30/05/2025
গ্রামের এক কোণে, কাঁচা রাস্তার ধারে ছোট্ট একটি মাটির ঘর।
চারদিকে ধানক্ষেত, বাঁশবন আর পাখির ডাক। ঘরের চালে টিন, দেয়ালে ধরা লোনাজল আর মায়ের সংগ্রামের ছাপ। আকাশ আধেক মেঘে ঢাকা, আর বাকিটা নীল—বৃষ্টির দিন, যেন প্রকৃতি নিজেই মনের গভীরে নেমে এসেছে।
বৃষ্টির মধ্যেই কাদাজলে বসে আছে ছোট্ট পাখি—মাত্র এক বছরের শিশু। তার হাতে একটি লাল গোলাপ ফুল, আর অন্য হাতে পুরনো হারিকেন। মুখে গোলাপি ফ্রেমের চশমা, চোখে কৌতূহল। সে বৃষ্টির জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাসছে—তাকে থামাতে পারেনি প্রকৃতি, পারেনি দরিদ্রতা।
পাখির একটু পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন রিনা, তার মা—লাঠিতে ভর দিয়ে এগোচ্ছেন কষ্টের ভার নিয়ে। বৃষ্টি তার কাঁধ বেয়ে নেমে যাচ্ছে, কিন্তু চোখে জল—সেই পুরনো, চেপে রাখা মায়েদের জল।
তার বুকের মধ্যে বাজছে একটি প্রশ্ন—“এই বৃষ্টিতে, এই কাদায়, পাখিকে আমি আর কতদিন আগলে রাখতে পারব?”
ঠিক তখনই পেছন থেকে দৌঁড়ে আসে পাখির বড় ভাই অয়ন। বয়স মাত্র ১০, কিন্তু মুখে যেন বড় কোনো মানুষের ছায়া। হাতে তেলের বোতল, মুখে হাসি, আর কাঁধে দায়িত্ব।
“মা! হারিকেনটা জ্বালাতে পারব। আমি ঠিক করে ফেলেছি!”
সে কাদায় হাঁটু গেড়ে বসে হারিকেন জ্বালায়। শিখা জ্বলে ওঠে। আলো ফুটে ওঠে চারপাশে—আর পাখির মুখেও।
অয়ন নিচু হয়ে বলে,
“পাখি, ভয় নেই। আলো জ্বলে উঠেছে। তুই খেলা কর, আমি তোর পাশে আছি।”
রিনা তাকিয়ে থাকে তার দুই সন্তানের দিকে—একজন এখনো মুখে ভাষা আনেনি, আর অন্যজন হয়ে উঠেছে সংসারের ভরসা। কিন্তু এর মাঝে আরেকজন আছেন—দূরে, ঢাকার কোলাহলে।
পাখি আর অয়নের বাবা—সিরাজ। বছর দুয়েক হলো ঢাকা শহরে কাজ করছেন—একটা গার্মেন্টসে। ভোরে উঠে কাজে যান, রাতে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসেন একা একটা রুমে। কখনো ফোন করেন, ছোট মেয়ের হাসি শোনেন, ছেলের কণ্ঠে সাহস পান।
সিরাজের মুখে তেমন শব্দ নেই, কিন্তু মনে অনেক কথা—
“আমার সন্তানরা যেন শিক্ষার আলো পায়, যেন ভাত না ফুরায়, যেন বৃষ্টির দিনে আলো না নিভে যায়।”
রিনা জানেন, এই ঘরের আলো সিরাজের পাঠানো টাকায়, এই হারিকেন জ্বলে তার ঘামে। তিনি জানেন, সিরাজ প্রতিদিন হাজারো লোকের ভিড়ে থেকেও একা—শুধু এই সংসারটা বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
বৃষ্টি তখনো পড়ে। হারিকেনের আলোয় কাদাজলে খেলে ছোট পাখি। অয়ন পাশে বসে, বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আর রিনা দাঁড়িয়ে, চোখে জল নিয়ে বলে,
“এই বৃষ্টি যাই হোক, আমার সংসারের আলো কেউ নিভাতে পারবে না। যতদিন ওদের বাবা আছে, যতদিন আমার অয়ন পাশে আছে—আমি লড়বো।”
আকাশ তখন দু’ভাগ—এক ভাগ অন্ধকার, আরেক ভাগ নীল। কিন্তু ঘরের ভেতর আলো—কারণ সেই হারিকেনটা শুধু জ্বলে না, সে হয়ে উঠেছে এক ত্যাগী বাবার ঘাম, এক ভাইয়ের সাহস, এক মায়ের অশ্রু, আর এক শিশুর হাসির প্রতিচ্ছবি।