমি কখনো দেখি নি। আমার কাছে রায়হানের আম্মুর ভালোবাসা মানেই ছিলো রায়হানের আম্মুর সুটকেস টা।

আমার অনেক খরচ বেঁচে যাচ্ছিলো, আর আজেবাজে খাবার না খাওয়াতে অসুস্থও কম হচ্ছিলাম।

একদিন দেখলাম রায়হান ওর আম্মুর সাথে অনেক ক্ষন ধরে বকবক করে টাকা চাইছে। ওর এক জোড়া জুতা পছন্দ হয়ে ছাব্বিশ টাকা। ওর সেটা লাগবে।
অনেক বুঝানোর পর ওর মা টাকাটা পাঠাতে রাজি হয়েছে।
রায়হান টিউশনি করে না। করলেও মাস দুই মাসের বেশি না।
যদিও করে তা দিয়ে ওর মায়ের জন্য কিছু নিয়ে যাবে আগে।

রায়হান ফোন রাখার পর আমি ওকে বললাম,
- জুতা কেনার জন্য না বলে বই বা ভার্সিটির ফি এর জন্য বললে তো এত কথা বলতে হতো না।

রায়হান ঘাড় বেঁকিয়ে অবাক হয়ে বলে,
- মিথ্যা বলতাম?

বাম হাতে মোবাইল ধরে ডান হাতে তুড়ি মেরে বলে,
- আমি মিথ্যা বললে, এইভাবে এইভাবে তুড়ি মেরে ধরে ফেলবে। আর আমি আম্মুকে কোন দিন মিথ্যা বলি নি। সত্য বললে যখন সব পাই মিথ্যা বলার দরকার কি?

কেমন যেন অবাকই হলাম, আমাদের ছাপোষা ঘরেও আমাকে যা চেয়েছি দিয়েছে তাও যখন অতিরিক্ত কোন টাকা লাগে তখন মিথ্যা বলে নিই।

রায়হানকে সারাদিন অন্য সব ছেলের সাথে আলাদা কোন অমিল পেতাম না আমি, ক্লাস, মিছিল, মিটিং, প্রেম করা, ক্লাস ফাঁকি দেওয়া। আড্ডা দেওয়া, ট্যুর দেওয়া। পরীক্ষার আগের দিন রাত জেগে পড়াশোনা করে কোন মতে পাশ করা। সব যেন একই অন্য সব ছেলের মতো।

শুধু ও যখন মায়ের সাথে কথা বলতো আমার তখন মনে হতো আমি আমার ক্লাস টু'য়ে পড়া আমার ছাত্র সাব্বির কে দেখি। সেও পড়তে বসলে তখন এইভাবে গল্প করে ওর মায়ের সাথে।
একদিন সবাই মিলে আমাদের রুমে পার্টি করছিলাম। আমরা দশ বারো জন। আড্ডা হচ্ছিলো, কার্ড খেলা হচ্ছিলো। গান হচ্ছিলো। রায়হান গিটারে সুর তুলে গান গাইছিলো।

ওর ফোন আসায় ও আসর ছেড়ে উঠে এলো। আমাদের কে ইশারায় চুপ হতে বলল,
তাও আওয়াজ হচ্ছিল।

-হ্যালো আম্মু! কে? আব্বু? তুমি? আম্মু -? কি হয়েছে?

ও শোনার চেষ্টা করছে। তখন চেঁচিয়ে উঠলো,
- থামবি তোরা?

-কি? আম্মুর কি হয়েছে? ব্যাথা পাইছে? এ্যাঁ? শুনতে পাচ্ছি না কি বলছো।

পুরো ঘর যেন ঠান্ডা হয়ে গেল।।আমার বুক কেমন যেন ধুপ ধুপ করছিলো। না চাইতেও মনে কিছু আসছিলো। যেন খুদে কচুরিপানা সড়িয়ে দিলে আবার ফেরত আসছে। আমি তো রায়হানের কাছে ওর মা কী।

আমি তাড়াতাড়ি উঠে যাচ্ছিল। তার আগেই হাত থেকে মোবাইলে ধুম করে ফ্লোরে পড়ে গেল রায়হান।

সবাই হুড়োহুড়ি করে উঠে এসে ঘিরে ধরলো রায়হান কে।
আমি মোবাইল কানে দিলাম,
ওপাশ থেকে কান্না জড়ানো স্বরে কে যেন বলছে,
- কাল যোহরের পর জানাজা,

বাকি কথা আমি শুনলাম না। সবাই রায়হান কে ডাকাডাকি করছে। মুখে পানি দিচ্ছে।
রায়হানের আম্মুকে আমি কখনো দেখি নি আমার কাছে রায়হানের আম্মু মানেই ছিলে মেরুন রঙের সেই সুটকেস টা। সুটকেস টা রায়হান যেখানে পড়ে আছে তার দুইহাত দূরে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অপলক তাকিয়ে আছি।
যত বার রায়হানের আম্মুর বানানো খাবার খেয়েছি ততবার মনে হতো উনি মাথায় হাত বুলিয়ে খাবার খাওয়াচ্ছেন।

সুটকেস টার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ে শার্ট ভিজে যাচ্ছে আমার জানা নেই।

রায়হান কে সবাই ডাকছে কারণ আমরা সবাই ততদিনে যেনে গিয়েছি রায়হান কেমন মা পাগল ছেলে৷ আমরা ওকে মাম্মাস বয় ডাকতাম।

সেদিন রায়হান কে আমরা সবাই কীভাবে নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা জানি না। রায়হানের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছিল আকাশা বাতাস পুরো ঘর।

রায়হান কখনো না বললেও আমার সব সময় মনে হতো রায়হান অনেক পয়সাওয়ালার ছেলে। ওর কাপড়চোপড় খাবার দাবার দেখে আমার মনে হতো বড়লোক বাপের আদরের ছেলে।
কিন্তু ওদের ঘরে গিয়ে দেখলাম তেমন না। আর পাঁচ টা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই ওদের ঘর। চার ভাই তিন বোন। তার মধ্য রায়হান সবার ছোট ছিল। অন্য সব ভাই বোনের সাথে রায়হানের বয়সের পার্থক্য প্রায় দশ পনের বছরের।
তাই হয়ত মায়ের এত কাছের ছিলো রায়হান।
যার কাছে মা আছে এমন যত্ন করার। সে তো সত্যিই অনেক বড়লোক।রায়হানের বাবা, ভাই বোন, ভাবী সবাই এক সাথেই থাকতো। কারো সাথে কোন খারাপ সর্ম্পক নেই। কিন্তু রায়হানের মুখে কারো নাম কোন দিন শুনি নি। শুধু ওর আম্মুর কথায় বলতো। আমি ভাবতাম মা বাবার আদরের একমাত্র ছেলে সে।

রায়হান কে রেখে এলাম আমরা। কিন্তু আমার মন পড়ে আছে সেখানে। রায়হান কি করবে এখন?
রুমে ফিরে রায়হানের আম্মুর সুটকেসটার উপর চোখ পড়লেই কেঁপে কেঁপে উঠছি। মুখে হাত দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠছি।

