06/08/2025
ধরুন, আপনি চান না আপনার টাকা তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নে ব্যয় হোক, কিংবা আফগানিস্তান যুদ্ধে। ফলে আপনি এমন একটি দলকে ভোট দিলেন, যারা এগুলোর বিরোধী। কিন্তু সেই একই দল রিটায়রমেন্টের বয়স বৃদ্ধির পক্ষে, আপনি আবার এর বিপক্ষে। সবচেয়ে নিকৃষ্ট পরিস্থিতি হচ্ছে যখন আপনার ভোটপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা দল তাদের প্রদত্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে। অবশ্য তারা এতে সিদ্ধহস্ত, প্রায়শই করে থাকে। সে ক্ষেত্রে আপনি কী করতে পারেন? হয়তো অতি উন্নত দেশে আপনি আদালতে মামলা করতে পারবেন, কিন্তু এই ঝামেলায় কেউ জড়াতে ইচ্ছুক না। একমাত্র উপায় হচ্ছে পাঁচ বছর অপেক্ষা করা। ভিন্নদলকে ভোট দেওয়া। এবং তারপর? একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির অপেক্ষা করা!
ভোট হচ্ছে স্বাধীনতা ক্ষুণ্নকরণের বিনিময়ে প্রাপ্ত ক্ষমতাচর্চার বিভ্রম। টম এবং জন দাঁড়িয়ে আছে ব্যালট বাক্সের সামনে। সেখানে দাঁড়িয়ে ভোটের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি নির্ধারণের খোয়াব দেখছে। অতি ক্ষুদ্র পরিসরে যদিও তা সত্য। কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য হচ্ছে একই সময়ে ৯৯.৯৯৯৯% ভোটার দেশ তো দেশ, খোদ টম আর জনের জীবনধারা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। নিজের জীবনের গতিপথ নির্ধারণের ক্ষমতাই যখন তাদের নেই, তাদের জীবন অন্যরা গড়ে দিচ্ছে, সে ক্ষেত্রে তারা খোয়াব দেখছে অন্যদের জীবনকেও 'প্রভাবিত' করার! সব ভোটার একই প্রতারণার শিকার। তারা যদি নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিত, তবে এর চেয়ে ঢের বেশি স্বাধীনতা ভোগ করত। উদাহরণত—বেতন পাওয়ার পরপরই নানা ট্যাক্সের ফাঁদে অর্ধেক টাকা সরকারের হাতে গচ্চা দেওয়ার পরিবর্তে যদি নিজের টাকা কোথায় ব্যয় করবে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের হাতে থাকত।
আরেকটি উদাহরণ দেখা যাক। আমাদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাচ্চাদের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ অতি ক্ষীণ। যদি তারা শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করতে চায় তবে শুধু ব্যালট বাক্সে কাজ হবে না, তাদের ভিন্নপথ ধরতে হবে। হয়তো লবিস্ট গ্রুপের শরণাপন্ন হতে হবে, মহামহিম রাজনীতিবিদদের সমীপে আর্জি দাখিল করতে হবে, কিংবা সরকারি ভবনের সামনে গিয়ে মিছিল-মিটিং-প্রতিবাদ করতে হবে। আমাদের দেশে অভিভাবকদের বহু সংস্থা আছে, তারা আমাদের শিক্ষানীতি প্রভাবিত করতে চাচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে বহু শ্রমব্যয়ের পর ফলাফল প্রায় শূন্য। যদি রাষ্ট্রপ্রভু শিক্ষাব্যবস্থায় বাগড়া না দিত, তবে কাজটা কিন্তু অনেক সহজ ছিল। শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজের নিতে পারত। ব্যক্তিগত এবং যৌথ; দুভাবেই।
শাসক দল ক্রমাগত জনগণকে ভোট দিতে উৎসাহিত করে। ভাবখানা এমন যে ভোটের মাধ্যমে তারা সরকারগঠন এবং সরকারের নীতি নির্ধারণে খুব আহামরি প্রভাব ফেলতে সক্ষম। আসল কথা হচ্ছে জনগণের ভোট, ভোটপ্রদানের উচ্চ হার রাজনীতিবিদদের হাতে স্ট্যাম্প তুলে দেবে, জনগণকে শাসন করার নৈতিক ও বৈধ অধিকার দেবে। স্বার্থ রাজনীতিবিদদের, জনগণের না। অনেকের বিশ্বাস নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা জনগণের নৈতিক দায়িত্ব। কখনো এমনও বলার চেষ্টা করা হয় যে যদি আপনি ভোট না দেন, তবে পাবলিক ডিবেটে আপনার মত প্রকাশের অধিকার নেই, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েও উচ্চবাধ্য করার সুযোগ নেই। যেহেতু আপনি ব্যালট বাক্সে ভোট দেননি, আপনার মতামত গোনায় আসবে না।
এই মতের প্রবক্তারা হয়তো দেখতে অক্ষম যে এখন এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালাদের বিক্রিত 'ভোটের মাধ্যমে প্রভাববিস্তারের' কল্পিত গপ্পো খাচ্ছে না। এরা স্টকহোম সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। তারা তাদের বন্দিকারীদের প্রেমে মন্ড। এটা বুঝতেও পারছে না যে রাজনীতিবিদ আর প্রশাসকদের ক্ষমতার জন্য সে নিজের স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিচ্ছে। [১]
তথ্যসূত্র :
[১] স্টকহোম সিন্ড্রোম একটি সাইকোলোজিক্যাল অবস্থান যেখানে বন্দি বন্দিকারীর প্রতি অনুরাগ অনুভব করে। তার এজেন্ডা নিজের এজেন্ডা বলে মনে করে। ১৯৭৩ সালে সুইডেনের স্টকহোমে এক ব্যাংক ডাকাতির সময় ডাকাতদল চারজন বন্দিকে ছয়দিন ধরে ব্যাংকের ভল্টে বন্দি করে রাখে। এসময় বন্দিদের সাথে ডাকাতদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। বন্দিনীদের একজন ফোনে সুইডিশ প্রধানমন্ত্রীকে বলে যে সে ডাকাতদের বিশ্বাস করে, কিন্তু পুলিশকে করে না। পুলিশি অভিযানে সে নিহত হওয়ার আশঙ্কা করছে। এ থেকেই স্টকহোম সিন্ড্রোমের উৎপত্তি।— অনুবাদক
এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটনিকা দ্রষ্টব্য।
https://www.britannica.com/science/Stockholmsyndrome
বই : বিয়ন্ড ডেমোক্রেসি
Intifada Books
ফাউন্টেন পাবলিকেশন্সের পলিটিক্যাল বইয়ের উইং
(আপডেট পেতে পেইজটি ফলো করুন)