17/08/2025
দারুণ লিখেছেন
মৃ*ত বাড়িতে কান্নাকাটি থাকবে এটাই খুব স্বাভাবিক। আমি, আমার স্ত্রী তিশা আর আম্মা তিনজন মিলে মিতু মানে আমার বোনের বাড়িতে এসেছি। রাতে ঘুমের মাঝেই ওর শাশুড়ি স্ট্রোক করে মা*রা গেছে। আত্মীয় স্বজন এসে ভরে গেছে। এদের মধ্যে আবার অনেকগুলো মাতব্বর গজিয়ে উঠেছে। কেউ এই ব্যবস্থা করছে ,কেউ ওই ব্যবস্থা করছে যা হয় আর কি। মিতুকে দেখলাম সাদা একটা ওড়না মাথায় দিয়ে এক কোণে বসে আছে । মিতুর হাজবেন্ড রাহাত হাউমাউ করে কেঁদে চলেছে, ওর ননদ রা সবাই চলে এসেছে। দাফন শেষ করে তারপর তিশা আর আম্মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। পরের দিন আম্মা আর তিশা আবার খাবারদাবার নিয়ে ওই বাড়িতে গেল।
প্রায় মাসখানেক পরে এক ছুটির দিনে গেলাম মিতুর ওখানে। রাহাত বাসায় ছিল না। মিতু বসে টিভি দেখছিল। আমি একটু অবাক হলাম। সোফার কাভারগুলো কি এরকম ছিল নাকি অন্যরকম? মনে করতে পারছি না। তাছাড়া দেয়ালে সুন্দর একটা অয়েল পেইন্টিং ঝুলছে,দেখতে ভালো লাগছে।
আমাকে দেখে মিতু খুব খুশি হলো।
- ভাইয়া বস , কি খাবি বল? এবার সত্যিই আমার অবাক হওয়ার পালা কারণ এই বাড়িতে এসে আমি কখনোই আমার বোনের মুখে এই কথা শুনিনি।
- আরে কিছু খাব না, শুধু তোকে দেখতে এলাম।
- তা কি করে হয়? আচ্ছা শোন তুই তো লাচ্ছি খেতে পছন্দ করিস । ফ্রিজে দই আছে, আমি এখনই বানিয়ে দিচ্ছি আর তুই কিন্তু রাতে খাওয়া দাওয়া করে তারপর যাবি। তোর পছন্দ মত রান্না করবো আমি ।
-না রে রাতে খেতে পারবো না তবে তোর হাতের লাচ্ছি খাইনা অনেকদিন সেটা বানিয়ে খাওয়া।
মিতু প্রায় দৌড়ে উঠে চলে গেল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলো। আমি ঠান্ডা লাচ্ছির গ্লাস হাতে নিলাম।
-এই পেইন্টিং টা কি নতুন কিনেছিস নাকি? খুব সুন্দর তো। -তোর পছন্দ হয়েছে ভাইয়া? আমি অনেকদিন ধরে কিনতে চাইছিলাম এরকম কিছু একটা কিন্তু..
-কিন্তু কি?
-আমার শাশুড়ি পছন্দ করত না তাই কেনা হয়নি। ভাইয়া তুই আমার বেডরুমে আয়, তোকে একটা জিনিস দেখাবো।
আমাকে লাচ্ছির গ্লাস হাতে নিয়েই উঠে দাঁড়াতে হলো কারণ ও আমার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। রুমটা ও খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। বাড়তি আসবাবপত্র সরিয়ে ফেলেছে, তাই ঘরটা বেশ বড় লাগছে। বেডশীট, পর্দা সব ম্যাচিং করা। নিচে ছোট ছোট কার্পেটের মতো কি যেন বলে ওগুলো ফ্লোরে বিছানো। এক কথায় ঘরটা দেখেই মন ভালো হয়ে যাওয়ার মত।
-তুই এত সুন্দর সাজাতে পারিস! আগে সাজাস নি কেন?
-তোর পছন্দ হয়েছে?
- কেন হবেনা? এত সুন্দর! মনে হচ্ছে কোন স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে গেছি।
-ভাবী এলে দেখাতাম আমি রান্না ঘরটা খুব সুন্দর ভাবে গুছিয়েছি। তুই ভাবীকে নিয়ে আসবি, একদিন আমি রান্না করে খাওয়াবো । আমার যাযা ইচ্ছে সব খাওয়াবো ।
-এমনভাবে বলছিস যেন তুই কোনদিন আমাদেরকে খাওয়াস নি !
-হ্যাঁ খাইয়েছি কিন্তু আমার ইচ্ছে মতো কখনো খাওয়াতে পারিনি। এইবার আমার ইচ্ছা মতো রান্না করে খাওয়াবো।
-তোর কি হয়েছে মিতু আমাকে বলতো?