দশ দিন পর রায়হান ফিরে এলো। উস্কখুস্ক চুল নিয়ে। মুখ ভর্তি দাড়ি নিয়ে।
এসেই বিছানায় পড়ে রইলো এক সপ্তাহ, আমি টেনে তুলে খাওয়াতাম। কোন বেলা খেত, কোন বেলা মুখেই খুলতো না। আমিও ওকে ফেলে খুব একটা রুম থেকে বের হতাম না। কিন্তু পরের মাসেই ফাইনাল পরীক্ষা।আমাকে ক্লাসে কোচিং এ ছুটতে হচ্ছে।
এক বিকেলে রুমে ফিরে দেখি বেডে বসে আছে রায়হান।
খুব একটা কথা হয় নি। ওর হাতে খাতা কলম মোবাইল কোন কিছুই উঠে নি পনের দিন। বন্ধুরা এসে রুমে একটু দেখে গেসে। কেউ কথা বলার সাহস করে নি।

আমি ওর পাশে বসে বললাম,
-এইবারের পরীক্ষাটা ড্রপ করবি-
বাকি কথা আমি বলতে পারলাম না। তার আগেই মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠলো রায়হান৷
-না। আমার পড়াশোনার জন্য মা আমাকে এইখানে পাঠিয়েছে। পড়াশোনার জন্য মাকে আমি শেষ মূহুর্তে একবার দেখতে পারি নি। এত কিছু করেছে মা।
পরীক্ষা আমি দিব।

বলতে বলতেই উঠে গেল সে। পরের দিন থেকে ঠিকঠাক হয়ে মোটামুটি আবার পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়। সবকিছু মোটামুটি স্বাভাবিক দেখতে মনে হলেও ওর সেই উচ্ছ্বাস টা আর নেই।
বেপোরোয়ো বেখেয়ালি আচরণ আর নেই। উড়ন্ত প্রজাপতি টা কেমন নিস্তেজ হয়ে গেল।

মাঝেমধ্যে মধ্য রাতে ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেতাম। মশারির ভেতর থেকে দেখতাম। রায়হান ওর আম্মুর সুটকেস টার সামনে বসে আছে।

উঠে সান্ত্বনা দেওয়ার সাহস আমার হতো না। আমিও যে তাকিয়ে থাকি মাঝেমধ্যে আমার গুপ্তধন পাওয়া সেই সুটকেসের দিকে।
রায়হান আর মাসের শেষে ব্যাগ আর সুটকেস নিয়ে বাড়ি যায় না। সেটা ভর্তি হয়ে আর আসে না।

এক বিকেলে রায়হান আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকে বলে,
- শাওন, কাপড় কীভাবে ধোয়? পানি দিয়ে সবান দেয় যে? তারপর কি করতে হয়?

আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। হোস্টেল লাইফ প্রায় শেষের পথে এই চার বছরে সে একবার ও কাপড় ধুয় নি আমার মনে হলো এখন। আর কেন সেটা মনে পড়তেই বুক ভারী হয়ে উঠে।

চারিপাশে তাকিয়ে সে বলে,
- সব ময়লা হয়ে আছে, কাল একটা কাজ ছিলো তাই শার্ট টা-
এত দিন সব আম্মু -
বাকি কথা শেষ করতে পারে না।

আমার একবার ও মনে হলো না আন্টি ওকে কিছু শেখায় নি। আমার কেন যেন মনে হলো আন্টি চায় নি ও কিছু শিখুক। আন্টি চাইতো ওর সব কাজে ওর থেকে ওর আম্মুকে লাগুক।

রায়হান কেমন যেন আস্তে আস্তে সব শিখে নিতে শুরু করলো। আমার ভালো লাগার কথা ছিলো কিন্তু আমার বুক ভারী হয়ে আসতো।

রায়হান আর বাড়িতে যেত না। কোন কিছু লাগলে কাউকে ফোন দিতো না।
আমাদের কাছে ধার চাইতো। ওর বাবা নিজ থেকে টাকা পাঠাতো। দিয়ে গেলে নিতো। কিন্তু খুঁজে নিতো না।

টিউশনি শুরু করে। আমারা পরীক্ষার পর হল ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়।
স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে যাওয়ার জন্য সারাদিন দৌড়াতে থাকে রায়হান।
হয়েও যায় সব। রায়হান যেন দেশ ছেড়ে পালাতে চায়।
যে ছেলে হোস্টেলে এসেছিল চারটা ব্যাগ কাঁধে সে ছেলে দেশ ছেড়ে চলে গেল দুইটা শার্ট আর একটা প্যান্ট একটা ব্যাগে ভরে।

রায়হান যাওয়ার সময় অনেক বার ওর আম্মুর সুটকেস টায় হাত বুলায়। ওর কাছে মায়ের স্মৃতি হিসেবে এই সুটকেস টা রয়ে গেল। প্রতিমাসে একবার এইটা টেনে টেনে নিয়ে যেত আবার নিয়ে আসতো। তার কাছে এই খালি সুটকেস এখন বিশাল মনে হচ্ছে। এত বড় সুটকেস নিয়ে সে কোথায় যাবে? তাই আমাকে বলল একটু রাখিস তোর কাছে যত দিন পারিস। অন্য কেউ পেলে কি করে, ছিড়ে টিরে ফেলবে।

আমি শক্ত করে ধরে বলি,
-সামলে রাখবো। আমিও যে গুপ্তধনে সন্ধান পেয়েছিলাম এইখানে।

যাওয়ার সময় শুধু আমি দিয়ে আসি রায়হান কে। আর কোন বন্ধু ওর হয়ে উঠে নি। ফ্যামিলির কাউকে আমি আর দেখি নি।

রায়হান যাওয়ার পর আমি একটা মেসে উঠি। তারপর একটা ছোটখাটো চাকরি ধরি৷ এক রুমে বাসা নিই।
বছর তিনেক পর মায়াকে বিয়ে করি।
আমাদের নতুন সংসার শুরু হয় নতুন বাসায়। তখনো আমাদের সংসারের এক কোণায় অথিতি হয়ে থাকতো রায়হানের আম্মুর সুটকেস টা। মায়া জিজ্ঞেস করলে ওকে রায়হানের কথা বলেছিলাম। ওর মায়ের কথা। ওদের মা ছেলে সে ভালোবাসার কথা।

মায়াও কখনো কোন কাজে লাগায় নি সেটা। ওভাবেই পড়ে রইলো।
রায়হানের সাথে আমার যোগাযোগ এখনো আছে। আমার আর কোন বন্ধু হয় নি তেমন। রায়হান ওখানে বিয়ে করেছে ওর দুইটা মেয়ে। আমারো একটা ছেলে একটা মেয়ে।
ভালো চাকরি হয়েছে। ছোট বাসা ছেড়ে বড় বাসা এরপর নিজস্ব ফ্ল্যাট। সব জায়গায় আমি সাথে নিয়ে গেসি রায়হানের আম্মুর সুটকেস টাকে।

বারো বছর পার হয়ে গেল রায়হানের দেশের বাইরে যাওয়ার। এরপর এদেশ সেদেশ ঘুরে এখন সে কানাডায় সেটেল হয়েছে। আমাদের যেতে বলে। মায়া ও অনেক দিন ধরে বলছিলো। ঠিও করলাম এইবার কানাডায় যাবো।

