25/07/2025
নিশব্দে ঘুরে বেড়ানো এক ভূতের নাম ভিক্টর বাউট। অস্ত্রের ব্যবসায় বিশ্বজুড়ে যে কজন মানুষ ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম এই রাশিয়ান নাগরিক। ভিক্টর বাউট শুধু একজন অস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন এক মহাজাল—যেখানে মিশে গেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, কর্পোরেট বাণিজ্য, সামরিক গোয়েন্দা তৎপরতা এবং রক্তাক্ত অর্থনীতি।
১৯৬৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের তাজিকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন বাউট। তিনি ছোটবেলা থেকেই ভাষাজ্ঞান এবং বুদ্ধিমত্তার জন্য পরিচিত ছিলেন। সোভিয়েত বিমানবাহিনীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই মানুষটি কয়েকটি ভাষায় দক্ষ ছিলেন এবং কিছু সূত্র মতে, KGB বা GRU-এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরপরই যখন অস্ত্র গুদামগুলো নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় পড়ে, তখনই বাউট গড়ে তোলেন এক বেসরকারি সাম্রাজ্য—যার ভিত্তি ছিল যুদ্ধ ও অস্ত্রের উপর।
তার ব্যবসা ছিল চতুর এবং সংগঠিত। নিজস্ব কার্গো বিমানবহর ব্যবহার করে তিনি পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে, যেকোনও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বা জাতিসংঘের অবরোধ অমান্য করে, অবাধে অস্ত্র সরবরাহ করতেন। এই বিমানগুলো প্রায়ই বৈধ বাণিজ্যের ছায়াতলে চলত—কখনো ফুলের চালান, কখনো ত্রাণ সামগ্রী বা গবাদি পশু। কিন্তু বাস্তবে সেগুলোর ভেতর থাকত AK-47, রকেট লঞ্চার, মর্টার, এমনকি হেলিকপ্টার পার্টস পর্যন্ত।
আফ্রিকার লাইবেরিয়া, সিয়েরা লিওন, কঙ্গো, অ্যাঙ্গোলা; মধ্যপ্রাচ্যের ইরাক, আফগানিস্তান, এমনকি দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়া—সব জায়গাতেই তার অস্ত্র পৌঁছেছে। লাইবেরিয়ার কুখ্যাত নেতা চার্লস টেইলরের কাছে হাজার হাজার শিশুসৈনিককে দিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাউট অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
২০০৮ সালে মার্কিন ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি (DEA) একটি ছদ্ম পরিচয়ে তাকে ফাঁদে ফেলে। তারা কলম্বিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী FARC-এর পরিচয়ে বাউটের সাথে যোগাযোগ করে এবং প্রস্তাব দেয়—মার্কিন নাগরিকদের হত্যা এবং বিমান ভূপাতিত করার জন্য তাদের অস্ত্র দরকার। বাউট রাজি হন এবং থাইল্যান্ডে এসে ধরা পড়েন। ২০১০ সালে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যার্পণ করা হয় এবং ২০১২ সালে তাকে ২৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
বিচারের সময় তার আইনজীবী বলেছিলেন, "বাউট হচ্ছেন বিশ্ব রাজনীতির 'ফল গাই', এক scapegoat, যাকে ব্যবহার করে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে চায়।" তবে বাস্তবতা হলো—তার অস্ত্রগুলো শত শত বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে শুধু ক্ষমতাবানই করেনি, অনেক রাষ্ট্রের ভিতও কাঁপিয়ে দিয়েছে।
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে ঘটে এক নাটকীয় মোড়। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বন্দী বিনিময়ের অংশ হিসেবে ভিক্টর বাউটকে মুক্তি দেওয়া হয়। তার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পান WNBA তারকা ব্রিটনি গ্রিনারকে, যিনি রাশিয়ায় গাঁজা বহনের অভিযোগে বন্দী ছিলেন। এই বিনিময় আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
রাশিয়ায় ফিরে বাউট হয়ে উঠেন এক ধরনের “ন্যাশনাল হিরো”। রুশ সরকার এবং মিডিয়া তাকে একজন "অন্যায়ের শিকার দেশপ্রেমিক ব্যবসায়ী" হিসেবে উপস্থাপন করে। তিনি একাধিক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি রাজনীতি করতে চান এবং রাশিয়ার জন্য কাজ করতে চান।
আজ ভিক্টর বাউট শুধুমাত্র একটি নাম নয়। তিনি একটি সময়ের প্রতীক—যেখানে যুদ্ধ ছিল ব্যবসা, মৃত্যু ছিল লাভ, আর নৈতিকতা ছিল শুধু একটি শব্দ। তার গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পেছনের পর্দায় কতটা নির্মম বাস্তবতা লুকিয়ে থাকে, যেখানে অস্ত্রের শব্দই নীতি নির্ধারণ করে, আর মানবতা শুধু গোলাবারুদের নিচে চাপা পড়ে থাকে।