30/06/2024
**ভারতের কাছে বাংলাদেশ বিক্রি হয়েছে না বাংলাদেশের কাছে ভারত বিক্রি হয়েছে?**
ভারতীয় মিডিয়ার সূত্র অনুযায়ী - তিস্তা চুক্তি এবার হচ্ছে সম্ভবত! বিজেপি এতদিন ধরে মমতার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে এই চুক্তি করতে চায়নি অথচ বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেই মমতাকে এড়িয়ে দশ বছর আগেই তিস্তা চুক্তি করতে পারতো করেনি ইচ্ছে করেই। চীনের জুজুর ভয় দেখিয়ে শেখ হাসিনা এবার তিস্তা চুক্তিটি সম্পন্ন করতে বাধ্য করবেন ভারতকে হয়ত!এটা বেশ ঐতিহাসিক এবং শেখ হাসিনা সরকারের বড় অর্জন হতে যাচ্ছে। কিন্তু মমতা হুমকি দিচ্ছে ফারাক্কা বাধের চুক্তি নবায়ন নিয়ে এটাও কিন্তু বেশ বড় ঝামেলা,তবে সাধারণত একবার চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর নবায়ন হয় বারবার। বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী: " তিস্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। সেই আলোচনার খুঁটিনাটি কেউ জানে না।" মমতা চায়না তিস্তা চুক্তি হোক তাই ভারত সরকারও বিস্তারিত শেয়ার করতে চাচ্ছে না গণমাধ্যমের সাথে এটা নিয়ে। মমতাকে পাত্তা না দিয়েই এবার চুক্তি করতে বিজেপি।
কিন্তু এই তিস্তা চুক্তির সাথে( যদি হয়!) ভারত বেশ অল্পমূল্যে ট্রানজিট নিচ্ছে সারা স্থল পথে, জলপথে দেশজুড়ে তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে। বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী প্রতি টনে মাশুল মাত্র তিনশ টাকার মতো। এটা বেশ কম। আর ট্রেনে পণ্যই পরিবহন হবে,আপাতত। ভুটান আর নেপালের সাথে পণ্য পরিবহন করতে চায় বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে দিয়ে। এটা ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার অন্যতম কারণ! বিবিসি বাংলা লিখেছে" বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও নতুন ট্রানজিট চুক্তি শর্ত, মাশুল, অর্থায়ন কিংবা অন্য কোনও বিষয়ে এখনও বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।চুক্তির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারাও কথা বলতে রাজি হননি।"
এত কমে কোন রাষ্ট্রের ট্রানজিট পাওয়া অনুচিত ,বাংলাদেশ সরকারের চার্জ নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনা করা উচিৎ।
তবে ভারতীয় পত্রিকা টেলিগ্রাফ এর সূত্র অনুযায়ী:
এছাড়া এই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে ভারতের কলকাতা থেকে ‘সেভেন সিস্টার্স’-খ্যাত সাত রাজ্যের ১২টি রুটে পণ্য ও যাত্রী চলাচলের সুবিধা। বাংলাদেশ সরকার দেশের ভেতরে ভারতকে রেলপথ স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় নয়াদিল্লির পরিকল্পনা সহজ হয়েছে। নতুন পরিকল্পনার আওতায় মোট এক হাজার ২৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের ১৪টি সেকশন থাকবে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ভেতরে থাকবে ৮৬১ কিলোমিটার। আর নেপালে ২০২ কিলোমিটার ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে থাকবে ২১২ কিলোমিটার পথ।
অর্থাৎ এই পথ পুরোটাই ভারত সরকার অর্থায়ন করবে। কিন্তু গণমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী ভারত সরকার বাংলাদেশের রেলপথ ব্যাবহার করার জন্য চার্জ দিবে কিনা সেটা পরিষ্কার না। এবং বাংলাদেশের ট্রেনগুলো ভারতের তৈরি ট্রেনলাইন ব্যবহার করতে পারবে কিনা সেটা পরিষ্কার না।
