18/07/2025
ইদানিং মানিকগঞ্জে কিছু অর্ধশিক্ষিত ইউটিউবারের আবির্ভাব হয়েছে। এরা মানিকগঞ্জের ভাষা নিয়ে বিকৃত কনটেন্ট বানাচ্ছে। এই মুর্খের দলে নারী এবং পুরুষও আছে।
এরা কিছু কিছু শব্দ/পদকে বাক্যে ব্যবহার করে একটি কমন ঢংয়ে উচচারণ করে তাকে মানিকগঞ্জের ভাষা বলে প্রচার করছে।
এইসব গাড়লদের বলি, মানিকগঞ্জের ৭টা উপজেলার সবগুলো উপজেলার ভাষাভঙ্গি, উচ্চারণরীতি এক নয়, কোথাও কোথাও সূক্ষ্ম পার্থক্য যেমন আছে, তেমনি মোটা দাগের পার্থক্যও স্পষ্ট।
ফেসবুকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেবার সুযোগ থাকলেও কাজটা কষ্টসাধ্য। তাই সহজ একটি উদাহরণ দেই।
যমুনা তীরবর্তী দৌলতপুর উপজেলার মানুষের ভাষাভঙ্গি, উচ্চারণরীতি থেকে মানিকগঞ্জের সিংগাইর, সদর, হরিরামপুর উপজেলার মানুষের ভাষাভঙ্গি উচ্চারণরীতি সম্পূর্ণ আলাদা।
এসব উপজেলার কৃষক, শ্রমজীবি মানুষসহ স্থায়ীভাবে দৌলতপুরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ভাষার টোন, উচ্চারণ রীতি, ভাষাভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্ট্যের।
একটি হলরুমে দৌলতপুর এবং সিংগাইর উপজেলা থেকে ১০ জন ১০জন করে ২০ জনকে নিমন্ত্রণ করে একসাথে বসান, তারপর তাদের বক্তব্য রাখতে বলুন, যে কেউ অনায়াসে দৌলতপুরের ১০জনকে চোখ বুঁজে আলাদা করতে পারবেন।
কেবল ভাষাভঙ্গি, উচ্চারণরীতিই নয়, শব্দগত পার্থক্যও আছে। মানিকগঞ্জে সব উপজেলার মানুষ কিন্তু মুড়িকে 'উড়ুম' বলে না। মুরগীকে 'কুইকড়্যা', শীতকে 'টাল', 'জার' বলে না। শব্দ এবং নামের ক্ষেত্রেও এরকম প্রচুর পার্থক্য আছে।
উচ্চারণগত এবং ভাষাভঙ্গিজনিত পার্থক্য এমনিতেই হয়নি, হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, নৈকট্য, দূরত্ব, ব্যবসাবাণিজ্যের সম্পর্কের কারণে। দেখবেন, দৌলতপুরের ভাষার সাথে পাবনা, সিরাজগঞ্জের মানুষের ভাষার যতটা মিল আছে মানিকগঞ্জ সদর, সাটুরিয়া, সিংগাইরের সাথে তার সিকি পরিমান মিলও নেই। এর কারণ প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে মানিকগঞ্জ মহকুমা গঠনের আগে দৌলতপুরের মানুষের মানিকগঞ্জ সদরে আসার কোন বাধ্যবাধকতাই ছিল না।
তারা ব্যবসা, বাণিজ্য, কৃষিপণ্য বিক্রয়, বিয়ে-সাদি, কেনাকাটার জন্য মানিকগঞ্জে না এসে নদী পাড়ি দিয়ে খুব সহজেই পাবনা, সিরাজগঞ্জে চলে যেতো পারতেন। এমনটাই চলেছে শত শত বছর ধরে।
দেশ স্বাধীন হবার এক যুগ পরেও বিশেষ করে বর্ষাকালে দৌলতপুর থেকে মানিকগঞ্জ সদরে আসতে দিনের অর্ধেক সময় পার হয়ে যেতো। অথচ নৌকা, ট্রলারে করে এক থেকে আধাঘন্টায় যমুনা পাড়ি দিয়ে সিরাজগঞ্জ, পাবনায় চলে যাওয়া যেতো। আর শহর হিসেবে পাবনা, সিরাজগঞ্জ মানিকগঞ্জের চেয়ে সমৃদ্ধও ছিল।
এসব কারণে যমুনার এপার-ওপারের মানুষের মাঝে মেলামেশা, যোগাযোগ ছিল নিবির, ফলে তাদের মধ্যে ভাষাভঙ্গির, ভাষারীতির মিল, বন্ধনটা অনায়াসে গড়ে উঠেছিল। এমন আরও অনেক কারণ, প্রসঙ্গ আছে, আছে বিভিন্ন উপজেলার মধ্য ভাষার মিল অমিলের বিষয়।
এইসব ইউটিউবারদের বলি, আপনারা কী জানেন মানিকগঞ্জ জেলার আঞ্চলিক ভাষার মান বাংলা ভাষার স্ট্যাণ্ডার্ড মান বা রেডিও, টিভিতে ব্যবহৃত ভাষার খুব কাছাকাছি, যা দেশের অধিকাংশ জেলার আঞ্চলিক ভাষার চেয়ে এগিয়ে। তার প্রমান, আপনি দেশের যে জেলাতেই যান না কেন সেই জেলার মানুষ আপনার কথা ঠিকই বুঝতে পারে। পক্ষান্তরে চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা আমার আপনার পক্ষে চট করে বুঝে ফেলা কষ্টের।
'মানিকগঞ্জের ভাষা' নাম দিয়ে বিকৃত কনটেন্ট বানিয়ে মানিকগঞ্জের ভাষা সম্পর্কে জেলার বাইরের মানুষের কাছে ভুল মেসেজ দেবেন না।
নিজেকে মূর্খ প্রমান করবেন না।
ভাষা নিয়ে কনটেন্ট তৈরীর অসুস্থতা বাদ দিয়ে মানিকগঞ্জের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বরেণ্য ব্যক্তিত্বদের নিয়ে কাজ করুন। আপনার পুরো জীবন পার করতে পারবেন, ফুরাবে না।
#পদাতিকেরপদাবলী