28/09/2025
সাংবাদিকতা বনাম তথ্য অধিকার: জানার শেষ কোথায়?
মাজিদ আল মামুন :
মানুষের জানার অধিকার গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। নাগরিকের করের টাকায় রাষ্ট্র পরিচালিত হয়, আর সেই রাষ্ট্রের কার্যক্রম কেমন চলছে- তা জানার অধিকার প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে। সাংবাদিকতার মূল দায়িত্বও সেই তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, তথ্য অধিকার ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা কি সবসময় একই পথে চলে? নাকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা মুখোমুখি দাঁড়ায়?
২০০৯ সালে বাংলাদেশে কার্যকর হয় তথ্য অধিকার আইন। এই আইনের মাধ্যমে নাগরিকরা সরকারি দপ্তর থেকে যে কোনো তথ্য চাইতে পারেন। সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবেদনকারীদের তথ্য দেওয়ার বাধ্যবাধকতায় থাকেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আইন সাধারণ মানুষকে ক্ষমতায়নের এক নতুন পথ খুলে দিয়েছে কারণ তথ্য জানার সুযোগ মানুষকে শুধু সচেতনই করে না বরং প্রশাসনের জবাবদিহিতাও বাড়ায়।
অন্যদিকে, সাংবাদিকরা সবসময় সমাজের “চোখ-কান” হয়ে কাজ করেন। তারা শুধু তথ্য সংগ্রহই করেন না বরং তা যাচাই-বাছাই করে জনগণের সামনে তুলে ধরেন। সাংবাদিকরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের মাধ্যমে অনেক সময় এমন সব সত্য উন্মোচন করেন, যা সাধারণ নাগরিক সরাসরি জানতে পারেন না।
একজন সাংবাদিক হিসেবে বলবো, তথ্য অধিকার আইন আমাদের জন্য সহায়ক কিন্তু তার বাইরেও সাংবাদিকতার মৌলিক দায়িত্ব হলো জনগণের কাছে সত্য তুলে ধরা। অনেক তথ্য আমরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে পাই, যা আইনের আওতায় আসে না।
যদিও তথ্য অধিকার আইন জনগণের জানার অধিকার নিশ্চিত করে, বাস্তবে অনেক সময় তা বাধাগ্রস্ত হয়। কিছু তথ্য সংবেদনশীল বলে প্রকাশ করা যায় না। যেমন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, কূটনৈতিক সম্পর্ক, বিচারাধীন মামলা বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা।
চায়ের আড্ডায় বসে বিষয়টি নিয়ে কথা হলে একজন অভিমত ব্যক্ত করেন, আমরা কর দিই, তাই সরকারের কাজ সম্পর্কে জানা আমাদের অধিকার। কিন্তু আবেদন করার পরও তথ্য পেতে দেরি হয়, অনেককে ঘুরপাক খেতে হয়।
অন্যদিকে সাংবাদিকদেরও প্রায়ই প্রশাসনিক জটিলতা ও রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়তে হয়। ফলে তথ্য অধিকার আইন থাকলেও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা সবসময় পূর্ণরূপে কার্যকর হয় না।
আসলে সাংবাদিকতা ও তথ্য অধিকার একে অপরের পরিপূরক। তথ্য অধিকার আইন সাধারণ মানুষকে সরাসরি তথ্য পাওয়ার সুযোগ দিলেও সাংবাদিকরা সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে, প্রেক্ষাপট তুলে ধরে এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য তা সহজবোধ্য করে তোলেন।
অন্যদিকে, সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনেক সময় তথ্য অধিকার প্রয়োগকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
যোগাযোগ ও গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সাংবাদিকতা ও তথ্য অধিকার আইনের সমন্বয় একটি গণতান্ত্রিক সমাজে অত্যন্ত জরুরি।
একটি কলেজের অধ্যক্ষ জানান, তথ্য অধিকার আইন হলো জনগণের জানার হাতিয়ার, আর সাংবাদিকতা হলো সেই তথ্যকে অর্থবহ করে তোলার মাধ্যম। এ দু'য়ের মধ্যে সমন্বয় যত বেশি হবে, গণতন্ত্র তত বেশি শক্তিশালী হবে।
সর্বোপরি তথ্য অধিকার আইন ও সাংবাদিকতা দুটি আলাদা পথ হলেও লক্ষ্য কিন্তু একটিই। আর তা হলো জনগণকে তথ্য দেওয়া। গণতন্ত্রে এই দু'য়ের সমন্বয় অপরিহার্য। তথ্য প্রবাহ স্বচ্ছ হলে রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা বাড়ে, আর সাংবাদিকতার স্বাধীনতা নিশ্চিত হলে জনগণ প্রকৃত সত্য জানতে পারে।
অতএব বলা যায়, তথ্য অধিকার আইন ও সাংবাদিকতা প্রতিদ্বন্দ্বী নয় বরং সহযোগী শক্তি। জনগণের জানার অধিকার নিশ্চিত করাই তাদের অভিন্ন লক্ষ্য।