
27/07/2025
যে প্রশ্নটি প্রায়ই আমাদের মন ও মস্তিষ্কে ঘুরপাক খায় : কেন এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশে উপনিবেশগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? এ প্রশ্নের উত্তর খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ষোড়শ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপে সংঘটিত আধুনিক শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে অস্তিত্বে আসা বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ বিপ্লব ইউরোপকে জ্ঞানগত পশ্চাদ্মুখিতা, বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতা ও গির্জার প্রভাব থেকে বের করে আনে। রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অঙ্গনসহ ইউরোপীয় জীবনধারার সব ক’টি ক্ষেত্রেই একসময় স্থবিরতা বিরাজ করছিল। এর ফলে ইউরোপীয় সমাজও ক্যাথলিক মতাদর্শের পোপ-পাদরিদের চিন্তাধারার কাছে বন্দী ছিল। সমগ্র ইউরোপ ও খ্রিষ্টান বিশ্বে তখন ক্যাথলিক গির্জার একচ্ছত্র আধিপত্য চলছিল। এ স্থবিরতা তৈরির পেছনে খ্রিষ্টান ধর্মগুরুদের উদ্দেশ্য ছিল—তাদের প্রতারণা ও অপকর্ম সম্পর্কে জনগণকে বেখবর রাখা। গির্জার কর্ণধাররা তখন অনেক অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে গিয়েছিল। তারা এমন অনৈতিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল, গির্জার পোপ-পাদরি কিংবা কোনো ধর্মগুরুর সঙ্গে যা একেবারেই মানানসই নয়। এমনিভাবে কোনো ধর্মের পবিত্র ধর্মীয় পেশাগুলোর সঙ্গেও যা কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ হয় না। [২৩]
ইউরোপীয় বিপ্লব তাদের সমাজকে মূর্খতার অন্ধকার, পশ্চাদ্মুখিতা ও স্থবিরতা থেকে বের করে বুদ্ধিবৃত্তি, ব্যক্তি, চিন্তা-দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বাধীনতা এনে দেয়। একই সঙ্গে গ্রিক ও ল্যাটিনদের জ্ঞান ও দর্শন চর্চার স্বাধীনতাও তারা এই বিপ্লবের কল্যাণেই লাভ করে। এ সময়ে ইউরোপে প্রতিষ্ঠিত হয় অনেকগুলো ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র। অস্তিত্বে আসে আধুনিক জাতীয় ভাষা। আর আবিষ্কৃত হয় ভয়ংকর বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন গোলাবারুদ ও অস্ত্র; যা ইউরোপজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্য ও সমর বিপ্লব ঘটায়। এ সমর বিপ্লব ইউরোপীয়দের ঔপনিবেশিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে আরও বেশি মদদ যোগায়। ছাপাখানার আবিষ্কারের ফলে সমগ্র ইউরোপে অত্যধিক দ্রুততার সঙ্গে বিভিন্ন শাস্ত্র, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটে। এ বিপ্লব ইউরোপে কৃষক ও দাস শ্রেণির বিলুপ্তি এবং সামন্তবাদেরও সমাপ্তি ঘটায়। এর পাশাপাশি তৎকালীন ইউরোপীয় সমাজে প্রচলিত শ্রেণিপ্রথা ও সামাজিক বৈষম্য বিলুপ্ত করে দেয়। সমগ্র ইউরোপজুড়ে এই বিপ্লব নতুন অনেক রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটায়। ফলে ইউরোপীয় দেশগুলোতে দ্রুততার সঙ্গে গণতান্ত্রিক মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়ে। গণতান্ত্রিক মতাদর্শ বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে পশ্চিম-ইউরোপের দেশগুলো ছিল সবচেয়ে এগিয়ে। [২৪]
এ সবগুলো উপাদানই মূল ইউরোপের সামনে—বিশেষ করে পশ্চিম-ইউরোপের সামনে এশিয়া ও আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলোর কাঁচামাল ও সম্পদ জবরদখল করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়।
খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দী থেকেই ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো এশিয়া ও আফ্রিকায় তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে নেয়। এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে প্রাকৃতিক সম্পদ ও বিভিন্ন কাঁচামালের এমন সমাহার ছিল, ইউরোপ বহুকাল পর্যন্ত যার নামও জানত না ঠিকমতো। ফলে এ দেশগুলোর দুর্বলতা ও পশ্চাদ্মুখিতার সুযোগ নিয়ে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো এসব দেশের সম্পদ কুক্ষিগত করে নেয় এবং নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে থাকে। আর বাস্তবতা তো এটাই যে, ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর উন্নতির নেশা ও শিল্পে বিপ্লব ঘটানোর এই আশাই এশিয়া ও আফ্রিকায় তাদের ঔপনিবেশিক অভিযানকে আরও ত্বরান্বিত করে।
তথ্যসূত্র :
[২৩] ড. আবদুল আজিজ আশ-শানাবি, উরুব্বা ফি মাতলায়িল কারনিল হাদিসা : ৭৮।
[২৪] ড. আবদুল বাসিত হাসান আবদুল আজিজ, তারিখু উরুব্বা আল-হাদিস : ৭৮।
প্রকাশিতব্য বই : এশিয়া ও আফ্রিকায় ইউরোপের উপনিবেশ
ইন্তিফাদা বুকস
নতুন প্রজন্মের প্রকাশনা