রায়হানেই সব ঠিকঠাক করে দিলো। আমার তেমন কিছু কর‍তে হলো না।
আমি শুধু করলাম একটা কাজ। রায়হানের আম্মুর সুটকেস টা ভরলাম, যেভাবে আসতো আমার গুপ্তধন হয়ে ওটা।
নানা রকম খাবারে। আচারে। রায়হানের পছন্দের সব খাবারে৷যেসব খাবার রায়হানের মা পাঠাতো, যেসব ছোট মাছ, ইলিশ মাছ ভাজি করে দিতো আমি যেন সব নিয়ে নিলাম।

পুরো সময় সুটকেস টা আমি হাতে ধরে ছিলাম। যেন আমার কাছে রাখা গুপ্তধন আমি যক্ষ হয়ে এতোদিন রক্ষা করেছি এখন আমি তার দায়মুক্তি নিচ্ছি।
মেয়ে আমার বলেই উঠে এত ব্যাগ থাকতে আমরা এই পুরানো সুইটকেস টা কেন নিয়ে যাচ্ছি?

আমি চুপ করে থাকি।

কানাডায় পৌঁছার পর রায়হান আমাদের নিতে আসে তার ওর মেয়েরাও আসে।
আমাকে দেখে ভীষণ খুশি হয় সে।
এসে জড়িয়ে ধরে। ওর খুশিটা দেখে পড়ার মতো।
আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে ওর চোখ পড়লো সুইটকেস টার উপর।

ও প্রথমে চুপ হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো, ওর মুখ থেকে কোন শব্দ বের হচ্ছে না।

তারপর একবার আমার দিকে তাকালো। আমি আলতো একটা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বুক টা কেমন যে করছে তা বুঝাতে পারছি না।

ওর চোখ ভিজে উঠেছে। কিন্তু তাও সামলাচ্ছে নিজেকে।

আমি খুব যত্ন করে ওর হাতে সুইটকেস টা দিলাম।
ওর গলায় কান্না দলা পাকাচ্ছে। তারপর ও কোন মতে বলল, গাড়িতে উঠ।

ও সামনের সিটে বসে আছে। আমার ছেলে মেয়ে ওর মেয়ে, মায়া। সবাই হাসিতে মেতে উঠেছে। কিন্তু রায়হান চুপ। কোন শব্দ করছে না। আমি জানি এখন ওর বুকে কি গভীর থেকে জমানো ব্যাথা নলকূপের চাপের মতো বের হয়ে আসছে।

ওর ঘরে গিয়ে সবাই ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করল।
মায়া ওদের জন্য নিয়ে যাওয়া জিনিস গুলো বের করে দিতে থাকে।

সব শেষ করে আমি রায়হান কে বললাম,
-সুইকেট টা খোল।

রায়হান ফ্লোরে বসল, আগে যেভাবে হোস্টেলে এসে বসে রায়হান খুলতো ওর মায়ের সুইটকেস টা। পাশে বসতাম আমিও। কি এলো নতুন?

রায়হান কাঁপা কাঁপা হাতে চেইন খুলল, খুলতেই দেখল সব আগের মতো সাজানো।
রায়হান আর নিজেকে সামলাতে পারছে না। একবার আমার দিকে তাকালো তখন চোখ বেয়ে পড়তে শুরু করেছে, জমানো সব স্মৃতি গুলো৷ কাঁপা কাঁপা হাতে সব ছুঁয়ে দেখছে।

তারপর হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ওর স্ত্রী, মেয়েরা। আমার ছেলে মেয়ে সবাই নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রইলো।
রায়হান হিচকি দিতে দিতে,
-"আম্মু"
বলে ঝাপিয়ে পড়ল, রায়হানের ওর মায়ের সুইটকেস টার উপর। যেটা ছিলো আমাদের গুপ্তধন।

হারিয়ে যাওয়া মানুষ গুলোকে তো আমরা ফেরত পেতে পারি না। ওদের স্মৃতি মাখা জিনিস গুলোতে তাদের খুঁজে ফেরাকেই তো মায়া বলে।

#রায়হানের_আম্মুর_সুইটকেসটা

#দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা

18/07/2023

আমি কোনোদিন বাবাকে মায়ের গায়ের উপর হাত তুলতে দেখিনি। আজ হাত তুললেন। সম্ভবত মায়ের গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ বসে গেছে। কিন্তু মায়ের চোখে পানি নেই। মায়ের অগ্নিচোখ। রাগে দাঁতে দাঁত চেপে কিড়মিড় করছেন। অথচ বাবার ছলছলে চোখ। বাবা ভেজা গলায় বললেন,

"উঠতে বসতে যে জোছনার খোটা দেও, সে আজ মরে গেছে। এবার খুশি তো? এখন থেকে অন্তত আমাকে রেহাই দেও।"

জোছনা নামটা আমি আজ প্রথম শুনিনি। আগেও বহুবার মায়ের মুখে শুনেছি। মা বাবার সাথে একটু রেগে গেলেই জোছনার নাম উঠে। আমি দুয়েকবার জানতে চেয়েছিলাম মায়ের কাছে, কে এই জোছনা? মা মুখে ভেংচির আকৃতি এনে ভাষাকে বিকৃতি করে বলেছিল,

"তোর বাপের নাঙ লাগে। আমারে বিয়ে করার আগে জোছনার লগে তোর বাপের পিড়িত ছিল।"

বাবা মাথা নিচু করে সেদিন আমার সামনে থেকে চলে গিয়েছিল। বুঝাই যাচ্ছে, নিজের ছেলের সামনে তিনি বেশ অপমানিত হয়েছেন।
বাবার জন্য আমার বড্ড মায়া লাগে। মায়ের এই অকথ্য ভাষার প্রতিবাদ বাবা কোনোদিন করেননি। কিন্তু আজ প্রতিবাদ করেছেন। প্রতিবাদের ভাষা ছিল সজোরে একটি থাপ্পড়। বিগত এত বছরের রাগ ক্ষোভ বাবা একটি থাপ্পড়ে কমাতে পেরেছেন তো? আমি দুপুরের খাবার খেতে বসেছি, মা তরকারি দিচ্ছিলেন। বাবা এলেন হঠাৎ ঘরে। তখনি মায়ের হুংকার!

"আমারে ঘুমে রাইখা কাউরে কিছু না কইয়া জোছনার কাছে গেছিলা? কইয়া গেলে কী হইতো? না করতাম আমি? এত বছরেও না কইরা ফিরাইতে পারছি?"

