23/07/2025
এ কেমন দেশ? কেমন মানুষ আমরা?
সমাজের প্রকৃত মুখ দেখতে পাওয়া যায় সংকটের সময়ে। আর সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি বিমান দুর্ঘটনা যেন আমাদের জাতিগত মানবিকতার আয়না ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। দুর্ঘটনা শুধু প্রযুক্তিগত নয়, এটি আমাদের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের চরম পতনের নগ্ন উদাহরণ।
১। পানি কি কেবল টাকার বিনিময়ে পাওয়ার জিনিস?
বিমান দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজে অংশ নেওয়া সাধারণ মানুষ ও স্বেচ্ছাসেবকরা যখন প্রচণ্ড গরমে কলেজ ক্যান্টিনে ঢুকেছেন এক গ্লাস পানির আশায়, তখন তাদের বলা হয়েছে—পানি কিনে নিতে হবে। অবস্থা বেগতিক হলে মাইলস্টোন কলেজের সেই ক্যান্টিন বন্ধ করে দেওয়া হয়—ঠিক তখনই যখন সবচেয়ে বেশি পানির প্রয়োজন ছিল। কারণ? “এই পানির দাম কে দেবে?”
একটি সমাজ তখনই রসাতলে যায়, যখন ব্যবসা-মনস্কতা মানবতাকে গ্রাস করে।
২। সাহায্য নয়, মোবাইল ভিডিও—মানবতা আজ ডিজিটাল ‘ভিউ’-এর নিচে চাপা।
ছোট ছোট বাচ্চারা পোড়া শরীর নিয়ে চিৎকার করে দৌড়াচ্ছে, কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না। বরং ব্যস্ত সবাই মোবাইলের ক্যামেরায় ভিডিও ধারণে। কারণ, “ভিউ” বাড়বে, ইনকাম হবে—সেই ভয়াবহ মুহূর্তটিও কেউ কেউ বানিয়ে নিচ্ছে কনটেন্ট। আমাদের করুণ বাস্তবতা হলো, প্রযুক্তি বাড়লেও মনুষ্যত্ব আর বেড়ে ওঠেনি।
৩। হাসপাতালে নেওয়ার মতো একটাও রিকশা বা সিএনজি থামেনি।
জ্বলন্ত শরীর নিয়ে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে শিশুরা, কিন্তু চালকরা থামছেন না। এমনকি আশপাশে থাকা কোনো প্রাইভেট গাড়িও এগিয়ে আসছে না। এই কি আমাদের শহর? এই কি আমাদের মানবতা? যেখানে সাহায্যের বদলে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়?
৪। সাহায্য নয়, সুযোগ—দুর্যোগে ওঠে দামের নিলাম।
একটি শিশু হাসপাতালের পথে—মাইলস্টোন কলেজ থেকে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে যেতে সিএনজি চালক চায় ১০০০ টাকা। আর মাত্র কিছুক্ষণের রিকশাযাত্রায় ভাড়া হয় ১০০ টাকা। দুর্যোগে যারা সহযোগিতা করে না বরং বাড়তি মুনাফা করে, তারা কি মানুষ?
৫। পরিচয়ের অভাবেই হারিয়ে যায় সন্তানরা।
ভয়ে কাঁপতে থাকা শিশুরা পরিচয় দিতে পারছে না, বলতে পারছে না বাসার ঠিকানা বা ফোন নম্বর। ফেসবুকে ঘুরছে তাদের আইডি কার্ডের ছবি, কিন্তু অধিকাংশ কার্ডেই অভিভাবকদের নম্বর নেই। একটু সচেতনতা, একটুখানি অগ্রদর্শিতা থাকলেই এই বিভ্রান্তি এড়ানো যেত।
৬। বিমানটা ১৯৬৬ সালের—পরিত্যক্ত হওয়ার কথা বহু আগেই।
যে যুদ্ধবিমানটি দুর্ঘটনার শিকার, সেটি ১৯৬৬ সালের পুরোনো মডেল—অনেক আগেই যেটি কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলার কথা ছিল। এমন পুরোনো, ঝুঁকিপূর্ণ বিমান নিয়ে আকাশে ওড়ার অনুমতি কেন, কিভাবে? এর দায় কার?
⸻
এটা কি নিছক দুর্ঘটনা? নাকি আমাদের নীতিহীনতার প্রতিচ্ছবি?
প্রতিবারের মতো এবারও কেউ দায় নেবে না। না কোনো কর্মকর্তা বরখাস্ত হবেন, না তদন্ত প্রতিবেদন জনসমক্ষে আসবে। একসময় সবাই ভুলে যাবে। আর এমন দুর্যোগ আবারও ফিরে আসবে—একই রকম অবহেলা, অবজ্ঞা, আর অমানবিকতার ছাপ রেখে।
বাংলাদেশে কেউ আর কাউকে সাহায্য করতে চায় না, করে না। সবাই নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত।
মানুষ মানুষকে দেখেও না দেখার ভান করে। আমরা যেন ক্রমেই সভ্য পৃথিবীর বিপরীত দিকে ছুটে চলেছি—একটি আত্মকেন্দ্রিক, দায়িত্বহীন, বিবেকহীন সমাজব্যবস্থার দিকে।
⸻
শেষ প্রশ্ন: এ কেমন দেশ? কেমন মানুষ আমরা?
যেখানে এক গ্লাস পানিও বিনামূল্যে পাওয়া যায় না;
যেখানে জ্বলন্ত শিশুর চেয়ে মোবাইল ভিডিও বেশি মূল্যবান;
যেখানে সাহায্যের চেয়ে ব্যবসা গুরুত্বপূর্ণ;
সেই দেশ কি কেবল দুর্ঘটনার শিকার? না কি সে নিজেই এক দুর্ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে?
এখন সময় প্রশ্ন করার—না শুধু রাষ্ট্রকে, বরং নিজেকেও।
আমরা কি সত্যিই মানুষ আছি?
©