ও আমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে সে বললো,
- আমার একটা সংসার হয়েছে যে ভাইয়া এত বছর পর।
-মানে! আমি আকাশ থেকে পরলাম।
- আমার বিয়ে হয়েছে সাড়ে আট বছর অথচ আমি আমার পছন্দে কোনদিন রান্না করতে পারিনি। আমার ঘর কি করে সাজাবো সেই সিদ্ধান্ত পর্যন্ত আমার শাশুড়ির ছিল । হ্যাঁ অবশ্যই এটা ওনার সংসার কিন্তু অন্তত আমার বেডরুম আর কিচেনের দায়িত্ব যেহেতু আমার এই দুটো অংশ আমার জন্য ছাড় দেয়া তার উচিত ছিল। এখন আমি মুক্ত, যা ইচ্ছে করতে পারি। রাহাত এসব খেয়াল করে না।
- তোর শাশুড়ি মারা গেছে তোর কষ্ট লাগে না?
- ভাইয়া তোর কাছে কিছু লুকাবো না। বিশ্বাস কর উনি মারা যাওয়াতে আমি একটুও কষ্ট পাইনি তবে যে আনন্দ পেয়েছি তাও না। কারণ রাহাত ভীষণ কষ্ট পেয়েছে আর কোন স্বামীর কষ্টে তার স্ত্রী আনন্দিত হতে পারে না। তবে একটা পাখিকে দীর্ঘদিন খাঁচায় আটকে রাখার পর যদি তাকে ছাড়া হয় তাহলে সেই আনন্দ অনেক গুণ বেড়ে যায় । আমি হয়তো খারাপ মেয়ে তাই মাঝে মাঝে চিন্তা করতাম বুড়িটা ম*রবে কবে? তাছাড়াও কথায় কথায় খোঁটা দেয়া, গালমন্দ করা এসব তো ছিলই। তোরা তো জানিসই, মা নিজেও জানে সবসময় বলেছে মানিয়ে নিতে, আমি মানিয়ে নিয়েছি কিন্তু এখন আর মানিয়ে নেয়ার কিছু নেই। আমার ছেলেটা যখন বড় হবে তখন এই দোতলা বাড়ির একটা ফ্লোর ওদের জন্য ছেড়ে দেব ওর বউ এসে নিজের মত করে সংসার করবে আর যদি এখানে থাকতে না চায় তাহলেও কোন সমস্যা নেই। দূরে থেকে যদি সম্পর্ক ভালো থাকে তাহলে ক্ষতি কি? আমি যেই কষ্ট করেছি অন্য কোন মেয়েকে সেই কষ্ট করতে দেবো না। সংসারের নেশা বড্ড কঠিন রে ভাইয়া। মেয়েরা এই নেশায় পাগল থাকে কিন্তু বেশিরভাগ মেয়ের কপালে এটা জোটে না। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে বাসায় ফিরে এলাম।
-কিরে মিতু কেমন আছে ?এখন বাসায় ফিরতে ফিরতে মায়ের প্রশ্ন
-ভালো আছে
-এই তিশা সাগরকে পানি দাও পরে দ্রুত চা বানাও, স্বামী ঘরে এসেছে, কোন খেয়াল নেই। দিব্যি রান্নাঘরে অন্য কাজ করছে। মা ড্রইংরুমে বসে বসে বস্তা পচা হিন্দি সিরিয়াল দেখছে। আমার বিরক্ত লাগছে, সারাদিন একটা মানুষ এই জিনিসগুলো কিভাবে দেখে?
তিশা আগে পানি দিয়ে গেল কিছুক্ষণ পর দুজনের জন্যই চা নিয়ে এলো। মা চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই মুখ বিকৃত করে বললেন আরও একটু চিনি দিতে। তিশা আবার দৌড়ে গেল। একটু পর বললেন চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, এটা যেন গরম না করা হয়। নতুন করে আরেক কাপ বানাতে হবে। তিশা রোবটের মত আবার বানিয়ে নিয়ে আসলো।
আমি বসে বসে টিভির সিরিয়ালের চেয়ে ঘরের সিরিয়ালটাই দেখছিলাম।
-শোনো রাতের জন্য ভারী রান্নার প্রয়োজন নেই। একটা ভাজি করো, দুপুরের ডাল তো আছেই আর আলু বেগুন দিয়ে রুই মাছের তরকারি রান্না করো।
তিশা মাথা নাড়িয়ে চলে গেল।
রাতের খাবার শেষ করে আমি শুয়ে পড়েছি। আমি জানি তিশার আসতে দেরি হবে। সে সবকিছু গোছাবে, থালাবাসন মাজবে তারপর আসবে। আমাদের দুই বছরের বিবাহিত জীবনে প্রতিদিন এই হয়ে আসছে। ও এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পরেই কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমাদের কাজের মেয়েটি আসা বন্ধ করে দেয়। আমি আগে লক্ষ্য করিনি অথবা গুরুত্ব দেইনি। বিয়ের আগে আমাদের দেড় বছরের সম্পর্ক ছিল। সেই সময়ে যে উচ্ছল প্রাণবন্ত তিশাকে আমি দেখতাম মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে সেই তিশাকে এখন আর মেলানো যাবে না। তার মধ্যে কেমন একটা রোবট রোবট ভাব চলে এসেছে। শারীরিকভাবেও এখন আর সে খুব একটা আকর্ষণ বোধ করে না আমার প্রতি তা আমি বুঝি। বিয়ের প্রথম প্রথম কিছুদিন আগ্রহ ছিল কিন্তু এখন আর নেই।
-ঘুমাওনি তুমি এখনো, কি হয়েছে, কোন সমস্যা? মিতু কেমন আছে ওর কোন সমস্যা হচ্ছে কি?