বাবা এগিয়ে এলেন। কষে থাপ্পড় দিয়ে জোছনার মৃত্যু সংবাদ প্রকাশ করলেন। এমতাবস্থায় আমার গলা দিয়ে আর ভাত নামবে না। বাবা ঘর থেকে চলে গেলেন। মায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, মৃত্যু সংবাদ শুনে রাগ একটু কমেছে। আমি খাবার রেখে নলকূপে হাত ধুয়ে ফেলেছি। মনটা কেমন খারাপ লাগছে। বাবা যে আজ আড়ৎ এ যাবেন না, বুঝাই যাচ্ছে। তার চেয়ে ভালো আমি আড়ৎ এ গিয়ে বসি। কাস্টমারকে চাউল দিতে দিতে মনটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখা যাবে।

রাত তখন বারোটা হবে। আমি বই পড়ছিলাম। হুমায়ূন স্যারের 'মিশির আলি সমগ্র।' বইয়ের 'তন্দ্রা বিলাস' আমার দুই চোখের তন্দ্রা কাটিয়ে দিলো। দরজায় ঠকঠক। দরজার ওপাশ থেকে বাবার গলার শব্দ।

"শাওন, ঘুমিয়ে পড়েছিস?"

আমি কোনো জবাব না দিয়ে দরজা খুলে দিলাম। বাবা ঘরে ঢুকে আমার বিছানায় বসতে বসতে বললেন,

"ঘুমাসনি এখনো! তোর সাথে গল্প করতে এলাম। বাপ-বেটার গল্প অন্য কারো শুনতে হয় না। তাই এখন এলাম। তোর সমস্যা হবে না তো?"

আমি মুচকি হেসে বললাম,

"না বাবা। আমার আরো ভালো লাগছে যে তুমি এসেছো। আজ এই ঘরেই ঘুমাও। মায়ের ব্যবহারে মন খারাপ করে থেকো না।"

বাবা পা তুলে আয়েশ করে বসলেন। ইশারায় আমাকে চেয়ার টেনে কাছে যেতে ইঙ্গিত করলেন। আমি কাঠের চেয়ার নিয়ে বাবার মুখোমুখি বসলাম। বাবা আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন,

"তোর অনেক কিছু জেনে রাখা দরকার। আমি তোকে জানাতে চাই। আগেও জানাতে চেয়েছি, সাহস হয়নি। ভেবেছি তোর মা যেমন অকথ্য ভাষায় কথা বলে, হয়তো তোর জানা হয়ে যাবে। কিন্তু তুই জানিস না কিছুই। শুধু একটি নাম জানিস, জোছনা। তুই এই নামটি তোর মায়ের মুখে শুনেছিস। যতবার শুনেছিস আমি লজ্জা পেয়েছি। বলতে পারিনি কিছু। আজ বলব।"

আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে বাবার গল্প শুনছি। যে নাম নিয়ে মায়ের অকথ্য ভাষা, বাবার লজ্জা পাওয়া। অজানাকে জানতে অবশ্যই মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। বাবা একনাগারে গল্প বলছেন। লুকায়িত এক গল্প।

"তোর মায়ের মুখে জোছনা নাম শুনে হয়তো ভেবেছিলি, আমার অন্য কারো সাথে কোনো সম্পর্ক আছে। সত্য হলো, জোছনার সাথে আমার কোনো অবৈধ সম্পর্ক নেই। জোছনা আমার বিয়ে করা প্রথম স্ত্রী ছিল। তোর দাদা দাদি পছন্দ করে বিয়ে করিয়েছেন। তোর দাদার বাড়ির কাছেই। আমরা যে এত বছর ধরে তোর দাদা দাদিকে রেখে শহরে থাকি, তার একটি কারণ এই জোছনা। তোকে নিয়ে যে প্রতিবার তোর দাদার বাড়ি যেতাম, আমি তোর সাথে সাথেই থাকতাম। যেন আমাদের গ্রামের কারো কাছ থেকে এই বিষয়ে কিছু শুনতে না হয়। তোর খারাপ লাগতে পারে শুনলে। তোর দাদা-দাদি মারা যাওয়ার পর গ্রামে খুব একটা যাই না। তোর মা সব জানে। তবুও তোকে বলেনি, যে আমি আগেও একটি বিয়ে করেছিলাম। আমার আর জোছনার একটি সন্তানও আছে। নাম ফাল্গুনী। তোর সৎ বোন ফাল্গুনীর মতো তোর নামটাও বাংলার বারো মাসের একটা নাম। গ্রামে আমরা শ্রাবণ মাসকেই শাওন মাস বলি। তোর মা আমার দ্বিতীয় স্ত্রী। সে যাই হোক। জোছনার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর সে পরবর্তীতে আবার বিয়ে করে এক স্কুল মাস্টারকে। তোর দাদার বাড়ি থেকে কয়েকটা গ্রাম পরে। আট বছর সংসার করলেও আর কোনো সন্তানাদি হয়নি। স্কুল মাস্টার মারা গেলেন চার সালের বন্যায়। আমি সব খোঁজই রাখতাম। রাখার কারণ ফাল্গুনী, আমার মেয়ে। আমি তাকে আমার কাছে রাখতে পারিনি। মাস্টার মারা যাওয়ার পর সেই সংসারে টানাটানি অবস্থা। আল্লাহ আমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন। কয়েকটা সংসার চালানোর তৌফিক দিয়েছেন। আমি প্রতি মাসেই যাই সেই এলাকায়। কাউকে দিয়ে খবর পাঠালে ফাল্গুনী আসে। বাবা বলে এসে জড়িয়ে ধরে। কতশত বায়না তার। আমি আসার পথে পুরো মাসের খরচ দিয়ে আসি ফাল্গুনীর হাতে। তোর মা এসব জানে। আমি গোপন করি না তোর মায়ের কাছে। আমি ফাল্গুনীর জন্মদাতা। সে আমার কাছে মেয়ে হিসেবে পাওনা। আমি তা দেবই। আমি ফাল্গুনীর মায়ের সাথে দেখা করি না। দেখা করাটা বেমানান। লোকে মন্দ বলবে। তাই লোক মারফত ফাল্গুনীকে ডেকে আনি। আর এখন তো নরসিংদী সরকারি কলেজেই অনার্স শেষ করবে এই বছর। এখন তো কলেজে গেলেই মেয়ের সাথে দেখা করতে পারি।
কিন্তু ঐ যে, আমি তোর মায়ের কাছে কোনোকিছু লুকাই না। তোর মা মনে করে আমি হয়তো ফাল্গুনীর মায়ের সাথেও দেখা করি। এজন্যই রাগের মাথায় দুই চারটে কথা শোনায়। এতে আমার খারাপ লাগে না। শুনতে শুনতে অভ্যেস হয়ে গেছে। কিন্তু তুই.... "

"বাবা এক মিনিট....."

আমি বাবাকে থামিয়ে প্রশ্ন করলাম,

"এত বড়ো জীবন ঘটিত বিষয়টা মায়ের কাছেও লুকিয়ে রাখো না। তাহলে আমি শুনলে কী সমস্যা বাবা?"

বাবা উত্তরে বললেন,

"আসলে আমি চেয়েছিলাম তুই বড়ো হলে সব বলব। তোর মানসিক বেড়ে উঠাতে মস্তিষ্কে কোনো প্রভাব পড়ুক, সেটা চাইতাম না। কিন্তু ভুলেই গিয়েছিলাম, যথেষ্ট বড়ো হয়েছিস। ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে আর পড়লি না। ফাল্গুনী শুনেও কষ্ট পেয়েছে। ওহ হ্যাঁ, ফাল্গুনী কয়েকবার বলেছিল তোকে সব জানাতে, আমি সাহস পাইনি। তবে বিশ্বাস কর, ফাল্গুনীর মায়ের সাথে আমি দেখা করতাম না কখনো। কিন্তু আজ মৃত্যু সংবাদ শুনে না গিয়ে থাকতে পারিনি। তার উপর তোর মায়ের এমন কথাটুকু সহ্য হয়নি। তাই..."

