18/05/2025
⛔ মৃত প্রেমিকার ঘ্রাণ ⛔
রুদ্র শিউলিকে কখনো ভালোবাসেনি, সে শিউলিকে পূজা করত।
একটা নরম, নিঃশব্দ মেয়েকে দেখা দিয়েছিল এক দুপুরের ক্লান্ত আলোয়—চোখে সারাজীবনের ঘুমহীনতা, ঠোঁটে ম্লান এক ছায়া হাসি।
শিউলি বলত, “তুমি যদি একদিন আমাকে ভুলে যাও, আমি নিজেকে মাটির নিচে টেনে নিয়ে যাব।”
রুদ্র হেসে বলত, “তোমার গন্ধটা আমি কোনোদিন ভুলব না—আতরের মতো, মৃত ফুলের মতো...”
তাদের ভালোবাসার গল্পটা স্বাভাবিক ছিল না। ওরা দেখা করত পুরনো ভগ্নপ্রায় এক বাড়িতে, যেখানে কাঁচ ভাঙা, দেয়ালের পেছনে আঁকা ছিল কোনও মৃত শিশুর ছবি। সে বাড়ির ঘরে একটা দরজা ছিল যা কখনো খোলা যেত না। শিউলি বলত, “ওটা খোলো না। ওখানে আমার দাদি ঘুমায়। তিনি কখনো মরে যাননি, শুধু ঘুমিয়ে আছেন।”
রুদ্র এটা ঠাট্টা বলে ভাবত। কিন্তু এরপর থেকেই ওদের মাঝে ভয়ের গন্ধ মিশতে শুরু করে।
একদিন হঠাৎ শিউলি নিখোঁজ হয়। রুদ্র শুধু জানত, সেই বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে সেদিন সে একটা চিৎকার শুনেছিল। দরজার নিচ দিয়ে গড়িয়ে এসেছিল এক ফোঁটা আতরের মতো ঘন কালচে তরল। আর শিউলির রুমে পড়ে ছিল এক গোছা চুল… এক ঝাঁক পচা শিউলি ফুলের ভেতর।
তারপর দিনগুলো গেলো—নিরব, ঠান্ডা, অন্ধকার।
রুদ্রের জীবন থমকে গেল। তার ঘরভর্তি আতরের গন্ধ ভেসে বেড়ায়, অথচ কেউ ব্যবহার করেনি। মধ্যরাতে দরজার কড়া নড়ে। আয়নায় নিজেকে দেখতে গিয়ে সে দেখতে পায়—তার পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে… মাথা নিচু, গা ভেজা, চোখের জায়গায় কেবল দুটো গর্ত, যেখানে শূন্যতা নয়, ঘৃণা, অভিমান আর অন্ধকার প্রেম জ্বলছে।
শিউলি বলল,
“তুমি আমাকে ভালোবাসোনি রুদ্র, তুমি আমাকে চাওনি, তুমি আমায় রেখে চলে গিয়েছিলে… এখন আমি তোমাকে ভালোবেসে খেয়ে ফেলতে এসেছি…”
এরপর থেকে শুরু হলো এক অদ্ভুত খেলা।
রুদ্র প্রতিদিন রাতে ঘুমাতে গেলে তার গায়ে কে যেন হাত বুলায়, কিন্তু শরীর ঠান্ডা হয়ে যায় পাথরের মতো।
সে যেদিকে তাকায়, দেয়ালে শিউলির চুল ঝুলে থাকে, পায়ের কাছে মৃত পাখির মতো পড়ে থাকে শিউলির ছিন্ন কাপড়।
শিউলির গন্ধে সে পাগল হয়ে যায়, দিনরাত শুঁকে বেড়ায়—ঘর, জামাকাপড়, বিছানার চাদর, পুরনো চিঠি।
কিন্তু কিছুতেই সে গন্ধ আর স্থির থাকে না। শিউলির ঘ্রাণ এক অভিশাপ, যত গন্ধ সে খুঁজে ফেরে, তা শুধু মৃত্যু ডেকে আনে।
একদিন রাতে রুদ্রের ঘরের দেয়ালে রক্তে লেখা এক লাইন—
“ভালোবাসা যদি দেহ পায় না, তবে সে গন্ধ হয়, ঘ্রাণ হয়ে ঘুম কাড়ে।”
এরপর প্রতিদিন সকালে সে শরীরে দাগ নিয়ে উঠে—ঘাড়ে কামড়ের মতো, বুকে নখের আঁচড়।
সে অফিসে যায় না, খায় না, আয়নায় নিজের চোখেও তাকায় না। সে শুধুই শোনে—শিউলি হাঁটে, হাসে, কাঁদে আর তাকে ডাকে।
"আয় রুদ্র... এবার তুইও ঘুমা… আমার মতো…"
একদিন সকালে, প্রতিবেশীরা রুদ্রের ঘরে ঢুকে দেখে—
ঘরের সব কাঁচ ভাঙা, ছাদে রক্তে লেখা—
“সে আমাকে ফেলে গিয়েছিল… তাই আমি তাকে ঘ্রাণ হয়ে তার রক্তে ভিজে থাকলাম…”
রুদ্রের দেহ ঝুলে আছে সিলিং ফ্যান থেকে।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, তার শরীরে একটি মেয়ের দেহ জড়ানো ছিল—কোনো কঙ্কালসার মৃত দেহ, যার চুল ছিল শিউলির মতো… এবং সে ঘরে গন্ধ ছিল—আতর, মৃত ফুল, আর পচা মাটির।
সেই রাতে যখন পুলিশ দেহ নামাতে গিয়েছিল, একজন অফিসার হঠাৎ পেছনে ঘুরে তাকায়, দেয়ালের পাশে বসে থাকা এক মেয়েকে দেখে। মেয়েটির ঠোঁটে ছিল রক্ত, আর সে বলেছিল,
“ভালোবাসলে শেষ করো… ফেলে যেও না…”
আজও সেই পুরনো বাড়িটাতে যারা ঢোকে, তারা দেখে দরজা খুলে গেছে—ভেতরে বালিশের পাশে একটা চুলের গোছা, একটা শুকনো হাত আর একগুচ্ছ আতরের শিশি, যেগুলো খুললেই ভেতর থেকে কোনো কথা নয়, কান্না ভেসে আসে…