এই ধরণের ট্রেন লাইন ইউকে ফ্রান্স এবং সারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে আছে।
কয়েকটা উদাহরণ গুগল করলেই পাবেন:
ইউরোস্টার(Eurostar): লন্ডন থেকে প্যারিস হয়ে ব্রাসেলস , আমস্টারডাম যায় এই ট্রেনলাইন।
থেলো(Thello): এই ট্রেনলাইন প্যারিস থেকে মিলান হয়ে ভেনিসে যায়।
ট্রেনেটালিয়া(Trenitalia): এটা মিউনিখ থেকে রোমে যায়
সুতরাং এই ধরণের ট্রেনলাইন অস্বাভাবিক কোন ঘটনা না।
সরকার ভারতের সাথে রুপিতে সামনে বাণিজ্য করতে যাচ্ছে ,কারণ বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ব্রিকস এর সদস্য হওয়ার আবেদন জানিয়েছে। চীনের সাথে ইউয়ান এবং ভারতের সাথে রুপিতে বাংলাদেশ সামনের দিনে বাণিজ্য করবে। সৌদি আরব ইতিমধ্যে ডলার দিয়ে তেল বেচাকেনার চুক্তি থেকে সরে এসেছে যেটা বিশ্ববাজারে ডলারের ব্যাপক দরপতন করেছে। ইউয়ান হতে যাচ্ছে সামনের দিনে ডলারের বিকল্প মুদ্রা,তবে এটা কতটুকু সফল হয় সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে! কিন্তু ব্রিকস এর সদস্য দেশগুলো সামনের দিনে ডলারের পরিবর্তে আঞ্চলিক মুদ্রায় বাণিজ্য করবে। ব্রিকস এর সদস্য হতে ইন্ডিয়ার সাপোর্ট লাগবে বাংলাদেশের। এছাড়া বাংলাদেশ ইউয়ান দিয়েই চীনের সাথে বাণিজ্য করবে সামনে। নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার আসছে আগামীতে।
নেপাল থেকে বিদুৎ আমদানি করতে চেয়েছিল বাংলদেশ বেশ কয়েকবছর ধরেই।অবশেষে ইন্ডিয়া মেনে নিয়েছে কিন্তু ইন্ডিয়ান গ্রিড দিয়ে বিদ্যুৎ আসবে বাংলাদেশে। ইকোনমিক টাইমস ইন্ডিয়ার ভাষ্যমতে "
বাংলদেশে নেপাল থেকে বিদুৎ আনার জন্য ভারত নিজের খরচে ৭৬৫ কেভির বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন তৈরি করবে যা কাতিহার - পার্বতীপুর- বর্ণানগর দিয়ে যাবে( এটা ভারতের আর্থিক সহায়তা না ইনভেস্টমেন্ট সেটা পরিস্কার না)।"
বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণ যাত্রী ইন্ডিয়ায় যায় চিকিৎসার জন্য, ভারত এবার ই মেডিকেল ভিসা চালু করবে আমাদের রোগীদের জন্য। এটাও রোগীদের দুর্ভোগ দূর করবে।
পর্যালোচনাঃ
এই সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তিঃ
১. তিস্তা চুক্তি( সম্ভবত)
২. ই মেডিকেল ভিসা
৩. নেপাল থেকে বিদুৎ আমদানি ,ভারতের আর্থিক সহায়তায়।
৪. ভারতের ট্রেন লাইন ব্যাবহার করে ভারত এবং নেপালে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন। ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়েতে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ এই চুক্তির মাধ্যমে। তবে নেপাল ও ভুটানে রেলের মাধ্যেমে ট্রানজিট পাওয়ার ব্যাপারটা বেশ বড় অর্জন।১৯৭৬ এবং ১৯৮৪ সালে হওয়া নেপাল এবং ভুটানে পণ্য এবং যাত্রী পরিবহনের চুক্তিটি ভারতের সম্মতিতে পূর্ণতা পেল।
৫. রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে নতুন ট্রেন সার্ভিস চালুকরণ।বাংলাদেশ থেকে ভারত যাওয়া আসা এখন একেবারে সহজ হয়ে গেছে।
৬. বাংলাদেশ এই ট্রেন লাইনের উপর ভিত্তি করে নতুন রাজনীতি করতে পারবে,ভারত যেমন কিছু হলেই পেঁয়াজ এবং ভোগ্যপণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দেয় তেমনি বাংলাদেশ ও ভারতের ট্রেনের আসা যাওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। মানে ভারতের মত পরাশক্তি সাথে আমাদের উপর নির্ভর করতে হবে সামনে। আবার বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন করতে পারবে এই ট্রেন লাইন ব্যাবহার করে(যদিও ব্যাপারটা পরিস্কার না)ফলে খরচ ও কমবে অনেক.