আমার কোনো ভাই-বোন নেই, এমন একটি আক্ষেপ ছিল সবসময়। আজ বাবার মুখে শুনলাম আমার একটি বোনও আছে। আমার বড়ো আপু। নাম ফাল্গুনী। কোনোদিন দেখিনি। বাবা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখ দুটো ছলছল। জোছনা নামের মানুষটির জন্য বাবার চোখে পানি। থাকাটা স্বাভাবিক। আমি বাবাকে প্রশ্ন করলাম,

"তোমাদের ছাড়াছাড়ি কেন হয়েছিল বাবা?"

বাবা দেয়াল থেকে দৃষ্টি আমার দিকে দিলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

"যে মানুষটা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে, তার সম্পর্কে কিছু না বলাই উত্তম। এতটুকু জেনে নে, আমাদের মনের মিল ছিল না। তবে বুঝতে একটু দেরি হওয়াতে সাড়ে চার বছর সংসার টিকেছিল। পরে আর টিকেনি। ফাল্গুনীকেও নিয়ে গেছে, আমার কাছে কোনোভাবেই রাখতে পারিনি। জোর করলে হয়তো পারতাম। আইনে গেলে ফাল্গুনীকে রাখতে পারতাম। থানা পুলিশ করে কোর্টে গিয়ে এতসব করতে ইচ্ছে হয়নি।"

আমি কিছু বলতে যাব, তার আগেই বাবা কীভাবে যেন প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

"মেঘনা দিয়ে এক ট্রলার ভর্তি চাউল আসার কথা। মুন্সিগঞ্জ বাজারের পরিচিত পাইকারদের থেকে কিনেছি। সন্ধ্যায় আসার কথা। রাত নয়টা অবধি বসেছিলাম, আসেনি। দোকানের আওলাদের কাছে নাম্বার আছে। সকালে আড়ৎ এ গিয়ে একটু খোঁজ করিস তো। আসলে রশিদ দিবে, টাকা দিয়ে দিস।"

কথাটুকু বলে বাবা উঠলেন। উঠে সাথে সাথে চলে গেলেন না। একটু দাঁড়িয়ে থেকে আবার বললেন,

"রাত একটা বেজে যাচ্ছে। জেগে থাকিস না, ঘুমিয়ে পড়। সকালে আড়ৎ এ যাবি।"

বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি চেয়ার আগের জায়গায় নিয়ে এলাম। আজ আর 'তন্দ্রা বিলাস' পড়ে শেষ করা হবে না। বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।

ঠিক এক সপ্তাহ পরে বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। আমি আড়ৎ এ ছিলাম। খবর পেয়ে ছুটে এসেছি বাড়িতে। বাড়ি ভর্তি মানুষ। কেউ মারা গেলে পরিচিত সবাই শেষ দেখা দেখতে আসে। মা বিলাপ করে কান্না করছেন। মায়ের মুখেই শুনতে পেলাম, সকালে শুধু বলেছিলেন বুকটা ব্যথা করে। মা ভেবেছেন খাওয়ার পর হয়তো এমনিতেই ব্যথা করছে। তাছাড়া ব্যথা ততোটা বেশিও না। কিছু না বলে বাবা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন। আমার মাথার উপর বটগাছের ছায়া ছিলেন। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। এত বড়ো পৃথিবীতে নিজেকে একা লাগছে। আমার দুই চোখ বেয়ে অঝরে পানি পড়ছে। সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এলেন এলাকার কয়েকজন। মানুষের সামনে কান্না করাটা অন্যসময় হলে লজ্জাকর পরিস্থিতী হতো। কিন্তু এখন লজ্জা লাগছে না। শুধু পানি পড়ছে। এক এক করে সব আত্মীয় স্বজন এলো। শেষ বিদায়ের আয়োজন চলছে। বরই পাতার গরম পানি বসানো হয়েছে। কবর খুঁড়তে লোক গেছে কবরস্থানে। পাশের বাড়ির একজন আমাকে সাথে করে নিয়ে গেলেন কাফনের কাপড় কিনতে। এ যেন এক অনুষ্ঠান চলছে। শেষ বিদায়ের অনুষ্ঠান।

বাবা মারা যাওয়ার মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। আমি আড়ৎ এ বসে আছি। বাবার অবর্তমানে দায়িত্ব বেড়ে গেছে। হঠাৎ আমার অবচেতন মনে ক্ষানিকটা ধাক্কা লাগল। ফাল্গুনী!
আমার একটা মাত্র বোন। বাবার মেয়ে। তাকে তো খবর দেওয়া হয়নি। আমার কাছে তো ফোন নাম্বারও নেই। বাড়িও চিনি না কোন গ্রামে থাকে! বাবাকে শেষ দেখা হয়নি তার। এটা তো তার প্রতি মস্ত বড়ো অন্যায় হয়েছে। মায়ের কাছে কি আপুদের বাড়ির ঠিকানা আছে? না, মা'কে কিছু বলা যাবে না। দাদার বাড়ির কেউ কি জানে?
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল, বাবা বলেছিলেন ফাল্গুনী আপু নরসিংদী সরকারী কলেজ থেকে এবার অনার্স শেষ করবেন। আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। একটা বড্ড ভুল হয়ে গেল। আপুকে বাবার মৃত্যু সংবাদ জানানোটা দরকার ছিল।

নরসিংদী সরকারি কলেজের দক্ষিন দিকে অনার্স ভবন। আমার পরিচিত কেউ নেই এখানে। অনার্স ভবনের সামনে অনেকেই আছে। আমি এগিয়ে গেলাম। সবাই বয়সে আমার বড়ো। একসাথে তিন চারজন কথা বলছে দাঁড়িয়ে। আমি গিয়ে সালাম দিলাম। জানতে চাইলাম, অনার্স শেষ বর্ষের ফাল্গুনী নামের কাউকে চিনে কি-না! সাথে সাথে একজন ডানদিকে তাকিয়ে একটু গলাটা উঁচিয়ে বলল,

"এই ফাল্গুনী, তোকে কেউ খুঁজতে আসছে।"

আমার চোখদুটো যেন অপেক্ষা সইছে না। কেউ একজন এগিয়ে আসছে। আমার তিন চার বছরের বড়ো হতে পারে। দেখতে খুবই সুন্দর। ইচ্ছে করছে এখনি চিৎকার করে বলি, আপু আমি তোমার একমাত্র ভাই শাওন। কিন্তু বলতে পারিনি। আমার গলার স্বর কি ভেজা? বুঝতে পারছি না।

"আমাকে খুঁজছ? কে তুমি?"