আমি সবগুলো প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
-আচ্ছা তিশা তোমার কখনো ইচ্ছা হয় না নিজের একটা সংসার হোক?
তিশা গভীর চোখে আমার দিকে তাকালো।
-তোমার মনে আছে গত মাসে আমার বোন আর দুলাভাই এসেছিল , তুমি তখন অফিসের কাজে চিটাগাং, ফোনে তোমাকে তাদের আসার কথা জানিয়েছিলাম।খাবারের পর ডেজার্ট হিসেবে আমি কাস্টার্ড বানিয়েছিলাম মায়ের অনুমতি ছাড়া। তাদের সামনে মা আমাকে কিছু বলেননি কিন্তু তারা চলে যাবার পরে এই বাড়িতে এক সপ্তাহ দুধ চা বানানো হয়নি। মা তো রং চা খান কিন্তু আমি তো দুধ চা ছাড়া খেতে পারি না আর জানোই তো দিনে দুবার চা না খেলে আমার মাথা খুব ব্যথা করে।
আমি একটু চমকে উঠলাম।
- কই তুমি তো আমাকে কখনো কিছু বলোনি ?
-মনে করে দেখাতো কখনোই কি আমি কিছু বলিনি?
আমি স্মৃতির পাতা হাতরাতে থাকলাম। বিয়ের প্রথম প্রথম তিশা অভিযোগ করতো। ও কাপড় আয়রন করতো বলে ইলেকট্রিসিটি বিল বেশি আসে এই নিয়ে মা ওকে কথা শুনিয়েছিল। ও একবার মাছের ঝোল রান্না করার বদলে দোপেঁয়াজে করেছিল মা সেটা মুখেও দেননি। কাজের মেয়েটিকে কাজ ছাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল কারণ পার্মানেন্ট কাজের মেয়ে তো পাওয়া গেছে সেটা আমার বউ তিশা। আমার দিকে যত আত্মীয়-স্বজন আছে যে কারো বাড়িতে গেলে ওকে শাড়ি পরে যেতে হয়। আমি বিয়ের আগে থেকেই জানি ও শাড়িতে একেবারে কমফোর্টেবল না। অনুষ্ঠান বাড়ি হলে ভিন্ন কথা ছিল কিন্তু তাও না। তিশা এইসব হিন্দি সিরিয়াল একেবারে পছন্দ করত না হয়তো এখনো করে না কারণ ওকে আমি কখনোই টিভির সামনে দেখি না।
আমি তিশার মাথায় হাত রাখলাম। ততক্ষণে সারা দিনের ক্লান্তিতে ও পাশ ফিরে ঘুমিয়ে গেছে। প্রথম প্রথম আমি জড়িয়ে না ধরলে ওর ঘুম আসতো না আর এখন আমার ছোঁয়ায় যেন ওর ঘুম আসে না। নিজেকে খুব অপরাধী লাগছে। আচ্ছা তিশা নিজেও কি মনে মনে আমার মায়ের মৃ*ত্যু কামনা করছে, হয়তো করছে তা না হলে সে নিজের একটা সংসার পাবে না। মনে পড়ে গেল মিতুর কথাগুলো "সংসার পাবার নেশা মেয়েদের জন্য বড্ড কঠিন রে ভাইয়া" । আমি প্রায় শিউরে উঠলাম। কেউ একজন আমার মায়ের মৃ*ত্যু কামনা করছে, যত তাড়াতাড়ি মৃ*ত্যু হবে সে তত খুশি হবে, হয়তো বহিঃপ্রকাশ করবে না, আমার বোন যেমন করেনি। আমার গা কেমন গুলিয়ে উঠলো, আচ্ছা এখন আমি এখন কি করবো? বুঝতে পারছি না সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
#আশংকা
কলমে:সুবর্না শারমিন নিশী