এই সফরের বিতর্কিত বিষয়াদিঃ
১. ভারত বাংলাদেশে ট্রেন লাইন তৈরি করবে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের জন্য। তবে প্রায় বেশিরভাগ ট্রেন মালবাহী হবে ,বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী তাই বলা হয়েছে।এতে ভারতের অনেক অর্থ সাশ্রয় হবে! বাংলাদেশের লাভ কি হবে এখনো সেটা পরিস্কার না এই ট্রেন লাইন দিয়ে। বাংলাদেশ ট্রেন প্রতি কত টাকা আয় করবে সেটাও পরিস্কার না। এই চুক্তি যেহেতু এখন প্রারম্ভিক পর্যায়ে অনেক কিছুই পরিস্কার না। ভারত নতুন তৈরিকৃত লাইনে তাদের দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে লড়াই করার জন্য অস্ত্রশস্ত্র পরিবহন করবে ,এটাও নিশ্চিত। কিন্তু এতে বাংলাদেশ সরকারের কি গাইডলাইন সেটাও পরিস্কার না।
২. ভারত বাংলাদেশের যে স্থলপথ ব্যাবহার করে সেটার ট্রানজিট ফিও অনেক কম,এটা বাড়ানো সময়ের দাবি। তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে ভারতে বাংলাদেশের ৯৭% পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়।
৩. মেরিটাইম এবং স্পেস সহায়তা - বাংলাদেশের বিশাল সমুদ্রসীমায় ভারত চীনের আধিপত্য কমাতে চাচ্ছে এবং নিজেদের প্রভাব বাড়াতে চাচ্ছে। বাংলাদেশ এ বিষয়ে কি করবে সেটা নিয়েই নিজেই পরিস্কার না,যেহেতু আমাদের দক্ষ জনবল নেই এই ক্ষেত্রে। কারণ বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ অংশে বড় বড় গ্যাসক্ষেত্র আছে।
স্পেস টেকনোলজিতে ভারত অনেক এগিয়ে ,এবং বেশ কম খরচে সম্প্রতি অনেকগুলো নবযান , স্যাটেলাইট তৈরি করেছে। ভারত সম্প্রতি চাঁদে চন্দ্রযান-৩ পাঠিয়েছে সেটা সারা বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছে।বাংলাদেশ ভারত থেকে এই ব্যাপারে অনেক সহয়তা নিতে পারে। নাসা,ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা অস্ট্রেলিয়া ভারতের ইসরো থেকে কম খরচে স্যাটেলাইট সহ বিভিন্ন প্রযুক্তি অর্ডার দিচ্ছে। এটা বাংলাদেশের জন্য বিরাট সুযোগ। কিন্তু এখানে একটা বিরাট ইস্যু আছে , যেটা হচ্ছে আমাদের নিরাপত্তা শঙ্কা। আমাদের আকাশ প্রতিরক্ষা অনেক দুর্বল ,এবং ভারতের আমাদের কাছে আমাদের আকাশ প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সকল তথ্য থাকবে। ভারত গত বছর পর্যন্ত আমাদের আকাশসীমা থেকে বছরে ১ বিলিয়ন ডলার আয় করতো।
৪.বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে অনেক ধোঁয়াশা
আছে, ট্রানজিট চার্জ বা অন্যান্য অর্থিক বিষয়াদি পরিস্কার না।
রেলের চুক্তিটি নিয়ে আরো বেশি করি পর্যালোচনা করা উচিৎ। সকল পথে ট্রানজিট চার্জ বাড়ানো উচিৎ। কারণ ভারত এই ট্রেনলাইন ব্যাবহার করে প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে,সেটা থেকে বাংলাদেশের বড় একটা অংশ পাওয়া উচিৎ।মেরিটাইম এবং স্পেস সহায়তা নিয়ে বেশ সতর্ক থাকা উচিত বাংলাদেশের। সময় নিয়ে পর্যালোচনা করা উচিৎ। ট্রেনের ইস্যুর চাইতে এটা বড় ইস্যু হওয়া উচিত।
তবে বাংলাদেশের আরেকটি যুদ্ধ চালানোর করার সক্ষমতা নেই। মিয়ানমারে বর্তমানে যে অবস্থা,তাতে ভারত আমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। মিয়ানমারের এই অস্থির সময়ে আমাদের ভারতের সাথে সম্পর্ক জোরদার করা প্রয়োজন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ চীনের তেমন কোন সহয়তা পায়নি।
যেকোন দ্বিপাক্ষিক চুক্তি দুটো দেশের পারস্পারিক স্বার্থ মাথায় রেখেই করা হয়। শুধু বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা হবে কিংবা শুধু ভারতের স্বার্থ রক্ষা হবে এই চুক্তিতে ভাবা অমূলক। যেমন বাংলাদেশে এক পক্ষ বলছে বাংলাদেশ বিক্রি হয়ে গেছে অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে রব উঠেছে ভারত বিক্রি হয়ে গেছে শেখ হাসিনার কাছে। মোদ্দাকথা বিক্রি হওয়া না হওয়া সরকারের সক্ষমতার উপর নির্ভর করে।বাংলাদেশ এবারের সফর থেকে অনেকে কিছু পাওয়ার সম্ভবনা যেমন আছে,তেমন হারানোর ও সম্ভবনা আছে! তবে সরকার কীভাবে বিষয়গুলো ম্যানেজ করে সেটা দেখার বিষয়।
বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ ছিল চুক্তিগুলোর সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হওয়ার সাথে সাথে প্রেস রিলিজের মাধ্যমে বিস্তারিত জানানো। দেরি করায় ইতিবাচক দিকগুলো খোদ মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারের লোকজনই ধোঁয়াশায় ছিল। ফলে সারাদেশে এক প্রকার নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছিলো,যা এখনো আছে।
পরিশেষে বলতে হয় এই সফরের সামগ্রিক দিক হিসেব করলে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বেশ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে এবং অনেক বড় ঝুঁকি ও নিয়েছে। এই সফরের ইতিবাচক দিকগুলো প্রচারের আলোয় আসেনি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে ভারতের সাথে পারস্পরিক অংশীদারিত্বের বিকল্প নেই। বাংলাদেশ যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক এই চুক্তিগুলো কোন না কোনদিন করতে হতো দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বার্থে।