আপুর কথায় কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। আসলে কে আমি? পরিচয়ের শুরুটা কীভাবে করব? মুখ ফুটে বললাম,

"আপু, আপনার সাথে কিছু কথা আছে। খুব জরুরী। একটু এদিকে আসবেন?"

অনার্স ভবনের সামনে দুর্বা ঘাসে শীতল পাটির মতো বিছানা পাতা। আমি আর আপু ঘাস মাড়িয়ে মাঠের মাঝখানটায় গেলাম। আপুর কৌতূহলী চোখ। হঠাৎ বললাম,

"আমি চিনিশপুর থেকে এসেছি। আমার নাম শাওন।"

কথাটুকু বলে আপুর দিকে তাকালাম। আপু নির্বাক। চোখের পলক পড়ছে না। চোখদুটো ভিজে উঠল আমার সামনে। আরেকটু এগিয়ে এসে আপু আমার কাঁধে হাত রাখল। তারপর মাথায়, তারপর গালে। এই স্পর্শ কত শীতল, কত মায়ায় ভরা। টলমল চোখ, ভেজা গলায় আপু বলল,

"তোমাকে দেখার ইচ্ছে ছোটোবেলা থেকে। আমার একটা ভাই আছে, আর তাকে আমি কখনো দেখিনি। এই কষ্টটা আমার অনেক বছরের। কত বড়ো হয়ে গেছো তুমি।"

আমার দৃষ্টি নিচের দিকে। ইচ্ছে করছে নিজের চোখের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করি। আমার চোখ থেকে এখন যেন কোনো পানি না পড়ে। আমি শত বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছি আটকাতে। আটকাতে আর পারলাম কই! এরই মধ্যে আপু আবার বলল,

"বাবা মারা যাওয়ার দিন গিয়েছিলাম তোমাদের বাড়িতে। আড়ৎ থেকে আওলাদ নামের কেউ একজন ফোন করেছিল। তোমাদের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে গিয়েছিলাম। বিশ মিনিটের মতো ছিলাম। সবাই কান্না করছে। মানুষের ভীড়ে আমিও বাবার মুখখানি শেষবারের মতো দেখে নিয়েছি। দেখে কান্নাও করেছি। কিন্তু কেউ জানে না আমি কে!
তোমাকেও খুঁজেছি। জিজ্ঞেস করিনি কারো কাছে। কে কবর খুঁড়তে গেল, কে বাজারে গেল! এসব বলার সময় শুনলাম তোমার নাম। কেউ একজন বলছে শাওন কাফনের কাপড় কিনতে গেছে। আমি আর সেখানে থাকিনি, চলে এসেছি।"

মাথা তুলে তাকাতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু চোখের পানি লুকাতে পারব না। টপ করে নিচে পড়বে। আপু আমার থুতনি ধরে মাথাটা উপরের দিকে তুললেন। টপ করে চোখের পানি আপুর কব্জিতে পড়ল। আপু আমার চোখের পানি মুছে দিচ্ছেন। বড়ো বোনের বুঝি এত মমতা থাকে? এত আদর থাকে?
আপু আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে মাথার চুল নাড়িয়ে বললেন,

" তুমি ছোটো হলেও এখন তোমার দায়িত্ব অনেক। মায়ের দিকে খেয়াল রেখো।"

আমি আড়ৎ থেকে আসার সময় বিশ হাজার টাকা নিয়ে এসেছি পকেটে ভরে। টাকাটা বের করে আপুর হাতে দিয়ে বললাম,

"আমি এখন আর ছোটো নই আপু। অনেক বড়ো হয়েছি। মায়ের খেয়াল যেমন রাখতে পারব, তেমনি আপুর জন্যও এই ভাইটি আছে।"

আপু একটু চমকালেন বোধ হয়। তারপর টাকাটা আমার হাতে দিয়ে বললেন,

"আমি তোমার চেয়েও বড়ো। এখন আমার টাকা লাগবে না। মামার বাড়িতে থাকি এখন।"

আমি টাকা ফেরত না নিয়ে বললাম,

"টাকা নিতেই হবে। আপুর সব দায়িত্ব এখন থেকে তার ভাইয়ের। বাবা শুধু আমার একার নয়, তোমারও বাবা। তোমারও অধিকার আছে। আমাকে শুধু আপু ডাকতে দিও, বঞ্চিত করো না।"

অনার্স ভবনের মাঠের দুর্বা ঘাস সাক্ষী হচ্ছে দুই ভাই বোনের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া পানির। ঘাস মাড়িয়ে সামনে এগুচ্ছি। আড়ৎ এ যেতে হবে। আড়ৎ থেকে বাড়িতে। মা কয়েকদিন ধরে মনমরা থাকে। মায়ের কাছাকাছি থাকাটা দরকার। গল্প করা দরকার। সব দায়িত্ব এখন আমাকেই পালন করতে হবে। রিকশায় উঠে কিছু দূর এসে পেছন ফিরে দেখি, আপু তখনো আমার চলে আসা দাঁড়িয়ে দেখছে। যেন ভাইকে বিদায় দিতে মন চাচ্ছে না।
আকাশে মেঘ জমেছে। গুড়মুড় শব্দ হচ্ছে। এক পশলা বৃষ্টি হলে মন্দ হয় না।

সমাপ্ত...

গল্প: সংসর্গ

লেখনীর শেষ প্রান্তে,,,,,,,
,,,,,,ওমর ফারুক শ্রাবণ

25/03/2023

ইফতার করতে বসছি,আম্মু গম্ভীর মুখে বললো," ইদানীং তুমি কি নিজেকে খুব লায়েক ভাবতে শুরু করেছো?"আব্বু আর ভাবি সাথে সাথে বললো,থাক না এখন,এইসব নিয়ে পরে কথা বলা যাবে।আম্মু বললো রাতে অবশ্যই তুই আমার সাথে দেখা করবি।মনে থাকে যেন।

সাময়িক স্বস্তি পেলেও গলায় একরকম অস্বস্তির কাঁটা বিধেই রইলো।কী অপরাধ করেছি বুঝতে পারছি না।তবে গুরুতর অপরাধ যে একটা করে ফেলেছি,এইটা নিশ্চিত।আম্মু শুধু শুধু কিছু করে না,বলেও না,এইটা নিপাতনে সিদ্ধ ব্যাপার। মনের মধ্যে এই খুঁদবুদি নিয়েই ইফতার করে ফেললাম।

খাটে শুয়ে ফেসবুক চালাচ্ছিলাম।দুপুরে বাঙ্গি নিয়ে একটা ট্রল পোস্ট দিয়েছিলাম,বন্ধুদের অনেকেই সেখানে মন্তব্য করেছে,তারমধ্য থেকে কিছু মজার মন্তব্যের উত্তর দিচ্ছিলাম।বড়ো ভাবি এসে বললো,আম্মা তোমাকে ডাকছে।

ভাবিকে বললাম,ঘটনা কী ভাবি?আম্মু হঠাৎ এভাবে চটলো কেন আমার উপর?ভাবি বললো,জানি না।তবে আম্মা যাই বলুক তুমি চুপ করে শুনবা।কোনো তর্ক করবা না।

আম্মু খাটে পা তুলে কায়দা করে বিচারকের মতো বসে আছে।লক্ষণ খারাপ।আমাদের বাড়ি মাঝেমধ্যে এমন বিচারসভা বসে।অধিকাংশ সময় আসামী থাকি আমি,মাঝেমধ্যে ভাইয়াও থাকে।যেদিন এমন বিচারসভা বসে,সেদিন বাড়ির পরিস্থিতি পালটে যায়।

আম্মু বললো,দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না,বস।আজ কিছু কথা বলবো,মন দিয়ে শুনবি।কথার মাঝখানে কোনো কথা বলবি না।মুখে আচ্ছা বললেও তেমন নির্ভার হতে পারলাম না।

আম্মু শুরু করলো-তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি।ভাইবোনদের মধ্যে আমি মেজ।তোর বড়ো মামা সবে কলেজে উঠেছে।আমাদের তখন খুবই অভাব কষ্ট।শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কারণেই আমাদের সব ভাইবোনের স্কুল কলেজ যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো অনির্দিষ্ট কালের জন্য।আব্বা সিজনাল ফলের ব্যবসা করতো।তরমুজ,বাঙ্গি,কাঁঠাল, আম,এইসব।

গৃষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে জনজীবন অতিষ্ঠ।আব্বা আর বড়োভাই গঞ্জে গিয়েছে মহাজনের কাছ থেকে পাওনা টাকা আনতে।দুই তিন চালান বাঙ্গি দিয়েছে মহাজনের মোকামে,কিন্তু সে এখন টাকা নিয়ে ভীষণ গড়িমসি করছে।

বাগেরহাট সদরে ছিলো সেই মহাজনের আড়ত।নৌকায় করে যেতে হতো।এদিকে দেপাড়া অঞ্চলের কৃষকদের থেকে বাঙ্গি এনেছে বাকিতে,তারা রোজ বাড়ি এসে টাকার তাগাদা দিচ্ছে।

আব্বা বারবার তাদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করলো,তাদের থেকে আনা বাঙ্গি মহাজনের আড়তে দিয়ে এসেছে,মহাজন টাকা দিলেই তাদের টাকা পরিশোধ করা হবে।কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা,তারা কোনো মহাজন ফহাজন চেনে না।তারা তোর নানাকে বাঙ্গি দিয়েছে,তার কাছ থেকেই টাকা নিবে।এবং ওইদিনই টাকা লাগবে।টাকা না নিয়ে তারা উঠোন থেকে এক পা'ও নড়াবে না।কী যে বিশ্রী একটা পরিস্থিতি!

পরে গ্রামের মাতুব্বরদের মধ্যস্থতায় তারা দুই দিনের সময় দিলো আব্বাকে।সকালে মা শুধু পানির নাস্তা রান্না করে আমাদের খেতে দিলো।আমরা একটু বড়ো ছিলাম,সংসারের পরিস্থিতি কিছুটা বুঝতাম।তোর নীনা খালা ছিলো সবার ছোটো,সংসারের এই জটিলতার সাথে পরিচিতছিলো না।এইসব পানির নাস্তা খেতে চাইতো না।

সম্প্রতি আব্বার ব্যবসার টাকা আটকে যাওয়ায় পানির নাস্তাও অনিয়মিত হয়ে উঠলো আমাদের পরিবারে।কারণ আগে থেকেই আব্বার নূন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।মাঝেমধ্যেই তরমুজ-বাঙ্গি খেয়ে থাকতে হতো আমাদের।

মহাজন টাকা নিয়ে খুব টালবাহানা শুরু করে দিয়েছিলো।এদিকে ঘরে চাল নেই,পাঁচ পাঁচটা ছেলেমেয়ে প্রায়ই অনাহারে থাকছে।অন্যদিকে পাওনাদার কৃষকদের ক্রমাগত চাপ আব্বা আর কোনোভাবেই নিতে পারছিলো না।

হঠাৎ এক দুপুরে আব্বা মহাজনের মাথা তরমুজ - বাঙ্গি পরিমাপ করা বাটখারা দিয়ে থেঁতলে দিয়ে জেলে গেলেন।বড়োভাই বাড়ি এসে এই খবর দিলে মা কেমন যেন পাথর হয়ে গেলো।

মা পরদিন বড়ভাই আর আমাকে মামাবাড়ি পাঠিয়েছিলো সংসারের বিস্তারিত হালচাল লেখা একটা চিঠি দিয়ে।মামাদেরকে লিখেছিলো,যেকোরেই হোক কিছু টাকা আমাদের সাথে যেন তারা পাঠায় এবং আব্বার জামিনের ব্যাপারে একটু চেষ্টাচরিত্র করে। কিন্তু সেদিন মামারা এক টাকা দিয়েও সহযোগিতা করেনি।

শুধু মামারাই না,পরিচিত সবাই সেদিন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো।কারণটা খুব পরিস্কার,এমন অসহায় একটা পরিবারের জন্য পয়সা খরচ করলে তা আর কোনদিন ফেরত আসবে না।আমি আর তোর সেজ খালা ছিলাম বয়সে কিছুটা বড়ো।যাদের কাছে সাহায্যের জন্য হাত পেতেছি,তাদের ভিতরের হিংস্র রূপ দেখেছি।

পরবর্তীতে আব্বা মামাদেরকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেছে।মা কখনোই দিতে চাইতো না,আব্বা দিতো।বলতো,বিপদে ওরা পাশে দাঁড়ায়নি,আমরাও যদি ওদের দেখানো পথে হাটি, তাহলে ওদের আর আমাদের মধ্যে পার্থক্য থাকলো কোথায়?কিন্তু মা তার ভাইদের সাথে আর কোনোদিনও সহজ স্বাভাবিক সম্পর্কে যায়নি।ভাইরা মারা গেলেও মা আর কোনদিন বাপের ভিটায় পাড়া দেয়নি।

আমাদের এক চিলতে জায়গা ছিলো খাল পাড়ে।সেখানে বাঙ্গি লাগিয়েছিলো আব্বা।আমরা ভাই-বোনেরা রোজ বিকেলে খাল থেকে পানি তুলে সেই গাছে দিতাম।নিয়মিত পরিচর্যা করতাম।মা বাধ্য হয়ে সেই জমি গ্রামের এক মাতুব্বরের কাছে বন্ধক রাখলো পাওনাদারদের পাওনা মেটাতে।

নিজের বিয়ের শেষ স্মৃতিচিহ্ন গলার একটা পদ্মহার বিক্রি করে বাবার জামিনের ব্যবস্থা করলো মা।আব্বা একদিন বিকেলে ছাড়া পেলো।সেই রাতে আব্বাকে নিয়ে আমরা উঠোনে পাটি পেতে বসলাম।দীর্ঘ রাত পর্যন্ত আব্বার জেলখানার গল্প শুনলাম।

খাবার সময় গড়িয়ে গেলেও সে রাতে মা কোনো খাবার দিতে পারেনি আমাদেরকে।পরিশেষে অনেক রাতে মা একটা বাঙ্গি কেটে দেয় আমাদের সবার সামনে।সবাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেলাম।শুধু তোর ছোটো খালা তুমুল বায়না ধরলো।সে বললো,গত কয়েকদিন শুধু বাঙ্গিই খাচ্ছে,সে আর এসব খাবে না।ভাত খাবে।আব্বা যেন তাকে ওই রাতে গরম ভাতের ব্যবস্থা করে দেয়।

মা তাকে বললো বাঙ্গি খেতে।পরদিন ভাতের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে।কিন্তু সে এক কথার মানুষ,ভাতই খাবে,বাঙ্গি কিছুতেই খাবে না।প্রতিদিনই তাকে ভাত দেয়া হবে বলা হলেও ঘুরেফিরে খাবার সময় শুধু বাঙ্গিই দেয়া হয়।

এক পর্যায়ে মা পিঁড়ি দিয়ে নীনার কপালে একটা বাড়ি দেয়।আব্বা নীনাকে কোলে নিয়ে খুব ছোটাছুটি করে।আমি আর তোর বড়মামা জার্মুনির লতা রস করে নীনার মাথায় চেপে ধরি।নীনা কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।

আব্বা ঘুমন্ত নীনার কপালে চুমু দিয়ে বলতে থাকে,আমার এই জেদি মেয়েটার একদিন অনেক টাকা পয়সা হবে।তার ঘরের ভাত খাবে হাজার হাজার মানুষ, তবুও ভাতের কোনো কমতি হবে না।এই বলে আব্বা শিশুদের মতো কাঁদলো অনেক্ক্ষণ। আমরা সব ভাইবোন তাকে জড়িয়ে বসে রইলাম উঠোনে।

তোর ছোটখালা এখন গুলশানের শ্রেষ্ঠ ধনীদের একজন।মোহাম্মদপুরে সে তোর নানা নানির নামে দুইটা এতিমখানা চালায়।আব্বার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে।কিন্তু আফসোস,মানুষটা আমাদের ভাইবোনদের এমন সুখ দেখে যেতে পারেনি।

আব্বা পরদিন বড়ভাইকে সাথে নিয়ে ঢাকায় চলে আসে।দুই তিনদিন রিকশা চালিয়ে চালডাল কিনে গামছায় বেঁধে বড়ভাইর কাছে পাঠিয়ে দেয়।আমরা প্রায় দেড় থেকে দুই সপ্তাহ পরে ভাতের মুখ দেখি।

বড়ভাই তোর সেজ মামাকে নিয়ে পরদিনই আবার বাগেরহাট থেকে ঢাকা চলে আসে।আব্বা সদরঘাটের বাদামতলায় ফলের একটা ছোটো দোকান দেয়।মানুষটা ব্যবসা খুব ভালো বুঝতো।সাথে ছিলো তোর কর্মঠ দুই মামা।

তিনজন মিলে দুই হাতে টাকা কামাতে লাগলো।ভাগ্য সহায় হলো তাদের।ওই মাসেই কামরাঙ্গির চরে একটা ছোট্ট বাসা ভাড়া করে আমাদেরকে ঢাকায় নিয়ে এলো।পরে ওই জায়গাটা কিনে আব্বা ফলের গোডাউন বানায়। ওইটাই এখন তোর মেজ মামার বাসা।

বাড়িতে আমরা তিন বোন আর মা,এই চারজন মিলে কাগজ কেটে ঠোঙ্গা বানাতাম।আমাদের বানানো সেই ঠোঙ্গা আমাদের আড়ত সহ আশপাশের সব আড়তে বিক্রি হতো।একসময় পুরো বাদামতলি ফল আড়তে আমাদের বানানো ঠোঙ্গা ছাড়া কোনো ঠোঙ্গা চলতো না।রাতারাতি আমাদের অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করলো।

আস্তে আস্তে আব্বার সেই দোকান বড়ো হলো।ঘাটেই আব্বা আর ভাইরা মিলে জায়গা কিনে পাকা আড়ত দিলো।আব্বা তার ব্যবসার শেষদিন অব্ধি তরমুজ- বাঙ্গির ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলো।

এরপর একে একে আমাদের ভাইবোনদের বিয়ে দিলো।তোর আব্বু ছিলো তোর নানার বাঙ্গির আড়তের ম্যানেজার।তোর ছোট খালার শ্বশুর ছিলেন আব্বার তরমুজ বাঙ্গির কোল্ড স্টোরেজ ব্যবসার অংশীদার।

এইযে আমরা আজিমপুরে যে এতো বড়ো বাসাটায় থাকছি এখন,এইটা তোর নানার তরমুজ বাঙ্গির ব্যবসার পয়সায় কেনা জায়গা।পাঁচতলা পর্যন্ত তোর নানাই করে দিয়েছিলেন বাঙ্গি বিক্রির টাকায়। পরবর্তীতে তোর আব্বু বিল্ডিং বাড়িয়েছে।

এতো কথা বলার উদ্দেশ্যে হচ্ছে,ফেসবুকে কাউকে যখন দেখি বাঙ্গি নিয়ে অমূলক ঠাট্টা- বিদ্রুপ করতে তখন আমাদের সেই না খেয়ে থাকা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে।দেড় -দুই সপ্তাহ শুধু বাঙ্গি খেয়ে থাকার কথা মনে পড়ে।নীনার কপাল কাটার কথা মনে পড়ে।

তোর সামান্য এই ঠাট্রা বিদ্রুপের কারণে একজন মানুষও যদি একটা বাঙ্গি কিনতে নিরুৎসাহিত হয়,তাহলে প্রকারান্তরে একজন কৃষকের বিক্রি কমে যায়।

হয়তো তার ঘরেও একটা ছোট্ট নীনা আছে।যে তার বাঙ্গি বিক্রেতা বাপের পথ চেয়ে রাতে উঠোনে বসে থাকে।বাপ বাঙ্গি বেচে চাল কিনে বাড়ি ফিরবে।সেই চাল রান্না হবে।সবাই মিলে আনন্দ করে ভাত খাবে।বাঙ্গি খেতে খেতে সে বড্ড ক্লান্ত।

শিক্ষিত মানুষজন নীনাদের কপাল কাটার কারণ কেন হবে?তারা তো দেশের হাজারো কপাল কাটা নীনাদের কপাল জোড়া লাগাবে।

মাথা উঁচু করে দেখলাম চোখের পানিতে আমার ট্রাউজার আর টি-শার্ট ভিজে জবজবা হয়ে গেছে।আব্বা চোখ মুছছে। ভাবি বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। কান্নায় তার চোখ ভেজা।দরজা ধরে ভাইয়াও কাঁদছে।

একটা ছোট্ট তরমুজ-বাঙ্গির সাথেও যে এতোগুলো হৃদয়ছোঁয়া ব্যপার জড়িয়ে থাকতে পারে,তা কখনো কল্পনাই করতে পারিনি।সিদ্ধান্ত নিলাম বাকি জীবনে আর কোনো ফল ফ্রুটস নিয়ে এভাবে বেহুদা ঠাট্টা তামাশা করবো না।

ছোট্ট নীনা এবং বাঙ্গি
S Tarik Bappy
২১.০৪.২১
পদ্ম কুঞ্জ,ফকিরহাট,বাগেরহাট।

Address

Fulbaria

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Ginni pandey posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share